হাওরের অকাল বন্যা : পরিত্রাণের উপায় কি

এস ডি সুব্রত

সাধারণত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভী বাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওরসমূহ নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত। হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশাল জলরাশি, যা বর্ষার চিত্র। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। গ্রামগুলো যেন দ্বীপের মতো ভাসতে থাকে পানির ওপর। আবার শুকনো মৌসুমে যেদিকে চোখ যায় অবারিত সবুজের সমারোহ। হাওরজুড়ে শুধু ধান আর ধান। সাধারণত চৈত্রের শেষে কাটা শুরু হয় এবং চলে বৈশাখ মাসজুড়ে। এ ধান দিয়েই হাওর পাড়ের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়।

হাওর হলো আমাদের জন্য ভাতের গামলা অর্থাৎ খাদ্যের এক অন্যতম উৎস। দেশে বছরে যে পরিমাণ চাল লাগে তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসে এ হাওর অঞ্চল থেকে। কয়েক বছর ধরে দেশে ধানের বাম্পার ফলনের পরও যেভাবে চালের দাম শুধু নিম্ন আয় নয়; সীমিত আয়ের পরিবারগুলোর নাগালের বাইরে চলে গেছে। হাওরের ধান রক্ষা করা না গেলে এ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। হাওরের অকাল বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সময়োপযোগী সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ অকাল বন্যা একেবারে রোধ করা না গেলেও ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা অসম্ভব নয়। এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সততা, সদিচ্ছা ও দেশপ্রেমের মনোভাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করতে হবে। সুনামগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস হচ্ছে এক ফসলি বোরো জমি। এ বোরো ফসলকে ঘিরে হাওর পাড়ের মানুষের জীবন যাত্রা চলে। এ ফসলের আয় থেকেই হাওরের সিংহভাগ মানুষ তাদের খাওয়া পড়াসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। নিয়মিত বিরতিতে এ অকাল বন্যায় হাওরের মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তবে সত্যিকারের কোন সমাধান হয় না।

প্রধানত ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে অকাল বন্যা হয়। প্রায় প্রতি বছর মেঘালয় ও আসামের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে সেই পানি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন হাওরে ঢুকতে শুরু করে। এ বছরও সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ একর জমির ধান ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে। অনেক বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল। কৃষক ও এলাকাবাসী দিনরাত বাঁধের পাশে থেকে নিজেরাই বিনা শ্রমে বাঁধে মাটি কাটছেন। আর দায়িত্বশীল পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে কাঁকড়া আর ইঁদুরকে চিহ্নিত করেছেন। যারা ভুক্তভোগী কৃষক তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, যারা প্রকৃত জমির মালিক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বাঁধ নির্মাণ কমিটিতে রাখা হয় না। সঠিকভাবে বাঁধের কাজ হয় না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নের ধান। পরিস্থিতি এমন যেন তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ পরিস্থিতিতে ওই এলাকার কৃষকের কিছুই করার নেই। কারণ বেশির ভাগ জমির ধান থাকে কাঁচা। আর কাঁচা ধান তো কাটার উপায় নেই। কাঁচা ধান কেটেও লাভ নেই। চেয়ে চেয়ে দেখা আর বোবা কান্না ছাড়া যেন কিছুই করার নেই।

সুনামগঞ্জের হাওরেও বাড়ছে পানি। ইতোমধ্যে সেখানকার দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর ও ধর্মপাশায় বিভিন্ন ছোট-বড় হাওরে ধান তলিয়ে গেছে। আর যেগুলো এখনো তলিয়ে যায়নি সেগুলোও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ২০১৭ সালের কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন কৃষকেরা। ওই বছরের অকাল বন্যায় হাওর অঞ্চলের কাঁচা ধান তলিয়ে গিয়েছিল পানির নিচে। ভাসিয়ে নিয়েছিল ক্ষেতের ধান, সেই সঙ্গে মাছ, মুরগি, গরু-ছাগলের খামারও। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় হাওরাঞ্চলে সাধারণত এপ্রিলের শেষদিকে ভারত থেকে নেমে আসে উজানের পাহাড়ি ঢল এবং এ পানিটা থাকে কয়েক মাস। আর কৃষকরা সাধারণত বৈশাখের শুরুর দিকে অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝিতে পাকা ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে তোলে। হাওরে ২০১৭ সালে বন্যা হয়েছিল এপ্রিলের শুরুর দিকে। এবারও হয়েছে প্রায় একই সময়ে। সেখানকার কৃষকেরা তাই খুব আতংকের মধ্যে আছেন।

হাওর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্টদের এখনেই ব্যবস্থা নিতে না পারলে খুব ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ ক্ষতি শুধু হাওর অঞ্চলের কৃষকদের নয়। এ ক্ষতি সারা দেশের। এটা ঠিক, হাওরের অকাল বন্যা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার উৎসস্থল আবার দেশের বাইরে। তা ছাড়া মেঘালয় ও আসামে যে বৃষ্টি হয় তার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট নদীগুলো হয়ে আমাদের হাওরেই এসে জমা হয়। অতএব এ দুর্যোগ ঠেকানো সহজ ব্যাপার নয়। আবার এটাও তো ঠিক যে, সীমান্তের ওপারে বছরে কোন সময়ে কতটুকু বৃষ্টি হয় তার রেকর্ড আমাদের অজানা নয়। আবার সেখানে আগামী কয়েক দিন কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তার আগাম তথ্য জানাও দুই দেশের মধ্যে বন্যা বা আবহাওয়াসংক্রান্ত তথ্য বিনিময় চুক্তি থাকার কারণে খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। এসব তথ্য জানা থাকলে পাহাড়ি ঢল ঠেকানো না হোক তার কারণে যাতে কম ক্ষয়ক্ষতি হয় অন্তত সে ব্যবস্থা নেয়া যায় নিশ্চয়ই।

এ সমস্যা সমাধানের জন্য সততা ও দেশপ্রেমের অভাব এবং কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট পিআইসির দুর্নীতির কারণে বহুলাংশে এ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। অধিকাংশ সময় দেখা যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ সময়মতো শেষ হয় না। আবার যদিও বা শেষ হয় তাদের কাজ হয় না সঠিক নিয়ম মেনে। আগে এসব বাঁধের কাজ করত ঠিকাদাররা। পরে ঠিকাদারদের অনিয়মের কারণে বাঁধের কাজ দেয়া হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসির দায়িত্বে। তাতে কী প্রকল্পের জন্য আলাদা পিআইসি গঠন করে বাঁধের কাজ করা হয়। এ কমিটির মধ্যে বাঁধের পাশের স্থানীয় কৃষকসহ অংশীজনদের প্রতিনিধিত্ব থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কৃষকদের রাখা হয় নামে মাত্র। পিআইসি গঠনে থাকে নানা অনিয়ম, যার ফলে বাঁধের কাজ সঠিকভাবে হয় না। প্রকল্পে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় তার সিকিভাগও ব্যয় হয় না। বাঁধের সিংহভাগ অর্থ চলে যায় দুর্নীতিবাজদের পকেটে। সরকার ২০১৭ সালের অকাল বন্যার পর হাওর ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে ওই ধরনের বন্যা থেকে ফসল ও অন্যান্য সম্পদ রক্ষার লক্ষ্যে সরকার নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সে প্রকল্পগুলোর কোনটা প্রয়োজনীয়, কোনটা অপ্রয়োজনীয়, তা নিয়ে তখন প্রচুর কথা উঠেছিল।

অকাল বন্যা ঠেকানোর নামে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলো সঠিকভাবে পরিকল্পনা মাফিক করা হয়নি। বাঁধে প্রটেকশন ব্যবস্থা ছিল না অনেক ক্ষেত্রে। আবার যেখানে প্রটেকশন ছিল তাও নড়বড়ে। সেøাপ ছিল না সঠিক। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাঁধের গোড়া থেকে মাটি তুলে বাঁধ দেয়া হয়, যা অল্পতেই ভেঙে যায়। বাঁধ নির্মাণের তদারকির দায়িত্বে যারা থাকেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। এখন খতিয়ে দেখার সময় এসেছে সরকারের এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাঁধ নির্মাণে এত দুর্নীতি হয় কি করে? কারা এর পেছনে জড়িত । এদের খুঁজে বের করে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরকার হাওরের ফসল রক্ষার জন্য প্রতি বছর ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে, তারপরও হাওরের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। এ ব্যাপারে সরকারকে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং হাওর পাড়ের কৃষকের ভাগ্য নিয়ে যেন কোন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধি ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারকে এখন থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২ , ২৮ চৈত্র ১৪২৮ ০৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

হাওরের অকাল বন্যা : পরিত্রাণের উপায় কি

এস ডি সুব্রত

সাধারণত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভী বাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওরসমূহ নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত। হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশাল জলরাশি, যা বর্ষার চিত্র। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। গ্রামগুলো যেন দ্বীপের মতো ভাসতে থাকে পানির ওপর। আবার শুকনো মৌসুমে যেদিকে চোখ যায় অবারিত সবুজের সমারোহ। হাওরজুড়ে শুধু ধান আর ধান। সাধারণত চৈত্রের শেষে কাটা শুরু হয় এবং চলে বৈশাখ মাসজুড়ে। এ ধান দিয়েই হাওর পাড়ের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়।

হাওর হলো আমাদের জন্য ভাতের গামলা অর্থাৎ খাদ্যের এক অন্যতম উৎস। দেশে বছরে যে পরিমাণ চাল লাগে তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসে এ হাওর অঞ্চল থেকে। কয়েক বছর ধরে দেশে ধানের বাম্পার ফলনের পরও যেভাবে চালের দাম শুধু নিম্ন আয় নয়; সীমিত আয়ের পরিবারগুলোর নাগালের বাইরে চলে গেছে। হাওরের ধান রক্ষা করা না গেলে এ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। হাওরের অকাল বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সময়োপযোগী সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ অকাল বন্যা একেবারে রোধ করা না গেলেও ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা অসম্ভব নয়। এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সততা, সদিচ্ছা ও দেশপ্রেমের মনোভাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করতে হবে। সুনামগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস হচ্ছে এক ফসলি বোরো জমি। এ বোরো ফসলকে ঘিরে হাওর পাড়ের মানুষের জীবন যাত্রা চলে। এ ফসলের আয় থেকেই হাওরের সিংহভাগ মানুষ তাদের খাওয়া পড়াসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। নিয়মিত বিরতিতে এ অকাল বন্যায় হাওরের মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তবে সত্যিকারের কোন সমাধান হয় না।

প্রধানত ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে অকাল বন্যা হয়। প্রায় প্রতি বছর মেঘালয় ও আসামের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে সেই পানি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন হাওরে ঢুকতে শুরু করে। এ বছরও সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ একর জমির ধান ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে। অনেক বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল। কৃষক ও এলাকাবাসী দিনরাত বাঁধের পাশে থেকে নিজেরাই বিনা শ্রমে বাঁধে মাটি কাটছেন। আর দায়িত্বশীল পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে কাঁকড়া আর ইঁদুরকে চিহ্নিত করেছেন। যারা ভুক্তভোগী কৃষক তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, যারা প্রকৃত জমির মালিক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বাঁধ নির্মাণ কমিটিতে রাখা হয় না। সঠিকভাবে বাঁধের কাজ হয় না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নের ধান। পরিস্থিতি এমন যেন তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ পরিস্থিতিতে ওই এলাকার কৃষকের কিছুই করার নেই। কারণ বেশির ভাগ জমির ধান থাকে কাঁচা। আর কাঁচা ধান তো কাটার উপায় নেই। কাঁচা ধান কেটেও লাভ নেই। চেয়ে চেয়ে দেখা আর বোবা কান্না ছাড়া যেন কিছুই করার নেই।

সুনামগঞ্জের হাওরেও বাড়ছে পানি। ইতোমধ্যে সেখানকার দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর ও ধর্মপাশায় বিভিন্ন ছোট-বড় হাওরে ধান তলিয়ে গেছে। আর যেগুলো এখনো তলিয়ে যায়নি সেগুলোও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ২০১৭ সালের কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন কৃষকেরা। ওই বছরের অকাল বন্যায় হাওর অঞ্চলের কাঁচা ধান তলিয়ে গিয়েছিল পানির নিচে। ভাসিয়ে নিয়েছিল ক্ষেতের ধান, সেই সঙ্গে মাছ, মুরগি, গরু-ছাগলের খামারও। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় হাওরাঞ্চলে সাধারণত এপ্রিলের শেষদিকে ভারত থেকে নেমে আসে উজানের পাহাড়ি ঢল এবং এ পানিটা থাকে কয়েক মাস। আর কৃষকরা সাধারণত বৈশাখের শুরুর দিকে অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝিতে পাকা ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে তোলে। হাওরে ২০১৭ সালে বন্যা হয়েছিল এপ্রিলের শুরুর দিকে। এবারও হয়েছে প্রায় একই সময়ে। সেখানকার কৃষকেরা তাই খুব আতংকের মধ্যে আছেন।

হাওর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্টদের এখনেই ব্যবস্থা নিতে না পারলে খুব ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ ক্ষতি শুধু হাওর অঞ্চলের কৃষকদের নয়। এ ক্ষতি সারা দেশের। এটা ঠিক, হাওরের অকাল বন্যা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার উৎসস্থল আবার দেশের বাইরে। তা ছাড়া মেঘালয় ও আসামে যে বৃষ্টি হয় তার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট নদীগুলো হয়ে আমাদের হাওরেই এসে জমা হয়। অতএব এ দুর্যোগ ঠেকানো সহজ ব্যাপার নয়। আবার এটাও তো ঠিক যে, সীমান্তের ওপারে বছরে কোন সময়ে কতটুকু বৃষ্টি হয় তার রেকর্ড আমাদের অজানা নয়। আবার সেখানে আগামী কয়েক দিন কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তার আগাম তথ্য জানাও দুই দেশের মধ্যে বন্যা বা আবহাওয়াসংক্রান্ত তথ্য বিনিময় চুক্তি থাকার কারণে খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। এসব তথ্য জানা থাকলে পাহাড়ি ঢল ঠেকানো না হোক তার কারণে যাতে কম ক্ষয়ক্ষতি হয় অন্তত সে ব্যবস্থা নেয়া যায় নিশ্চয়ই।

এ সমস্যা সমাধানের জন্য সততা ও দেশপ্রেমের অভাব এবং কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট পিআইসির দুর্নীতির কারণে বহুলাংশে এ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। অধিকাংশ সময় দেখা যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ সময়মতো শেষ হয় না। আবার যদিও বা শেষ হয় তাদের কাজ হয় না সঠিক নিয়ম মেনে। আগে এসব বাঁধের কাজ করত ঠিকাদাররা। পরে ঠিকাদারদের অনিয়মের কারণে বাঁধের কাজ দেয়া হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসির দায়িত্বে। তাতে কী প্রকল্পের জন্য আলাদা পিআইসি গঠন করে বাঁধের কাজ করা হয়। এ কমিটির মধ্যে বাঁধের পাশের স্থানীয় কৃষকসহ অংশীজনদের প্রতিনিধিত্ব থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কৃষকদের রাখা হয় নামে মাত্র। পিআইসি গঠনে থাকে নানা অনিয়ম, যার ফলে বাঁধের কাজ সঠিকভাবে হয় না। প্রকল্পে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় তার সিকিভাগও ব্যয় হয় না। বাঁধের সিংহভাগ অর্থ চলে যায় দুর্নীতিবাজদের পকেটে। সরকার ২০১৭ সালের অকাল বন্যার পর হাওর ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে ওই ধরনের বন্যা থেকে ফসল ও অন্যান্য সম্পদ রক্ষার লক্ষ্যে সরকার নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সে প্রকল্পগুলোর কোনটা প্রয়োজনীয়, কোনটা অপ্রয়োজনীয়, তা নিয়ে তখন প্রচুর কথা উঠেছিল।

অকাল বন্যা ঠেকানোর নামে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলো সঠিকভাবে পরিকল্পনা মাফিক করা হয়নি। বাঁধে প্রটেকশন ব্যবস্থা ছিল না অনেক ক্ষেত্রে। আবার যেখানে প্রটেকশন ছিল তাও নড়বড়ে। সেøাপ ছিল না সঠিক। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাঁধের গোড়া থেকে মাটি তুলে বাঁধ দেয়া হয়, যা অল্পতেই ভেঙে যায়। বাঁধ নির্মাণের তদারকির দায়িত্বে যারা থাকেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। এখন খতিয়ে দেখার সময় এসেছে সরকারের এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাঁধ নির্মাণে এত দুর্নীতি হয় কি করে? কারা এর পেছনে জড়িত । এদের খুঁজে বের করে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরকার হাওরের ফসল রক্ষার জন্য প্রতি বছর ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে, তারপরও হাওরের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। এ ব্যাপারে সরকারকে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং হাওর পাড়ের কৃষকের ভাগ্য নিয়ে যেন কোন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধি ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারকে এখন থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]