বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা-সংঘর্ষ

একাত্তরের ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশে একদিকে পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ এবং পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে।

এদিন গোয়ালন্দ ঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর একটি জলযান ডুবিয়ে দেয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তান বাহিনী পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। অন্যদিকে সিলেট শহর সংলগ্ন লাক্কাতুরা চা বাগানের বেশ কয়েকজন চা শ্রমিককে পাকিস্তানি হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে।

এদিনে নড়াইল শহর পাকিস্তান বাহিনীর দখলে চলে যায়। সকালে ক্যাপ্টেন নওজেশের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীর ভারি অস্ত্রে আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে তিস্তা ব্রিজের অবস্থান ছেড়ে দেয় এবং পিছু হটে শিঙ্গের ডাবরি, রাজার হাট ও টগরাইহাট নামক স্থানগুলোতে অবস্থান নেয়।

পাকবাহিনী টাঙ্গাইল দখলের পর ময়মনসিংহ শহর দখলের লক্ষ্যে এগিয়ে এলে মধুপুর গড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর হামলা করে। দু’পক্ষের মধ্যে প্রচ- গুলি বিনিময় হয়। পাকবাহিনীর দু’জন ড্রাইভার ঘটনাস্থলে মারা যায়। এ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই ছিলেন

অস্ত্রচালনায় অনভ্যস্ত ছাত্র।

এদিন বগুড়া পাকিস্তান বাহিনীর দখলে চলে যায়। বদরগঞ্জে পাকবাহিনী ট্যাংক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে।

পাকিস্তান বাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে না এসে খানসামার পথ ধরে পেছন থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক পাকিস্তান সেনারা খানসামার কাছে একটি নদী পার হতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায় এবং পাকিস্তান বাহিনীর বালুচ ডি কোম্পানিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে।

বানেশ্বরে পাকিস্তান সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন। বানেশ্বর ও সেই সঙ্গে সারদার পতন হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ ঘটনা ‘বানেশ্বরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

রাজশাহীর সারদায় পাকসেনা চলে আসায় বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর প্রায় দুই হাজার লোক নদীর ধারে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তান বাহিনী সবাইকে ঘিরে ফেলে এবং গুলি করে ও পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে প্রায় ৮০০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ বেদনাদায়ক ঘটনাটি মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সারদার গণহত্য’ নামে খ্যাত।

রাজশাহী সেনানিবাস এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তান বাহিনী আর্টিলারি, পদাতিক ও বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান সেনাদের এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে চাপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় সমবেত হয় এবং গোদাগাড়িতে অবস্থান নেয়।

গঙ্গাসাগর ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তান বাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ করে। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৩ জন অফিসারসহ অনেক সৈন্য মারা যায়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল শহীদ হন। পাকিস্তান বাহিনী পুনরায় রাজশাহী দখল করে।

এদিনে মার্কিন সিনেটে সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক খুন ও বেসামরিক লোকদের যথেচ্ছ হত্যার খবরে আমি আতঙ্কিত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশি সংবাদদাতাদের বহিষ্কারের যে নীতি পাকিস্তান সরকার অনুসরণ করছে তার ফলে কংগ্রেসের সদস্যবর্গ ও বহির্বিশ্বের পক্ষে সেখানে কী ঘটছে তা জানা অসম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক লোকদের পাইকারি হত্যা ও নির্বিচারে খুন-খারাপির খবরগুলো যতক্ষণ না অসত্য প্রমাণিত হচ্ছে তদ্দিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দান অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি।’

এদিনে ঢাকায় পাকিস্তানের পক্ষে গঠিত শান্তি কমিটির উদ্যোগে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। শান্তি কমিটি গঠনের পর এটিই ছিল তাদের বড় কর্মসূচি। এ মিছিলের সম্মুখভাগে ছিলেন খান এ. সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আজম, এ.এস.এম সোলায়মান, এ.কে.এম শফিকুল ইসলাম, এ.টি.সাদী, আবুল কাশেম, সৈয়দ আজিজুল হক, আতাউল হক, মেজর আফসার উদ্দিন, কবি বেনজির আহম্মদ, পীর মোহসেন উদ্দিন, অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান প্রমুখ।

বুধবার, ১৩ এপ্রিল ২০২২ , ৩০ চৈত্র ১৪২৮ ১১ রমাদ্বান ১৪৪৩

১৩ এপ্রিল ১৯৭১

বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা-সংঘর্ষ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একাত্তরের ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশে একদিকে পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ এবং পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে।

এদিন গোয়ালন্দ ঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর একটি জলযান ডুবিয়ে দেয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তান বাহিনী পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। অন্যদিকে সিলেট শহর সংলগ্ন লাক্কাতুরা চা বাগানের বেশ কয়েকজন চা শ্রমিককে পাকিস্তানি হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে।

এদিনে নড়াইল শহর পাকিস্তান বাহিনীর দখলে চলে যায়। সকালে ক্যাপ্টেন নওজেশের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীর ভারি অস্ত্রে আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে তিস্তা ব্রিজের অবস্থান ছেড়ে দেয় এবং পিছু হটে শিঙ্গের ডাবরি, রাজার হাট ও টগরাইহাট নামক স্থানগুলোতে অবস্থান নেয়।

পাকবাহিনী টাঙ্গাইল দখলের পর ময়মনসিংহ শহর দখলের লক্ষ্যে এগিয়ে এলে মধুপুর গড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর হামলা করে। দু’পক্ষের মধ্যে প্রচ- গুলি বিনিময় হয়। পাকবাহিনীর দু’জন ড্রাইভার ঘটনাস্থলে মারা যায়। এ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই ছিলেন

অস্ত্রচালনায় অনভ্যস্ত ছাত্র।

এদিন বগুড়া পাকিস্তান বাহিনীর দখলে চলে যায়। বদরগঞ্জে পাকবাহিনী ট্যাংক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে।

পাকিস্তান বাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে না এসে খানসামার পথ ধরে পেছন থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক পাকিস্তান সেনারা খানসামার কাছে একটি নদী পার হতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায় এবং পাকিস্তান বাহিনীর বালুচ ডি কোম্পানিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে।

বানেশ্বরে পাকিস্তান সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন। বানেশ্বর ও সেই সঙ্গে সারদার পতন হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ ঘটনা ‘বানেশ্বরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

রাজশাহীর সারদায় পাকসেনা চলে আসায় বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর প্রায় দুই হাজার লোক নদীর ধারে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তান বাহিনী সবাইকে ঘিরে ফেলে এবং গুলি করে ও পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে প্রায় ৮০০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ বেদনাদায়ক ঘটনাটি মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সারদার গণহত্য’ নামে খ্যাত।

রাজশাহী সেনানিবাস এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তান বাহিনী আর্টিলারি, পদাতিক ও বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান সেনাদের এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে চাপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় সমবেত হয় এবং গোদাগাড়িতে অবস্থান নেয়।

গঙ্গাসাগর ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তান বাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ করে। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৩ জন অফিসারসহ অনেক সৈন্য মারা যায়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল শহীদ হন। পাকিস্তান বাহিনী পুনরায় রাজশাহী দখল করে।

এদিনে মার্কিন সিনেটে সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক খুন ও বেসামরিক লোকদের যথেচ্ছ হত্যার খবরে আমি আতঙ্কিত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশি সংবাদদাতাদের বহিষ্কারের যে নীতি পাকিস্তান সরকার অনুসরণ করছে তার ফলে কংগ্রেসের সদস্যবর্গ ও বহির্বিশ্বের পক্ষে সেখানে কী ঘটছে তা জানা অসম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক লোকদের পাইকারি হত্যা ও নির্বিচারে খুন-খারাপির খবরগুলো যতক্ষণ না অসত্য প্রমাণিত হচ্ছে তদ্দিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দান অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি।’

এদিনে ঢাকায় পাকিস্তানের পক্ষে গঠিত শান্তি কমিটির উদ্যোগে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। শান্তি কমিটি গঠনের পর এটিই ছিল তাদের বড় কর্মসূচি। এ মিছিলের সম্মুখভাগে ছিলেন খান এ. সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আজম, এ.এস.এম সোলায়মান, এ.কে.এম শফিকুল ইসলাম, এ.টি.সাদী, আবুল কাশেম, সৈয়দ আজিজুল হক, আতাউল হক, মেজর আফসার উদ্দিন, কবি বেনজির আহম্মদ, পীর মোহসেন উদ্দিন, অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান প্রমুখ।