হালখাতা যেভাবে ঋণ পরিশোধের গ্রামীণ প্রণোদনা

মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান

পহেলা বৈশাখ বাঙালি জীবনের এক অন্যতম উৎসবের পর্ব। তবে আজকাল শহরে যে বৈশাখ উদ্যাপন তা কিছুটা আন্তরিকতার ছোঁয়ায় বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্যের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত বৈশাখী ঐতিহ্য। গ্রামের হাট বাজারের ব্যবসায়ীরা পুরোনো বছরের দেনা-পাওনার হিসেব করে নতুন বছরের শুরুতেই অনাদায়ী পাওনাগুলো আদায়ের মাধ্যমে হিসাব হাল নাগাদ করতেন। এই যে নতুন হিসাব খোলার খাতাÑএটাকে হালখাতা হিসেবে এক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে পালন করা হতো।

মোঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখে খাজনা পরিশোধের প্রথার মাধ্যমে প্রচলিত এই ধারা পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসনের আওতায় জমিদাররাও অনুসরণ করতে থাকে। তাদের প্রজাদের নিকট থেকে বকেয়া খাজনা আদায়ের দিন ছিল এটি। জমিদাররা এদিনে তাদের প্রজাদের মিষ্টিমুখ বা ভূরিভোজ করাতেন।

সেই ধারাবাহিকতায় পরে ব্যাবসায়ী আর দোকান মালিকরা এই প্রথা অনুসরণ করতে থাকে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো হতো, ধূপ বা আগর বাতি জ্বালিয়ে পবিত্র করা হতো। সব ক্রেতাকে দাওয়াত করে মিষ্টি মুখ করানো হতো। বছরের শুরুতে এ আয়োজনে যারা আসতেন খুব স্বাভাবিকভাবেই যদি কোন দেনা থাকত তবে তারা যথাসম্ভব পরিশোধ করতেন এবং মিষ্টি মুখের মাধ্যমে নতুন করে বেচাকেনা শুরুর জন্য স্বাগত জানাতেন। জিলাপির লোভে আমরা হালখাতায় যেতাম। কোন দেনা পাওনা না থাকলেও আমাদের মিষ্টি মুখ করানো হতো এবং বাড়ি আসার সময় একটা জিলাপির প্যাকেট ধরিয়ে দেয়া হতো।

শৈশব থেকেই দেখেছি বছরের এই সময়টাই লাল রঙের মুদ্রণে ছোট আকারের চিঠি আসত। এই চিঠি হালখাতার তা আমরা নিশ্চিত ছিলাম। ব্যাংকের নোটিস পেলে ঋণগ্রহীতারা এখন চিন্তিত হয়ে পড়েন কিন্তু হালখাতার চিঠি হাতে পেলেই জিলাপির স্বাদে জিভ ভিজে উঠতো। এসব এখন শুধুই স্মৃতি। ব্যবসায়ী ও খরিদদারদের মধ্যে এ যেন ছিল এক অলিখিত প্রথা। নববর্ষে খরিদদাররা তাদের গত বছরের যত দেনা পাওনা, তা হাসিমুখে পরিশোধ করে মিষ্টিমুখ করে বাড়ি ফিরতেন। এখানে ছিল না কোন নোটিস বা পুনঃতফসিল করার আরজি।

কালক্রমে এই লেনদেন শুধু কেনাবেচায় সীমিত থাকেনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাইরে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ প্রয়োজনে যেমন ছেলেমেয়ের বিয়ে, ক্ষরা বন্যায় ফসলের ক্ষতিতে আকাল বা অশুখ-বিসুখে টাকার প্রয়োজনে নির্ভর করতে হয়েছে গ্রামের ধনী কৃষক, মহাজন, সুদের কারবারীদের ওপর। অপ্রাতিষ্ঠানিক এই ঋণ গ্রহণে না ছিল কোন সাক্ষী, না ছিল সুনির্দিষ্ট কোন শর্ত। কেউ হয়তো ঋণ পরিশোধে সমর্থ হয়েছেন কেউ পরিশোধ করতে পারেননি। কিন্তু ঋণ না দিয়ে খেলাপি হননি। আত্মসম্মান আর মহাজনী ক্ষমতার কাছে নিরবে আত্মসমর্পণ করেছেন, রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন সামান্য জমিটুকু। কিন্তু আধুনিক শহুরে ঋণগ্রহীতাদের মতো বছরের পর বছর ঋণখেলাপি হয়ে থাকেননি।

ক্রয়-বিক্রয়ের এ আর্থিক সংস্কৃতিতে এসেছে পরিবর্তন। দেখেছি সেই চিরচেনা গ্রামে পরিবর্তিত হচ্ছে অবকাঠামো, জীবনাচার এবং সংস্কৃতিতেও এসেছে পরিবর্তন। তবে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে গ্রামীণ পেশায়। ৩০-৪০ বছর পূর্বেও শতকরা ৮০ ভাগ গ্রামবাসী ছিল কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল সেখানে এই পরিমাণ এসেছে অর্ধেকে। ৫০ বছর পূর্বে যে বাড়ির লোকসংখ্যা ছিল পাঁচজন এখন, তা হয়েছে ২০ জন। জমি বাড়েনি কিন্তু পরিবারে লোকসংখ্যা বেড়েছে। জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েছে, আয় বাড়েনি। এ কারণে প্রয়োজনের তাগিদে কৃষি কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হতে হয়েছে বাড়ির অন্য সদস্যদের। পেশা পরিবর্তনের জন্য চাই মূলধন। গ্রাম পর্যায়ে আর্থিক লেনদেনের কোন নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান না থাকায় ঋণের প্রয়োজন মেটাতো গ্রামীণ মহাজন জোতদার গোষ্ঠী। সেখানে না ছিল কোন নিয়ম না ছিল কোন উপযোগী শর্ত। যারা সংগ্রহ করতে পেরেছে তারা অন্য কোন ব্যবসা বা কাজে যোগ দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ কৃষক পরিবারই ছদ্ম বেকারত্বের বেড়াজালে যে জমিতে তিন জন শ্রমিকের প্রয়োজন সেখানে নিয়োজিত থেকেছে ছয়জন। শ্রমশক্তির এই অপচয় নিরোধে এগিয়ে এসেছে ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও।

ঋণ বিতরণে কেন এনজিও উৎসাহিত হচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের গ্রামের এনজিওকর্মী সেন্টু জানায় বেশ কয়েকটি কারণে এই ঋণ প্রদান আরও গতি পাচ্ছে। প্রথমত, গ্রহীতারা সবাই নিজেই বিনিয়োগ করে এবং পরিশ্রম করে ব্যবসাকে লাভজনক করে তোলে। দ্বিতীয়ত, এনজিও কর্মীদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও সহযোগিতায় উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগ হওয়ায় বিনিয়োগটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। তৃতীয়ত, বেশির ভাগ নারী সদস্য আন্তরিক ও নিবেদিত হওয়ায় এবং তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ ঊন্মুক্ত হয় এবং পরবর্তী ঋণ গ্রহণের স্বার্থে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করেন। আর ঋণ বিতরণ এবং তা পরিশোধে কোন ঝুঁকি না থাকায় ঋণ বিতরণ গতি পাচ্ছে, উৎসাহিত হচ্ছে এনজিও।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিবরণী অনুযায়ী দেশের কৃষকরা যে পরিমাণ নতুন ঋণ নিচ্ছেন তার চেয়ে বেশি পুরোনো ঋণ পরিশোধ করছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ১৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ হয়েছিল। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এই ঋণ বিতরণ হয়েছিল ১৩ হাজার ১০৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ঋণ বিতরণের পরিমাণ বেড়েছে ৮ শতাংশ।

অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে তারা ঋণ পরিশোধ করেছেন ১৬ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। সারা দেশে যেখানে ঋণখেলাপিদের নেতিবাচক কর্মকা-ে ব্যাংকগুলো স্থবির হয়ে পড়ছে সেখানে আমাদের কৃষকেরা ঋণ পরিশোধ করছেন ঋণ গ্রহণের চেয়েও বেশি। এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সরকার প্রদত্ত অল্প সুদে দেয়া ঋণ গ্রহণ, ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং। তবে এটুকু বলতেই হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বকেয়া পরিশোধের হালখাতা সংস্কৃতির ঐতিহ্য কারও কছে ঋণী থাকার মানসিকতা বা মূলধন আত্মসাতের সংস্কৃতিতে গ্রামের সাধারণ মানুষ কখনোই অভ্যস্ত ছিল না।

ঋণ পরিশোধের এ ইতিবাচক ধারার বিশ্লেষণে আরও জানা যায় গতানুগতিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনা গ্রাম পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে সমর্থ না হওয়ায় এবং এই লেনদেন অসুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করে সর্বস্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবায় টানতে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকার ২০১৪ সাল থেকে এজেন্ট ব্যাংক পদ্ধতির সূচনা করে। এজেন্ট ব্যাংকের মাঠকর্মীরা এজেন্টদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন বিধায় অল্প সময়ে বেশি ঋণ বিতরণ সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে দেশব্যাপী গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে, পাড়া-মহল্লায় এ রকম এজেন্ট ব্যাংকের শাখা ছড়িয়ে পড়েছে। গত আট বছরে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার গ্রাহক বেড়েছে প্রায় এক কোটির বেশি। এনজিওদের ঋণ বিতরণের এই সাফল্য যেমন গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছে এবং নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলছে একই সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে এনজিওকেও শক্ত ভিত্তি দিচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঋণ গ্রহণের ইতিবাচক এ প্রভাব একদিকে ঋণ প্রদানকারী এনজিও যেমন তাদের বিনিয়োগ থেকে আশানুরূপ রিটার্ন পাচ্ছেন তেমনি গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাবলম্বী হতে পারছেন, জীবনমানে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এভাবে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে লেনদেনের প্রীতিকর প্রথা শুরু হয়েছিল হালখাতার মাধ্যমে। অতঃপর নগদ অর্থের প্রয়োজনে দাদন ব্যবসায়ী আর সুদের কারবারি, আরও পরে এন জিও এবং সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব লেনদেনের প্রয়োজনেই গড়ে উঠল এজেন্ট ব্যাংক। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। এই যে আধুনিক ব্যাংকিং সেবার সুযোগ এবং ঋণ প্রদানে এনজিও এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা এবং সনাতনী কৃষির পরিবর্তে মাছ চাষ, হাস-মুরগি পালন, শাকসবজি চাষ, পশু পালনসহ অপ্রচলিত পেশায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও গ্রামীণ অর্থনীতিতে জোরালো ভূমিকা রাখছে।

ক্ষেতে খামারে বিনিয়োগ থেকে যে লাভ আসছে, তা থেকে সহজেই ঋণ পরিশোধ করে আবার ঋণ গ্রহণের এই প্রক্রিয়ায় ঋণদাতা এবং গ্রহীতা উভয় খুশি থাকায় গ্রামের মানুষ তাদের জীবনযাত্রার এই চলমান প্রক্রিয়ায় খুশি। এ কারণে কোন প্রতারণা বা অমিতব্যায়ী হয়ে কোন অনিশ্চিত বা আইনি পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে চায় না গ্রামের সহজ সরল মানুষ।

দেশে ব্যাংক ঋণের এক বিশাল পরিমাণ যেখানে খেলাপি বা অনাদায়ী হয়ে আছে বছরের পর বছর। বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে কিন্তু যথাসময়ে পরিশোধ না করায় তা খেলাপি ঋণে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। পুঁজির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে, অর্থনীতি গতিহীন হয়ে পড়ছে। সে প্রেক্ষাপটে গ্রামের মানুষ আত্মমর্যাদাবোধ আর ঋণ পরিশোধের আবহমান হালখাতা সংস্কৃতির অনুশীলনের ধারাবাহিকতায় হাসিমুখে পরিশোধ করে দিচ্ছে সরকারি অথবা বেসরকারি ঋণ। গ্রামের মানুষের ঋণ পরিশোধের এই ইতিবাচক ধারার প্রতিফলন হোক শহরেও। খেলাপি ঋণের অপছায়ামুক্ত হোক প্রতিটি বাংলা নতুন বছর।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র]

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

হালখাতা যেভাবে ঋণ পরিশোধের গ্রামীণ প্রণোদনা

মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান

পহেলা বৈশাখ বাঙালি জীবনের এক অন্যতম উৎসবের পর্ব। তবে আজকাল শহরে যে বৈশাখ উদ্যাপন তা কিছুটা আন্তরিকতার ছোঁয়ায় বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্যের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত বৈশাখী ঐতিহ্য। গ্রামের হাট বাজারের ব্যবসায়ীরা পুরোনো বছরের দেনা-পাওনার হিসেব করে নতুন বছরের শুরুতেই অনাদায়ী পাওনাগুলো আদায়ের মাধ্যমে হিসাব হাল নাগাদ করতেন। এই যে নতুন হিসাব খোলার খাতাÑএটাকে হালখাতা হিসেবে এক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে পালন করা হতো।

মোঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখে খাজনা পরিশোধের প্রথার মাধ্যমে প্রচলিত এই ধারা পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসনের আওতায় জমিদাররাও অনুসরণ করতে থাকে। তাদের প্রজাদের নিকট থেকে বকেয়া খাজনা আদায়ের দিন ছিল এটি। জমিদাররা এদিনে তাদের প্রজাদের মিষ্টিমুখ বা ভূরিভোজ করাতেন।

সেই ধারাবাহিকতায় পরে ব্যাবসায়ী আর দোকান মালিকরা এই প্রথা অনুসরণ করতে থাকে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো হতো, ধূপ বা আগর বাতি জ্বালিয়ে পবিত্র করা হতো। সব ক্রেতাকে দাওয়াত করে মিষ্টি মুখ করানো হতো। বছরের শুরুতে এ আয়োজনে যারা আসতেন খুব স্বাভাবিকভাবেই যদি কোন দেনা থাকত তবে তারা যথাসম্ভব পরিশোধ করতেন এবং মিষ্টি মুখের মাধ্যমে নতুন করে বেচাকেনা শুরুর জন্য স্বাগত জানাতেন। জিলাপির লোভে আমরা হালখাতায় যেতাম। কোন দেনা পাওনা না থাকলেও আমাদের মিষ্টি মুখ করানো হতো এবং বাড়ি আসার সময় একটা জিলাপির প্যাকেট ধরিয়ে দেয়া হতো।

শৈশব থেকেই দেখেছি বছরের এই সময়টাই লাল রঙের মুদ্রণে ছোট আকারের চিঠি আসত। এই চিঠি হালখাতার তা আমরা নিশ্চিত ছিলাম। ব্যাংকের নোটিস পেলে ঋণগ্রহীতারা এখন চিন্তিত হয়ে পড়েন কিন্তু হালখাতার চিঠি হাতে পেলেই জিলাপির স্বাদে জিভ ভিজে উঠতো। এসব এখন শুধুই স্মৃতি। ব্যবসায়ী ও খরিদদারদের মধ্যে এ যেন ছিল এক অলিখিত প্রথা। নববর্ষে খরিদদাররা তাদের গত বছরের যত দেনা পাওনা, তা হাসিমুখে পরিশোধ করে মিষ্টিমুখ করে বাড়ি ফিরতেন। এখানে ছিল না কোন নোটিস বা পুনঃতফসিল করার আরজি।

কালক্রমে এই লেনদেন শুধু কেনাবেচায় সীমিত থাকেনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাইরে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ প্রয়োজনে যেমন ছেলেমেয়ের বিয়ে, ক্ষরা বন্যায় ফসলের ক্ষতিতে আকাল বা অশুখ-বিসুখে টাকার প্রয়োজনে নির্ভর করতে হয়েছে গ্রামের ধনী কৃষক, মহাজন, সুদের কারবারীদের ওপর। অপ্রাতিষ্ঠানিক এই ঋণ গ্রহণে না ছিল কোন সাক্ষী, না ছিল সুনির্দিষ্ট কোন শর্ত। কেউ হয়তো ঋণ পরিশোধে সমর্থ হয়েছেন কেউ পরিশোধ করতে পারেননি। কিন্তু ঋণ না দিয়ে খেলাপি হননি। আত্মসম্মান আর মহাজনী ক্ষমতার কাছে নিরবে আত্মসমর্পণ করেছেন, রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন সামান্য জমিটুকু। কিন্তু আধুনিক শহুরে ঋণগ্রহীতাদের মতো বছরের পর বছর ঋণখেলাপি হয়ে থাকেননি।

ক্রয়-বিক্রয়ের এ আর্থিক সংস্কৃতিতে এসেছে পরিবর্তন। দেখেছি সেই চিরচেনা গ্রামে পরিবর্তিত হচ্ছে অবকাঠামো, জীবনাচার এবং সংস্কৃতিতেও এসেছে পরিবর্তন। তবে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে গ্রামীণ পেশায়। ৩০-৪০ বছর পূর্বেও শতকরা ৮০ ভাগ গ্রামবাসী ছিল কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল সেখানে এই পরিমাণ এসেছে অর্ধেকে। ৫০ বছর পূর্বে যে বাড়ির লোকসংখ্যা ছিল পাঁচজন এখন, তা হয়েছে ২০ জন। জমি বাড়েনি কিন্তু পরিবারে লোকসংখ্যা বেড়েছে। জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েছে, আয় বাড়েনি। এ কারণে প্রয়োজনের তাগিদে কৃষি কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হতে হয়েছে বাড়ির অন্য সদস্যদের। পেশা পরিবর্তনের জন্য চাই মূলধন। গ্রাম পর্যায়ে আর্থিক লেনদেনের কোন নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান না থাকায় ঋণের প্রয়োজন মেটাতো গ্রামীণ মহাজন জোতদার গোষ্ঠী। সেখানে না ছিল কোন নিয়ম না ছিল কোন উপযোগী শর্ত। যারা সংগ্রহ করতে পেরেছে তারা অন্য কোন ব্যবসা বা কাজে যোগ দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ কৃষক পরিবারই ছদ্ম বেকারত্বের বেড়াজালে যে জমিতে তিন জন শ্রমিকের প্রয়োজন সেখানে নিয়োজিত থেকেছে ছয়জন। শ্রমশক্তির এই অপচয় নিরোধে এগিয়ে এসেছে ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও।

ঋণ বিতরণে কেন এনজিও উৎসাহিত হচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের গ্রামের এনজিওকর্মী সেন্টু জানায় বেশ কয়েকটি কারণে এই ঋণ প্রদান আরও গতি পাচ্ছে। প্রথমত, গ্রহীতারা সবাই নিজেই বিনিয়োগ করে এবং পরিশ্রম করে ব্যবসাকে লাভজনক করে তোলে। দ্বিতীয়ত, এনজিও কর্মীদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও সহযোগিতায় উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগ হওয়ায় বিনিয়োগটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। তৃতীয়ত, বেশির ভাগ নারী সদস্য আন্তরিক ও নিবেদিত হওয়ায় এবং তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ ঊন্মুক্ত হয় এবং পরবর্তী ঋণ গ্রহণের স্বার্থে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করেন। আর ঋণ বিতরণ এবং তা পরিশোধে কোন ঝুঁকি না থাকায় ঋণ বিতরণ গতি পাচ্ছে, উৎসাহিত হচ্ছে এনজিও।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিবরণী অনুযায়ী দেশের কৃষকরা যে পরিমাণ নতুন ঋণ নিচ্ছেন তার চেয়ে বেশি পুরোনো ঋণ পরিশোধ করছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ১৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ হয়েছিল। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এই ঋণ বিতরণ হয়েছিল ১৩ হাজার ১০৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ঋণ বিতরণের পরিমাণ বেড়েছে ৮ শতাংশ।

অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে তারা ঋণ পরিশোধ করেছেন ১৬ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। সারা দেশে যেখানে ঋণখেলাপিদের নেতিবাচক কর্মকা-ে ব্যাংকগুলো স্থবির হয়ে পড়ছে সেখানে আমাদের কৃষকেরা ঋণ পরিশোধ করছেন ঋণ গ্রহণের চেয়েও বেশি। এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সরকার প্রদত্ত অল্প সুদে দেয়া ঋণ গ্রহণ, ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং। তবে এটুকু বলতেই হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বকেয়া পরিশোধের হালখাতা সংস্কৃতির ঐতিহ্য কারও কছে ঋণী থাকার মানসিকতা বা মূলধন আত্মসাতের সংস্কৃতিতে গ্রামের সাধারণ মানুষ কখনোই অভ্যস্ত ছিল না।

ঋণ পরিশোধের এ ইতিবাচক ধারার বিশ্লেষণে আরও জানা যায় গতানুগতিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনা গ্রাম পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে সমর্থ না হওয়ায় এবং এই লেনদেন অসুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করে সর্বস্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবায় টানতে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকার ২০১৪ সাল থেকে এজেন্ট ব্যাংক পদ্ধতির সূচনা করে। এজেন্ট ব্যাংকের মাঠকর্মীরা এজেন্টদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন বিধায় অল্প সময়ে বেশি ঋণ বিতরণ সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে দেশব্যাপী গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে, পাড়া-মহল্লায় এ রকম এজেন্ট ব্যাংকের শাখা ছড়িয়ে পড়েছে। গত আট বছরে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার গ্রাহক বেড়েছে প্রায় এক কোটির বেশি। এনজিওদের ঋণ বিতরণের এই সাফল্য যেমন গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছে এবং নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলছে একই সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে এনজিওকেও শক্ত ভিত্তি দিচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঋণ গ্রহণের ইতিবাচক এ প্রভাব একদিকে ঋণ প্রদানকারী এনজিও যেমন তাদের বিনিয়োগ থেকে আশানুরূপ রিটার্ন পাচ্ছেন তেমনি গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাবলম্বী হতে পারছেন, জীবনমানে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এভাবে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে লেনদেনের প্রীতিকর প্রথা শুরু হয়েছিল হালখাতার মাধ্যমে। অতঃপর নগদ অর্থের প্রয়োজনে দাদন ব্যবসায়ী আর সুদের কারবারি, আরও পরে এন জিও এবং সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব লেনদেনের প্রয়োজনেই গড়ে উঠল এজেন্ট ব্যাংক। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। এই যে আধুনিক ব্যাংকিং সেবার সুযোগ এবং ঋণ প্রদানে এনজিও এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা এবং সনাতনী কৃষির পরিবর্তে মাছ চাষ, হাস-মুরগি পালন, শাকসবজি চাষ, পশু পালনসহ অপ্রচলিত পেশায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও গ্রামীণ অর্থনীতিতে জোরালো ভূমিকা রাখছে।

ক্ষেতে খামারে বিনিয়োগ থেকে যে লাভ আসছে, তা থেকে সহজেই ঋণ পরিশোধ করে আবার ঋণ গ্রহণের এই প্রক্রিয়ায় ঋণদাতা এবং গ্রহীতা উভয় খুশি থাকায় গ্রামের মানুষ তাদের জীবনযাত্রার এই চলমান প্রক্রিয়ায় খুশি। এ কারণে কোন প্রতারণা বা অমিতব্যায়ী হয়ে কোন অনিশ্চিত বা আইনি পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে চায় না গ্রামের সহজ সরল মানুষ।

দেশে ব্যাংক ঋণের এক বিশাল পরিমাণ যেখানে খেলাপি বা অনাদায়ী হয়ে আছে বছরের পর বছর। বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে কিন্তু যথাসময়ে পরিশোধ না করায় তা খেলাপি ঋণে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। পুঁজির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে, অর্থনীতি গতিহীন হয়ে পড়ছে। সে প্রেক্ষাপটে গ্রামের মানুষ আত্মমর্যাদাবোধ আর ঋণ পরিশোধের আবহমান হালখাতা সংস্কৃতির অনুশীলনের ধারাবাহিকতায় হাসিমুখে পরিশোধ করে দিচ্ছে সরকারি অথবা বেসরকারি ঋণ। গ্রামের মানুষের ঋণ পরিশোধের এই ইতিবাচক ধারার প্রতিফলন হোক শহরেও। খেলাপি ঋণের অপছায়ামুক্ত হোক প্রতিটি বাংলা নতুন বছর।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র]