ধর্মীয় বিভেদমুক্ত দেশ গড়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

পারস্পরিক সৌহার্দ্য আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ‘ধর্মীয় বিভেদমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ’ দেশ গড়তে জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ‘আসুন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হয়ে, বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলি। যেখানে বৈষম্য থাকবে না, মানুষে মানুষে থাকবে না কোন ভেদাভেদ, থাকবে না ধর্মে-ধর্মে কোন বিভেদ।’ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

এদিকে সকালে রাজধানীতে অন্য এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির কোন সংঘাত বা বিরোধ নেই।

কিছু লোক ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ সৃষ্টি করতে চায়। এটা মোটেও সঠিক নয়। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’

বাঙালির বর্ষবরণ পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বারবার বাধা দেয়া এবং তিন দশক আগে (বাংলা ১৪০০ সালে) রমনা বটমূলে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা স্মরণ করে শিল্পকলা একাডেমির ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এগুলো করাই হয়েছিল যাতে আমাদের সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হয়ে যায়।’

সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘জাগতিক নিয়মের পথ-পরিক্রমায় বছর শেষে আমাদের মধ্যে আবার এসেছে নতুন বছর- ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। সবাইকে নতুন বছরের আন্তরিক শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।’ এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালির মুখের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। যার ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা মানে আমাদের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত হলেও ঐতিহ্য ও কৃষ্টির জায়গায় সব বাঙালি এক ও অভিন্ন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদ?যাপন এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে।’

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত দুই বছর বর্ষবরণের আয়োজন করতে না পারার কথা উল্লেখ করে এবার সবাইকে উৎসবে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তবে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

উপযুক্ত ৯০ শতংশ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে

জনগণকে এই মহামারী থেকে সুরক্ষিত রাখতে সরকার সচেষ্ট জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ টিকা পাওয়ার যোগ্য মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। টিকা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের পর এখন বুস্টার ডোজ দেয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারী শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মহামারীজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে পণ্য পরিবহনেও ভাড়া ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশেও কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আমরা কিন্তু চুপচাপ বসে নেই। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে স্বস্তি নিয়ে আসার।’

১ কোটি পরিবারকে টিসিবি পণ্য প্রদান

জনগণের জন্য নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘চলতি পবিত্র রমজানে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে প্রায় এক কোটি পরিবারকে কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাশ্রয়ী দামে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার।

রাজধানীতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫টি ফ্রিজার ভ্যানে করে সাশ্রয়ী দামে মাংস, ডিম ও দুধ বিক্রির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর ফলে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ইতোমধ্যে কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে। এছাড়া আসন্ন ঈদ উপলক্ষে এক কোটি ৩৩ হাজার ৫৪টি ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে এক লাখ ৩৩০ মেট্রিক টনের বেশি চালের বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’

দুর্ভিক্ষাবস্থার কথা বলছে কিছু গণমাধ্যম

কিছু কিছু গণমাধ্যমে এমনভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যেন দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে, এমন মন্তব্য করে জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে আপনাদের জানাতে চাই যে, দেশে চালসহ কোন পণ্যের ঘাটতি নেই। সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার জন্য টিসিবির দোকানে মানুষ ভিড় করবে এটাই স্বাভাবিক। এটাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার কী কারণ থাকতে পারে?’

দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি কৃষি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির ফলে চাল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি ছাড়নো হচ্ছে

সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে, এতে কোন ঋণ নেয়া হয়নি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। আর শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে।’

দেশি-বিদেশি ঋণ নেয়া হলেও তা যেন বোঝা না হয়ে ওঠে, সেদিকে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সম্পদ বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করা।’

পদ্মা সেতু চালু কয়েক মাস পরেই

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২২ ও ২০২৩ সাল হবে বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক বছর। আর কয়েক মাস পরই চালু হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এই সেতু জিডিপিতে এক দশমিক ২ শতাংশ হারে অবদান রাখবে। এ বছরের শেষ নাগাদ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে মেট্রোরেল চালু হবে। মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আগামী অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে দেশের প্রথম টানেল।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আগামী বছর

এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট আগামী বছরের শেষ নাগাদ চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গত মাসে পায়রায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্ধারিত সময়ের আগেই উদ্বোধন করা হয়েছে। অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।’

উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি গত ১৩ বছরে যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, তা অর্থনীতির সামষ্টিক সূচকগুলো বিবেচনা করলেই স্পষ্ট হয়। ২০০৯ সালে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ৭০২ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে বর্তমানে ২ হাজার ৫৯১ ডলারে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারীর সময়ও ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্থবছর রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। এবছরও আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসছে।’ এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবছর রপ্তানি আয়ে বাংলাদেশ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রেখে মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ফলে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।

৮ জেলায় শিল্পকলা একাডেমি ভবন উদ্বোধন

সকালে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের ৮টি জেলায় নবনির্মিত শিল্পকলা একাডেমি ভবনের উদ্বোধন করেন তিনি। বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী দেশে এবং বিদেশে অবস্থানকারী সব বাংলাদেশিদের পবিত্র মাহে রমজান, আজ বাংলা নববর্ষ এবং আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগাম শুভেচ্ছা জানান। তিনি করোনার জন্য সতর্কতার সঙ্গে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বক্তব্য রাখেন।

অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নবনির্মিত ৮টি শিল্ককলা একাডেমি ভবনের ওপর একটি তথ্যচিত্রও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। কুষ্টিয়া, খুলনা, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও রংপুর জেলার নবনির্মিত শিল্পকলা একডেমিগুলো অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিল।

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

ধর্মীয় বিভেদমুক্ত দেশ গড়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

পারস্পরিক সৌহার্দ্য আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ‘ধর্মীয় বিভেদমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ’ দেশ গড়তে জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ‘আসুন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হয়ে, বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলি। যেখানে বৈষম্য থাকবে না, মানুষে মানুষে থাকবে না কোন ভেদাভেদ, থাকবে না ধর্মে-ধর্মে কোন বিভেদ।’ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

এদিকে সকালে রাজধানীতে অন্য এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির কোন সংঘাত বা বিরোধ নেই।

কিছু লোক ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ সৃষ্টি করতে চায়। এটা মোটেও সঠিক নয়। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’

বাঙালির বর্ষবরণ পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বারবার বাধা দেয়া এবং তিন দশক আগে (বাংলা ১৪০০ সালে) রমনা বটমূলে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা স্মরণ করে শিল্পকলা একাডেমির ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এগুলো করাই হয়েছিল যাতে আমাদের সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হয়ে যায়।’

সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘জাগতিক নিয়মের পথ-পরিক্রমায় বছর শেষে আমাদের মধ্যে আবার এসেছে নতুন বছর- ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। সবাইকে নতুন বছরের আন্তরিক শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।’ এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালির মুখের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। যার ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা মানে আমাদের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত হলেও ঐতিহ্য ও কৃষ্টির জায়গায় সব বাঙালি এক ও অভিন্ন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদ?যাপন এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে।’

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত দুই বছর বর্ষবরণের আয়োজন করতে না পারার কথা উল্লেখ করে এবার সবাইকে উৎসবে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তবে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

উপযুক্ত ৯০ শতংশ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে

জনগণকে এই মহামারী থেকে সুরক্ষিত রাখতে সরকার সচেষ্ট জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ টিকা পাওয়ার যোগ্য মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। টিকা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের পর এখন বুস্টার ডোজ দেয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারী শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মহামারীজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে পণ্য পরিবহনেও ভাড়া ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশেও কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আমরা কিন্তু চুপচাপ বসে নেই। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে স্বস্তি নিয়ে আসার।’

১ কোটি পরিবারকে টিসিবি পণ্য প্রদান

জনগণের জন্য নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘চলতি পবিত্র রমজানে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে প্রায় এক কোটি পরিবারকে কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাশ্রয়ী দামে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার।

রাজধানীতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫টি ফ্রিজার ভ্যানে করে সাশ্রয়ী দামে মাংস, ডিম ও দুধ বিক্রির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর ফলে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ইতোমধ্যে কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে। এছাড়া আসন্ন ঈদ উপলক্ষে এক কোটি ৩৩ হাজার ৫৪টি ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে এক লাখ ৩৩০ মেট্রিক টনের বেশি চালের বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’

দুর্ভিক্ষাবস্থার কথা বলছে কিছু গণমাধ্যম

কিছু কিছু গণমাধ্যমে এমনভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যেন দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে, এমন মন্তব্য করে জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে আপনাদের জানাতে চাই যে, দেশে চালসহ কোন পণ্যের ঘাটতি নেই। সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার জন্য টিসিবির দোকানে মানুষ ভিড় করবে এটাই স্বাভাবিক। এটাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার কী কারণ থাকতে পারে?’

দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি কৃষি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির ফলে চাল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি ছাড়নো হচ্ছে

সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে, এতে কোন ঋণ নেয়া হয়নি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। আর শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে।’

দেশি-বিদেশি ঋণ নেয়া হলেও তা যেন বোঝা না হয়ে ওঠে, সেদিকে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সম্পদ বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করা।’

পদ্মা সেতু চালু কয়েক মাস পরেই

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২২ ও ২০২৩ সাল হবে বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক বছর। আর কয়েক মাস পরই চালু হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এই সেতু জিডিপিতে এক দশমিক ২ শতাংশ হারে অবদান রাখবে। এ বছরের শেষ নাগাদ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে মেট্রোরেল চালু হবে। মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আগামী অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে দেশের প্রথম টানেল।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আগামী বছর

এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট আগামী বছরের শেষ নাগাদ চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গত মাসে পায়রায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্ধারিত সময়ের আগেই উদ্বোধন করা হয়েছে। অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।’

উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি গত ১৩ বছরে যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, তা অর্থনীতির সামষ্টিক সূচকগুলো বিবেচনা করলেই স্পষ্ট হয়। ২০০৯ সালে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ৭০২ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে বর্তমানে ২ হাজার ৫৯১ ডলারে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারীর সময়ও ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্থবছর রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। এবছরও আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসছে।’ এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবছর রপ্তানি আয়ে বাংলাদেশ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রেখে মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ফলে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।

৮ জেলায় শিল্পকলা একাডেমি ভবন উদ্বোধন

সকালে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের ৮টি জেলায় নবনির্মিত শিল্পকলা একাডেমি ভবনের উদ্বোধন করেন তিনি। বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী দেশে এবং বিদেশে অবস্থানকারী সব বাংলাদেশিদের পবিত্র মাহে রমজান, আজ বাংলা নববর্ষ এবং আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগাম শুভেচ্ছা জানান। তিনি করোনার জন্য সতর্কতার সঙ্গে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বক্তব্য রাখেন।

অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নবনির্মিত ৮টি শিল্ককলা একাডেমি ভবনের ওপর একটি তথ্যচিত্রও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। কুষ্টিয়া, খুলনা, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও রংপুর জেলার নবনির্মিত শিল্পকলা একডেমিগুলো অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিল।