হামলা : সেদিন যা ঘটেছিল

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় বইমেলা থেকে ফিরছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের অধ্যাপক, প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ। টিএসসির চত্বর এলাকায় পৌঁছা মাত্র একদল দুর্বৃত্ত ঘিরে ফেলেন তাকে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন হুমায়ুন আজাদকে। চারদিকে চিৎকার শুরু হলে হামলাকারীরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল এবং পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হলেও শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে মৃত্যু হয় এ লেখকের।

১৮ বছর পর বিচার কার্যক্রম শেষে গতকাল রায় হয়েছে। রায়ে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ৪ জঙ্গিকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়।

যেভাবে হামলা

সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান তার অভিযোগপত্রে বলেন, ঘটনার দিন জেএমবি নেতা আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে মিজানুর রহমান মিনহাজ একটি চাপাতি নিয়ে জেএমবির ‘কিলিং স্কোয়াডের সদস্য’ নূর মোহাম্মদ ওরফে শামিম কাঠের বাটওয়ালা সামনের দিকে তিনটি ছিদ্রযুক্ত ছুরি নিয়ে, ভাগ্নে শহিদ ও নুরুল্লাহ হাফেজ বোমা নিয়ে রাত ৮টার দিকে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে অবস্থান নেয়। এরপর রাত সোয়া ৯টার দিকে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বইমেলা থেকে বের হয়ে হেঁটে পূর্বপাশের ফুটপাত দিয়ে টিএসসির দিকে যাওয়ার সময় আক্রান্ত হন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘মিজানুর রহমান মিনহাজ ও শামিম ব্যাগ থেকে চাপাতি ও ছুরি বের করে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ঘাড়ে, মাথায়, মুখে, গলায়, হাতে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপুর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত ও মারাত্মক জখম করে। ঘটনাস্থলে চাপাতি ও ছুরি ফেলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্নে শহিদ ও হাফেজ নুরুল্লাহ তাদের ব্যাগে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অন্ধকারে জনগণের সঙ্গে মিশে যায়।’

রাত ১১টার দিকে পৃথক পৃথকভাবে ঘাতকরা মাদারটেকের একটি বাসায় পৌঁছায়। এরপর তারা জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে মোবাইল ফোনে ঘটনা জানায় বলে তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে লিখেছেন। ওই ঘটনায় শায়খ রহমান ও সানি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। অন্য মামলায় তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় তাদের বিচারের সুযোগ হয়নি।

সাক্ষীদের জবানবন্দি

হামলার ঘটনার পর রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শরিফুল হাসান। এ মামলায় তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্যও দিয়েছেন। সেদিনের কথা স্মরণ করে শরিফুল বলেন, ‘আমি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে গান শুনছিলাম। হঠাৎ একটি বোমা বিস্ফোরণের মত শব্দ হলো। নিজেকে খুব সাহসী বলব না, তবে ভয়টা একটু কম। ... তো কোথা থেকে এলো সেই শব্দ, সেটি জানতে টিএসসি থেকে দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম বাংলা একাডেমির দিকে। আজও মনে আছে, রাস্তার মাঝে যে সড়ক বিভাজন ছিল, সেটি ধরে হাঁটছিলাম। এক জায়গায় কয়েকজন লোকের ভিড় দেখে গেলাম। আগেই বলেছি, রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে অছে রক্তাক্ত একজন মানুষ। কিন্তু কেউ ধরছে না।’

হাসান জানান, আগে সামনাসামনি না দেখলেও বইয়ের ফ্ল্যাপে কিংবা পত্রিকায় ছবি দেখে হুমায়ুন আজাদের চেহারা তার বেশ পরিচিতই ছিল। ‘কাছে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন একজন মানুষ। পুরো মুখম-ল রক্তাক্ত। আমি ধরে মুখটা ঘোরাতেই চিনতে পারি। এরপর চিৎকার করে বলি, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার হুমায়ুন আজাদ। এখনি হাসপাতালে নিতে হবে! কিন্তু কীভাবে নেব?’

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের তখনকার সংগঠক, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব আশরাফ সিদ্দিকী বিটুর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা জানান হাসান। হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নিতে পাশ দিয়ে যাওয়া একটি গাড়ির চালককে অনুরোধ করলেও রাজি হননি তিনি। তখন রক্তাক্ত লেখককে কাছাকাছি থাকা পুলিশ ট্রাকের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ট্রাকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় হুমায়ুন আজাদকে। ট্রাকে তোলার ওই সময়ে রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদের ছবি তোলেন একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক। হাসপাতালে নেয়ার সময় পুলিশের ট্রাকে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কথোপকথনের প্রসঙ্গ ধরে শরিফুল বলেন, স্যারকে জড়িয়ে ধরে আছি। এত কাছের ঢাকা মেডিকেল মনে হচ্ছে বহুদূর।

স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা আমাকে কই নিয়ে যাও?’ আমি বললাম, স্যার, হাসপাতালে। আপনার কিছু হয়নি। আপনি ভালো হয়ে যাবেন। স্যার বললেন, ‘আমার চশমা কই?’ আমি বললাম, স্যার, আছে। স্যার বললেন, ‘আমাকে তুমি পুলিশের গাড়িতে কেন নিয়েছ?’ আমি বললাম, স্যার, আমরা আপনার ছাত্র। ঠিক আছে স্যার আমরা এখনি নেমে যাব।’

ওই রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গুরুতর আহত হুমায়ুন আজাদকে স্থানান্তর করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। শরিফুল বলেন, ‘আমরা পরে জেনেছিলাম, স্যারকে কুপিয়ে ফেলে যাওয়ার ১০-১২ মিনিটের মাথায় আমরা হাসপাতালে নিতে পেরেছিলাম। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, আরেকটু দেরি হলে রক্তক্ষরণে স্যার মারা যেতে পারতেন! ভেবে খুব ভালো লাগছিল যে স্যারকে আমরা বাঁচাতে পেরেছিলাম। কিন্তু আসলে কী বাঁচাতে পেরেছিলাম? ছয় মাস পর তো স্যার মারা গেলেন জার্মানিতে!’

সানির ইশারা পেয়ে হামলা

আদালতে দেয়া আনোয়ারুলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টার আগে জেএমবি নেতা বাংলা ভাই দিনাজপুরে যান। সেখানে তিনি আনোয়ারুলকে নূর মোহাম্মদের মুঠোফোন নম্বর দেন। পরে ঢাকায় আনোয়ারুলের সঙ্গে মিজানুর, সানি ও নুরুল্লাহর দেখা হয়। সানি তখন আনোয়ারুল ও নুরুল্লাহকে বলেন, ‘তোমরা আজকে আমাদের সঙ্গে একটা কাজে যাবে। তোমাদের কাজ হবে নূর মোহাম্মদ ও মিজানুরকে অনুসরণ করা। তাদের কাজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোমা ফাটিয়ে নিরাপদে তাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে।’

আঘাত করেন মিজানুর ও নূর মোহাম্মদ

আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে মিজানুর বলেছেন, ‘আমরা জানতে পারি, বইমেলা থেকে প্রতিদিন রাত ৮টা বা সাড়ে ৮টার দিকে হুমায়ুন আজাদ হেঁটে বাসায় যান। এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সেদিন আমিসহ অন্যরা বাংলা একাডেমিতে যাই। রাত সোয়া ৯টায় হুমায়ুন আজাদ যখন বইমেলা শেষে বাসায় ফিরছিলেন, তখন আমরা তার পিছু নেই।’

জবানবন্দিতে মিজানুর বলেছেন, ‘হুমায়ুন আজাদকে আমি ও নূর মোহাম্মদ ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করি। তখন দূরে থাকা লোকজন ছুটে এলে আনোয়ারুল একটা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। তখন লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে পালাতে থাকে। আমরাও পালিয়ে যাই। রাত ১১টার দিকে মোবাইল ফোনে শায়খ আবদুর রহমানকে এ ঘটনা জানাই।’

সুস্থ হয়ে উঠলেও আঘাতজনিত কারণেই তার মৃত্যু

হামলার পর সিএমএইচ ও থাইল্যান্ডে কয়েক মাস চিকিৎসা নেয়ার পর ২০০৪ সালের আগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান হুমায়ুন আজাদ। ওই বছর ১২ আগস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুসনদের বরাতে অভিযোগপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসের আঘাতে জেরে লেখকের মৃত্যু হয়েছে। অ্যানাটমিক্যালি আকস্মিক মৃত্যুর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘আক্রান্ত হইয়া মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তিনি অসুস্থ ও আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া পড়েন। চিকিৎসার পরও আরোগ্য না হইয়া বরং তিনি ধীরে ধীরে আরও বেশি অসুস্থ হইয়া জার্মানি মিউনিখে নিজ বাসস্থানে যাওয়ার চারদিন পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়েন।’

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

হামলা : সেদিন যা ঘটেছিল

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় বইমেলা থেকে ফিরছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের অধ্যাপক, প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ। টিএসসির চত্বর এলাকায় পৌঁছা মাত্র একদল দুর্বৃত্ত ঘিরে ফেলেন তাকে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন হুমায়ুন আজাদকে। চারদিকে চিৎকার শুরু হলে হামলাকারীরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল এবং পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হলেও শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে মৃত্যু হয় এ লেখকের।

১৮ বছর পর বিচার কার্যক্রম শেষে গতকাল রায় হয়েছে। রায়ে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ৪ জঙ্গিকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়।

যেভাবে হামলা

সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান তার অভিযোগপত্রে বলেন, ঘটনার দিন জেএমবি নেতা আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে মিজানুর রহমান মিনহাজ একটি চাপাতি নিয়ে জেএমবির ‘কিলিং স্কোয়াডের সদস্য’ নূর মোহাম্মদ ওরফে শামিম কাঠের বাটওয়ালা সামনের দিকে তিনটি ছিদ্রযুক্ত ছুরি নিয়ে, ভাগ্নে শহিদ ও নুরুল্লাহ হাফেজ বোমা নিয়ে রাত ৮টার দিকে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে অবস্থান নেয়। এরপর রাত সোয়া ৯টার দিকে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বইমেলা থেকে বের হয়ে হেঁটে পূর্বপাশের ফুটপাত দিয়ে টিএসসির দিকে যাওয়ার সময় আক্রান্ত হন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘মিজানুর রহমান মিনহাজ ও শামিম ব্যাগ থেকে চাপাতি ও ছুরি বের করে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ঘাড়ে, মাথায়, মুখে, গলায়, হাতে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপুর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত ও মারাত্মক জখম করে। ঘটনাস্থলে চাপাতি ও ছুরি ফেলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্নে শহিদ ও হাফেজ নুরুল্লাহ তাদের ব্যাগে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অন্ধকারে জনগণের সঙ্গে মিশে যায়।’

রাত ১১টার দিকে পৃথক পৃথকভাবে ঘাতকরা মাদারটেকের একটি বাসায় পৌঁছায়। এরপর তারা জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে মোবাইল ফোনে ঘটনা জানায় বলে তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে লিখেছেন। ওই ঘটনায় শায়খ রহমান ও সানি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। অন্য মামলায় তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় তাদের বিচারের সুযোগ হয়নি।

সাক্ষীদের জবানবন্দি

হামলার ঘটনার পর রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শরিফুল হাসান। এ মামলায় তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্যও দিয়েছেন। সেদিনের কথা স্মরণ করে শরিফুল বলেন, ‘আমি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে গান শুনছিলাম। হঠাৎ একটি বোমা বিস্ফোরণের মত শব্দ হলো। নিজেকে খুব সাহসী বলব না, তবে ভয়টা একটু কম। ... তো কোথা থেকে এলো সেই শব্দ, সেটি জানতে টিএসসি থেকে দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম বাংলা একাডেমির দিকে। আজও মনে আছে, রাস্তার মাঝে যে সড়ক বিভাজন ছিল, সেটি ধরে হাঁটছিলাম। এক জায়গায় কয়েকজন লোকের ভিড় দেখে গেলাম। আগেই বলেছি, রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে অছে রক্তাক্ত একজন মানুষ। কিন্তু কেউ ধরছে না।’

হাসান জানান, আগে সামনাসামনি না দেখলেও বইয়ের ফ্ল্যাপে কিংবা পত্রিকায় ছবি দেখে হুমায়ুন আজাদের চেহারা তার বেশ পরিচিতই ছিল। ‘কাছে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন একজন মানুষ। পুরো মুখম-ল রক্তাক্ত। আমি ধরে মুখটা ঘোরাতেই চিনতে পারি। এরপর চিৎকার করে বলি, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার হুমায়ুন আজাদ। এখনি হাসপাতালে নিতে হবে! কিন্তু কীভাবে নেব?’

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের তখনকার সংগঠক, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব আশরাফ সিদ্দিকী বিটুর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা জানান হাসান। হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নিতে পাশ দিয়ে যাওয়া একটি গাড়ির চালককে অনুরোধ করলেও রাজি হননি তিনি। তখন রক্তাক্ত লেখককে কাছাকাছি থাকা পুলিশ ট্রাকের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ট্রাকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় হুমায়ুন আজাদকে। ট্রাকে তোলার ওই সময়ে রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদের ছবি তোলেন একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক। হাসপাতালে নেয়ার সময় পুলিশের ট্রাকে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কথোপকথনের প্রসঙ্গ ধরে শরিফুল বলেন, স্যারকে জড়িয়ে ধরে আছি। এত কাছের ঢাকা মেডিকেল মনে হচ্ছে বহুদূর।

স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা আমাকে কই নিয়ে যাও?’ আমি বললাম, স্যার, হাসপাতালে। আপনার কিছু হয়নি। আপনি ভালো হয়ে যাবেন। স্যার বললেন, ‘আমার চশমা কই?’ আমি বললাম, স্যার, আছে। স্যার বললেন, ‘আমাকে তুমি পুলিশের গাড়িতে কেন নিয়েছ?’ আমি বললাম, স্যার, আমরা আপনার ছাত্র। ঠিক আছে স্যার আমরা এখনি নেমে যাব।’

ওই রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গুরুতর আহত হুমায়ুন আজাদকে স্থানান্তর করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। শরিফুল বলেন, ‘আমরা পরে জেনেছিলাম, স্যারকে কুপিয়ে ফেলে যাওয়ার ১০-১২ মিনিটের মাথায় আমরা হাসপাতালে নিতে পেরেছিলাম। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, আরেকটু দেরি হলে রক্তক্ষরণে স্যার মারা যেতে পারতেন! ভেবে খুব ভালো লাগছিল যে স্যারকে আমরা বাঁচাতে পেরেছিলাম। কিন্তু আসলে কী বাঁচাতে পেরেছিলাম? ছয় মাস পর তো স্যার মারা গেলেন জার্মানিতে!’

সানির ইশারা পেয়ে হামলা

আদালতে দেয়া আনোয়ারুলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টার আগে জেএমবি নেতা বাংলা ভাই দিনাজপুরে যান। সেখানে তিনি আনোয়ারুলকে নূর মোহাম্মদের মুঠোফোন নম্বর দেন। পরে ঢাকায় আনোয়ারুলের সঙ্গে মিজানুর, সানি ও নুরুল্লাহর দেখা হয়। সানি তখন আনোয়ারুল ও নুরুল্লাহকে বলেন, ‘তোমরা আজকে আমাদের সঙ্গে একটা কাজে যাবে। তোমাদের কাজ হবে নূর মোহাম্মদ ও মিজানুরকে অনুসরণ করা। তাদের কাজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোমা ফাটিয়ে নিরাপদে তাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে।’

আঘাত করেন মিজানুর ও নূর মোহাম্মদ

আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে মিজানুর বলেছেন, ‘আমরা জানতে পারি, বইমেলা থেকে প্রতিদিন রাত ৮টা বা সাড়ে ৮টার দিকে হুমায়ুন আজাদ হেঁটে বাসায় যান। এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সেদিন আমিসহ অন্যরা বাংলা একাডেমিতে যাই। রাত সোয়া ৯টায় হুমায়ুন আজাদ যখন বইমেলা শেষে বাসায় ফিরছিলেন, তখন আমরা তার পিছু নেই।’

জবানবন্দিতে মিজানুর বলেছেন, ‘হুমায়ুন আজাদকে আমি ও নূর মোহাম্মদ ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করি। তখন দূরে থাকা লোকজন ছুটে এলে আনোয়ারুল একটা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। তখন লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে পালাতে থাকে। আমরাও পালিয়ে যাই। রাত ১১টার দিকে মোবাইল ফোনে শায়খ আবদুর রহমানকে এ ঘটনা জানাই।’

সুস্থ হয়ে উঠলেও আঘাতজনিত কারণেই তার মৃত্যু

হামলার পর সিএমএইচ ও থাইল্যান্ডে কয়েক মাস চিকিৎসা নেয়ার পর ২০০৪ সালের আগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান হুমায়ুন আজাদ। ওই বছর ১২ আগস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুসনদের বরাতে অভিযোগপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসের আঘাতে জেরে লেখকের মৃত্যু হয়েছে। অ্যানাটমিক্যালি আকস্মিক মৃত্যুর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘আক্রান্ত হইয়া মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তিনি অসুস্থ ও আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া পড়েন। চিকিৎসার পরও আরোগ্য না হইয়া বরং তিনি ধীরে ধীরে আরও বেশি অসুস্থ হইয়া জার্মানি মিউনিখে নিজ বাসস্থানে যাওয়ার চারদিন পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়েন।’