বর্ষবরণ : আদিবাসী অঞ্চলের মেলা ও উৎসব

পাভেল পার্থ

১.

ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচয় মুছতে থাকলেও এখনও এক এক ঋতু সাজে এক এক উৎসব আর মেলার আয়োজনে। অঞ্চল ও জাতিভেদেও ঋতুভিত্তিক আচাররীতিগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। বারো মাসে তের পার্বণের বাংলাদেশে বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের কৃত্য-আচারগুলো সব ক্ষেত্রেই উৎসমুখরতা তৈরি করে। পাশাপাশি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকে ঘিরে দেশের নানা প্রান্তে আয়োজিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি, গাজন, চড়ক কি বৈশাখী মেলা। বাংলা বছরকে ঘিরে বাঙালি সমাজে চৈত্রসংক্রান্তি, হালখাতা, নববর্ষ যেমন বাংলার জনোৎসব তেমনি দেশের আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্যসমূহও জনোৎসবে রূপ নেয়। অঞ্চল ও জাতিভেদে বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসবের নামগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। সমতলের কোচ ও হাজং আদিবাসীরা বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসবকে ‘বিহু’ বলেন।

ভাওয়াল ও মধুপুর গড়ের বর্মণ ও কোচ আদিবাসীরা সন্যাসী পূজা, গাজন, চড়ক পূজার মাধ্যমে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ উৎসবকে বলেন বিষু। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের আদিবাসীদের অনেকেই এ সময় পালন করেন দ-বর্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা বর্ষবিদায় ও বরণের এ উৎসবকে বলেন বিজু। মারমারা বলেন সাংগ্রাই। রাখাইনদের ভাষায় সাংগ্রেং। ত্রিপুরারা বলেন বৈসু বা বৈসুক কোথাও বুইসুক। গুর্খা ও অহমিয়ারা বলেন বিহু। তঞ্চংগ্যারা বলেন বিষু। ম্রোরা এ উৎসবের নাম দিয়েছেন চানক্রান। চাক আদিবাসীরা এ উৎসবকে বলেন সাংগ্রাইং। খিয়াং আদিবাসীদের অনেকেই এ উৎসবকে সাংলান বলে থাকেন।

২.

নাটোরের চলনবিল অঞ্চলের বাগদী সমাজ চৈত্রসংক্রান্তির দিন নীলককণ্ঠ পূজা করে। বৈশাখের প্রথম দিনে গোয়ালঘরে আয়োজন করে ‘দুধ-উদলানো’ কৃত্য। গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে সেই দুধ গোয়ালঘরের মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। বছরের প্রথম দিনে এভাবেই ভূমিজননীকে দুধ দিয়ে নতুনবার্তা বয়ে আনবার আহ্বান জানায় বাগদী সমাজ। যাতে বছরজুড়ে গোয়ালভরা সুস্থ দুধেল গরু থাকে, সংসারের আয় রোজগার ভালো হয়, সংসারের মঙ্গল হয়। রবিদাসদের ভেতর হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। মৌসুমি ফল আমকে বর্ষবিদায়ের এ রীতির ভেতর দিয়েই সমাজ গ্রহণ করে। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্র স্থলে কর্মের পূজা করা হয়।

রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সঙ্গে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো দেওকুড়িতে রাখে। হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল যার কর্মে যা লাগে সব। এ সময় ঢোল, খাজরি, ঝাল বাজানো হয়। রবিদাসদের ভেতর এ সময় বাইশাখী পূজাও পালিত হয়। আদিবাসী বেদিয়া-মাহাতোরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটাখুঁড়ে, গিমাসহ নানা জাতের তিতাশাক খায়। ছাতাপরব ও পাতাপরবের ভেতর দিয়ে আয়োজিত হয় সাঁওতালদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণপর্ব। এসময় বাড়ির সকল গাছের গোড়ায় নতুন মাটি তুলে দিতে হয়। নতুন বছর যেন ফুলে-ফুলে-শস্য-ফসলে ভরপুর থাকে গাছগাছালি এই মানতে। বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য হিসেবে মু-ারা গ্রামপূজা হিসেবে পালন করে মুড়ই পূজা।

৩.

বিজুই চাকমাদের সবচে বড় আয়োজনের সামাজিক উৎসব। ফুল বিজু, মূল বিজু ও গয্যাপয্যা দিন এ তিন পর্বে বিভক্ত বিজুর শুরু হয় বাংলা চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ। পাহাড়-টিলা-বন ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে এদিনে শিশু, কিশোর ও বালিকারা সংগ্রহ করেন নানা পদের ফুল। ভাতজরা ফুল বা বেইফুল ছাড়া বিজু জমে না। ভাতজরা ফুল বিজুর সময়ে ফুটে বলে অনেকে একে বিজুফুলও বলে। ফুল বিজুর দিনে সবাই সকাল সকাল স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে নেয়। স্নানের সময় ডুব দিলে বিজুগুলো নামের সুস্বাদু ফল পাওয়া যেতে পারে আশায় কেউই স্নানের জন্য দেরি করে না। সংগৃহীত ফুল নদী বা ছড়ার পাড়ে পূজা করে জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ঘরবাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়। ফুল বিজুর দিন থেকে পরবর্তী সাত দিন চাকমারা ঘরের দরজা, ঘরের খুঁটি ও বাড়ির আশপাশে সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে রাখে।

ফুল বিজুর পরের দিনই শুরু হয় মূল বিজু। এদিনে চাকমা বাড়িতে বাড়িতে নানা পদের রান্না হয়। এসবের ভেতর বিজুর পাজোন বা এক ধরনের মিশ্র সবজি হলো সবার কাক্সিক্ষত খাবার। পাজানোর তরিতরকারি খুঁজতে জঙ্গলে যাওয়াকে চাকমা ভাষায় বলে ‘তোনতগা যানা’। সান্যা পিঠা, বিনি পিঠা, বিনি হগা, বড়া পিঠা বানানো হয় ঘরে ঘরে। খবরক, গ্যাল্লং, লংকাপোড়া বিনি, কালাবিনি, লালবিনির মতো নানা জুমধান থেকে তৈরি করা জগরা, কানজি ও দোয়াচুয়ানির আনন্দিত আসর জমে ওঠে। চাকমারা নববর্ষের দিনকে গয্যাপয্যা বলে মানে আরাম-আয়েশ গড়াগড়ি করে কাটানোর দিন। নারীরা এদিন মালোকখীমার উদ্দেশ্যে ভাত উৎসর্গ করেন। বিজুর সময় চাকমা গ্রামে গ্রামে গেংখুলীরা উভোগীত, রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাং ছড়া পালাসহ নানা পালাগানের আয়োজন করেন। মারমারাও প্রায় তিন দিন ধরেই পালন করে সাংগ্রাই।

৪.

ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন বছর ঘিরে সবচেয়ে বড় আয়োজনের মেলা আয়োজিত হতো চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়ার রাজানগর ও রাউজানের পাহাড়তুলী গ্রামে। ১৮৬০ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চাকমা রাজ্য দখল করার আগ পর্যন্ত রাজানগর ছিল চাকমা রাজাদের সদর দপ্তর। ১৮৪২ সালে পাহাড়তুলী গ্রামে মংসার্কেল প্রধান মহামুণি বৌদ্ধ মূর্তি স্থাপন করেন। বিজু উপলক্ষে এসব স্থানে আয়োজিত মেলায় তখনকার দিনে মেলার প্রথম তিন দিন দোকানি ছাড়া শুধু স্থানীয় আদিবাসী নারী-পুরুষেরই প্রবেশাধিকার ছিল। তারপর এটি সবার জন্য উন্মুক্ত হতো। খাগড়াছড়ির রামগড়ে একটা সময় ফুলবিজুর দিন থেকেই আয়োজিত হত মহামুনি বৌদ্ধ মেলা। চলতো প্রায় কয়েক সপ্তাহ। মানিকছড়ির মং রাজার মহামুনি মন্দির প্রাঙ্গণে বসতো নববর্ষের মেলা। দায় ও বর্ষবরণের অনন্য আয়োজন হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মেলাগুলোও আজ প্রায় নিখোঁজ ও নিথর। কিন্তু বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব ও মেলার এ বর্ণময় আয়োজন দেশের সমতল কি বনপাহাড়ের আদিবাসী জীবনের আনন্দময় গভীরতাকেই তুলে ধরে বারবার।

বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুককে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে জমে ওঠে বিজু মেলা। ঠিক যেমন করে সমতল আদিবাসী এলাকায় আয়োজিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি মেলা বা চড়কের মেলা। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের নিজস্ব প্রকাশনাসমূহ সবচে বেশি প্রকাশিত হয় এসময়টাতেই। বর্ষবিদায় ও বরণের এ সব আয়োজন সরাসরি স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশের সম্পর্ককে হাজির করে। বনপাহাড়ের নানা জাতের ফুলই জানিয়ে দেয় বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। জানায় ডাক দিয়েছে নতুন বছর। কিন্তু দিনে দিনে দেশের আদিবাসী জীবন ও জনপদ ক্রমাগতভাবেই এক বিপন্নতা ও ঝুঁকির ভেতর দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর নানা সময়ে সংগঠিত নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা তাদের বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উৎসব বর্জন করতে বাধ্য হয়েছেন বহুবার।

কিন্তু রাষ্ট্র এখনো পর্যন্ত দেশের আদিবাসী জীবনের উৎসব, মেলা ও আকাক্সক্ষার বৈভবকে সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হয়নি। রাষ্ট্র বহুদিন বাদে বহু বিতর্ককে জিইয়ে রেখে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ তৈরি করেছে। উক্ত আইনে দেশের আদিবাসী জনগণের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রকে আদিবাসী কি বাঙালি সবার বর্ষব্যাপী উৎসব ও মেলাইকেই সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বছরের বিদায় ও বরণ ঘিরে এসব উৎসব ও মেলা আয়োজনের সঙ্গে শুধু বিশ্বাস ও বিনোদন নয়, জড়িয়ে আছে এ জনপদের উৎপাদন সম্পর্কের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি। সব জীবনের সাংস্কৃতিক প্রবাহের আপন বিকাশের ভেতর দিয়েই দেশীয় অর্থনীতির ভিত আরও মজবুত ও গতিময় হয়ে ওঠুক নতুন বছরে।

[লেখক : গবেষক]

image

দেশের আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্যসমূহও জনোৎসবে রূপ নেয়

আরও খবর
বৈশাখের বার্তা
হালখাতা যেভাবে ঋণ পরিশোধের গ্রামীণ প্রণোদনা
বাঙালির মহামিলনের দিন

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

বর্ষবরণ : আদিবাসী অঞ্চলের মেলা ও উৎসব

পাভেল পার্থ

image

দেশের আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্যসমূহও জনোৎসবে রূপ নেয়

১.

ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচয় মুছতে থাকলেও এখনও এক এক ঋতু সাজে এক এক উৎসব আর মেলার আয়োজনে। অঞ্চল ও জাতিভেদেও ঋতুভিত্তিক আচাররীতিগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। বারো মাসে তের পার্বণের বাংলাদেশে বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের কৃত্য-আচারগুলো সব ক্ষেত্রেই উৎসমুখরতা তৈরি করে। পাশাপাশি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকে ঘিরে দেশের নানা প্রান্তে আয়োজিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি, গাজন, চড়ক কি বৈশাখী মেলা। বাংলা বছরকে ঘিরে বাঙালি সমাজে চৈত্রসংক্রান্তি, হালখাতা, নববর্ষ যেমন বাংলার জনোৎসব তেমনি দেশের আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্যসমূহও জনোৎসবে রূপ নেয়। অঞ্চল ও জাতিভেদে বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসবের নামগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। সমতলের কোচ ও হাজং আদিবাসীরা বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসবকে ‘বিহু’ বলেন।

ভাওয়াল ও মধুপুর গড়ের বর্মণ ও কোচ আদিবাসীরা সন্যাসী পূজা, গাজন, চড়ক পূজার মাধ্যমে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ উৎসবকে বলেন বিষু। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের আদিবাসীদের অনেকেই এ সময় পালন করেন দ-বর্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা বর্ষবিদায় ও বরণের এ উৎসবকে বলেন বিজু। মারমারা বলেন সাংগ্রাই। রাখাইনদের ভাষায় সাংগ্রেং। ত্রিপুরারা বলেন বৈসু বা বৈসুক কোথাও বুইসুক। গুর্খা ও অহমিয়ারা বলেন বিহু। তঞ্চংগ্যারা বলেন বিষু। ম্রোরা এ উৎসবের নাম দিয়েছেন চানক্রান। চাক আদিবাসীরা এ উৎসবকে বলেন সাংগ্রাইং। খিয়াং আদিবাসীদের অনেকেই এ উৎসবকে সাংলান বলে থাকেন।

২.

নাটোরের চলনবিল অঞ্চলের বাগদী সমাজ চৈত্রসংক্রান্তির দিন নীলককণ্ঠ পূজা করে। বৈশাখের প্রথম দিনে গোয়ালঘরে আয়োজন করে ‘দুধ-উদলানো’ কৃত্য। গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে সেই দুধ গোয়ালঘরের মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। বছরের প্রথম দিনে এভাবেই ভূমিজননীকে দুধ দিয়ে নতুনবার্তা বয়ে আনবার আহ্বান জানায় বাগদী সমাজ। যাতে বছরজুড়ে গোয়ালভরা সুস্থ দুধেল গরু থাকে, সংসারের আয় রোজগার ভালো হয়, সংসারের মঙ্গল হয়। রবিদাসদের ভেতর হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। মৌসুমি ফল আমকে বর্ষবিদায়ের এ রীতির ভেতর দিয়েই সমাজ গ্রহণ করে। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্র স্থলে কর্মের পূজা করা হয়।

রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সঙ্গে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো দেওকুড়িতে রাখে। হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল যার কর্মে যা লাগে সব। এ সময় ঢোল, খাজরি, ঝাল বাজানো হয়। রবিদাসদের ভেতর এ সময় বাইশাখী পূজাও পালিত হয়। আদিবাসী বেদিয়া-মাহাতোরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটাখুঁড়ে, গিমাসহ নানা জাতের তিতাশাক খায়। ছাতাপরব ও পাতাপরবের ভেতর দিয়ে আয়োজিত হয় সাঁওতালদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণপর্ব। এসময় বাড়ির সকল গাছের গোড়ায় নতুন মাটি তুলে দিতে হয়। নতুন বছর যেন ফুলে-ফুলে-শস্য-ফসলে ভরপুর থাকে গাছগাছালি এই মানতে। বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য হিসেবে মু-ারা গ্রামপূজা হিসেবে পালন করে মুড়ই পূজা।

৩.

বিজুই চাকমাদের সবচে বড় আয়োজনের সামাজিক উৎসব। ফুল বিজু, মূল বিজু ও গয্যাপয্যা দিন এ তিন পর্বে বিভক্ত বিজুর শুরু হয় বাংলা চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ। পাহাড়-টিলা-বন ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে এদিনে শিশু, কিশোর ও বালিকারা সংগ্রহ করেন নানা পদের ফুল। ভাতজরা ফুল বা বেইফুল ছাড়া বিজু জমে না। ভাতজরা ফুল বিজুর সময়ে ফুটে বলে অনেকে একে বিজুফুলও বলে। ফুল বিজুর দিনে সবাই সকাল সকাল স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে নেয়। স্নানের সময় ডুব দিলে বিজুগুলো নামের সুস্বাদু ফল পাওয়া যেতে পারে আশায় কেউই স্নানের জন্য দেরি করে না। সংগৃহীত ফুল নদী বা ছড়ার পাড়ে পূজা করে জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ঘরবাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়। ফুল বিজুর দিন থেকে পরবর্তী সাত দিন চাকমারা ঘরের দরজা, ঘরের খুঁটি ও বাড়ির আশপাশে সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে রাখে।

ফুল বিজুর পরের দিনই শুরু হয় মূল বিজু। এদিনে চাকমা বাড়িতে বাড়িতে নানা পদের রান্না হয়। এসবের ভেতর বিজুর পাজোন বা এক ধরনের মিশ্র সবজি হলো সবার কাক্সিক্ষত খাবার। পাজানোর তরিতরকারি খুঁজতে জঙ্গলে যাওয়াকে চাকমা ভাষায় বলে ‘তোনতগা যানা’। সান্যা পিঠা, বিনি পিঠা, বিনি হগা, বড়া পিঠা বানানো হয় ঘরে ঘরে। খবরক, গ্যাল্লং, লংকাপোড়া বিনি, কালাবিনি, লালবিনির মতো নানা জুমধান থেকে তৈরি করা জগরা, কানজি ও দোয়াচুয়ানির আনন্দিত আসর জমে ওঠে। চাকমারা নববর্ষের দিনকে গয্যাপয্যা বলে মানে আরাম-আয়েশ গড়াগড়ি করে কাটানোর দিন। নারীরা এদিন মালোকখীমার উদ্দেশ্যে ভাত উৎসর্গ করেন। বিজুর সময় চাকমা গ্রামে গ্রামে গেংখুলীরা উভোগীত, রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাং ছড়া পালাসহ নানা পালাগানের আয়োজন করেন। মারমারাও প্রায় তিন দিন ধরেই পালন করে সাংগ্রাই।

৪.

ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন বছর ঘিরে সবচেয়ে বড় আয়োজনের মেলা আয়োজিত হতো চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়ার রাজানগর ও রাউজানের পাহাড়তুলী গ্রামে। ১৮৬০ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চাকমা রাজ্য দখল করার আগ পর্যন্ত রাজানগর ছিল চাকমা রাজাদের সদর দপ্তর। ১৮৪২ সালে পাহাড়তুলী গ্রামে মংসার্কেল প্রধান মহামুণি বৌদ্ধ মূর্তি স্থাপন করেন। বিজু উপলক্ষে এসব স্থানে আয়োজিত মেলায় তখনকার দিনে মেলার প্রথম তিন দিন দোকানি ছাড়া শুধু স্থানীয় আদিবাসী নারী-পুরুষেরই প্রবেশাধিকার ছিল। তারপর এটি সবার জন্য উন্মুক্ত হতো। খাগড়াছড়ির রামগড়ে একটা সময় ফুলবিজুর দিন থেকেই আয়োজিত হত মহামুনি বৌদ্ধ মেলা। চলতো প্রায় কয়েক সপ্তাহ। মানিকছড়ির মং রাজার মহামুনি মন্দির প্রাঙ্গণে বসতো নববর্ষের মেলা। দায় ও বর্ষবরণের অনন্য আয়োজন হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মেলাগুলোও আজ প্রায় নিখোঁজ ও নিথর। কিন্তু বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব ও মেলার এ বর্ণময় আয়োজন দেশের সমতল কি বনপাহাড়ের আদিবাসী জীবনের আনন্দময় গভীরতাকেই তুলে ধরে বারবার।

বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুককে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে জমে ওঠে বিজু মেলা। ঠিক যেমন করে সমতল আদিবাসী এলাকায় আয়োজিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি মেলা বা চড়কের মেলা। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের নিজস্ব প্রকাশনাসমূহ সবচে বেশি প্রকাশিত হয় এসময়টাতেই। বর্ষবিদায় ও বরণের এ সব আয়োজন সরাসরি স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশের সম্পর্ককে হাজির করে। বনপাহাড়ের নানা জাতের ফুলই জানিয়ে দেয় বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। জানায় ডাক দিয়েছে নতুন বছর। কিন্তু দিনে দিনে দেশের আদিবাসী জীবন ও জনপদ ক্রমাগতভাবেই এক বিপন্নতা ও ঝুঁকির ভেতর দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর নানা সময়ে সংগঠিত নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা তাদের বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উৎসব বর্জন করতে বাধ্য হয়েছেন বহুবার।

কিন্তু রাষ্ট্র এখনো পর্যন্ত দেশের আদিবাসী জীবনের উৎসব, মেলা ও আকাক্সক্ষার বৈভবকে সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হয়নি। রাষ্ট্র বহুদিন বাদে বহু বিতর্ককে জিইয়ে রেখে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ তৈরি করেছে। উক্ত আইনে দেশের আদিবাসী জনগণের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রকে আদিবাসী কি বাঙালি সবার বর্ষব্যাপী উৎসব ও মেলাইকেই সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বছরের বিদায় ও বরণ ঘিরে এসব উৎসব ও মেলা আয়োজনের সঙ্গে শুধু বিশ্বাস ও বিনোদন নয়, জড়িয়ে আছে এ জনপদের উৎপাদন সম্পর্কের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি। সব জীবনের সাংস্কৃতিক প্রবাহের আপন বিকাশের ভেতর দিয়েই দেশীয় অর্থনীতির ভিত আরও মজবুত ও গতিময় হয়ে ওঠুক নতুন বছরে।

[লেখক : গবেষক]