বাঙালির মহামিলনের দিন

সজীব ওয়াফি

বছর পেরিয়ে দুয়ারে হাজির হয়েছে পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। ১৪২৯ বঙ্গাব্দ কালের যাত্রা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে বাঙালির এক মহামিলনের দিন। সব বাঙালি যৌথভাবে পালন করতে পহেলা বৈশাখ ব্যতীত আর কোন উৎসব নেই। দুই ঈদ, পূজায় সম্প্রীতি সৌহার্দ্য থাকলেও সেটা ধর্মীয় উৎস। আবার একুশে ফেব্রুয়ারি বা জাতীয় দিবসগুলো আনন্দ উৎসব নয়। এ কারণে সারা বছর আমরা যেমন উন্মুখ হয়ে থাকি কবে আসবে পহেলা বৈশাখ, নানা ঢঙে নানা সাজে সাজাবো; ঠিক পাহাড়ে কিংবা সমতলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মানুষের ভেতরেও থাকে নানা আয়োজন। তারা আয়োজন করে বৈসাবির।

পাকিস্তান সরকার সব সময়ই বাঙালির সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তা বিকাশের অন্তরায় ছিল। বাঙালিও নানা দমনপীড়ন উপেক্ষা করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬৭ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পহেলা বৈশাখের সরকারি ছুটি বাতিল করলেন। ঘোষণা দিলেন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ, রবীন্দ্রসংগীত ইসলামবিরোধী। ছায়ানট সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের উদ্যাপন শুরু করল; আইয়ুব খানের চোখ রাঙানি শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকেনি। মঙ্গল শোভাযাত্রাও প্রায় একেইভাবে প্রতিবাদের সাংস্কৃতিক প্রকাশ। তবে মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকার আগে শুরু হয়েছে যশোরে; ১৯৮৫ সালে চারুপিঠ নামক এক আর্ট স্কুলের হাত ধরে। বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী আবরণের মাধ্যমে প্রতিবাদ ফুটিয়ে তোলা এই আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক দিক। আয়োজকের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এতে অংশগ্রহণ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা। যাহোক UNESCO কর্তৃক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইনটেনজিবল হেরিটেজ ধারায় স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের বাঙালিত্বের অহংকার।

আশির দশকে শুরু হলো পান্তা ইলিশের উৎপাত। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১৯৮৪ সালে ‘দৈনিক দেশ’ পত্রিকার কার্যালয়ে এর উৎপত্তি। সামরিক সরকারের রোষানলে পরে পত্রিকাটি বন্ধ ছিল। কোন কাজ নেই, এ রকম সময়ে পত্রিকাটির দায়িত্বশীলেরা পহেলা বৈশাখের দিনে রমনার বটমূলের দক্ষিণ পাশে গাছের নিচে পান্তা ভাতের দোকান দিয়ে বসলেন। বাঙালিয়ানার স্মরণে খাওয়ার উপকরণ— কাঁচা পেঁয়াজ-মরিচ, আলু ভর্তা আর ডালের বড়ার সঙ্গে আগের দিন রান্না করা লাল বিরই চালের পান্তা। পরবর্তী সময়ে সেটাকে রূপ নেয় ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার অহংকারে। বৈশাখের দিন এক প্লেট পান্তা-ইলিশ বিক্রি হয় হাজার টাকারও ওপরে। একে তো বৈশাখ মাস ইলিশের মৌসুম না, তার ওপরে অস্বাভাবিক চাহিদায় ইলিশের দামে ডাকাতি চলে। এক কেজি ইলিশের দাম পৌঁছায় ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি। কথা হলো যারা এই ইলিশ খায়, তারা এত টাকা পায় কোথায়? অবশ্যই যারা লুটেরা, বৈষম্যের প্রতীক, সমাজের বিষফোঁড়া তাদের লুটপাটে। তারা বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিবন্ধক।

বৈশাখ পত্তনের গোড়ার দিক থেকে গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরাও বৈশাখ উদ্যাপন করতেন। তবে সেটা ভিন্ন কায়দায়। তাদের উদ্দেশ্যেও ভিন্ন, ব্যবসায়িক। তারা খুলে বসতেন হালখাতা অনুষ্ঠান। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কাগজ ত্রিভুজ আকৃতিতে কেটে দড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দোকানটি সাজান। ভেতরটায় সাজান বাসর ঘরে ব্যবহৃত প্লাস্টিক কাগজের নানা ফুল দিয়ে। কেউ কেউ দুটি কলাগাছ, মঙ্গলঘট এবং আমপাতা দিয়ে প্রবেশদ্বার তৈরি করেন। সকাল থেকে খদ্দের আসতে থাকে; বাকির খাতা পরিশোধ করেন, যাদের বাকি নেই তারা অগ্রিম কিছু টাকা হালখাতায় জমা রাখেন। সকলকে মিষ্টিমুখ করে খোশমেজাজে কথাবার্তা বলেন। ক্রেতা-বিক্রেতার ভেতরে গড়ে ওঠে সৌহার্দ্য ভাব-বিনিময়। তবে হালখাতার এই আয়োজনটা এখন তেমন একটা নেই, বহুলাংশে কমে গেছে; রয়ে সয়ে পুরান ঢাকায় এবং গ্রামের দিকে কিছুটা চলমান আছে। এই যে কত কিছুই না থাকা এর দায় আমাদের সচেতন ব্যক্তিদের, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর। সংস্কৃতির ধারা রক্ষার্থে দলবল নিয়ে আমাদের ছুটতে হবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। উদ্বেলিত করতে হবে ঐতিহ্যবাহী যাত্রায়, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারিসারি আর মুর্শিদি গানে। ছুটতে হবে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ধারা পুনরুজ্জীবনে লোকজ সংস্কৃতিতে।

মানুষের আচার-আচরণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংস্কৃতির যোগ-বিয়োগ হয়। এটা চিরাচরিত নিয়মিত। তেমনি যুগের পরিক্রমায় আমাদের পহেলা বৈশাখ নতুনভাবে অলংকৃত হচ্ছে। অনেক জিনিস নেই হয়ে গেছে, আবার অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে। যে জিনিস চলে গেছে, সে আর ফিরবে না এমন কিছু না। তাকে ফেরানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন মননের এবং আমাদের সামষ্টিক স্বদিচ্ছা। কাজেই আমাদের সাংস্কৃতিক ধারা ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকুক। পহেলা বৈশাখে জগতের সব গ্লানি দূর হয়ে যাক এ প্রার্থনা। করোনা মহামারী-পরবর্তী সুচিসিগ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের পৃথিবী। সবাইকে বৈশাখী শুভেচ্ছা।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

বাঙালির মহামিলনের দিন

সজীব ওয়াফি

বছর পেরিয়ে দুয়ারে হাজির হয়েছে পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। ১৪২৯ বঙ্গাব্দ কালের যাত্রা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে বাঙালির এক মহামিলনের দিন। সব বাঙালি যৌথভাবে পালন করতে পহেলা বৈশাখ ব্যতীত আর কোন উৎসব নেই। দুই ঈদ, পূজায় সম্প্রীতি সৌহার্দ্য থাকলেও সেটা ধর্মীয় উৎস। আবার একুশে ফেব্রুয়ারি বা জাতীয় দিবসগুলো আনন্দ উৎসব নয়। এ কারণে সারা বছর আমরা যেমন উন্মুখ হয়ে থাকি কবে আসবে পহেলা বৈশাখ, নানা ঢঙে নানা সাজে সাজাবো; ঠিক পাহাড়ে কিংবা সমতলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মানুষের ভেতরেও থাকে নানা আয়োজন। তারা আয়োজন করে বৈসাবির।

পাকিস্তান সরকার সব সময়ই বাঙালির সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তা বিকাশের অন্তরায় ছিল। বাঙালিও নানা দমনপীড়ন উপেক্ষা করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬৭ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পহেলা বৈশাখের সরকারি ছুটি বাতিল করলেন। ঘোষণা দিলেন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ, রবীন্দ্রসংগীত ইসলামবিরোধী। ছায়ানট সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের উদ্যাপন শুরু করল; আইয়ুব খানের চোখ রাঙানি শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকেনি। মঙ্গল শোভাযাত্রাও প্রায় একেইভাবে প্রতিবাদের সাংস্কৃতিক প্রকাশ। তবে মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকার আগে শুরু হয়েছে যশোরে; ১৯৮৫ সালে চারুপিঠ নামক এক আর্ট স্কুলের হাত ধরে। বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী আবরণের মাধ্যমে প্রতিবাদ ফুটিয়ে তোলা এই আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক দিক। আয়োজকের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এতে অংশগ্রহণ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা। যাহোক UNESCO কর্তৃক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইনটেনজিবল হেরিটেজ ধারায় স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের বাঙালিত্বের অহংকার।

আশির দশকে শুরু হলো পান্তা ইলিশের উৎপাত। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১৯৮৪ সালে ‘দৈনিক দেশ’ পত্রিকার কার্যালয়ে এর উৎপত্তি। সামরিক সরকারের রোষানলে পরে পত্রিকাটি বন্ধ ছিল। কোন কাজ নেই, এ রকম সময়ে পত্রিকাটির দায়িত্বশীলেরা পহেলা বৈশাখের দিনে রমনার বটমূলের দক্ষিণ পাশে গাছের নিচে পান্তা ভাতের দোকান দিয়ে বসলেন। বাঙালিয়ানার স্মরণে খাওয়ার উপকরণ— কাঁচা পেঁয়াজ-মরিচ, আলু ভর্তা আর ডালের বড়ার সঙ্গে আগের দিন রান্না করা লাল বিরই চালের পান্তা। পরবর্তী সময়ে সেটাকে রূপ নেয় ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার অহংকারে। বৈশাখের দিন এক প্লেট পান্তা-ইলিশ বিক্রি হয় হাজার টাকারও ওপরে। একে তো বৈশাখ মাস ইলিশের মৌসুম না, তার ওপরে অস্বাভাবিক চাহিদায় ইলিশের দামে ডাকাতি চলে। এক কেজি ইলিশের দাম পৌঁছায় ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি। কথা হলো যারা এই ইলিশ খায়, তারা এত টাকা পায় কোথায়? অবশ্যই যারা লুটেরা, বৈষম্যের প্রতীক, সমাজের বিষফোঁড়া তাদের লুটপাটে। তারা বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিবন্ধক।

বৈশাখ পত্তনের গোড়ার দিক থেকে গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরাও বৈশাখ উদ্যাপন করতেন। তবে সেটা ভিন্ন কায়দায়। তাদের উদ্দেশ্যেও ভিন্ন, ব্যবসায়িক। তারা খুলে বসতেন হালখাতা অনুষ্ঠান। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কাগজ ত্রিভুজ আকৃতিতে কেটে দড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দোকানটি সাজান। ভেতরটায় সাজান বাসর ঘরে ব্যবহৃত প্লাস্টিক কাগজের নানা ফুল দিয়ে। কেউ কেউ দুটি কলাগাছ, মঙ্গলঘট এবং আমপাতা দিয়ে প্রবেশদ্বার তৈরি করেন। সকাল থেকে খদ্দের আসতে থাকে; বাকির খাতা পরিশোধ করেন, যাদের বাকি নেই তারা অগ্রিম কিছু টাকা হালখাতায় জমা রাখেন। সকলকে মিষ্টিমুখ করে খোশমেজাজে কথাবার্তা বলেন। ক্রেতা-বিক্রেতার ভেতরে গড়ে ওঠে সৌহার্দ্য ভাব-বিনিময়। তবে হালখাতার এই আয়োজনটা এখন তেমন একটা নেই, বহুলাংশে কমে গেছে; রয়ে সয়ে পুরান ঢাকায় এবং গ্রামের দিকে কিছুটা চলমান আছে। এই যে কত কিছুই না থাকা এর দায় আমাদের সচেতন ব্যক্তিদের, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর। সংস্কৃতির ধারা রক্ষার্থে দলবল নিয়ে আমাদের ছুটতে হবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। উদ্বেলিত করতে হবে ঐতিহ্যবাহী যাত্রায়, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারিসারি আর মুর্শিদি গানে। ছুটতে হবে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ধারা পুনরুজ্জীবনে লোকজ সংস্কৃতিতে।

মানুষের আচার-আচরণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংস্কৃতির যোগ-বিয়োগ হয়। এটা চিরাচরিত নিয়মিত। তেমনি যুগের পরিক্রমায় আমাদের পহেলা বৈশাখ নতুনভাবে অলংকৃত হচ্ছে। অনেক জিনিস নেই হয়ে গেছে, আবার অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে। যে জিনিস চলে গেছে, সে আর ফিরবে না এমন কিছু না। তাকে ফেরানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন মননের এবং আমাদের সামষ্টিক স্বদিচ্ছা। কাজেই আমাদের সাংস্কৃতিক ধারা ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকুক। পহেলা বৈশাখে জগতের সব গ্লানি দূর হয়ে যাক এ প্রার্থনা। করোনা মহামারী-পরবর্তী সুচিসিগ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের পৃথিবী। সবাইকে বৈশাখী শুভেচ্ছা।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]