সাড়ে ৩শ’ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৪৮টি নিবন্ধিত

দেশে নিবন্ধনের চেয়ে অনিবন্ধিত মেইলিং ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানই বেশি। সারাদেশে নিবন্ধনহীন এই ধরনের সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ’। অথচ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান মাত্র ৭৮টি। আবার অনেক নিবদ্ধিত প্রতিষ্ঠানও নিয়মিত লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে নিযুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নবায়ন না হওয়ায় পণ্য পেতে গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়ছেন বলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো নানা অপরাধে জড়াচ্ছে, মাদক আনা-নেয়ার কাজেও লিপ্ত হচ্ছে। এজন্য সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

দেশে কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা করতে হলে ‘মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ’ থেকে লাইসেন্স বা নিবন্ধন নিতে হয়। এই কর্তৃপক্ষের কার্যালয় ‘ডাক অধিদপ্তরে’। এই কর্তৃপক্ষের অধীনে এখন পর্যন্ত লাইসেন্স নিয়েছে ৭৮টি প্রতিষ্ঠান।

জানতে চাইলে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (যুগ্মসচিব) ড. মো. মহিউদ্দিন সংবাদকে জানান, তারা সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে দায়িত্ব পেয়েছি বেশিদিন হয়নি। এর মধ্যে যারা লাইসেন্স ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করছে তাদের চিঠি দেয়া শুরু করেছি। আমার কাছে এরকম ১৩৯টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা রয়েছে।’

ঈদের পর লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে ‘নামবেন’ জানিয়ে ড. মহিউদ্দিন বলেন, ‘যারা নিবন্ধন ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করছে তাদের সবাইকে শনাক্ত করা হবে। আরও কঠোর হবো। সরকারি নিয়মকানুন না মেনে কাউকে এ ব্যবসা করতে দেয়া হবে না।’

ওই কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, সারাদেশে তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস কার্যক্রম চালাচ্ছে। বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এজন্য এবার কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আইনের আওতায় নতুন বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। এর আলোকে অবৈধভাবে পরিচালিত মেইলিং ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে ওই

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর অনুমোদনহীন মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সেবা ব্যবহার না করার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়। এর ফলে নথিপত্র বিতরণ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুরিয়ার সেবা প্রতিষ্ঠানের বৈধতা যাচাই করে সেবা নেয়ার কথা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা অনুযায়ী লাইসেন্সবিহীন মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সেবার মাধ্যমে ডাক দ্রব্য গ্রহণ, পরিবহন ও বিলি বিতরণ বেআইনি ও সম্পূর্ণভাবে বিধিবহির্ভূত। এজন্য লাইসেন্সবিহীন মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডাক দ্রব্যাদি আদান-প্রদানে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়।

কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের’ তথ্য অনুযায়ী, এই সমিতির সদস্য প্রতিষ্ঠান ১৫২টি। এর মধ্যে ৭৮টি প্রতিষ্ঠান সরকার অনুমোদিত অর্থাৎ নিবন্ধিত। বাকি ৭৪টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারকে ‘ট্যাক্স-ভ্যাট’ দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে সংগঠনের নেতাদের দাবি।

জানতে চাইলে ‘কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের’ সভাপতি হাফিজুর রহমান পুলক সংবাদকে জানান, সংগঠনের সদস্য ১৫২টি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও প্রায় সাড়ে তিনশ’ প্রতিষ্ঠান কুরিয়ার সার্ভিস ও ই-কমার্স ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে। এই তালিকা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরেই রয়েছে। সরকার চাইলেই অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

অনুমোদনহীন সাড়ে তিনশ’ প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারি প্রশাসনের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই মন্তব্য করে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের এই কর্ণধার বলেন, ‘এটি দেখার দায়িত্ব সমিতির নয়। সরকারি কর্তৃপক্ষের। যথাযথ মনিটরিং না থাকায় লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেমন জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না, তেমনি এগুলো থেকে সরকার কোন ট্যক্স-ভ্যাটও পাচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠান কোন নিষিদ্ধ পণ্য বা মাদক আনা-নেয়া করলেও তাদের আইনের আওতায় নিতে পারছে না প্রশাসন।’ প্রায়ই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন।

সার্ভিস লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করা ঠিক হচ্ছে কী-না জানতে চাইলে হাফিজুর রহমান পুলক বলেন, ‘আমরা কী করব? এ বিষয় দেখার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ আছে। যারা লাইসেন্স ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। তাছাড়া এই সেক্টরের উন্নয়ন ও বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সালে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সমন্বয়নে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু ৯ বছরে কমিটির সভা হয়েছে মাত্র একটি।’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে তিন ধরনের কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান মোট ১৯৭টি লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে ৮১টি হলো অভ্যন্তরীণ মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ৮৬টি এবং অন-বোর্ড মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ৩০টি। ওই বছর লাইসেন্স নবায়ন করেছিল মাত্র ৫৬টি প্রতিষ্ঠান।

সরকার ২০১৩ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীনে ‘মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে। এই কর্তৃপক্ষের বিধিমালার ১১(১) ধারায় বলা রয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানের মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার ব্যবসা পরিচালনা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং আইনত দ-নীয় অপরাধ।

কয়েকজন কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের ‘জটিল’ শর্তের কারণে অনেকেই তা করতে চাচ্ছেন না। কারণ দেশে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা প্রসারিত হওয়ায় সরকারের ‘ডাক বিভাগের’ প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ নিয়মিত কমছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ‘ক্ষতিপূরণ ফি’ বাবদ টাকা আদায় করছে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, যা অন্য কোন ব্যবসায় ‘নজিরবিহীন’।

এ বিষয়ে সিএসএবি সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘পার্সেল বেইজড ও ই-কমার্স কুরিয়ার সার্ভিস চলছে অবৈধভাবে। আর ডকুমেন্টস বেইজড কুরিয়ার সার্ভিসের প্রায় ৮০ শতাংশই বন্ধের উপক্রম। কারণ প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ার বাজারেই অনলাইনে লেনদেন বেড়েছে। এই অবস্থায় কারো পক্ষেই প্রতি ডকুমেন্ট বা পার্সেল থেকে ২০ পয়সা করে ডাক বিভাগকে ক্ষতিপূরণ ফি দেয়া সম্ভব নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসান খাচ্ছে, এর দায় ব্যবসায়ীরা নেবে কেন?’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, দেশে ‘ডকুমেন্ট বেইজড’ কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায় শীর্ষে রয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উএসবি এক্সপ্রেস কুরিয়ার সার্ভিস, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, এসএ পরিবহন, ফেডেক্স কুরিয়ার সার্ভিস, ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিস এবং করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস অন্যতম।

এছাড়া দেশে অসংখ্য ই-কমার্স প্লাটফর্ম কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে। তারা অনলাইনে মাধ্যমে অসংখ্য পণ্যের বিজ্ঞাপন করে। মানুষ যখন আকৃষ্ট হয়ে সেই পণ্যটি ক্রয় করতে যায়। তখন তারা ই-কমার্স এর মাধ্যমে গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে দেয়। সাফল্যের পাশাপাশি বদনামও কামিয়েছে ই-কমার্স প্লাটফর্ম।

বাংলাদেশে ই-কমার্স ইভ্যালি, দারাজ, পিকাবু ও অন্যান্য ই-কমার্সগুলো উন্নতি করছে। তবে অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার দায়ে ই-ভ্যালি ও দারাজের বিরুদ্ধে একাদিক মামলা চলমান রয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

সাড়ে ৩শ’ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৪৮টি নিবন্ধিত

রাকিব উদ্দিন

দেশে নিবন্ধনের চেয়ে অনিবন্ধিত মেইলিং ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানই বেশি। সারাদেশে নিবন্ধনহীন এই ধরনের সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ’। অথচ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান মাত্র ৭৮টি। আবার অনেক নিবদ্ধিত প্রতিষ্ঠানও নিয়মিত লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে নিযুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নবায়ন না হওয়ায় পণ্য পেতে গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়ছেন বলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো নানা অপরাধে জড়াচ্ছে, মাদক আনা-নেয়ার কাজেও লিপ্ত হচ্ছে। এজন্য সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

দেশে কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা করতে হলে ‘মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ’ থেকে লাইসেন্স বা নিবন্ধন নিতে হয়। এই কর্তৃপক্ষের কার্যালয় ‘ডাক অধিদপ্তরে’। এই কর্তৃপক্ষের অধীনে এখন পর্যন্ত লাইসেন্স নিয়েছে ৭৮টি প্রতিষ্ঠান।

জানতে চাইলে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (যুগ্মসচিব) ড. মো. মহিউদ্দিন সংবাদকে জানান, তারা সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে দায়িত্ব পেয়েছি বেশিদিন হয়নি। এর মধ্যে যারা লাইসেন্স ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করছে তাদের চিঠি দেয়া শুরু করেছি। আমার কাছে এরকম ১৩৯টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা রয়েছে।’

ঈদের পর লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে ‘নামবেন’ জানিয়ে ড. মহিউদ্দিন বলেন, ‘যারা নিবন্ধন ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করছে তাদের সবাইকে শনাক্ত করা হবে। আরও কঠোর হবো। সরকারি নিয়মকানুন না মেনে কাউকে এ ব্যবসা করতে দেয়া হবে না।’

ওই কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, সারাদেশে তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস কার্যক্রম চালাচ্ছে। বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এজন্য এবার কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আইনের আওতায় নতুন বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। এর আলোকে অবৈধভাবে পরিচালিত মেইলিং ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে ওই

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর অনুমোদনহীন মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সেবা ব্যবহার না করার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়। এর ফলে নথিপত্র বিতরণ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুরিয়ার সেবা প্রতিষ্ঠানের বৈধতা যাচাই করে সেবা নেয়ার কথা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা অনুযায়ী লাইসেন্সবিহীন মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সেবার মাধ্যমে ডাক দ্রব্য গ্রহণ, পরিবহন ও বিলি বিতরণ বেআইনি ও সম্পূর্ণভাবে বিধিবহির্ভূত। এজন্য লাইসেন্সবিহীন মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডাক দ্রব্যাদি আদান-প্রদানে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়।

কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের’ তথ্য অনুযায়ী, এই সমিতির সদস্য প্রতিষ্ঠান ১৫২টি। এর মধ্যে ৭৮টি প্রতিষ্ঠান সরকার অনুমোদিত অর্থাৎ নিবন্ধিত। বাকি ৭৪টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারকে ‘ট্যাক্স-ভ্যাট’ দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে সংগঠনের নেতাদের দাবি।

জানতে চাইলে ‘কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের’ সভাপতি হাফিজুর রহমান পুলক সংবাদকে জানান, সংগঠনের সদস্য ১৫২টি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও প্রায় সাড়ে তিনশ’ প্রতিষ্ঠান কুরিয়ার সার্ভিস ও ই-কমার্স ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে। এই তালিকা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরেই রয়েছে। সরকার চাইলেই অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

অনুমোদনহীন সাড়ে তিনশ’ প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারি প্রশাসনের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই মন্তব্য করে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের এই কর্ণধার বলেন, ‘এটি দেখার দায়িত্ব সমিতির নয়। সরকারি কর্তৃপক্ষের। যথাযথ মনিটরিং না থাকায় লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেমন জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না, তেমনি এগুলো থেকে সরকার কোন ট্যক্স-ভ্যাটও পাচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠান কোন নিষিদ্ধ পণ্য বা মাদক আনা-নেয়া করলেও তাদের আইনের আওতায় নিতে পারছে না প্রশাসন।’ প্রায়ই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন।

সার্ভিস লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করা ঠিক হচ্ছে কী-না জানতে চাইলে হাফিজুর রহমান পুলক বলেন, ‘আমরা কী করব? এ বিষয় দেখার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ আছে। যারা লাইসেন্স ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। তাছাড়া এই সেক্টরের উন্নয়ন ও বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সালে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সমন্বয়নে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু ৯ বছরে কমিটির সভা হয়েছে মাত্র একটি।’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে তিন ধরনের কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান মোট ১৯৭টি লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে ৮১টি হলো অভ্যন্তরীণ মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ৮৬টি এবং অন-বোর্ড মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ৩০টি। ওই বছর লাইসেন্স নবায়ন করেছিল মাত্র ৫৬টি প্রতিষ্ঠান।

সরকার ২০১৩ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীনে ‘মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে। এই কর্তৃপক্ষের বিধিমালার ১১(১) ধারায় বলা রয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানের মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার ব্যবসা পরিচালনা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং আইনত দ-নীয় অপরাধ।

কয়েকজন কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের ‘জটিল’ শর্তের কারণে অনেকেই তা করতে চাচ্ছেন না। কারণ দেশে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা প্রসারিত হওয়ায় সরকারের ‘ডাক বিভাগের’ প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ নিয়মিত কমছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ‘ক্ষতিপূরণ ফি’ বাবদ টাকা আদায় করছে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, যা অন্য কোন ব্যবসায় ‘নজিরবিহীন’।

এ বিষয়ে সিএসএবি সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘পার্সেল বেইজড ও ই-কমার্স কুরিয়ার সার্ভিস চলছে অবৈধভাবে। আর ডকুমেন্টস বেইজড কুরিয়ার সার্ভিসের প্রায় ৮০ শতাংশই বন্ধের উপক্রম। কারণ প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ার বাজারেই অনলাইনে লেনদেন বেড়েছে। এই অবস্থায় কারো পক্ষেই প্রতি ডকুমেন্ট বা পার্সেল থেকে ২০ পয়সা করে ডাক বিভাগকে ক্ষতিপূরণ ফি দেয়া সম্ভব নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসান খাচ্ছে, এর দায় ব্যবসায়ীরা নেবে কেন?’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, দেশে ‘ডকুমেন্ট বেইজড’ কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায় শীর্ষে রয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উএসবি এক্সপ্রেস কুরিয়ার সার্ভিস, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, এসএ পরিবহন, ফেডেক্স কুরিয়ার সার্ভিস, ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিস এবং করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস অন্যতম।

এছাড়া দেশে অসংখ্য ই-কমার্স প্লাটফর্ম কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে। তারা অনলাইনে মাধ্যমে অসংখ্য পণ্যের বিজ্ঞাপন করে। মানুষ যখন আকৃষ্ট হয়ে সেই পণ্যটি ক্রয় করতে যায়। তখন তারা ই-কমার্স এর মাধ্যমে গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে দেয়। সাফল্যের পাশাপাশি বদনামও কামিয়েছে ই-কমার্স প্লাটফর্ম।

বাংলাদেশে ই-কমার্স ইভ্যালি, দারাজ, পিকাবু ও অন্যান্য ই-কমার্সগুলো উন্নতি করছে। তবে অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার দায়ে ই-ভ্যালি ও দারাজের বিরুদ্ধে একাদিক মামলা চলমান রয়েছে।