মুক্তাঞ্চল সফরের জন্য বিদেশিদের প্রতি আহ্বান

একাত্তরের ১৪ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এক ভাষণে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফরের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, রাজনীতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানান। তিনি সব বন্ধুরাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের এবং রেডক্রসসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি সরাসরি বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান।

এদিকে সারাদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পাকহানাদার বাহিনী বিমান আক্রমণ চালায়। পাশাপাশি আশুগঞ্জেও পাকবাহিনী বিমান আঘাত হানে। এই আক্রমণে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বহু নিরীহ মানুষ ও বাঙালি সৈন্য শহীদ হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিগ্রেড কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তান বাহিনী উজানিসার ব্রিজের কাছে আসার পর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর একজন অফিসারসহ ১৭৩ জন সৈন্য নিহত হয়।

টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর মধ্যে সারাদিন প্রচ- যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সৈন্যরা প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটে কালিহাতি ও ঘাটাইল অঞ্চলে অবস্থান নেয়।

দিনাজপুরের খানসামা এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নীলফামারী থেকে আগত পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের হঠাৎ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে পিছু হটে।

এদিন ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ পাকসেনারা আক্রমণ করে এবং আগুনে পঞ্চগড় শহর জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে অমরখানায় অবস্থান নেয়।

এদিন সকাল ৯টায় পাকিস্তান বাহিনী কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ এসে জেলখানার উত্তরে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনারা জেল অফিসে কর্মরত হেড ক্লার্ক ও সিপাইসহ পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করে।

রাজশাহী শহরের লক্ষীপুর গার্লস স্কুলের সামনে পাকিস্তান সৈন্যরা মোশারফ হোসেন সন্টুসহ ৩০ জনকে সমবেত করে। এদের মধ্য থেকে মঈনউদ্দিন আহমদ মানিক, আশরাফ হোসেন রতন ও মাসুদ রানা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে পালায়। বাকি সবাইকে পাকিস্তানি হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মোশারফ হোসেন সন্টু লাশের নিচে চাপা পড়ে আহত অবস্থায় বেঁচে যান।

পাকিস্তান বাহিনী সান্তাহার আসার পর বিহারীরা মিলিত হয়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে হামলা করে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অগণিত মানুষকে হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সান্তাহার গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

পাকিস্তান বাহিনীর দুটি কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাদের রাজারহাট ও কুলারহাট অবস্থানের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা স্থান দুটি ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে।

এদিন রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এলাকাতে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি, বুড়িঘাট ও রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে একটি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, রাঙ্গামাটি ও বরফকলের মধ্যস্থলে লে. মাহফুজ একটি কোম্পানি নিয়ে এবং কুতুবছড়ি এলাকাতে সুবেদার মুতালেব একটি কোম্পানি নিয়ে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী প্রচ- যুদ্ধের পর কুমিল্লার কসবা পাকিস্তান সেনাদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে নেয়।

এদিন ঢাকায় মৌলভী ফরিদ আহমদের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চক্রান্ত আখ্যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার শপথ ঘোষণা করে হানাদার ও সহযোগীরা।

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

১৪ এপ্রিল ১৯৭১

মুক্তাঞ্চল সফরের জন্য বিদেশিদের প্রতি আহ্বান

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একাত্তরের ১৪ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এক ভাষণে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফরের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, রাজনীতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানান। তিনি সব বন্ধুরাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের এবং রেডক্রসসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি সরাসরি বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান।

এদিকে সারাদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পাকহানাদার বাহিনী বিমান আক্রমণ চালায়। পাশাপাশি আশুগঞ্জেও পাকবাহিনী বিমান আঘাত হানে। এই আক্রমণে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বহু নিরীহ মানুষ ও বাঙালি সৈন্য শহীদ হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিগ্রেড কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তান বাহিনী উজানিসার ব্রিজের কাছে আসার পর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর একজন অফিসারসহ ১৭৩ জন সৈন্য নিহত হয়।

টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর মধ্যে সারাদিন প্রচ- যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সৈন্যরা প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটে কালিহাতি ও ঘাটাইল অঞ্চলে অবস্থান নেয়।

দিনাজপুরের খানসামা এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নীলফামারী থেকে আগত পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের হঠাৎ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে পিছু হটে।

এদিন ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ পাকসেনারা আক্রমণ করে এবং আগুনে পঞ্চগড় শহর জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে অমরখানায় অবস্থান নেয়।

এদিন সকাল ৯টায় পাকিস্তান বাহিনী কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ এসে জেলখানার উত্তরে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনারা জেল অফিসে কর্মরত হেড ক্লার্ক ও সিপাইসহ পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করে।

রাজশাহী শহরের লক্ষীপুর গার্লস স্কুলের সামনে পাকিস্তান সৈন্যরা মোশারফ হোসেন সন্টুসহ ৩০ জনকে সমবেত করে। এদের মধ্য থেকে মঈনউদ্দিন আহমদ মানিক, আশরাফ হোসেন রতন ও মাসুদ রানা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে পালায়। বাকি সবাইকে পাকিস্তানি হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মোশারফ হোসেন সন্টু লাশের নিচে চাপা পড়ে আহত অবস্থায় বেঁচে যান।

পাকিস্তান বাহিনী সান্তাহার আসার পর বিহারীরা মিলিত হয়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে হামলা করে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অগণিত মানুষকে হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সান্তাহার গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

পাকিস্তান বাহিনীর দুটি কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাদের রাজারহাট ও কুলারহাট অবস্থানের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা স্থান দুটি ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে।

এদিন রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এলাকাতে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি, বুড়িঘাট ও রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে একটি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, রাঙ্গামাটি ও বরফকলের মধ্যস্থলে লে. মাহফুজ একটি কোম্পানি নিয়ে এবং কুতুবছড়ি এলাকাতে সুবেদার মুতালেব একটি কোম্পানি নিয়ে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী প্রচ- যুদ্ধের পর কুমিল্লার কসবা পাকিস্তান সেনাদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে নেয়।

এদিন ঢাকায় মৌলভী ফরিদ আহমদের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চক্রান্ত আখ্যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার শপথ ঘোষণা করে হানাদার ও সহযোগীরা।