শাহজালালে তিক্ত অভিজ্ঞতা

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল

১.

আমার এক বন্ধু সপরিবারে দেশে ছুটি কাটিয়ে সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডে পৌঁছেছেন। সপ্তাহ খানেক আগেই তাদের ফেরার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নির্ধারিত তারিখে তারা ফ্লাই করতে পারেনি। তাদের আট বছর বয়সী ছেলের পাসপোর্টে রি-এন্ট্রি ভিসা ছিল না। ফলে ইমিগ্রেশন অফিসার তার যাত্রাপথে বাধার সৃষ্টি করে। এ বাধার রেশ মা-বাবার ওপরে গিয়েও বর্তায়। অবুঝ শিশুসন্তানকে একা ফেলে রেখে তো চলে যাওয়া যায় না! অগত্যা তাদের সবাইকে দেশে আরও কিছু দিন থেকে যেতে হলো।

আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে যারা এখনো আইরিশ পাসপোর্ট কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাননি তাদের দেশটির বাইরে ভ্রমণ করতে গেলে নিয়মানুসারে পুনরায় ঢোকার জন্য রি-এন্ট্রি ভিসা নিতে হয়। যেহেতু আমার বন্ধু ও বন্ধুপতœীর স্থায়ী বসবাসের অনুমতি রয়েছে সে ক্ষেত্রে তাদের রি-এন্ট্রি ভিসার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু তাদের ছেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় স্থায়ী বসবাসের আওতাধীন পড়ে না। তাই আয়ারল্যান্ডের বাইরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে তার রি-এন্ট্রি ভিসা নেয়া অত্যাবশ্যক। কিন্তু বিচার মন্ত্রণালয় এক বিশেষ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভিসার এ বাধ্যবাধকতাকে সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন, যা নভেম্বর ২০২১ থেকে কার্যকর হয়ে মে ২০২২ পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। সরকার কর্তৃক জারিকৃত এ অস্থায়ী নিয়মের ফলে যাদের রি-এন্ট্রি ভিসা নেয়ার প্রয়োজন হতো তাদের সে প্রয়োজনীয়তা নির্ধারিত সময় অবধি আর রইল না। সে প্রেক্ষাপটে রি-এন্ট্রি ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশে ভ্রমণ ও আয়ারল্যান্ডে পুনরায় ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার বন্ধুর ছেলের কোনো বাধা থাকল না।

কিন্তু ঝামেলা বাধল বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে। ইমিগ্রেশন অফিসার রি-এন্ট্রি ভিসা ছাড়া কোন অবস্থাতেই তাকে ছাড়তে রাজি নয়। বিচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত এবিষয়ক বিজ্ঞপ্তির কপি, আইরিশ ইমিগ্রেশনের ওয়েবসাইটে রক্ষিত তথ্যাদি দেখিয়ে ও অনেক অনুনয় বিনয় করেও তাকে মানানো গেল না। তিনি আইরিশ ইমিগ্রেশনে ই-মেইলের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যে যাচাইয়ের চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাৎক্ষণিক কোন উত্তর পেলেন না। আরও দু-চার ঘণ্টা পর তিনি যখন উত্তর পেলেন অর্থাৎ জানতে পারলেন ছেলেটি ভিসা ছাড়াই ফ্লাই করতে পারত, ততক্ষণে তাদের বিমান আকাশে উড়ে অনেক পথ এগিয়ে যায়। পরে এক সপ্তাহ পর প্রায় আড়াই লাখ টাকা গচ্ছা দিয়ে তাদের আয়ারল্যান্ডে ফিরে আসতে হয়। যেদিন এসেছেন ওইদিনও তাদের একই কারণে হেনস্তার শিকার হতে হয়। সৌভাগ্যবশত এক সিনিয়র অফিসারের সদয় সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

২ .

মাস তিনেক আগে প্রায় আড়াই বছর পর দেশে গিয়েছিলাম। দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে বলে হরহামেশাই বিদেশ থেকে খবর পেতাম। ভাবতাম, দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত মানুষের মননের ও নৈতিকতারও উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু না। দেশে পা রেখেই তা উপলব্ধি করলাম। মানুষের মনমানসিকতা, শিষ্টাচারবোধ ও আচরণিক পরিবর্তন বা উন্নয়ন মোটেও পরিলক্ষিত হয়নি। এয়ারপোর্টে নেমে যখন ইমিগ্রেশন স্পটে গেলাম, দেখা গেলো পুরো এলাকার কোথাও শৃঙ্খলার লেশ মাত্র নেই। বরাবরের মতো আমরা সরাসরি ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াতে চাইলে বাধাপ্রাপ্ত হলাম। বলা হলো বাম পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে হেলথ কার্ডে ক্লিয়ারেন্স স্ট্যাম্প নিয়ে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াতে। কথা মতো তাই করলাম।

লোকাল ট্রেনের মতো কচ্ছপগতিতে এগিয়ে চলছিল তাদের কার্যক্রম। প্রায় এক ঘণ্টা পর ইমিগ্রেশন অফিসারের কাউন্টারের ধারেকাছে পৌঁছাতে সক্ষম হই। স্ত্রী সন্তানাদিসহ আমরা চারজন প্যাসেঞ্জার ছিলাম। কাউন্টারের সামনে আমরা চারজনই দাঁড়িয়ে থেকে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে পারব কি না, জানতে চাইলে ভদ্রলোক বেশ নিরস কণ্ঠে ‘না’ সূচক উত্তর দিলেন। অগত্যা তাদের একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। অভিবাসনিক কাজ শেষ করে পাসপোর্টটি হাতে হাতে না দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার আমার দিকে ছুড়ে দিলেন। এরপর আমার ১৪ বছরের মেয়ে সাইয়েরাহর পালা। তার ক্ষেত্রেও ঠিক একই আচরণ করা হলো। আমার মেয়ে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, ভদ্রলোক কি বেশ ক্লান্ত? মুখে কোনো হাসির রেখা নেই, গ্রিটিংস নেই। পাসপোর্টটিও ঢিল ছুড়ে দিল। এ কেমন আচরণ? কেমন শিষ্টাচারবোধ?’

৩.

ল্যাগেজ নিতে এসে আরেক সমস্যার সম্মুখীন হলাম। কোথাও ট্রলি নেই। ‘ট্রলি কোথায় পাওয়া যাবে?’ একজন কর্তব্যরত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর প্রান্তের শেষের দিক দেখিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখি এক তুঘলকি কা-। প্রায় দুই আড়াইশ মানুষ গোলাকার হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বাহির থেকে একটি একটি করে ট্রলি আসছে আর একেকজনকে বিদায় করছে। কারও কারও একের অধিক ট্রলি প্রয়োজন হলেও তাকে একটির বেশি দেয়া হচ্ছে না। এমন অবস্থা দেখে আমি লাইনে না দাঁড়িয়ে গেটের সামনে যাই। যে লোকটি ট্রলি দিচ্ছে তার কাছে ট্রলির এমন সংকটের কারণ বা হেতু জানতে চাই। তিনি বললেন, যথেষ্ট পরিমাণ ট্রলি নেই। আমাদের ফ্লাইট রাত ১১টায় অবতরণ করলেও তখন বাজে প্রায় ১টা। তারা যেভাবে ট্রলি বিতরণ শুরু করেছে এভাবে চলতে থাকলে ভোর ৪টাতেও বাড়ি পৌঁছা যাবে কি না, সন্দেহ। তাই তাকে পর্যাপ্ত ট্রলি সরবরাহের অনুরোধ জানালাম। তার কিছুই করার নেই, প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপদেশ দান করলেন।

৪.

নিজের প্রিয় দেশের বিমানবন্দরে এভাবে হয়রানির শিকার ও ন্যক্কারজনক ঘটনার সম্মুখীন হওয়া সত্যি পীড়াদায়ক। পৃথিবীর কোথাও এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং বিদেশে সাজানো-গোছানো ঝকঝকে-চকচকে এয়ারপোর্টগুলোতে ঝামেলা বা হয়রানির ভয় নেই। লাগেজ বা মালপত্র চুরি হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা নেই। বৈধ কাগজপত্র থাকলে অহেতুক ভোগান্তিতে পরার বিন্দু মাত্র সুযোগ নেই। অফিসাররা দক্ষতার সঙ্গে কাগজপত্র যাচাই বাছাই করবে, সত্যটা উদ্ঘাটন করবে, সঠিক জিনিসটা বুঝে নেবে।

বিশ্বের কোথাও এক ধাক্কায় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১০০% বাড়িয়ে দেয়ার নজির নেই। অথচ বাংলাদেশ সরকার তাই করেছে। তবু কেনো ইমিগ্রেশন অফিসারদের মতো সরকারি চাকরিজীবীরা মুখ গোমড়া করে রাখেন? কেনো তাদের মুখে হাসির ছিটেফোঁটা থাকে না? কেন তারা ন্যূনতম কার্টিসি, ম্যানার বা গ্রিটিংসে অভ্যস্ত নন? কেনো যাত্রীদের অহেতুক ভোগান্তিতে ফেলান? কেন তাদের হৃদয় ঝকঝকে চকচকে হয়ে উঠে না? তবে কি মনে করব ওদের আরও শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে?

এয়ারপোর্ট হচ্ছে একটি দেশের প্রতিবিম্ব। কোন বাড়িতে পা রেখে যেমন ওই বাড়ির নাড়ি-নক্ষত্র আঁচ করা যায়, তেমনি কোনো দেশের এয়ারপোর্টে পা রেখেই ওই দেশটা সম্পর্কে একটা ধারণা নেয়া যায়। তাই আমরা আশা করব, অন্তত দেশকে ভালোবেসে, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে এবং দেশের স্বার্থে ও দেশের মান রক্ষার্থে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আলোচ্য বিষয়সমূহের ওপর কঠোর নজরদারি সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; লিমরিক, আয়ারল্যান্ড]

সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২ , ২৮ চৈত্র ১৪২৮ ০৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

শাহজালালে তিক্ত অভিজ্ঞতা

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল

১.

আমার এক বন্ধু সপরিবারে দেশে ছুটি কাটিয়ে সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডে পৌঁছেছেন। সপ্তাহ খানেক আগেই তাদের ফেরার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নির্ধারিত তারিখে তারা ফ্লাই করতে পারেনি। তাদের আট বছর বয়সী ছেলের পাসপোর্টে রি-এন্ট্রি ভিসা ছিল না। ফলে ইমিগ্রেশন অফিসার তার যাত্রাপথে বাধার সৃষ্টি করে। এ বাধার রেশ মা-বাবার ওপরে গিয়েও বর্তায়। অবুঝ শিশুসন্তানকে একা ফেলে রেখে তো চলে যাওয়া যায় না! অগত্যা তাদের সবাইকে দেশে আরও কিছু দিন থেকে যেতে হলো।

আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে যারা এখনো আইরিশ পাসপোর্ট কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাননি তাদের দেশটির বাইরে ভ্রমণ করতে গেলে নিয়মানুসারে পুনরায় ঢোকার জন্য রি-এন্ট্রি ভিসা নিতে হয়। যেহেতু আমার বন্ধু ও বন্ধুপতœীর স্থায়ী বসবাসের অনুমতি রয়েছে সে ক্ষেত্রে তাদের রি-এন্ট্রি ভিসার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু তাদের ছেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় স্থায়ী বসবাসের আওতাধীন পড়ে না। তাই আয়ারল্যান্ডের বাইরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে তার রি-এন্ট্রি ভিসা নেয়া অত্যাবশ্যক। কিন্তু বিচার মন্ত্রণালয় এক বিশেষ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভিসার এ বাধ্যবাধকতাকে সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন, যা নভেম্বর ২০২১ থেকে কার্যকর হয়ে মে ২০২২ পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। সরকার কর্তৃক জারিকৃত এ অস্থায়ী নিয়মের ফলে যাদের রি-এন্ট্রি ভিসা নেয়ার প্রয়োজন হতো তাদের সে প্রয়োজনীয়তা নির্ধারিত সময় অবধি আর রইল না। সে প্রেক্ষাপটে রি-এন্ট্রি ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশে ভ্রমণ ও আয়ারল্যান্ডে পুনরায় ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার বন্ধুর ছেলের কোনো বাধা থাকল না।

কিন্তু ঝামেলা বাধল বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে। ইমিগ্রেশন অফিসার রি-এন্ট্রি ভিসা ছাড়া কোন অবস্থাতেই তাকে ছাড়তে রাজি নয়। বিচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত এবিষয়ক বিজ্ঞপ্তির কপি, আইরিশ ইমিগ্রেশনের ওয়েবসাইটে রক্ষিত তথ্যাদি দেখিয়ে ও অনেক অনুনয় বিনয় করেও তাকে মানানো গেল না। তিনি আইরিশ ইমিগ্রেশনে ই-মেইলের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যে যাচাইয়ের চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাৎক্ষণিক কোন উত্তর পেলেন না। আরও দু-চার ঘণ্টা পর তিনি যখন উত্তর পেলেন অর্থাৎ জানতে পারলেন ছেলেটি ভিসা ছাড়াই ফ্লাই করতে পারত, ততক্ষণে তাদের বিমান আকাশে উড়ে অনেক পথ এগিয়ে যায়। পরে এক সপ্তাহ পর প্রায় আড়াই লাখ টাকা গচ্ছা দিয়ে তাদের আয়ারল্যান্ডে ফিরে আসতে হয়। যেদিন এসেছেন ওইদিনও তাদের একই কারণে হেনস্তার শিকার হতে হয়। সৌভাগ্যবশত এক সিনিয়র অফিসারের সদয় সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

২ .

মাস তিনেক আগে প্রায় আড়াই বছর পর দেশে গিয়েছিলাম। দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে বলে হরহামেশাই বিদেশ থেকে খবর পেতাম। ভাবতাম, দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত মানুষের মননের ও নৈতিকতারও উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু না। দেশে পা রেখেই তা উপলব্ধি করলাম। মানুষের মনমানসিকতা, শিষ্টাচারবোধ ও আচরণিক পরিবর্তন বা উন্নয়ন মোটেও পরিলক্ষিত হয়নি। এয়ারপোর্টে নেমে যখন ইমিগ্রেশন স্পটে গেলাম, দেখা গেলো পুরো এলাকার কোথাও শৃঙ্খলার লেশ মাত্র নেই। বরাবরের মতো আমরা সরাসরি ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াতে চাইলে বাধাপ্রাপ্ত হলাম। বলা হলো বাম পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে হেলথ কার্ডে ক্লিয়ারেন্স স্ট্যাম্প নিয়ে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াতে। কথা মতো তাই করলাম।

লোকাল ট্রেনের মতো কচ্ছপগতিতে এগিয়ে চলছিল তাদের কার্যক্রম। প্রায় এক ঘণ্টা পর ইমিগ্রেশন অফিসারের কাউন্টারের ধারেকাছে পৌঁছাতে সক্ষম হই। স্ত্রী সন্তানাদিসহ আমরা চারজন প্যাসেঞ্জার ছিলাম। কাউন্টারের সামনে আমরা চারজনই দাঁড়িয়ে থেকে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে পারব কি না, জানতে চাইলে ভদ্রলোক বেশ নিরস কণ্ঠে ‘না’ সূচক উত্তর দিলেন। অগত্যা তাদের একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। অভিবাসনিক কাজ শেষ করে পাসপোর্টটি হাতে হাতে না দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার আমার দিকে ছুড়ে দিলেন। এরপর আমার ১৪ বছরের মেয়ে সাইয়েরাহর পালা। তার ক্ষেত্রেও ঠিক একই আচরণ করা হলো। আমার মেয়ে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, ভদ্রলোক কি বেশ ক্লান্ত? মুখে কোনো হাসির রেখা নেই, গ্রিটিংস নেই। পাসপোর্টটিও ঢিল ছুড়ে দিল। এ কেমন আচরণ? কেমন শিষ্টাচারবোধ?’

৩.

ল্যাগেজ নিতে এসে আরেক সমস্যার সম্মুখীন হলাম। কোথাও ট্রলি নেই। ‘ট্রলি কোথায় পাওয়া যাবে?’ একজন কর্তব্যরত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর প্রান্তের শেষের দিক দেখিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখি এক তুঘলকি কা-। প্রায় দুই আড়াইশ মানুষ গোলাকার হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বাহির থেকে একটি একটি করে ট্রলি আসছে আর একেকজনকে বিদায় করছে। কারও কারও একের অধিক ট্রলি প্রয়োজন হলেও তাকে একটির বেশি দেয়া হচ্ছে না। এমন অবস্থা দেখে আমি লাইনে না দাঁড়িয়ে গেটের সামনে যাই। যে লোকটি ট্রলি দিচ্ছে তার কাছে ট্রলির এমন সংকটের কারণ বা হেতু জানতে চাই। তিনি বললেন, যথেষ্ট পরিমাণ ট্রলি নেই। আমাদের ফ্লাইট রাত ১১টায় অবতরণ করলেও তখন বাজে প্রায় ১টা। তারা যেভাবে ট্রলি বিতরণ শুরু করেছে এভাবে চলতে থাকলে ভোর ৪টাতেও বাড়ি পৌঁছা যাবে কি না, সন্দেহ। তাই তাকে পর্যাপ্ত ট্রলি সরবরাহের অনুরোধ জানালাম। তার কিছুই করার নেই, প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপদেশ দান করলেন।

৪.

নিজের প্রিয় দেশের বিমানবন্দরে এভাবে হয়রানির শিকার ও ন্যক্কারজনক ঘটনার সম্মুখীন হওয়া সত্যি পীড়াদায়ক। পৃথিবীর কোথাও এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং বিদেশে সাজানো-গোছানো ঝকঝকে-চকচকে এয়ারপোর্টগুলোতে ঝামেলা বা হয়রানির ভয় নেই। লাগেজ বা মালপত্র চুরি হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা নেই। বৈধ কাগজপত্র থাকলে অহেতুক ভোগান্তিতে পরার বিন্দু মাত্র সুযোগ নেই। অফিসাররা দক্ষতার সঙ্গে কাগজপত্র যাচাই বাছাই করবে, সত্যটা উদ্ঘাটন করবে, সঠিক জিনিসটা বুঝে নেবে।

বিশ্বের কোথাও এক ধাক্কায় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১০০% বাড়িয়ে দেয়ার নজির নেই। অথচ বাংলাদেশ সরকার তাই করেছে। তবু কেনো ইমিগ্রেশন অফিসারদের মতো সরকারি চাকরিজীবীরা মুখ গোমড়া করে রাখেন? কেনো তাদের মুখে হাসির ছিটেফোঁটা থাকে না? কেন তারা ন্যূনতম কার্টিসি, ম্যানার বা গ্রিটিংসে অভ্যস্ত নন? কেনো যাত্রীদের অহেতুক ভোগান্তিতে ফেলান? কেন তাদের হৃদয় ঝকঝকে চকচকে হয়ে উঠে না? তবে কি মনে করব ওদের আরও শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে?

এয়ারপোর্ট হচ্ছে একটি দেশের প্রতিবিম্ব। কোন বাড়িতে পা রেখে যেমন ওই বাড়ির নাড়ি-নক্ষত্র আঁচ করা যায়, তেমনি কোনো দেশের এয়ারপোর্টে পা রেখেই ওই দেশটা সম্পর্কে একটা ধারণা নেয়া যায়। তাই আমরা আশা করব, অন্তত দেশকে ভালোবেসে, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে এবং দেশের স্বার্থে ও দেশের মান রক্ষার্থে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আলোচ্য বিষয়সমূহের ওপর কঠোর নজরদারি সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; লিমরিক, আয়ারল্যান্ড]