নববর্ষ ও বাঙালির আত্মপরিচয়

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

সারা বছরের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন সহজেই মনে রাখা যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, পহেলা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, এগারোই জ্যৈষ্ঠ, যোলোই ডিসেম্বর। এসব দিন মনে মনে নাড়াচাড়া করলে বড়ো চমৎকার ভাবের উদয় হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি, আটই ফাল্গুন নয়; ছাব্বিশে মার্চ, এগারোই চৈত্র নয়; পঁচিশে বৈশাখ, নয়ই মে নয়; এগারোই জ্যৈষ্ঠ, ছাব্বিশে মে নয়।

আমাদের জাতীয় দিবসগুলোর সঙ্গে ইংরেজি তারিখের বা বাংলা তারিখের পূর্বোক্ত সম্পর্ক কেবল সাম্প্রতিক বছরের। সত্যি কথা বলতে কি ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির একুশে ফাল্গুনের কত তারিখ পড়েছিল আমাদের অনেকেরই জানা নেই।

আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো- পহেলা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, এগারোই জ্যৈষ্ঠ, এ দিনগুলো যেসব ঘটনার জন্য স্মরণীয় সেসব ঘটনা ঘটেছে অনেক আগে। সাম্প্রতিক কালের সব স্মরণীয় ঘটনাই আমরা ইংরেজি তারিখ দিয়ে চিহ্নিত করেছি। নজরুল ইসলামের জন্মদিন এগারোই জ্যৈষ্ঠ কিন্তু মৃত্যু দিন কবে আমাদের সকলের মনে পড়ে না। ঊনত্রিশে বা ত্রিশে আগস্টের কথা বলবেন যারা সচেতন। বারোই ভাদ্রের কথা মনে নেই কারোরই। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দিন বাইশে শ্রাবণ।

রবীন্দ্র-নজরুলের জন্মদিন আমরা বাংলা তারিখ দিয়ে মনে রাখি। অথচ শহীদ দিবস বা স্বাধীনতা দিবস ইংরেজি তারিখ দিয়ে। এ যোগাযোগ কি কেবলই কাকতালীয়?

যদি এমন ধরে নেয়া যায় যে, বর্তমান পৃথিবীতে পশ্চিমা রীতিনীতির সঙ্গে মিল রেখেই সব কাজকর্ম চলে তাই সর্বত্রই ইংরেজি পঞ্জিকার নিয়মে সময় নির্ণয়ের বিধান মেনে নেয়া হয়েছে। আমরাও মেনে নিয়েছি। সময় নির্ণয়ের একটি সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি না-থাকলে বর্তমানে পৃথিবীতে বাস করা যাবে না। তাহলে পঁচিশে বৈশাখ, এগারোই জ্যৈষ্ঠের ব্যাখ্যা কি? না-কি এই সত্যি যে কিছু কিছু পালনীয় দিন বিশেষ কোনো কারণে আমরা বাংলা তারিখে মনে রাখি, পালন করি। যেমন পহেলা বৈশাখ। চৌদ্দোই/পনেরোই এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে- এ কথা কি বলা যায়? আর ও-রকম বলবার প্রয়োজনই-বা কী?। আর একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা-পরবর্তী সব স্মরণীয় দিনই আমরা ইংরেজি তারিখ দিয়ে শনাক্ত করেছি। অবশ্য তার আগেও করেছি। পশ্চিমা কায়দায় লেখাপড়া শেখা আমরা পশ্চিমী পণ্ডিতদের লেখা ইতিহাস পড়ে নিজেদের সব বিগত ঘটনা জেনেছি, আমাদের আর কী-ই-বা করার ছিল।

এই সবই হয়তো সত্যি। দিন-তারিখ শনাক্ত করার ব্যাপারে প্রয়োজনটাই হয়তো মুখ্য। কিন্তু প্রয়োজনটা কার? কেবল পশ্চিমা শিক্ষিত সমাজেরই কি? আমাদের দেশে শতকরা আশি/পঁচাশি ভাগ লোক যারা গ্রামে বাস করেন, শতকরা পঁচাত্তর

জন লোক যাদের অক্ষর পরিচয় নেই, তাদের এই সব স্মরণীয়, পালনীয় দিন মনে রাখবার কোনো প্রয়োজন নেই? ইংরেজি তারিখের হিসাব তাদের খুব ভালো রপ্ত আছে- এমন কথা কেউ বলবেন না নিশ্চয়ই। বৈশাখ থেকে আরম্ভ করে চৈত্র অবধি এ বারো মাসের প্রতিটি দিনের হিসাব তারা বাংলা পঞ্জিকার বিধানে করতেই অভ্যস্ত। অন্য হিসাব তারা জানেন না; এমনকি অনেকে তাদের দিন তারিখ খরা, বর্ষা ইত্যকার ঋতুর হিসাবেও করে থাকেন। তাহলে কি ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াচ্ছে না যে, উনিশ শ’ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের কথা মনে রাখবার প্রয়োজন কেবল শহরবাসী শিক্ষিতদেরই? কেননা গ্রামবাসী নিরক্ষরদের হিসাবে উনিশ শ’ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি অপরিচিত।

অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বাংলা বছরকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারে শহুরে বাঙালিদেরই উৎসাহ বেশি। নতুন বছরের আরম্ভ গ্রামীণ জীবনে সাড়া জাগায় না এমন নয়। মেলা বসে, আড়ংয়ে নানারকম তামাশা হয়, পট, পুতুল, চালুনী, ডালা, হাঁড়ি এসব বিক্রি হয়; কিন্তু শহরে বর্ষবরণ উৎসবের কাছে ওসব কিছু নয়। শহুরেরা যে কেবল নাচ-গানবাজনা-নাটকেই দিনটি ভরে দেন তা নয়, হাতের কাজ ও ডিস্কো ক্যাসেট বিক্রিরও ব্যবস্থা করেন। পহেলা বৈশাখে হালখাতার দিন মহাজনের গদিতে উপস্থিত হওয়ার দায় তো তাদের নেই। আমাদের পণ্ডিতেরা বলে থাকেন ‘বাংলা নববর্ষ’ বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত অর্থবহ দিন। অনুষ্ঠান উৎসবের মাধ্যমে দিনটিকে পালন করা বাঙালি সংস্কৃতির অতি প্রাচীন রীতি। ব্যবসায়ীরা এ দিন হালখাতা খোলে ও গ্রামেগঞ্জে মেলা শুরু হয়। তবে গ্রামেগঞ্জে, এর ব্যাপ্তি কি পরিমাণ তার কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।

অবশ্য একথা সত্যি যে, ‘পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে উৎসবটি ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল এবং নববর্ষ পালনের খবরও ধীরে ধীরে কমে আসছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের পরবর্তী বছরগুলোতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৬৪ সালে তথা ১৩৭১ সালের পহেলা বৈশাখ প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। প্রাদেশিক সরকার ওই বছরই সর্বপ্রথম দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে এবং সেদিন ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভূতপূর্ব জনসমাগম দেখা যায়, শোনা যায়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঐকতান গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে এত দর্শক-শ্রোতা ছিল যে, ভিড়ের চাপে কয়েকজন আহত হয়।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শক সংখ্যা দেখে কোন কোন পত্রিকায় বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। উদ্ধৃত রচনার শেষ বাক্যটি প্রণিধানযোগ্য। আইয়ুব স্নেহধন্য মোনায়েম খানের হাত থেকে উপাধি নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা অস্বীকার করেন বলেই ওই হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়।

প্রসঙ্গ ঘোলাটে করে লাভ নেই। স্পষ্টত বাংলা বর্ষ নির্ণয়ের সঙ্গে আবহমান গ্রাম-বাংলার অবিচ্ছিন্ন, আত্মিক যোগাযোগ আর আধুনিক শহুরে বাংলার সঙ্গে ইংরেজি বছরের। তবে কখনও কখনও কিছু ঘটে যখন ওই বাঙালিত্বের পেছনে এসে দাঁড়ানো ছাড়া শহুরেদেরও কোনো উপায় থাকে না।

সময় পরিমাপের জন্য একটি পদ্ধতির প্রয়োজন আছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের হিসাব রাখার জন্য একটি উপায় তো চাই। খ্রিস্টাব্দ, সংবৎ, শকাব্দ, হিজরি ঐ-রকম এক-একটি পদ্ধতি। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এই সব পদ্ধতির ব্যবহার অত্যন্ত অর্থবহ। এ ব্যবহারের মধ্যে কেবল প্রয়োজনই নয়, ব্যবহারকারীর সংস্কৃতি চেতনা ও আত্মপরিচয় ফুটে ওঠে।

তাহলে কি বাংলা সন-তারিখের সর্বব্যাপী প্রচলন বা বাংলা ভাষার অবাধ ব্যবহারেই আমাদের আত্মপরিচয়জনিত প্রশ্নের জবাব দেবে? অবশ্যই নয়। আসল সমস্যা হচ্ছে সেই মন- যেখান থেকে বাংলা তারিখের ব্যবহার বা জীবনের সর্বস্তরে প্রকৃত বাংলা ভাষায় ব্যবহারের জন্য কোনো তাগিদ উৎসারিত হয় না; বাংলা হরফে ইংরেজি নামের সাইনবোর্ডে এক লিখে আর ইংরেজি নকলে বাংলা কথার গান এবং ছবি বানিয়ে যেমন তৃপ্তি পায়। সমস্যা হচ্ছে সেই বোধ- যা যে কোন উপায়ে নিজ স্বার্থ উদ্ধারে বাধাগ্রস্ত নয়। ওই মানসিকতা ও মূল্যবোধের বিসর্জনই বাঙালির জন্য প্রকৃত নববর্ষের সূচনা করবে।

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

নববর্ষ ও বাঙালির আত্মপরিচয়

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

image

প্রচ্ছদ : কাইয়ুম চৌধুরী

সারা বছরের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন সহজেই মনে রাখা যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, পহেলা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, এগারোই জ্যৈষ্ঠ, যোলোই ডিসেম্বর। এসব দিন মনে মনে নাড়াচাড়া করলে বড়ো চমৎকার ভাবের উদয় হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি, আটই ফাল্গুন নয়; ছাব্বিশে মার্চ, এগারোই চৈত্র নয়; পঁচিশে বৈশাখ, নয়ই মে নয়; এগারোই জ্যৈষ্ঠ, ছাব্বিশে মে নয়।

আমাদের জাতীয় দিবসগুলোর সঙ্গে ইংরেজি তারিখের বা বাংলা তারিখের পূর্বোক্ত সম্পর্ক কেবল সাম্প্রতিক বছরের। সত্যি কথা বলতে কি ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির একুশে ফাল্গুনের কত তারিখ পড়েছিল আমাদের অনেকেরই জানা নেই।

আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো- পহেলা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, এগারোই জ্যৈষ্ঠ, এ দিনগুলো যেসব ঘটনার জন্য স্মরণীয় সেসব ঘটনা ঘটেছে অনেক আগে। সাম্প্রতিক কালের সব স্মরণীয় ঘটনাই আমরা ইংরেজি তারিখ দিয়ে চিহ্নিত করেছি। নজরুল ইসলামের জন্মদিন এগারোই জ্যৈষ্ঠ কিন্তু মৃত্যু দিন কবে আমাদের সকলের মনে পড়ে না। ঊনত্রিশে বা ত্রিশে আগস্টের কথা বলবেন যারা সচেতন। বারোই ভাদ্রের কথা মনে নেই কারোরই। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দিন বাইশে শ্রাবণ।

রবীন্দ্র-নজরুলের জন্মদিন আমরা বাংলা তারিখ দিয়ে মনে রাখি। অথচ শহীদ দিবস বা স্বাধীনতা দিবস ইংরেজি তারিখ দিয়ে। এ যোগাযোগ কি কেবলই কাকতালীয়?

যদি এমন ধরে নেয়া যায় যে, বর্তমান পৃথিবীতে পশ্চিমা রীতিনীতির সঙ্গে মিল রেখেই সব কাজকর্ম চলে তাই সর্বত্রই ইংরেজি পঞ্জিকার নিয়মে সময় নির্ণয়ের বিধান মেনে নেয়া হয়েছে। আমরাও মেনে নিয়েছি। সময় নির্ণয়ের একটি সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি না-থাকলে বর্তমানে পৃথিবীতে বাস করা যাবে না। তাহলে পঁচিশে বৈশাখ, এগারোই জ্যৈষ্ঠের ব্যাখ্যা কি? না-কি এই সত্যি যে কিছু কিছু পালনীয় দিন বিশেষ কোনো কারণে আমরা বাংলা তারিখে মনে রাখি, পালন করি। যেমন পহেলা বৈশাখ। চৌদ্দোই/পনেরোই এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে- এ কথা কি বলা যায়? আর ও-রকম বলবার প্রয়োজনই-বা কী?। আর একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা-পরবর্তী সব স্মরণীয় দিনই আমরা ইংরেজি তারিখ দিয়ে শনাক্ত করেছি। অবশ্য তার আগেও করেছি। পশ্চিমা কায়দায় লেখাপড়া শেখা আমরা পশ্চিমী পণ্ডিতদের লেখা ইতিহাস পড়ে নিজেদের সব বিগত ঘটনা জেনেছি, আমাদের আর কী-ই-বা করার ছিল।

এই সবই হয়তো সত্যি। দিন-তারিখ শনাক্ত করার ব্যাপারে প্রয়োজনটাই হয়তো মুখ্য। কিন্তু প্রয়োজনটা কার? কেবল পশ্চিমা শিক্ষিত সমাজেরই কি? আমাদের দেশে শতকরা আশি/পঁচাশি ভাগ লোক যারা গ্রামে বাস করেন, শতকরা পঁচাত্তর

জন লোক যাদের অক্ষর পরিচয় নেই, তাদের এই সব স্মরণীয়, পালনীয় দিন মনে রাখবার কোনো প্রয়োজন নেই? ইংরেজি তারিখের হিসাব তাদের খুব ভালো রপ্ত আছে- এমন কথা কেউ বলবেন না নিশ্চয়ই। বৈশাখ থেকে আরম্ভ করে চৈত্র অবধি এ বারো মাসের প্রতিটি দিনের হিসাব তারা বাংলা পঞ্জিকার বিধানে করতেই অভ্যস্ত। অন্য হিসাব তারা জানেন না; এমনকি অনেকে তাদের দিন তারিখ খরা, বর্ষা ইত্যকার ঋতুর হিসাবেও করে থাকেন। তাহলে কি ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াচ্ছে না যে, উনিশ শ’ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের কথা মনে রাখবার প্রয়োজন কেবল শহরবাসী শিক্ষিতদেরই? কেননা গ্রামবাসী নিরক্ষরদের হিসাবে উনিশ শ’ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি অপরিচিত।

অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বাংলা বছরকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারে শহুরে বাঙালিদেরই উৎসাহ বেশি। নতুন বছরের আরম্ভ গ্রামীণ জীবনে সাড়া জাগায় না এমন নয়। মেলা বসে, আড়ংয়ে নানারকম তামাশা হয়, পট, পুতুল, চালুনী, ডালা, হাঁড়ি এসব বিক্রি হয়; কিন্তু শহরে বর্ষবরণ উৎসবের কাছে ওসব কিছু নয়। শহুরেরা যে কেবল নাচ-গানবাজনা-নাটকেই দিনটি ভরে দেন তা নয়, হাতের কাজ ও ডিস্কো ক্যাসেট বিক্রিরও ব্যবস্থা করেন। পহেলা বৈশাখে হালখাতার দিন মহাজনের গদিতে উপস্থিত হওয়ার দায় তো তাদের নেই। আমাদের পণ্ডিতেরা বলে থাকেন ‘বাংলা নববর্ষ’ বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত অর্থবহ দিন। অনুষ্ঠান উৎসবের মাধ্যমে দিনটিকে পালন করা বাঙালি সংস্কৃতির অতি প্রাচীন রীতি। ব্যবসায়ীরা এ দিন হালখাতা খোলে ও গ্রামেগঞ্জে মেলা শুরু হয়। তবে গ্রামেগঞ্জে, এর ব্যাপ্তি কি পরিমাণ তার কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।

অবশ্য একথা সত্যি যে, ‘পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে উৎসবটি ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল এবং নববর্ষ পালনের খবরও ধীরে ধীরে কমে আসছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের পরবর্তী বছরগুলোতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৬৪ সালে তথা ১৩৭১ সালের পহেলা বৈশাখ প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। প্রাদেশিক সরকার ওই বছরই সর্বপ্রথম দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে এবং সেদিন ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভূতপূর্ব জনসমাগম দেখা যায়, শোনা যায়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঐকতান গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে এত দর্শক-শ্রোতা ছিল যে, ভিড়ের চাপে কয়েকজন আহত হয়।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শক সংখ্যা দেখে কোন কোন পত্রিকায় বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। উদ্ধৃত রচনার শেষ বাক্যটি প্রণিধানযোগ্য। আইয়ুব স্নেহধন্য মোনায়েম খানের হাত থেকে উপাধি নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা অস্বীকার করেন বলেই ওই হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়।

প্রসঙ্গ ঘোলাটে করে লাভ নেই। স্পষ্টত বাংলা বর্ষ নির্ণয়ের সঙ্গে আবহমান গ্রাম-বাংলার অবিচ্ছিন্ন, আত্মিক যোগাযোগ আর আধুনিক শহুরে বাংলার সঙ্গে ইংরেজি বছরের। তবে কখনও কখনও কিছু ঘটে যখন ওই বাঙালিত্বের পেছনে এসে দাঁড়ানো ছাড়া শহুরেদেরও কোনো উপায় থাকে না।

সময় পরিমাপের জন্য একটি পদ্ধতির প্রয়োজন আছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের হিসাব রাখার জন্য একটি উপায় তো চাই। খ্রিস্টাব্দ, সংবৎ, শকাব্দ, হিজরি ঐ-রকম এক-একটি পদ্ধতি। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এই সব পদ্ধতির ব্যবহার অত্যন্ত অর্থবহ। এ ব্যবহারের মধ্যে কেবল প্রয়োজনই নয়, ব্যবহারকারীর সংস্কৃতি চেতনা ও আত্মপরিচয় ফুটে ওঠে।

তাহলে কি বাংলা সন-তারিখের সর্বব্যাপী প্রচলন বা বাংলা ভাষার অবাধ ব্যবহারেই আমাদের আত্মপরিচয়জনিত প্রশ্নের জবাব দেবে? অবশ্যই নয়। আসল সমস্যা হচ্ছে সেই মন- যেখান থেকে বাংলা তারিখের ব্যবহার বা জীবনের সর্বস্তরে প্রকৃত বাংলা ভাষায় ব্যবহারের জন্য কোনো তাগিদ উৎসারিত হয় না; বাংলা হরফে ইংরেজি নামের সাইনবোর্ডে এক লিখে আর ইংরেজি নকলে বাংলা কথার গান এবং ছবি বানিয়ে যেমন তৃপ্তি পায়। সমস্যা হচ্ছে সেই বোধ- যা যে কোন উপায়ে নিজ স্বার্থ উদ্ধারে বাধাগ্রস্ত নয়। ওই মানসিকতা ও মূল্যবোধের বিসর্জনই বাঙালির জন্য প্রকৃত নববর্ষের সূচনা করবে।