বাংলার প্রাণের সুর বেজে উঠছে আজ

মামুনুর রশীদ

সারা বছর ইংরেজিতে ঘুরে ঘুরে ডানে বায়ে গিয়ে তারপর এক সময় ত্রিশে চৈত্র সন্ধ্যা বেলায় ফিরে আসি বাংলায়। বাঁশির সুরে সেতারের ঝংকারে অথবা ঝড়-বাদলের দুরন্ত বাঁশরি শুনে রাত্রি কাটে বাংলায়। তার পরদিন কোন এক বটমূলে বাংলার গান শুনে বাংলা খাবার খেয়ে দিন কেটে যায়। বিকেলের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মেলা ভ-ল না হলে প্রচুর জনসমুদ্রের মধ্য দিয়ে ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা। অতপর ক্লান্তি এবং পরের বছর আবার চৈত্র সংক্রান্তিতে বাংলার রূপ দেখা।

এর মধ্যে অবশ্য ফেব্রুয়ারি মাসটাও আছে, যখন ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে একবার ঘুম ভাঙে বাংলার জন্য। যার স্থিতিকাল একদিন একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে। অথচ দুঃখীনি বাংলার কিছুই হলো না, সেই কবে সংস্কৃত, উর্দ্দু, ফার্সি, ইংরেজি, রাজভাষা হিসেবে চালু হয়েছিল তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এসে একটা যতিও টেনে ছিল।

মানুষের ভাষা আর রাষ্ট্রভাষা মিলে একাকার হয়েছিল বাংলা। সেটাও হয়েছিল একটা বড় ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যুগল আন্দোলনের পর। আন্দোলনটি অবশ্য রক্তাক্ত হলো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে।

এই পহেলা বৈশাখই বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল অসাম্প্রদায়িকতার বাণী পৌঁছে দিয়েছিল ঘরে ঘরে। ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। পরবর্তীকালে ভাষা এবং তার ভূখ-ের জন্য প্রাণ দিয়েছিল এই অসাম্প্রদায়িক সব বাঙালি। তাই এক ধরনের মানুষ বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তারা অসুরের হয়ে কথা বলে। বলে ফেলে টিপ পড়ছস ক্যান? অথবা বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় ম-লকে মিথ্যায় অভিযুক্ত করে।

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়, একটা স্বচ্ছ ইতিহাসকে গুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে অনবরত। কিন্তু লাভ হয় না। মানুষ রুখে দাঁড়ায়, অসুর ধরা পড়ে হৃদয় ম-ল অকারন সাজা খেটে একসময় জনদাবির কারণেই কারাগার থেকে বেড়িয়ে আসে। লক্ষ কোটি টিপ শোভা পায় নারীদের প্রশস্ত কপালে। নববর্ষের রাখিবন্ধনে বাঁধা এই অঞ্চলের সব বাংলা ভাষাভাষি মানুষ। সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই দাপদাহের বৈশাখী রুখে দাঁড়ায়।

সেই আকবরের আমল থেকে অদ্যাবধি যে বাংলা সাঅ চালু হয়েছে তাতে শুধু সংখ্যা গণনা নয়, রয়েছে বাংলার সুজলা-সুফলা শস্য ভা-ারের অবদান। সপ্তডিঙ্গা মধুকর দিয়ে একদা বাংলার সোনালি সম্ভার পার হত সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে।

কেমন সমৃদ্ধ ছিল এই বাংলা তার একটি প্রমাণ মেলে মোঘল সম্রাজ্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে। আওরঙ্গজেবের সময় শুধু বাংলা থেকে এক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো এবং বাংলার ইতিহাস প্রণেতা ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথান বাংলাকে আখ্যায়িত করেছেন বাহার ই স্তানে গায়েবি বলে। যার অর্থ অচেনা চির বসন্তের দেশ। যেখানে গ্রীষ্মেও ঘাস শুকিয়ে যায় না।

কালক্রমে সেই দেশের সবুজ বনানী সুউচ্চ পাহাড়, অসংখ্য নদ-নদী আমরা বিপন্ন করে তুলেছি দুর্ব্যবহারে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এটা অবশ্যই ব্যতিক্রম এই বঙ্গভূমি আবার শুধু বাংলা ভাষাভাষির নয়, আরও চল্লিশটি ভাষাভাষির মানুষ এখানে বসবাস করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে। তারা এত প্রকৃতির কাছাকাছি যে তারা ভূমিকে মনে করে ধরিত্রি। বন, পাহাড়, নদী এসবেরই তারা রক্ষক। ভাষা ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্র থাকলেও তারা এই বঙ্গভূমির সন্তান। চৈত্রের শেষ দিনে তারাও মেতে উঠে উৎসবে। বিজু বা বৈসাবির মাধ্যমে তারা যুক্ত হয় বর্ষ শেষের আনন্দ উৎসবে। বাংলা নববর্ষ অর্র্থাৎ পহেলা বৈশাখ শুধু একটি উৎসবের দিন নয় এটি অমঙ্গলের বিরুদ্ধে মঙ্গলের প্রেরণা।

আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগে প্রতিটি গ্রামে এই দিনে ভ্রাম্যমাণ সঙের অভিনয় হতো সেই সঙের বিষয়বস্তু ছিল গ্রামের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং অত্যাচারী মহাজন বা ধর্মকে যারা ব্যবহার করে সেইসব মানুষের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ একমুষ্ঠি চাল, বা সামান্য অর্থ দিয়ে তাদের সম্মানিত করত।

গত ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে ঢাকা ও বিভিন্ন বড় বড় শহরে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়েছে। এই শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের অমঙ্গলের প্রতীক অত্যন্ত শিল্পীতভাবে নির্মিত হয় এবং পহেলা বৈশাখে প্রথম প্রহরে বিশাল শোভাযাত্রা নিয়ে বড় বড় রাজপথ প্রদিক্ষণ করা হয়ে থাকে।

কিন্তু দুঃখজনক হলো পহেলা বৈশাখের এই প্রেরণা দেশের শাসকগোষ্ঠী গ্রহণ না করে ভিনদেশী সংস্কৃতির চর্চায় ব্যস্ত থাকছে। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে অবমাননা করে গ্রামে-গঞ্জে ছোট থেকে বড় শহরে বিদেশি শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষারও প্রচলন শুরু করেছে। এই প্রচলন এত দ্রুতভাবে বাড়ছে যে, সেখানে বাংলা নববর্ষের চেতনা পৌঁছাচ্ছে না। বাঙালিয়ানাকে ভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে দেয়ার অপচেষ্টাও তারা করেছে। বর্তমানে প্রযুক্তির অব্যাহত সম্প্রসারণের ফলে ফেইসবুক, ইউটিউবে যথেচ্ছ মন্তব্য করে এক ধরনের সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকা-ও পরিলক্ষিত হচ্ছে। খোদ পশ্চিমা বিশ্বে এইসব চর্চাকে গণতন্ত্রবিরোধীও বলা হচ্ছে। যে সংস্কৃতিতে, যে ভাষায় মানুষের প্রাণের সুর বেজে উঠে সেই ভাষা এবং তার উৎস হোক আমাদের চিরদিনের সঙ্গী।

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

বাংলার প্রাণের সুর বেজে উঠছে আজ

মামুনুর রশীদ

image

সারা বছর ইংরেজিতে ঘুরে ঘুরে ডানে বায়ে গিয়ে তারপর এক সময় ত্রিশে চৈত্র সন্ধ্যা বেলায় ফিরে আসি বাংলায়। বাঁশির সুরে সেতারের ঝংকারে অথবা ঝড়-বাদলের দুরন্ত বাঁশরি শুনে রাত্রি কাটে বাংলায়। তার পরদিন কোন এক বটমূলে বাংলার গান শুনে বাংলা খাবার খেয়ে দিন কেটে যায়। বিকেলের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মেলা ভ-ল না হলে প্রচুর জনসমুদ্রের মধ্য দিয়ে ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা। অতপর ক্লান্তি এবং পরের বছর আবার চৈত্র সংক্রান্তিতে বাংলার রূপ দেখা।

এর মধ্যে অবশ্য ফেব্রুয়ারি মাসটাও আছে, যখন ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে একবার ঘুম ভাঙে বাংলার জন্য। যার স্থিতিকাল একদিন একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে। অথচ দুঃখীনি বাংলার কিছুই হলো না, সেই কবে সংস্কৃত, উর্দ্দু, ফার্সি, ইংরেজি, রাজভাষা হিসেবে চালু হয়েছিল তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এসে একটা যতিও টেনে ছিল।

মানুষের ভাষা আর রাষ্ট্রভাষা মিলে একাকার হয়েছিল বাংলা। সেটাও হয়েছিল একটা বড় ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যুগল আন্দোলনের পর। আন্দোলনটি অবশ্য রক্তাক্ত হলো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে।

এই পহেলা বৈশাখই বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল অসাম্প্রদায়িকতার বাণী পৌঁছে দিয়েছিল ঘরে ঘরে। ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। পরবর্তীকালে ভাষা এবং তার ভূখ-ের জন্য প্রাণ দিয়েছিল এই অসাম্প্রদায়িক সব বাঙালি। তাই এক ধরনের মানুষ বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তারা অসুরের হয়ে কথা বলে। বলে ফেলে টিপ পড়ছস ক্যান? অথবা বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় ম-লকে মিথ্যায় অভিযুক্ত করে।

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়, একটা স্বচ্ছ ইতিহাসকে গুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে অনবরত। কিন্তু লাভ হয় না। মানুষ রুখে দাঁড়ায়, অসুর ধরা পড়ে হৃদয় ম-ল অকারন সাজা খেটে একসময় জনদাবির কারণেই কারাগার থেকে বেড়িয়ে আসে। লক্ষ কোটি টিপ শোভা পায় নারীদের প্রশস্ত কপালে। নববর্ষের রাখিবন্ধনে বাঁধা এই অঞ্চলের সব বাংলা ভাষাভাষি মানুষ। সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই দাপদাহের বৈশাখী রুখে দাঁড়ায়।

সেই আকবরের আমল থেকে অদ্যাবধি যে বাংলা সাঅ চালু হয়েছে তাতে শুধু সংখ্যা গণনা নয়, রয়েছে বাংলার সুজলা-সুফলা শস্য ভা-ারের অবদান। সপ্তডিঙ্গা মধুকর দিয়ে একদা বাংলার সোনালি সম্ভার পার হত সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে।

কেমন সমৃদ্ধ ছিল এই বাংলা তার একটি প্রমাণ মেলে মোঘল সম্রাজ্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে। আওরঙ্গজেবের সময় শুধু বাংলা থেকে এক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো এবং বাংলার ইতিহাস প্রণেতা ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথান বাংলাকে আখ্যায়িত করেছেন বাহার ই স্তানে গায়েবি বলে। যার অর্থ অচেনা চির বসন্তের দেশ। যেখানে গ্রীষ্মেও ঘাস শুকিয়ে যায় না।

কালক্রমে সেই দেশের সবুজ বনানী সুউচ্চ পাহাড়, অসংখ্য নদ-নদী আমরা বিপন্ন করে তুলেছি দুর্ব্যবহারে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এটা অবশ্যই ব্যতিক্রম এই বঙ্গভূমি আবার শুধু বাংলা ভাষাভাষির নয়, আরও চল্লিশটি ভাষাভাষির মানুষ এখানে বসবাস করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে। তারা এত প্রকৃতির কাছাকাছি যে তারা ভূমিকে মনে করে ধরিত্রি। বন, পাহাড়, নদী এসবেরই তারা রক্ষক। ভাষা ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্র থাকলেও তারা এই বঙ্গভূমির সন্তান। চৈত্রের শেষ দিনে তারাও মেতে উঠে উৎসবে। বিজু বা বৈসাবির মাধ্যমে তারা যুক্ত হয় বর্ষ শেষের আনন্দ উৎসবে। বাংলা নববর্ষ অর্র্থাৎ পহেলা বৈশাখ শুধু একটি উৎসবের দিন নয় এটি অমঙ্গলের বিরুদ্ধে মঙ্গলের প্রেরণা।

আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগে প্রতিটি গ্রামে এই দিনে ভ্রাম্যমাণ সঙের অভিনয় হতো সেই সঙের বিষয়বস্তু ছিল গ্রামের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং অত্যাচারী মহাজন বা ধর্মকে যারা ব্যবহার করে সেইসব মানুষের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ একমুষ্ঠি চাল, বা সামান্য অর্থ দিয়ে তাদের সম্মানিত করত।

গত ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে ঢাকা ও বিভিন্ন বড় বড় শহরে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়েছে। এই শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের অমঙ্গলের প্রতীক অত্যন্ত শিল্পীতভাবে নির্মিত হয় এবং পহেলা বৈশাখে প্রথম প্রহরে বিশাল শোভাযাত্রা নিয়ে বড় বড় রাজপথ প্রদিক্ষণ করা হয়ে থাকে।

কিন্তু দুঃখজনক হলো পহেলা বৈশাখের এই প্রেরণা দেশের শাসকগোষ্ঠী গ্রহণ না করে ভিনদেশী সংস্কৃতির চর্চায় ব্যস্ত থাকছে। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে অবমাননা করে গ্রামে-গঞ্জে ছোট থেকে বড় শহরে বিদেশি শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষারও প্রচলন শুরু করেছে। এই প্রচলন এত দ্রুতভাবে বাড়ছে যে, সেখানে বাংলা নববর্ষের চেতনা পৌঁছাচ্ছে না। বাঙালিয়ানাকে ভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে দেয়ার অপচেষ্টাও তারা করেছে। বর্তমানে প্রযুক্তির অব্যাহত সম্প্রসারণের ফলে ফেইসবুক, ইউটিউবে যথেচ্ছ মন্তব্য করে এক ধরনের সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকা-ও পরিলক্ষিত হচ্ছে। খোদ পশ্চিমা বিশ্বে এইসব চর্চাকে গণতন্ত্রবিরোধীও বলা হচ্ছে। যে সংস্কৃতিতে, যে ভাষায় মানুষের প্রাণের সুর বেজে উঠে সেই ভাষা এবং তার উৎস হোক আমাদের চিরদিনের সঙ্গী।