নওগাঁর হিজাব বিতর্ক ছিল ‘পরিকল্পিত’ নেপথ্যে ‘দুর্নীতি’

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের হিজাব বিতর্কের নেপথ্যে ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের করা দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা। সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনি পালকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দিতে ‘পরিকল্পিতভাবে’ তাকে বিতর্কিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিন দাউল বারবাকপুর গ্রামে গিয়ে স্থানীয় এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ তার দুর্নীতি এবং অপকর্ম বাস্তবায়ন করতে বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচনের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশ অমান্য করে তার পছন্দের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি গঠন করেছেন। মূলত নতুন কমিটির নেতারাই পরিকল্পিতভাবে হিজাব বিতর্ক ছড়িয়ে অভিভাবকদের উসকে দিয়েছে স্কুলে হামলা চালাতে।

তাদের দাবি, হিজাব বিতর্কে আমোদিনিকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রধান শিক্ষক পদে তাদের পছন্দের একজন শিক্ষককে বেছে নিতে চেয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।

সাহাদাত হোসেন নামের একজন শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ ২০১২ সালে বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রধান শিক্ষক ছাত্রদের বিভিন্ন প্রকার ফি, টিউশন ফি, রেজি: ফি, ফরম-ফিলাপ ফি, ব্যাংকের টাকা, জনৈক্য ব্যক্তির দেয়া ৭৯ হাজার টাকা, উপবৃত্তির টাকাসহ বিভিন্ন ফান্ডের অপব্যবহার করেন এবং নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। তিনি বলেন, গত মাস পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিনটি গ্রাম্য সালিশে তিন শিক্ষক নিয়োগে ৩৫ লাখ টাকা অনুদানের অপব্যবহার করার জন্য প্রধান শিক্ষক ও আগের পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে দায়ী করা হয়। এজন্য সভাপতি এবং তাকে স্কুলের উন্নয়নের জন্য ৯ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। কমিটির সাবেক সভাপতি তার অংশের ৫ লাখ টাকা জরিমানা পরিশোধ করলেও প্রধান শিক্ষক তার ৪ লাখ টাকা এখনো পরিশোধ করেননি।

তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে দাবি করে আমোদিনি পাল বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ আগামী ১০ মে অবসরে যাবেন। এরপর নিয়ম অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক হওয়ার কথা আমার। শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা হজম করতে বর্তমান প্রধান শিক্ষকসহ স্কুলের আরও কিছু শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির কিছু সদস্য চান না আমি প্রধান শিক্ষক হই। আমাকে বিপদে ফেলার জন্য এই চক্রটি স্কুল ড্রেস পরে না আসার জন্য ছাত্রীদের শাসন করার ওই ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে হিজাব বিতর্ক হিসেবে ছড়িয়েছে এবং অভিভাবকদের উসকে দিয়ে স্কুলে হামলা চালিয়েছে। আমাকে স্কুল থেকে সরানোর জন্যই মূলত প্রধান শিক্ষক আমাকে শোকজ করেছেন।’

প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়দের অভিযোগ, আমোদিনি পাল মেয়েদের হিজাব পরার জন্য মারধর করেছেন। এমন পরস্থিতিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের পরামর্শে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ওই দিনই আমি আমোদিনি পালকে শোকজ করি। এখানে কোন চক্রান্ত হয়নি। আমি তো কয়েকদিন পর অবসরেই যাচ্ছি। এখানে স্কুলে কে প্রধান শিক্ষক হলো আর না হলো তাতে আমার কী যায় আসে?’

গ্রাম্য সালিশের জরিমানা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্রামের লোকজনই স্কুলে এসে আমাকে মারধর করেছে এতে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারা তিন দফা সালিশ-দরবার করে জোরপূর্বক আমার কাছে ৪ লাখ টাকা চেয়েছে, আমি জীবন বাঁচাতে ওই টাকা দিতে চেয়েছিলাম।’

ওই টাকা দিয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেন দেবো?’। সেই ঘটনায় কোন মামলা করেছিলেন? ‘না, তবে এখন মনে হচ্ছে মামলা করা দরকার ছিল।’

নওগাঁর হিজাব ইস্যুতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল

নওগাঁর মহাদেবপুরে দাউল বারবাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ‘হিজাব পরায়’ শিক্ষার্থীদের পেটানোর অভিযোগের তুলে বিদ্যালয়ে হামলার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। স্কুলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য গুজব ছড়িয়ে শিক্ষিকা আমোদিনি পালের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষকে উসকে দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে তদন্ত কমিটির প্রধান মহাদেবপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল মালেকসহ কমিটির তিন সদস্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে চার পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউএনও মিজানুর রহমান সংবাদকে বলেন, কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্তে হিজাব পরায় শিক্ষার্থীদের পেটানোর অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। তদন্তে কমিটির কাছে মনে হয়েছে স্কুলড্রেসের কারণেই গত ৬ এপ্রিল বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনি পাল ও শরীরচর্চার শিক্ষক বদিউল আলম শিক্ষার্থীদের প্রহার করেন। স্কুলের অভ্যান্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষিকা আমোদিনি পালকে ফাঁসানোর জন্য ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা এই গুজব ছড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া গত ৭ এপ্রিল বিদ্যালয়ে ১৫০ থেকে ২০০ জন ব্যক্তি হামলা চালিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, স্কুলড্রেস না পরে আসায় শিক্ষিকা আমোদিনি পাল ও আরেক শিক্ষক বদিউল আলম শিক্ষার্থীদের প্রহার করেন। অথচ প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ শুধু শিক্ষিকা আমোদিনি পালকে শোকজ করেন। এই ঘটনা তদন্ত কমিটির কাছে উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়েছে। শুধু শিক্ষিকা আমোদিনি পালকে শোকজ করায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া প্রতিবেদনে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষার্থীদের প্রহার করায় শিক্ষিকা আমোদিনি পাল ও শিক্ষক বদিউল আলমের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

কারা গুজব ছড়িয়েছে তদন্ত কমিটি সেই সব ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পেরেছে কি-না এ বিষয়ে ইউএনও বলেন, ‘কিছু ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেছে। তবে এই মুহূর্তে নাম বলা যাচ্ছে না। আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সবাই জানতে পারবে।’ তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি যেসব পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দিয়েছে সেগুলো আমলে নিয়ে এই ঘটনায় যেখানে যেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন তা করা হবে।

প্রভাবমুক্ত হয়ে তদন্ত করতে পেরেছেন উল্লেখ করে তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল মালেক বলেন, ‘বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও এলাকাবাসী সবাইকে আমরা ডেকেছি। সবার সব কিছু শোনা এবং তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা প্রতিবেদন তৈরি করেছি। ইউএনও মহোদয় প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন।’

উল্লেখ্য, গত বুধবার স্কুলের সমাবেশ চলাকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের মারধরের ঘটনা ঘটে। সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনি এবং তার সহকর্মী বদিউল আলম স্কুলড্রেস না পরার জন্য কয়েকজন শিক্ষার্থীকে শাসন করেছিলেন, যাদের মধ্যে একাধিক হিন্দু শিক্ষার্থীও ছিল। রাতে শামীম আহমেদ জয় নামে একজন সোশ্যাল মিডিয়ায় হিজাব পরার কারণে ছাত্রীদের মারধরের জন্য আমোদিনিকে দায়ী করে একটি পোস্ট করেন। পরে পোস্টটি মুছে দিলেও ততক্ষণে পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। আমোদিনির অপসারণের দাবিতে বৃহস্পতিবার শতাধিক লোক স্কুল অবরোধ করে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। পুলিশ সেদিন পরিস্থিতি সামাল দেয় এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমোদিনি পালের বিরুদ্ধে শোকজ করেন।

শাসন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেছে যে তারা হিজাব না পরার জন্য আমোদিনি তাদের মারধর করেছে এবং অন্যরা দাবি করেছে যে তারা স্কুলের পোশাক না পরার জন্য তাদের শাসন করেছে। এদিকে বিদ্যালয়ে হামলার ঘটনায় বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ বাদী হয়ে হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অজ্ঞাত ১৪০-১৫০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে রোববার মহাদেবপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল ২০২২ , ২৯ চৈত্র ১৪২৮ ১০ রমাদ্বান ১৪৪৩

নওগাঁর হিজাব বিতর্ক ছিল ‘পরিকল্পিত’ নেপথ্যে ‘দুর্নীতি’

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের হিজাব বিতর্কের নেপথ্যে ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের করা দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা। সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনি পালকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দিতে ‘পরিকল্পিতভাবে’ তাকে বিতর্কিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিন দাউল বারবাকপুর গ্রামে গিয়ে স্থানীয় এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ তার দুর্নীতি এবং অপকর্ম বাস্তবায়ন করতে বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচনের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশ অমান্য করে তার পছন্দের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি গঠন করেছেন। মূলত নতুন কমিটির নেতারাই পরিকল্পিতভাবে হিজাব বিতর্ক ছড়িয়ে অভিভাবকদের উসকে দিয়েছে স্কুলে হামলা চালাতে।

তাদের দাবি, হিজাব বিতর্কে আমোদিনিকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রধান শিক্ষক পদে তাদের পছন্দের একজন শিক্ষককে বেছে নিতে চেয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।

সাহাদাত হোসেন নামের একজন শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ ২০১২ সালে বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রধান শিক্ষক ছাত্রদের বিভিন্ন প্রকার ফি, টিউশন ফি, রেজি: ফি, ফরম-ফিলাপ ফি, ব্যাংকের টাকা, জনৈক্য ব্যক্তির দেয়া ৭৯ হাজার টাকা, উপবৃত্তির টাকাসহ বিভিন্ন ফান্ডের অপব্যবহার করেন এবং নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। তিনি বলেন, গত মাস পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিনটি গ্রাম্য সালিশে তিন শিক্ষক নিয়োগে ৩৫ লাখ টাকা অনুদানের অপব্যবহার করার জন্য প্রধান শিক্ষক ও আগের পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে দায়ী করা হয়। এজন্য সভাপতি এবং তাকে স্কুলের উন্নয়নের জন্য ৯ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। কমিটির সাবেক সভাপতি তার অংশের ৫ লাখ টাকা জরিমানা পরিশোধ করলেও প্রধান শিক্ষক তার ৪ লাখ টাকা এখনো পরিশোধ করেননি।

তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে দাবি করে আমোদিনি পাল বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ আগামী ১০ মে অবসরে যাবেন। এরপর নিয়ম অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক হওয়ার কথা আমার। শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা হজম করতে বর্তমান প্রধান শিক্ষকসহ স্কুলের আরও কিছু শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির কিছু সদস্য চান না আমি প্রধান শিক্ষক হই। আমাকে বিপদে ফেলার জন্য এই চক্রটি স্কুল ড্রেস পরে না আসার জন্য ছাত্রীদের শাসন করার ওই ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে হিজাব বিতর্ক হিসেবে ছড়িয়েছে এবং অভিভাবকদের উসকে দিয়ে স্কুলে হামলা চালিয়েছে। আমাকে স্কুল থেকে সরানোর জন্যই মূলত প্রধান শিক্ষক আমাকে শোকজ করেছেন।’

প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়দের অভিযোগ, আমোদিনি পাল মেয়েদের হিজাব পরার জন্য মারধর করেছেন। এমন পরস্থিতিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের পরামর্শে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ওই দিনই আমি আমোদিনি পালকে শোকজ করি। এখানে কোন চক্রান্ত হয়নি। আমি তো কয়েকদিন পর অবসরেই যাচ্ছি। এখানে স্কুলে কে প্রধান শিক্ষক হলো আর না হলো তাতে আমার কী যায় আসে?’

গ্রাম্য সালিশের জরিমানা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্রামের লোকজনই স্কুলে এসে আমাকে মারধর করেছে এতে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারা তিন দফা সালিশ-দরবার করে জোরপূর্বক আমার কাছে ৪ লাখ টাকা চেয়েছে, আমি জীবন বাঁচাতে ওই টাকা দিতে চেয়েছিলাম।’

ওই টাকা দিয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেন দেবো?’। সেই ঘটনায় কোন মামলা করেছিলেন? ‘না, তবে এখন মনে হচ্ছে মামলা করা দরকার ছিল।’

নওগাঁর হিজাব ইস্যুতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল

নওগাঁর মহাদেবপুরে দাউল বারবাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ‘হিজাব পরায়’ শিক্ষার্থীদের পেটানোর অভিযোগের তুলে বিদ্যালয়ে হামলার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। স্কুলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য গুজব ছড়িয়ে শিক্ষিকা আমোদিনি পালের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষকে উসকে দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে তদন্ত কমিটির প্রধান মহাদেবপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল মালেকসহ কমিটির তিন সদস্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে চার পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউএনও মিজানুর রহমান সংবাদকে বলেন, কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্তে হিজাব পরায় শিক্ষার্থীদের পেটানোর অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। তদন্তে কমিটির কাছে মনে হয়েছে স্কুলড্রেসের কারণেই গত ৬ এপ্রিল বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনি পাল ও শরীরচর্চার শিক্ষক বদিউল আলম শিক্ষার্থীদের প্রহার করেন। স্কুলের অভ্যান্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষিকা আমোদিনি পালকে ফাঁসানোর জন্য ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা এই গুজব ছড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া গত ৭ এপ্রিল বিদ্যালয়ে ১৫০ থেকে ২০০ জন ব্যক্তি হামলা চালিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, স্কুলড্রেস না পরে আসায় শিক্ষিকা আমোদিনি পাল ও আরেক শিক্ষক বদিউল আলম শিক্ষার্থীদের প্রহার করেন। অথচ প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ শুধু শিক্ষিকা আমোদিনি পালকে শোকজ করেন। এই ঘটনা তদন্ত কমিটির কাছে উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়েছে। শুধু শিক্ষিকা আমোদিনি পালকে শোকজ করায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া প্রতিবেদনে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষার্থীদের প্রহার করায় শিক্ষিকা আমোদিনি পাল ও শিক্ষক বদিউল আলমের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

কারা গুজব ছড়িয়েছে তদন্ত কমিটি সেই সব ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পেরেছে কি-না এ বিষয়ে ইউএনও বলেন, ‘কিছু ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেছে। তবে এই মুহূর্তে নাম বলা যাচ্ছে না। আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সবাই জানতে পারবে।’ তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি যেসব পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দিয়েছে সেগুলো আমলে নিয়ে এই ঘটনায় যেখানে যেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন তা করা হবে।

প্রভাবমুক্ত হয়ে তদন্ত করতে পেরেছেন উল্লেখ করে তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল মালেক বলেন, ‘বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও এলাকাবাসী সবাইকে আমরা ডেকেছি। সবার সব কিছু শোনা এবং তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা প্রতিবেদন তৈরি করেছি। ইউএনও মহোদয় প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন।’

উল্লেখ্য, গত বুধবার স্কুলের সমাবেশ চলাকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের মারধরের ঘটনা ঘটে। সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনি এবং তার সহকর্মী বদিউল আলম স্কুলড্রেস না পরার জন্য কয়েকজন শিক্ষার্থীকে শাসন করেছিলেন, যাদের মধ্যে একাধিক হিন্দু শিক্ষার্থীও ছিল। রাতে শামীম আহমেদ জয় নামে একজন সোশ্যাল মিডিয়ায় হিজাব পরার কারণে ছাত্রীদের মারধরের জন্য আমোদিনিকে দায়ী করে একটি পোস্ট করেন। পরে পোস্টটি মুছে দিলেও ততক্ষণে পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। আমোদিনির অপসারণের দাবিতে বৃহস্পতিবার শতাধিক লোক স্কুল অবরোধ করে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। পুলিশ সেদিন পরিস্থিতি সামাল দেয় এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমোদিনি পালের বিরুদ্ধে শোকজ করেন।

শাসন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেছে যে তারা হিজাব না পরার জন্য আমোদিনি তাদের মারধর করেছে এবং অন্যরা দাবি করেছে যে তারা স্কুলের পোশাক না পরার জন্য তাদের শাসন করেছে। এদিকে বিদ্যালয়ে হামলার ঘটনায় বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ বাদী হয়ে হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অজ্ঞাত ১৪০-১৫০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে রোববার মহাদেবপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।