বাসযোগ্য রাজধানী চাই

এম এইচ খান মঞ্জু

বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণসহ সামগ্রিক পরিবেশ দূষণের কবলে ঢাকাসহ সারাদেশ। বেশকিছু আন্তর্জাতিক জরিপে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও শব্দদূষণে বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান উঠে আসে। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের দূষণ ও দূষণজনিত সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটগুলো চিহ্নিত ও আলোচিত হলেও এর কার্যকর প্রতিকার হয়নি।

প্রায় ৫ বছর আগে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে দূষণের কারণে বিশ্বে ৯০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। দূষণজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যায় দেশ হিসেবে প্রথম নামটি ছিল বাংলাদেশের। দ্বিতীয় অবস্থান ছিল আফ্রিকান দেশ সোমালিয়ার। বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, সংক্রমণজনিত জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। আর জটিল, দূরারোগ্য রোগসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা দেশি-বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বেশি।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউনের ক্ষতি, প্রণোদনাসহ নানাভাবে জনগণের রাজস্ব থেকে অতিরিক্ত এ ব্যয় হলেও এর চেয়ে অনেক বেশি প্রাণঘাতী বায়ু, পানি ও পরিবেশগত দূষণ মোকাবিলায় সরকারের বাজেট ও কর্মপরিকল্পনা খুবই অপ্রতুল। আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, করোনাভাইরাসের চেয়ে দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। দেশের হাসপাতাল, ডাক্তারের চেম্বার ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতে আগত রোগীদের বেশির ভাগ বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ, শব্দদূষণ ও পরিবেশগত দূষণের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার।

বায়ুদূষণের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। ফলে এ সমস্যা সমাধানে একটি সামগ্রিক চিন্তা ও পরিকল্পনা জরুরি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে না পারলে পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। দূষিত বায়ু জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূলিকণা মানবদেহের ভেতরে ঢুকে ফুসফুসে গেঁথে থাকে এবং একনাগাড়ে এসব উপাদানের ভেতর দিয়ে চলাচল করলে হৃদ্রোগ, হাঁপানি ও ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ত্রুটিপূর্ণ বাস, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, বেবিট্যাক্সি এবং বিভিন্ন কারখানা থেকে কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এখান থেকে মিথেন, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণিদেহে প্রবেশ করছে। তাছাড়া চামড়া শিল্প, রং কারখানা, রাসায়নিক গবেষণাগার, পয়োশোধনাগার থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন সালফাইডের সবই জীবজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কঠিন বর্জ্য-আবর্জনা পোড়ানোর ফলে বাতাসে মিশে যাওয়া কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এসবেস্টস আঁশ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে ধুলাবালি, সিগারেটের ধোঁয়া ও কীটনাশক স্পের কতা প্রতিনিয়ত বাতাসকে দূষিত করে মানবদেহে ক্যান্সারসহ অ্যালার্জিজনিত নানা জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। রাজধানীর এক-চতুর্থাংশ শিশুর ফুসফুসের সক্ষমতা দ্রুত কমছে। দীর্ঘ মেয়াদে ধুলার মধ্যে থাকার কারণে অ্যাজমা, সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসনালি-সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবার, এমনকি রাষ্ট্রও।

তাই এই সমস্যা সমাধানে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। শুধু সরকারি উদ্যোগই নয়, প্রয়োজন এর সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে যুক্ত করে দেশের মানুষকে আরও বেশি সচেতন করে তোলা। বৃক্ষনিধন বন্ধ করে দেশব্যাপী বনায়ন কর্মসূচিকে উৎসাহিত করতে হবে। সেই সঙ্গে দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। ইটভাটাগুলো দ্রুত আধুনিকায়ন করতে হবে। নির্মাণকাজে যাতে ধুলা কম হয়, সে বিষয়ে তদারকি বাড়াতে হবে।

[লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ]

আরও খবর

বুধবার, ১৩ এপ্রিল ২০২২ , ৩০ চৈত্র ১৪২৮ ১১ রমাদ্বান ১৪৪৩

বাসযোগ্য রাজধানী চাই

এম এইচ খান মঞ্জু

বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণসহ সামগ্রিক পরিবেশ দূষণের কবলে ঢাকাসহ সারাদেশ। বেশকিছু আন্তর্জাতিক জরিপে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও শব্দদূষণে বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান উঠে আসে। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের দূষণ ও দূষণজনিত সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটগুলো চিহ্নিত ও আলোচিত হলেও এর কার্যকর প্রতিকার হয়নি।

প্রায় ৫ বছর আগে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে দূষণের কারণে বিশ্বে ৯০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। দূষণজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যায় দেশ হিসেবে প্রথম নামটি ছিল বাংলাদেশের। দ্বিতীয় অবস্থান ছিল আফ্রিকান দেশ সোমালিয়ার। বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, সংক্রমণজনিত জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। আর জটিল, দূরারোগ্য রোগসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা দেশি-বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বেশি।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউনের ক্ষতি, প্রণোদনাসহ নানাভাবে জনগণের রাজস্ব থেকে অতিরিক্ত এ ব্যয় হলেও এর চেয়ে অনেক বেশি প্রাণঘাতী বায়ু, পানি ও পরিবেশগত দূষণ মোকাবিলায় সরকারের বাজেট ও কর্মপরিকল্পনা খুবই অপ্রতুল। আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, করোনাভাইরাসের চেয়ে দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। দেশের হাসপাতাল, ডাক্তারের চেম্বার ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতে আগত রোগীদের বেশির ভাগ বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ, শব্দদূষণ ও পরিবেশগত দূষণের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার।

বায়ুদূষণের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। ফলে এ সমস্যা সমাধানে একটি সামগ্রিক চিন্তা ও পরিকল্পনা জরুরি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে না পারলে পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। দূষিত বায়ু জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূলিকণা মানবদেহের ভেতরে ঢুকে ফুসফুসে গেঁথে থাকে এবং একনাগাড়ে এসব উপাদানের ভেতর দিয়ে চলাচল করলে হৃদ্রোগ, হাঁপানি ও ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ত্রুটিপূর্ণ বাস, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, বেবিট্যাক্সি এবং বিভিন্ন কারখানা থেকে কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এখান থেকে মিথেন, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণিদেহে প্রবেশ করছে। তাছাড়া চামড়া শিল্প, রং কারখানা, রাসায়নিক গবেষণাগার, পয়োশোধনাগার থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন সালফাইডের সবই জীবজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কঠিন বর্জ্য-আবর্জনা পোড়ানোর ফলে বাতাসে মিশে যাওয়া কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এসবেস্টস আঁশ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে ধুলাবালি, সিগারেটের ধোঁয়া ও কীটনাশক স্পের কতা প্রতিনিয়ত বাতাসকে দূষিত করে মানবদেহে ক্যান্সারসহ অ্যালার্জিজনিত নানা জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। রাজধানীর এক-চতুর্থাংশ শিশুর ফুসফুসের সক্ষমতা দ্রুত কমছে। দীর্ঘ মেয়াদে ধুলার মধ্যে থাকার কারণে অ্যাজমা, সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসনালি-সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবার, এমনকি রাষ্ট্রও।

তাই এই সমস্যা সমাধানে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। শুধু সরকারি উদ্যোগই নয়, প্রয়োজন এর সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে যুক্ত করে দেশের মানুষকে আরও বেশি সচেতন করে তোলা। বৃক্ষনিধন বন্ধ করে দেশব্যাপী বনায়ন কর্মসূচিকে উৎসাহিত করতে হবে। সেই সঙ্গে দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। ইটভাটাগুলো দ্রুত আধুনিকায়ন করতে হবে। নির্মাণকাজে যাতে ধুলা কম হয়, সে বিষয়ে তদারকি বাড়াতে হবে।

[লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ]