অমিত রায় চৌধুরী
ছেলেবেলার কথা কেউ হয়তো সহজে ভোলে না। এমন দিনে তো নয়ই। নতুন বছর আসছে নতুন আশ্বাসে। এমনই একটা নিষ্পাপ আনন্দে মন ভরে উঠত। দিনের প্রথম আলো যখন ঝরা পাতার ওপর ঠিকরে পড়েছে, প্রার্থনা করেছিÑবছরটা ভালো কাটুক। মনের কোণে লুকিয়ে রাখা দুঃখগুলো সরে যাক। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শূচি হোক ধরা’। বিজ্ঞান নয়, মনে গেঁথে থাকা বিশ্বাসটাই বলে দিত-সকালটা ভালো কাটলে সারা বছরটাই ভালো যাবে। পরিপার্শ্বটাই যেন নববর্ষের সাজে সেজে উঠত। পাড়ায়-পাড়ায় নাটক, গান, কবিতা-আবৃত্তির কত বাহারি অয়োজন! পোশাক কেনার ততটা উচ্ছ্বাস চোখে পড়েনি। হয়তো সামর্থ্যওে কিছুটা খামতি ছিল। কিন্তু পরিবেশটাই মন কেমন করা আনন্দে নেচে উঠত। মেলা, জলসা, দোকানপাট-সবখানেই মানুষের ভিড়। বড়দের হাত ধরে হালখাতায় যাওয়ার দ্বিধাহীন উৎসাহ। একান্তেই স্মৃতিমেদুর সেসব দৃশ্যপট নির্মাণ করি। বর্তমানকে কিছুতেই সেসব দিনগুলোর সঙ্গে মেলাতে পারি না। লক্ষণীয় ছিল উৎসবের অসাম্প্র্রদায়িক চরিত্র। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, উপজাতিÑসবাই একাকার। এ যেন জীবনেরই উদ্যাপন।
বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকের মতে গৌরবঙ্গের রাজা শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। তবে গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক মত-মোগল সম্র্রাট আকবরই বাংলা সন জনপ্রিয় করেন। উদ্দেশ্য ছিল কৃষিপণ্যের খাজনা আদায়ে জটিলতা নিরসন। তবে ২০০ বছর আগেও উৎসবের আকার এমন ব্যাপক ছিল না। ব্যবসায়ীদের নতুন হিসাব খোলার দিন পহেলা বৈশাখ। জমিদার-মালিকরাও প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। আস্তে আস্তে এ সংস্কৃতি সমাজের গভীরে পৌঁছে গেল। আদান প্রদানের নতুন চর্চা সমাজে ঠাঁই করে নিল। রাজস্ব আদায়ের দিনই হয়ে উঠল জীবনকে নতুন করে উদ্যাপন করার দিন। তবে ইংরেজদের হাত ধরেই হয়তো উৎসবে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। উনিশ শতকে এসেছে নতুন সভ্যতা, নতুন সংস্কৃতি। তার চেহারা আলাদা, চরিত্র ভিন্ন। এরপর পরিবর্তনের পালা। জামা-কাপড়, চলন-বলন-সবখানেই রূপান্তর।
দেশভাগের পর ভাষাযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙালি তার আদর্শিক দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত মীমাংসা করে ফেলে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার ভরকেন্দ্রে এসে যায়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে স্বাধীনতার পথে চালিত করেন। যে জাতি তার শেকড়ে বাঁধা থাকে, তাকে উৎপাটন করা সহজ নয়। পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রও বাঙালির অন্তর্গত শক্তিকে শনাক্ত করতে দেরি করেনি। রবীন্দ্রজয়ন্তী, ভাষা দিবস বা নববর্ষ উদ্্যাপন তাদের পছন্দ হয়নি। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায়। তাতে লাভ হয়নি শাসকের। এরই প্রতিক্রিয়ায় বরং সাংস্কৃতিক আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ৬০-র দশকে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠা স্বাধিকার আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। স্বাধীনতার পর মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসত্তার ঐতিহ্য প্রতীকে পরিণত হয়। লাখ নরনারীর প্রাণিত অংশগ্রহণে বর্ণময় হয়ে ওঠা বাঙালির এই পরম্পরা বিশ্বসভায় নজর কাড়ে। ২০১৬ সালে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে বাঙালির এ ঐতিহ্যকে ইউনিসেফ স্বীকৃতি দেয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দেশ আদর্শিক গন্তব্য হারিয়ে ফেলে। অর্থনীতি ও সংস্কৃতির চরিত্র বদলে ফেলা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি-মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্গত দর্শনের সঙ্গে আপস অব্যাহত থাকে। বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত মেরামত না করে বরং বাঙালি সংস্কৃতির অনুশীলনকেই কোণঠাসা করা হয়। পাঠ্যপুস্তকের কনটেন্ট বদল, উগ্র মৌলবাদী চক্রের সংগঠিত প্রপাগান্ডা এমনকি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মূল্যবোধের পরিপন্থী ক্রিয়াকলাপ অবলীলায় প্রশ্রয় পায়। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে পার্থিব সম্পদ দখলের বেলাগাম লালসা, যা বাঙালি মননের গড়নটাকেই বদলে ফেলছে। প্রশ্ন উঠবে নীতির রাজ্যে এ দুর্ভিক্ষ কি শুধু এ বাংলায়? এ কথা বলার সুযোগ নেই। ওপার বাংলাও এ প্রতিযোগিতায় পেছনে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। যে জাতি একদা বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বে জগতজোড়া খ্যাতি কুড়িয়েছিল, যে শুদ্ধাচার, উচ্চ নৈতিকমান কিংবা মানবিক উৎকর্ষ বাঙালিকে বিশ্বসভায় আলাদা করেছিল-সে জাতির এই বিচ্যুতি কি আর্থিক সমৃদ্ধির মূল্য নাÑকি সময়ের অনিবার্য অভিঘাত-সে প্রশ্ন সমাজবিজ্ঞানের উপজীব্য হয়েই থাকবে।
স্মৃতির বারান্দায় প্রাইমারি স্কুলের বেশকিছু ছবি আজ ভেসে উঠছে। পাকিস্তান আমলের শেষ প্রান্ত। হাইস্কুলের বড় মেয়েরা আগাগোড়াই শাড়ি পড়েছে। বর্ষবরণের এ দিনে সাদা শাড়ি লাল পাড়। কপালে লাল টিপ, খোঁপায় ফুল। সমাজে সমীহ আদায় করেই তারা হেঁটেছে রাজপথে। শুদ্ধতায়, গরিমায় মাথা উঁচু করে। এমন চিত্রপটের ব্যতিক্রম দেখিনি ৮০-র দশকেও। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। ধর্মীয় সভা হয়েছে। দেখেছি পাড়ার অমুসলিম সিনিয়ার সিটিজেনরাও তাতে যোগ দিয়েছেন। গভীর আগ্রহ আর মনোযোগ নিয়ে। সে সব সভায় ঘৃণা বা বিদ্বেষের লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু আজ দৈনন্দিন চর্চা, পোশাক, সজ্জা, উপাসনা এমনকি বিদ্যালয়-সর্বত্রই বিভাজনের লক্ষণ রেখা কৌশলে টেনে দেয়া হচ্ছে। সমাজমনে সাম্প্রদায়িক বিষ সংক্রমণের লক্ষণ স্পষ্ট। যে সমাজ রবীন্দ্রবিরোধী পশ্চিমা ষঢ়যন্ত্র প্রবল বিক্রমে রুখে দিয়েছিল, সে সমাজই আজ মন্দির ভাঙচুরের নীরব সাক্ষী। ঘরে ঘরে চলে প্রতিকারহীন সাম্প্রদায়িক প্রপাগান্ডা। ফাঁদে ফেলে সংখ্যালঘু নির্যাতন-প্রকাশ্যে, বিনা বাধায়। নিগ্রহের নতুন প্যাটার্ন ধর্ম অবমাননা। সারাদেশজুড়ে পাতা এই চালাকির জাল। শিক্ষক, কর্মজীবী, কৃষক-গ্রাম থেকে শহর-সর্বত্রই সংখ্যালঘু তটস্থ। লক্ষ্য জমি দখল নতুবা স্রেফ দেশান্তর। ধর্মের মাঙ্গলিক বার্তা যদি জনমানসকে স্পর্শ করে, তবে তা তো সমাজের জন্য কল্যাণকর। সেই সুস্থ সমাজই গড়ে তোলে সামাজিক পুঁজি। আর সে প্রক্রিয়ার সাক্ষী আমাদের শৈশব-কৈশোর। কিন্তু মতলববাজদের এজেন্ডাই আজ আলাদা। অনৈতিকতা, অপরাধ, দুর্নীতি-কল্পনার সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। অথচ সেই অপরাধ জগতে ধাতস্থ মনই ধর্মকে ব্যবহার করে বর্ম হিসেবে। সমাজে অন্যায়-অপরাধ প্রত্যাখ্যাত হয় না, অথচ ঘৃণার বিস্তার ঘটে অবলীলায়।
সব সামাজিক উদ্যাপনের মূল সুর এক। বহুত্ব, বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি। সাম্প্রতিক সময়ে সমাজমনে অসুখের যে সব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে তা হলো ঘৃণা-বিভক্তি। মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করার পরিকল্পিত ছক। তুমি-আমি কিংবা আমরা-তারা বয়ানে বিভাজন আরোপ করা হচ্ছে। বিচ্ছিন্নতার এই দেওয়াল ক্রমেই চওড়া হচ্ছে মনোজগতে; যা আবহমান সমাজবুননে ফাটল ধরাচ্ছে। প্রাত্যহিক আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষালয়, অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারিÑসবখানেই এর ছাপ প্রকট। সামাজিক এ ক্ষতের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সঠিক রাজনীতির অনুপস্থিতি ও দুর্বলতা। মানুষ ক্রমেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, না হয় নিজের সুবিধা হাসিলের জন্য নিষ্ক্রিয় থাকছে নতুবা সব ধরনের সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতাকে অনুমোদন করছে। শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলা করায় বিপুল জনগোষ্ঠীকে মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর এই শূন্যস্থান পূরণ করছে স্বস্তা মূল্যবোধহীন, উগ্র অসহনশীল আদর্শ। মজার বিষয় হলো-দুর্নীতি-প্রতারণা করলেও কেউ সামাজিক প্রতিরোধ বা গঞ্জনার মুখে পড়ে না। পক্ষান্তরে নারীর পোশাক বা সাজসজ্জা নিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কিংবা সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বিঘিœত হলে কার্যত দুর্বৃত্তই প্রশ্রয় পেয়ে যায়।
একজন কলেজ শিক্ষিকা কপালে টিপ পরার কারণে পুলিশ কর্মীর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন রাজধানীর জনাকীর্ণ রাজপথে। সমাজ-সংস্কৃতি, নৈতিকতা এমনকি দেশের প্রচলিত আইন-কোথাও ব্যক্তির সাজসজ্জায় বাধা নেই। দ্বিতীয়ত কপালে টিপ পরার রেওয়াজ আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিরই অঙ্গ। তৃতীয়ত মিথ্যার আড়ালে ঘটনাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছে অভিযুক্ত। চতুর্থত কেউ এই হামলাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেনি। একজন নারী আক্রান্ত হওয়ার পরও তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে মুখর হয়নি প্রত্যক্ষদর্শীরা। এটা কি সামাজিক নিষ্ক্রিয়তা না পরোক্ষ অনুমোদন-বলা মুশকিল। আর এ কথাও ঠিক-নববর্ষের প্রাসঙ্গিকতা সমকালীন বাঙালি মননে কতটা জায়গা পেয়েছে-তাও হয়তো ভেবে দেখার এখনই সময়।
বাংলা নববর্ষের আবেদন শুধু দেশের মানচিত্রে আবদ্ধ নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালি বাস করে-সবখানেই তার নৈতিক বিস্তার। কিন্তু কেন যেন মনে হয়-বাঙালির নৈতিক জীবনে আজ ধস নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গের চিত্রও খুব সুস্থ নয়। অবিভক্ত ভারতে কমপক্ষে ১০ জন প্রথিতযশা বাঙালি জাতীয় কংগ্রেসের সর্ব ভারতীয় সভাপতি হয়েছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি-সর্বত্রই শাসন করেছেন জগত বিখ্যাত বাঙালিরা। বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজী, চিত্তরঞ্জন, সুবাস বোস, প্রফুল্ল রায়, সত্যেন বোস, জগদীশ বোস-নাম বলতে গেলে সে তালিকা কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আজ সেখানেও বিপন্নতার সংকেত। নীতির রাজ্যে খরা। মেধার ঝলক নেই। আলোর আভা ক্রমশ ক্ষীয়মান।
তবুও আমরা আলোর সন্ধানী। সৃষ্টির মাঝে যে মানুষ থাকে না, তার শরীর আছে, প্রাণ নেই। সংস্কৃতির প্রবহমানতায় ভেসে যিনি শাসন করেন চারপাশ, তিনিই দিনশেষে হয়ে ওঠেন বাঙালি। সারা বছরজুড়েই চলে বাঙালির উৎসব। এ দিনগুলিই আমাদের শক্তি জোগায়। নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়। জীবনের সব আক্ষেপ, সব অপূর্ণতার বোধকে পাশে ফেলে বৈশাখ দেখায় কঠিন সত্যের পথ, কাউকে শেখায় হার না মানার শপথ, আবার কাউকে দেয় বৈরিতার মুখে অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মন্ত্র। মনের আকাশটায় আজ জমাট বেঁধেছে অনিশ্চয়তা। আশঙ্কার সব মেঘ ভাসিয়ে নিয়ে যাক দূরন্ত এক বৈশাখী ঝড়Ñএমন প্রত্যাশাই থাকবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]
বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩
অমিত রায় চৌধুরী
ছেলেবেলার কথা কেউ হয়তো সহজে ভোলে না। এমন দিনে তো নয়ই। নতুন বছর আসছে নতুন আশ্বাসে। এমনই একটা নিষ্পাপ আনন্দে মন ভরে উঠত। দিনের প্রথম আলো যখন ঝরা পাতার ওপর ঠিকরে পড়েছে, প্রার্থনা করেছিÑবছরটা ভালো কাটুক। মনের কোণে লুকিয়ে রাখা দুঃখগুলো সরে যাক। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শূচি হোক ধরা’। বিজ্ঞান নয়, মনে গেঁথে থাকা বিশ্বাসটাই বলে দিত-সকালটা ভালো কাটলে সারা বছরটাই ভালো যাবে। পরিপার্শ্বটাই যেন নববর্ষের সাজে সেজে উঠত। পাড়ায়-পাড়ায় নাটক, গান, কবিতা-আবৃত্তির কত বাহারি অয়োজন! পোশাক কেনার ততটা উচ্ছ্বাস চোখে পড়েনি। হয়তো সামর্থ্যওে কিছুটা খামতি ছিল। কিন্তু পরিবেশটাই মন কেমন করা আনন্দে নেচে উঠত। মেলা, জলসা, দোকানপাট-সবখানেই মানুষের ভিড়। বড়দের হাত ধরে হালখাতায় যাওয়ার দ্বিধাহীন উৎসাহ। একান্তেই স্মৃতিমেদুর সেসব দৃশ্যপট নির্মাণ করি। বর্তমানকে কিছুতেই সেসব দিনগুলোর সঙ্গে মেলাতে পারি না। লক্ষণীয় ছিল উৎসবের অসাম্প্র্রদায়িক চরিত্র। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, উপজাতিÑসবাই একাকার। এ যেন জীবনেরই উদ্যাপন।
বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকের মতে গৌরবঙ্গের রাজা শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। তবে গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক মত-মোগল সম্র্রাট আকবরই বাংলা সন জনপ্রিয় করেন। উদ্দেশ্য ছিল কৃষিপণ্যের খাজনা আদায়ে জটিলতা নিরসন। তবে ২০০ বছর আগেও উৎসবের আকার এমন ব্যাপক ছিল না। ব্যবসায়ীদের নতুন হিসাব খোলার দিন পহেলা বৈশাখ। জমিদার-মালিকরাও প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। আস্তে আস্তে এ সংস্কৃতি সমাজের গভীরে পৌঁছে গেল। আদান প্রদানের নতুন চর্চা সমাজে ঠাঁই করে নিল। রাজস্ব আদায়ের দিনই হয়ে উঠল জীবনকে নতুন করে উদ্যাপন করার দিন। তবে ইংরেজদের হাত ধরেই হয়তো উৎসবে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। উনিশ শতকে এসেছে নতুন সভ্যতা, নতুন সংস্কৃতি। তার চেহারা আলাদা, চরিত্র ভিন্ন। এরপর পরিবর্তনের পালা। জামা-কাপড়, চলন-বলন-সবখানেই রূপান্তর।
দেশভাগের পর ভাষাযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙালি তার আদর্শিক দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত মীমাংসা করে ফেলে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার ভরকেন্দ্রে এসে যায়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে স্বাধীনতার পথে চালিত করেন। যে জাতি তার শেকড়ে বাঁধা থাকে, তাকে উৎপাটন করা সহজ নয়। পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রও বাঙালির অন্তর্গত শক্তিকে শনাক্ত করতে দেরি করেনি। রবীন্দ্রজয়ন্তী, ভাষা দিবস বা নববর্ষ উদ্্যাপন তাদের পছন্দ হয়নি। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায়। তাতে লাভ হয়নি শাসকের। এরই প্রতিক্রিয়ায় বরং সাংস্কৃতিক আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ৬০-র দশকে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠা স্বাধিকার আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। স্বাধীনতার পর মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসত্তার ঐতিহ্য প্রতীকে পরিণত হয়। লাখ নরনারীর প্রাণিত অংশগ্রহণে বর্ণময় হয়ে ওঠা বাঙালির এই পরম্পরা বিশ্বসভায় নজর কাড়ে। ২০১৬ সালে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে বাঙালির এ ঐতিহ্যকে ইউনিসেফ স্বীকৃতি দেয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দেশ আদর্শিক গন্তব্য হারিয়ে ফেলে। অর্থনীতি ও সংস্কৃতির চরিত্র বদলে ফেলা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি-মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্গত দর্শনের সঙ্গে আপস অব্যাহত থাকে। বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত মেরামত না করে বরং বাঙালি সংস্কৃতির অনুশীলনকেই কোণঠাসা করা হয়। পাঠ্যপুস্তকের কনটেন্ট বদল, উগ্র মৌলবাদী চক্রের সংগঠিত প্রপাগান্ডা এমনকি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মূল্যবোধের পরিপন্থী ক্রিয়াকলাপ অবলীলায় প্রশ্রয় পায়। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে পার্থিব সম্পদ দখলের বেলাগাম লালসা, যা বাঙালি মননের গড়নটাকেই বদলে ফেলছে। প্রশ্ন উঠবে নীতির রাজ্যে এ দুর্ভিক্ষ কি শুধু এ বাংলায়? এ কথা বলার সুযোগ নেই। ওপার বাংলাও এ প্রতিযোগিতায় পেছনে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। যে জাতি একদা বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বে জগতজোড়া খ্যাতি কুড়িয়েছিল, যে শুদ্ধাচার, উচ্চ নৈতিকমান কিংবা মানবিক উৎকর্ষ বাঙালিকে বিশ্বসভায় আলাদা করেছিল-সে জাতির এই বিচ্যুতি কি আর্থিক সমৃদ্ধির মূল্য নাÑকি সময়ের অনিবার্য অভিঘাত-সে প্রশ্ন সমাজবিজ্ঞানের উপজীব্য হয়েই থাকবে।
স্মৃতির বারান্দায় প্রাইমারি স্কুলের বেশকিছু ছবি আজ ভেসে উঠছে। পাকিস্তান আমলের শেষ প্রান্ত। হাইস্কুলের বড় মেয়েরা আগাগোড়াই শাড়ি পড়েছে। বর্ষবরণের এ দিনে সাদা শাড়ি লাল পাড়। কপালে লাল টিপ, খোঁপায় ফুল। সমাজে সমীহ আদায় করেই তারা হেঁটেছে রাজপথে। শুদ্ধতায়, গরিমায় মাথা উঁচু করে। এমন চিত্রপটের ব্যতিক্রম দেখিনি ৮০-র দশকেও। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। ধর্মীয় সভা হয়েছে। দেখেছি পাড়ার অমুসলিম সিনিয়ার সিটিজেনরাও তাতে যোগ দিয়েছেন। গভীর আগ্রহ আর মনোযোগ নিয়ে। সে সব সভায় ঘৃণা বা বিদ্বেষের লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু আজ দৈনন্দিন চর্চা, পোশাক, সজ্জা, উপাসনা এমনকি বিদ্যালয়-সর্বত্রই বিভাজনের লক্ষণ রেখা কৌশলে টেনে দেয়া হচ্ছে। সমাজমনে সাম্প্রদায়িক বিষ সংক্রমণের লক্ষণ স্পষ্ট। যে সমাজ রবীন্দ্রবিরোধী পশ্চিমা ষঢ়যন্ত্র প্রবল বিক্রমে রুখে দিয়েছিল, সে সমাজই আজ মন্দির ভাঙচুরের নীরব সাক্ষী। ঘরে ঘরে চলে প্রতিকারহীন সাম্প্রদায়িক প্রপাগান্ডা। ফাঁদে ফেলে সংখ্যালঘু নির্যাতন-প্রকাশ্যে, বিনা বাধায়। নিগ্রহের নতুন প্যাটার্ন ধর্ম অবমাননা। সারাদেশজুড়ে পাতা এই চালাকির জাল। শিক্ষক, কর্মজীবী, কৃষক-গ্রাম থেকে শহর-সর্বত্রই সংখ্যালঘু তটস্থ। লক্ষ্য জমি দখল নতুবা স্রেফ দেশান্তর। ধর্মের মাঙ্গলিক বার্তা যদি জনমানসকে স্পর্শ করে, তবে তা তো সমাজের জন্য কল্যাণকর। সেই সুস্থ সমাজই গড়ে তোলে সামাজিক পুঁজি। আর সে প্রক্রিয়ার সাক্ষী আমাদের শৈশব-কৈশোর। কিন্তু মতলববাজদের এজেন্ডাই আজ আলাদা। অনৈতিকতা, অপরাধ, দুর্নীতি-কল্পনার সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। অথচ সেই অপরাধ জগতে ধাতস্থ মনই ধর্মকে ব্যবহার করে বর্ম হিসেবে। সমাজে অন্যায়-অপরাধ প্রত্যাখ্যাত হয় না, অথচ ঘৃণার বিস্তার ঘটে অবলীলায়।
সব সামাজিক উদ্যাপনের মূল সুর এক। বহুত্ব, বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি। সাম্প্রতিক সময়ে সমাজমনে অসুখের যে সব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে তা হলো ঘৃণা-বিভক্তি। মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করার পরিকল্পিত ছক। তুমি-আমি কিংবা আমরা-তারা বয়ানে বিভাজন আরোপ করা হচ্ছে। বিচ্ছিন্নতার এই দেওয়াল ক্রমেই চওড়া হচ্ছে মনোজগতে; যা আবহমান সমাজবুননে ফাটল ধরাচ্ছে। প্রাত্যহিক আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষালয়, অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারিÑসবখানেই এর ছাপ প্রকট। সামাজিক এ ক্ষতের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সঠিক রাজনীতির অনুপস্থিতি ও দুর্বলতা। মানুষ ক্রমেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, না হয় নিজের সুবিধা হাসিলের জন্য নিষ্ক্রিয় থাকছে নতুবা সব ধরনের সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতাকে অনুমোদন করছে। শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলা করায় বিপুল জনগোষ্ঠীকে মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর এই শূন্যস্থান পূরণ করছে স্বস্তা মূল্যবোধহীন, উগ্র অসহনশীল আদর্শ। মজার বিষয় হলো-দুর্নীতি-প্রতারণা করলেও কেউ সামাজিক প্রতিরোধ বা গঞ্জনার মুখে পড়ে না। পক্ষান্তরে নারীর পোশাক বা সাজসজ্জা নিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কিংবা সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বিঘিœত হলে কার্যত দুর্বৃত্তই প্রশ্রয় পেয়ে যায়।
একজন কলেজ শিক্ষিকা কপালে টিপ পরার কারণে পুলিশ কর্মীর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন রাজধানীর জনাকীর্ণ রাজপথে। সমাজ-সংস্কৃতি, নৈতিকতা এমনকি দেশের প্রচলিত আইন-কোথাও ব্যক্তির সাজসজ্জায় বাধা নেই। দ্বিতীয়ত কপালে টিপ পরার রেওয়াজ আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিরই অঙ্গ। তৃতীয়ত মিথ্যার আড়ালে ঘটনাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছে অভিযুক্ত। চতুর্থত কেউ এই হামলাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেনি। একজন নারী আক্রান্ত হওয়ার পরও তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে মুখর হয়নি প্রত্যক্ষদর্শীরা। এটা কি সামাজিক নিষ্ক্রিয়তা না পরোক্ষ অনুমোদন-বলা মুশকিল। আর এ কথাও ঠিক-নববর্ষের প্রাসঙ্গিকতা সমকালীন বাঙালি মননে কতটা জায়গা পেয়েছে-তাও হয়তো ভেবে দেখার এখনই সময়।
বাংলা নববর্ষের আবেদন শুধু দেশের মানচিত্রে আবদ্ধ নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালি বাস করে-সবখানেই তার নৈতিক বিস্তার। কিন্তু কেন যেন মনে হয়-বাঙালির নৈতিক জীবনে আজ ধস নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গের চিত্রও খুব সুস্থ নয়। অবিভক্ত ভারতে কমপক্ষে ১০ জন প্রথিতযশা বাঙালি জাতীয় কংগ্রেসের সর্ব ভারতীয় সভাপতি হয়েছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি-সর্বত্রই শাসন করেছেন জগত বিখ্যাত বাঙালিরা। বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজী, চিত্তরঞ্জন, সুবাস বোস, প্রফুল্ল রায়, সত্যেন বোস, জগদীশ বোস-নাম বলতে গেলে সে তালিকা কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আজ সেখানেও বিপন্নতার সংকেত। নীতির রাজ্যে খরা। মেধার ঝলক নেই। আলোর আভা ক্রমশ ক্ষীয়মান।
তবুও আমরা আলোর সন্ধানী। সৃষ্টির মাঝে যে মানুষ থাকে না, তার শরীর আছে, প্রাণ নেই। সংস্কৃতির প্রবহমানতায় ভেসে যিনি শাসন করেন চারপাশ, তিনিই দিনশেষে হয়ে ওঠেন বাঙালি। সারা বছরজুড়েই চলে বাঙালির উৎসব। এ দিনগুলিই আমাদের শক্তি জোগায়। নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়। জীবনের সব আক্ষেপ, সব অপূর্ণতার বোধকে পাশে ফেলে বৈশাখ দেখায় কঠিন সত্যের পথ, কাউকে শেখায় হার না মানার শপথ, আবার কাউকে দেয় বৈরিতার মুখে অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মন্ত্র। মনের আকাশটায় আজ জমাট বেঁধেছে অনিশ্চয়তা। আশঙ্কার সব মেঘ ভাসিয়ে নিয়ে যাক দূরন্ত এক বৈশাখী ঝড়Ñএমন প্রত্যাশাই থাকবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]