পহেলা বৈশাখের স্মৃতি

বিমল গুহ

গ্রামীণ পরিবেশে যে-কর্মব্যস্ততার মধ্যে মানুষ থাকে- তাতে কিছু-না-কিছু বিনোদনের প্রয়োজন হয়। তা মনের ক্লান্তি যেমন দূর করে, তেমনি সামনে চলার পথকেও সুগম করে তোলে। এভাবে প্রত্যেক সমাজে বিনোদনের নানান উপায় উদ্ভাবন করেছে মানুষ। পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এসব উৎসবাদির প্রচলন হয়েছে বাঙালি সমাজে। আমাদের সামাজিক পরিবেশেও নানা আয়োজনের ব্যবস্থা আছে, যা চলে এসেছে সংঘবদ্ধ সমাজ-ভাবনা থেকে। তেমনই উৎসব চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈখাখ। চৈত্রসংক্রান্তি বাংলাপঞ্জিকা অনুসারে চলমান বছরের শেষদিন, আর নূতন বছরের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ। বাঙালি সমাজে প্রচলিত রীতি অনুসারে বছরের শেষদিন বছর-বিদায়ের প্রস্তুতি, আর পরের দিন নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার আয়োজন থাকে। চলতি বছরের শেষদিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তিতে বাড়িতে-বাড়িতে টক, তিতা, অম্ল ইত্যাদি পঞ্চব্যঞ্জন ভোজনের রেওয়াজ আছে। আমরা ছোটবেলা থেকেই সেই আচারের সঙ্গে পরিচিত। আর পহেলা বৈশাখের দিন খই-নাড়ু ও নানান পদের মিষ্টি খাওয়া হয়। এর পেছনের যুক্তি বোঝা যায়- টক-ঝাল খেয়ে আগের বছর শেষ করে নতুন বছরে থেকে মিষ্টিমুখ হবে- যাতে সারাবছর মানুষের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করা হয়!

সেই কবে শিশুকাল পার করে এসেছি আমরা। তবু মনে হয়, বছরের এই একটি দিন আমাদের সঙ্গেই রয়েছে। ‘স্মৃতি বড়ো লোভাতুর, বিড়ালের মতো ঘুরে-ফিরে চারপাশে’। পহেলা বৈশাখের স্মৃতিও তেমন। দূর গাঁয়ের স্মৃতির কাছে এখনো ফিরে যাই প্রতিবছর। বড়ই মধুর সেই ফেলে-আসা শৈশবের দিন। এই এত বছর পেরিয়ে এসেও মনে হয়, প্রত্যহ ভোরে ঘুম থেকে উঠে একবার ছুটে যাই সেই গ্রামে- সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া গ্রাম। কী মধুর নাম- আমার মায়ের নাম যেন! আমার রক্তের স্রোতে উন্মাতাল বয়ে যাওয়া কেমন উজানে-ঢেউতোলা নামের সৌরভ, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় দিনের সৌরভ। সেইখানে কানামাছি, দাড়িয়াবান্দা, হা-ডু-ডু, চি-কুৎকুৎ-ছুট, বৈশাখী মেলা- আরও কত কি আনন্দ ছিলো আমাদের! পহেলা বৈশাখ ছিলো আমাদের অপেক্ষার এক নাম। নতুন কাপড়-জামা, মৌ-মৌ গন্ধে বিভোর হওয়ার সেই স্মৃতি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাল্লা-ছুট দিতাম পাড়ার সবাই। চৈত্রসংক্রান্তির নব সাজ- পুরনো বছরের বিদায়, আর নতুনের আহ্বান!

আমাদের কাজ ছিলো পাড়ায় পাড়ায় দলবেঁধে ছোটা। কোথায় ভাঁটফুল, কোথায় কাঠগোলাপের বন, কোথায় বেতসলতার ঝোপ- খুঁজে বের করা! বছরের শেষদিনে আমরাও ঘটা করে পুরানোকে বিদায় জানিয়েছি, পড়ার টেবিল, খাতাবই ঝাড়মোছ করেছি। এভাবে ঘরদোর পরিষ্কার করে নতুন বছরকে আহ্বান করেছি। মা-কে দেখেছি গোবরের ছিটা দিয়ে সারা উঠোন পবিত্র করতো। আমি শুনেছি, গোবরে জীবানু-প্রতিষেধক উপাদান আছে! গ্রামের মাটির ঘরের দেওয়ালেও গোবরের লেপন দেয়া হতো। বাড়ির প্রতিটি কক্ষের দরজায় ঝোলানো হতো গোছা-গোছা নিমপাতা, কাঠগোলাপের মালা। এটুকু জেনেছি যে, নিমপাতা বায়ুকে পরিশুদ্ধ করে। শুধু বাসগৃহ নয়, গোয়ালঘর থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘর, বাড়ির গেটেও থাকতো ভাঁটফুলের সাজ। ঘরের মেঝেয় নক্শা কাটতো কুলবধূরা। নিজেরা যেমন পরিশুদ্ধ হতাম, পাশাপাশি গৃহপালিত পশু- গরুছাগলগুলিকে পুকুরে বা নদীতে নিয়ে গোসল করানো হতো, আর গলায় ও কপালে ঝোলানো হতো ফুলের মালা- সেই কাঠগোলাপের মালা! এটাকে বলা হতো ‘বিষুব উৎসব’। স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় বলতো ‘বিউ পরব’! আমাদের পাশের জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামে এইদিন পালিত হতো ‘বৈসাবি’ উৎসব হিসেবে। তাদের সেই উৎসবও চলতো সপ্তাহব্যাপী। দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য আছে- উৎসব আর আনন্দের মধ্যে নববর্ষকে আহ্বান করা! এছাড়াও বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে আরও নানা ধরনের আনন্দোৎসব পালিত হয়ে আসছে বহুকাল থেকে। দুর্গাপূজা, ঈদউৎসব, দোলপূর্ণিমা, নবান্নের উৎসব ইত্যাদি নানা উৎসব পালিত হয় গ্রামে।

পহেলা বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সম্পর্ক আবহমান বাংলার। পহেলা বৈশাখের আগের দিনই চৈত্রসংক্রান্তি। এ এক মহা আনন্দের উপলক্ষ ছিলো গ্রামে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন আর-এক মহোৎসবের নাম ‘ক্ষেত্রপাল’-এর পূজা। বলা ভালো- ভূমি পূজার উৎসব। ক্ষেত্রপালের পূজাই মানে ভূমিদেবতার পূজা। সহজভাষায় ক্ষেত্র বা ভূ-পালকের পূজা। ক্ষেত্রপাল কৃষির লৌকিক দেবতা বিশেষ। এই পূজা কোথাও মূর্তির আকারে, আবার কোথাও কল্পিত-ঘট বানিয়ে করা হয়। লোকবিশ্বাস, ক্ষেত্রপালের কাছে মানত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। পহেলা বৈশাখের আগেরদিন শঙ্খনদীর তীরে বসতো এই আয়োজন, অর্থাৎ ক্ষেত্রপালের পূজা ও উৎসব। মানুষের ঢল নামতো। আমরা ছোটরাও যেতাম ক্ষেত্রপাল-এর উৎসব দেখতে। পূজার আশেপাশে মেলা বসে যেতো। ক্ষেত্রপাল রাগী দেবতা জানতাম। বড়োরা দেবতার উদ্দেশ্যে মন্ত্রপাঠ করতো, কোথাও-কোথাও হতো পশুবলিদানও।

লালসালু মোড়ানো দেবতার ঘট, লাল সিঁদুরে রাঙা মাটির বাসন ঘটিবাটি ইত্যাদি। এত লালের আয়োজন- শিশুমনে ভীতির উদ্রেক হতো। ক্ষেত্রপালের মেলা জমে উঠতো সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। মেলায় কাসর-ঘণ্টা বাজতো সারাক্ষণ। ঠাকুরের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে সেবকসেবিকা- যারা মাথা কুটে মরছে- তাদের বিশ্বাস, তারা দেবতার কৃপা লাভ করবে। মধ্যদুপুরে সূর্য যেন নেমে আসে দেবালয়ে। দেবতার প্রতিনিধি হয়ে কেউ কেউ দুঃখী-সরল মানুষদের পক্ষে দেবতার কাছে প্রার্থনা করতো। স্থানীয় ভাষায় এই প্রতিনিধিদের বলতো ‘গাছা’। তাদের বিশ্বাস যে, এতে দেবতার কৃপালাভে দুর্গতি থেকে মুক্তি পেতে তা সহায়ক হবে! আরেকটা কুসংস্কার চালু ছিলো গ্রামে, লোকে বলতো ‘বাণ মারা’, অর্থাৎ তান্ত্রিক মন্ত্রবলে অন্যকে বশীভূত করা। পছন্দের মানুষকে পাওয়ার জন্য ‘বাণ’ মারার প্রচলন হয় বলে লোকবিশ্বাস রয়েছে। সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণেও ‘বাণ’ মেরে প্রতিপক্ষকে কাবু করার চেষ্টা হতো বলেও কথিত আছে। এসব নানান ফন্দি! এই ‘বাণ’ খুলে দিতো এইসব ‘গাছা’। তারা বলে দিতো- তোমাদের ঘরের চালের অমুক কোণে ‘বাণ’টা আটকে আছে, সেটা মুক্ত না-করলে ওই মেয়ের আর বিয়ে হবে না। তার জন্য ভক্তদের দক্ষিণা দিতে হতো। ক্ষেত্রপালের ‘গাছা’ দৈববলে খুলে দিতো সেই ‘বাণ’, তাতে মুক্ত হতো সব বাধা!

ক্ষেত্রপালের পূজাকে ঘিরে জমে উঠতো মেলা। ছোটদের জন্য বাড়তি ফূর্তির মেলা। পূজারীর কাঁসর-ঘণ্টার সাথে সাথে আমাদের ছোটদের প্রত্যেকের হাতে বেজে উঠতো ভেঁপু। আমাদের মধ্যে কেউ ধুলিওড়ানো মাঠে ওড়াতো রঙিন ঘুড়ি- লাল-নীল-হলুদ-সবুজ। ক্ষেত্রপালের পূজা ছাড়াও অবস্থাপন্ন পরিবারগুলি আলাদাভাবে ঘরে-ঘরে আয়োজন করতো ভূমিপূজার! আমাদের বাড়ির পূজার বেদি বসাতো জল শুকিয়ে-যাওয়া পুকুরের ঘাটে। খাঁখাঁ রৌদ্দুর থেকে রেহাই পেতে বৃষ্টির বন্দনাও করা হতো। আমার মা’রও বিশ্বাস ছিলো- এই ভূমিপূজায় ধরিত্রীদেবতা খুশি হয়ে সন্তানের ও পরিবারের মঙ্গল সাধন করে থাকে। আমার বাড়তি আনন্দ হলো- পূজায় পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে থালা সাজিয়ে দেয়া হতো, সাথে থাকতো তেলেভাজা সিগ্ধডিম। ধরিত্রীদেবতা বা ভূমিদেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো এসব উপকরণ। পূজা শেষ হলে সেই উপকরণ আমাদেরকে প্রসাদ হিসেবে খেতে দিতো। আমি আর ছোটভাই নির্মল সেই ভাজা ডিমটির দিকে তাকিয়ে হাঁটুগেরে ঠাকুরের পাশে বসে থাকতাম পূজা শেষ না-হওয়া অবধি। পূজায় ব্রাহ্মণের বিলম্ব হলে আমরা একজন অন্যজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম, আর ফিস ফিস করে বলতাম- ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি শেষ করে না কেনো? আমরা কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো। পূজা শেষ হলে ডিমটা দুভাই ভাগ করে খেতাম।

সেরকম আরও একটা পূজার আয়োজনের অপেক্ষায় থাকতাম আমরা দুভাই। সেটা হলো ‘মঙ্গলচণ্ডীর পূজা’, বছরের যে কোনো সময় হয়। এখানে দেবীকে দেওয়া হতো- ক্ষীরের সন্দেশ। এই পূজাও শেষ-না-হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে বসে থাকা! অপেক্ষা ক্ষীরের সন্দেশ বা ক্ষীরের লেই খাওয়া। অন্য সময় ঝগড়াঝাটি করলেও তখন দুভাই এক। তখন আমাদের মধ্যে আর কোনো বিবাদ নেই। পূজা শেষে মা আমাদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন ক্ষিরের সন্দেশ। ছোটদের জন্য আনন্দ-আয়োজন হলেও এসব বাঙালি জনগোষ্ঠীর একাংশের লালিত সংস্কৃতি। আবার কিছু কিছু উৎসব আছে সর্বজনীন; যেমন- পহেলা বৈশাখ, নবান্নের উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি।

পুরানোকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে আহ্বান ঘটা করে আহ্বান জানানোই রেওয়াজ। চৈত্রসংক্রান্তির পরের দিন বাংলা নববর্ষ, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে ব্যবসায়ীদের জন্যও উৎসবের দিন। এদিন গ্রামের ছোট-বড় সব দোকানদার বা ব্যবসায়ীরা বকেয়া আদায়ের জন্য দোকানে-দোকানে খুলতো হালখাতা অর্থাৎ নতুন খাতা। পুরনো বছরের বকেয়া শোধ করে দিতো খরিদ্দারেরা। দোকানে-দোকানে থাকতো মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা। অনেক সময় বড়দের সঙ্গে ছোটরাও যেতো মিষ্টির লোভে! বাবার হাত ধরে আমিও দু-একবার গিয়েছি দোকানের ‘পুন্যাহ’ উৎসবে! এখনো গ্রামে, এমনকি শহরেও সেই প্রথা চালু আছে। সেদিন পার্বত্য রাজারাও পালন করে রাজস্ব আদায়ের বার্ষিক আয়োজন- পুণ্যাহ উৎসব। উনিশ শতকের মাঝামঝি সময় থেকে ‘পুণ্যাহ উৎসব’ বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন পালিত হয়ে আসছে। সাতচল্লিশের পর ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বাতিল হলে জমিদার, তালুকদারদের রাজস্ব আদায়ের এই পদ্ধতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে এখনও সে-পদ্ধতি চালু আছে। আমাদের কাছাকাছি বান্দরবানের বোমাংরাজার পুণ্যাহ দেখতে আমিও গিয়েছি। নির্দিষ্ট সময়ে রাজা রাজপোশাকে সিংহাসনে বসে থাকতেন; আর পার্বত্যঅঞ্চলে বসবাসরত অধিবাসীগণ খাজনা দিয়ে যেতো। এই উপলক্ষে নানা আয়োজন করা হয়। কথিত আছে- অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজদের দেওয়ানী লাভের পর প্রথম পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো মুর্শিদাবাদে ইংরেজদের রাজনৈতিক আবাসস্থলে। সেই পুণ্যাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি ক্লাইভ সভাপতিত্ব করেছিলেন।

এখনো গ্রামে গ্রামে পহেলা বৈশাখের দিন পুরানোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করে নিতে উৎসুক হয়ে ওঠে প্রতিটি মহল্লা। সবাই নতুন কাপড় পড়ে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। পুরো গ্রাম মহোৎসবে মেতে ওঠে। বড়দের জন্যও আনন্দের দিন। প্রত্যেক বাড়িতে নাড়ু, খই, মুড়ি-মুড়কি, আটকড়াই, বাতাসা, গজা, জিলিপি খাওয়ার উৎসব। কোনো কোনো বাড়িতে-বাড়িতে সপ্তপদী শাক-ডাটা নিরামিষ ভোজ। শুনেছি এসব নাকি ভেষজ ঔষধ- বছরান্তে একবার খেতে হয়। এতে অজানা রোগ-শোক নিরাময় হয়! কেউ বলে- তিতা খাওয়া। এই সপ্তপদের মধ্যে থাকতো- গিমাশাক, সর্ষেশাক, হলুদপাতা, পাটশাক, কলমীশাক, থানকুনিপাতা, নিমপাতা- এসব মিলে সপ্তপদ মেশানো সব্জি। তার সাথে কাঁচা কাঁঠাল, করলা, আলুরও মিশ্রণ থাকতো। বেশ উপাদেয় হতো শাক-ডাটার ব্যঞ্জন। এ সবের আয়োজন থাকতো প্রত্যেক ঘরে।

আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শঙ্খনদী। বৈশাখে নদী প্রায় শুকিয়ে যেতো। এই সময়টাকে হতো ভক্তদের বারুণী-স্নান। আর শুকনো চরে বসতো বারুণী-মেলা। মেলায় ছিলো- নাগরদোলা, জাদু, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, মোরগের লড়াই ইত্যাদির আয়োজন। বিকেল থেকে মধ্যরাত অবধি চলতো মেলা। আমরা কেউ ভেঁপু, কেউ বেলুন আর কেউ ঘুড়ির খেলায় মত্ত হতাম। দীর্ঘ নদী-চরে ঘুড়ি ওড়ানোর এই খেলা চলতো পরে আরও ৪/৫দিন। বৈশাখের দাবদাহেও আমাদের ক্ষান্তি ছিলো না। তখন গ্রীষ্মের ফল পাকতো। আমাদের ছিলো গ্রামের বড় কৃষি খামার। তরমুজ, বাঙ্গি নিজেদের ক্ষেতে গিয়ে ইচ্ছে মতো খেতাম, বন্ধুরা মিলে। পহেলা বৈশাখে সারা গ্রাম যেন উৎসবের গ্রাম, আমাদের বাঙালির গ্রাম। গ্রামে কোথাও ঢাকা শহরের বৈশাখী পান্তা-ইলিশের ব্যাপার ছিলো না। বৈশাখের পান্তা-ইলিশ শহরবাসীর সংযোজন। কারণ গ্রামের সব উপকরণ শহরে জোগাড় করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা পান্তা-ইলিশের নূতন সংস্কৃতি চালু করে। শহরের আর একটা বড় সংযোজন- মঙ্গলশোভাযাত্রা। এটা এখন পহেলা বৈশাখের প্রতীকের রূপ নিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে শান্তিযাত্রার ধারণা থেকে একসময় পহেলা বৈশাখে মঙ্গলশোভাযাত্রায় প্রচলন হয়ে যায়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ‘মঙ্গলশোভাযাত্রা’কে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা বাঙালির অর্জন, পহেলা বৈশাখের এক রূপময় স্মারক।

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

পহেলা বৈশাখের স্মৃতি

বিমল গুহ

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

গ্রামীণ পরিবেশে যে-কর্মব্যস্ততার মধ্যে মানুষ থাকে- তাতে কিছু-না-কিছু বিনোদনের প্রয়োজন হয়। তা মনের ক্লান্তি যেমন দূর করে, তেমনি সামনে চলার পথকেও সুগম করে তোলে। এভাবে প্রত্যেক সমাজে বিনোদনের নানান উপায় উদ্ভাবন করেছে মানুষ। পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এসব উৎসবাদির প্রচলন হয়েছে বাঙালি সমাজে। আমাদের সামাজিক পরিবেশেও নানা আয়োজনের ব্যবস্থা আছে, যা চলে এসেছে সংঘবদ্ধ সমাজ-ভাবনা থেকে। তেমনই উৎসব চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈখাখ। চৈত্রসংক্রান্তি বাংলাপঞ্জিকা অনুসারে চলমান বছরের শেষদিন, আর নূতন বছরের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ। বাঙালি সমাজে প্রচলিত রীতি অনুসারে বছরের শেষদিন বছর-বিদায়ের প্রস্তুতি, আর পরের দিন নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার আয়োজন থাকে। চলতি বছরের শেষদিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তিতে বাড়িতে-বাড়িতে টক, তিতা, অম্ল ইত্যাদি পঞ্চব্যঞ্জন ভোজনের রেওয়াজ আছে। আমরা ছোটবেলা থেকেই সেই আচারের সঙ্গে পরিচিত। আর পহেলা বৈশাখের দিন খই-নাড়ু ও নানান পদের মিষ্টি খাওয়া হয়। এর পেছনের যুক্তি বোঝা যায়- টক-ঝাল খেয়ে আগের বছর শেষ করে নতুন বছরে থেকে মিষ্টিমুখ হবে- যাতে সারাবছর মানুষের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করা হয়!

সেই কবে শিশুকাল পার করে এসেছি আমরা। তবু মনে হয়, বছরের এই একটি দিন আমাদের সঙ্গেই রয়েছে। ‘স্মৃতি বড়ো লোভাতুর, বিড়ালের মতো ঘুরে-ফিরে চারপাশে’। পহেলা বৈশাখের স্মৃতিও তেমন। দূর গাঁয়ের স্মৃতির কাছে এখনো ফিরে যাই প্রতিবছর। বড়ই মধুর সেই ফেলে-আসা শৈশবের দিন। এই এত বছর পেরিয়ে এসেও মনে হয়, প্রত্যহ ভোরে ঘুম থেকে উঠে একবার ছুটে যাই সেই গ্রামে- সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া গ্রাম। কী মধুর নাম- আমার মায়ের নাম যেন! আমার রক্তের স্রোতে উন্মাতাল বয়ে যাওয়া কেমন উজানে-ঢেউতোলা নামের সৌরভ, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় দিনের সৌরভ। সেইখানে কানামাছি, দাড়িয়াবান্দা, হা-ডু-ডু, চি-কুৎকুৎ-ছুট, বৈশাখী মেলা- আরও কত কি আনন্দ ছিলো আমাদের! পহেলা বৈশাখ ছিলো আমাদের অপেক্ষার এক নাম। নতুন কাপড়-জামা, মৌ-মৌ গন্ধে বিভোর হওয়ার সেই স্মৃতি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাল্লা-ছুট দিতাম পাড়ার সবাই। চৈত্রসংক্রান্তির নব সাজ- পুরনো বছরের বিদায়, আর নতুনের আহ্বান!

আমাদের কাজ ছিলো পাড়ায় পাড়ায় দলবেঁধে ছোটা। কোথায় ভাঁটফুল, কোথায় কাঠগোলাপের বন, কোথায় বেতসলতার ঝোপ- খুঁজে বের করা! বছরের শেষদিনে আমরাও ঘটা করে পুরানোকে বিদায় জানিয়েছি, পড়ার টেবিল, খাতাবই ঝাড়মোছ করেছি। এভাবে ঘরদোর পরিষ্কার করে নতুন বছরকে আহ্বান করেছি। মা-কে দেখেছি গোবরের ছিটা দিয়ে সারা উঠোন পবিত্র করতো। আমি শুনেছি, গোবরে জীবানু-প্রতিষেধক উপাদান আছে! গ্রামের মাটির ঘরের দেওয়ালেও গোবরের লেপন দেয়া হতো। বাড়ির প্রতিটি কক্ষের দরজায় ঝোলানো হতো গোছা-গোছা নিমপাতা, কাঠগোলাপের মালা। এটুকু জেনেছি যে, নিমপাতা বায়ুকে পরিশুদ্ধ করে। শুধু বাসগৃহ নয়, গোয়ালঘর থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘর, বাড়ির গেটেও থাকতো ভাঁটফুলের সাজ। ঘরের মেঝেয় নক্শা কাটতো কুলবধূরা। নিজেরা যেমন পরিশুদ্ধ হতাম, পাশাপাশি গৃহপালিত পশু- গরুছাগলগুলিকে পুকুরে বা নদীতে নিয়ে গোসল করানো হতো, আর গলায় ও কপালে ঝোলানো হতো ফুলের মালা- সেই কাঠগোলাপের মালা! এটাকে বলা হতো ‘বিষুব উৎসব’। স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় বলতো ‘বিউ পরব’! আমাদের পাশের জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামে এইদিন পালিত হতো ‘বৈসাবি’ উৎসব হিসেবে। তাদের সেই উৎসবও চলতো সপ্তাহব্যাপী। দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য আছে- উৎসব আর আনন্দের মধ্যে নববর্ষকে আহ্বান করা! এছাড়াও বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে আরও নানা ধরনের আনন্দোৎসব পালিত হয়ে আসছে বহুকাল থেকে। দুর্গাপূজা, ঈদউৎসব, দোলপূর্ণিমা, নবান্নের উৎসব ইত্যাদি নানা উৎসব পালিত হয় গ্রামে।

পহেলা বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সম্পর্ক আবহমান বাংলার। পহেলা বৈশাখের আগের দিনই চৈত্রসংক্রান্তি। এ এক মহা আনন্দের উপলক্ষ ছিলো গ্রামে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন আর-এক মহোৎসবের নাম ‘ক্ষেত্রপাল’-এর পূজা। বলা ভালো- ভূমি পূজার উৎসব। ক্ষেত্রপালের পূজাই মানে ভূমিদেবতার পূজা। সহজভাষায় ক্ষেত্র বা ভূ-পালকের পূজা। ক্ষেত্রপাল কৃষির লৌকিক দেবতা বিশেষ। এই পূজা কোথাও মূর্তির আকারে, আবার কোথাও কল্পিত-ঘট বানিয়ে করা হয়। লোকবিশ্বাস, ক্ষেত্রপালের কাছে মানত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। পহেলা বৈশাখের আগেরদিন শঙ্খনদীর তীরে বসতো এই আয়োজন, অর্থাৎ ক্ষেত্রপালের পূজা ও উৎসব। মানুষের ঢল নামতো। আমরা ছোটরাও যেতাম ক্ষেত্রপাল-এর উৎসব দেখতে। পূজার আশেপাশে মেলা বসে যেতো। ক্ষেত্রপাল রাগী দেবতা জানতাম। বড়োরা দেবতার উদ্দেশ্যে মন্ত্রপাঠ করতো, কোথাও-কোথাও হতো পশুবলিদানও।

লালসালু মোড়ানো দেবতার ঘট, লাল সিঁদুরে রাঙা মাটির বাসন ঘটিবাটি ইত্যাদি। এত লালের আয়োজন- শিশুমনে ভীতির উদ্রেক হতো। ক্ষেত্রপালের মেলা জমে উঠতো সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। মেলায় কাসর-ঘণ্টা বাজতো সারাক্ষণ। ঠাকুরের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে সেবকসেবিকা- যারা মাথা কুটে মরছে- তাদের বিশ্বাস, তারা দেবতার কৃপা লাভ করবে। মধ্যদুপুরে সূর্য যেন নেমে আসে দেবালয়ে। দেবতার প্রতিনিধি হয়ে কেউ কেউ দুঃখী-সরল মানুষদের পক্ষে দেবতার কাছে প্রার্থনা করতো। স্থানীয় ভাষায় এই প্রতিনিধিদের বলতো ‘গাছা’। তাদের বিশ্বাস যে, এতে দেবতার কৃপালাভে দুর্গতি থেকে মুক্তি পেতে তা সহায়ক হবে! আরেকটা কুসংস্কার চালু ছিলো গ্রামে, লোকে বলতো ‘বাণ মারা’, অর্থাৎ তান্ত্রিক মন্ত্রবলে অন্যকে বশীভূত করা। পছন্দের মানুষকে পাওয়ার জন্য ‘বাণ’ মারার প্রচলন হয় বলে লোকবিশ্বাস রয়েছে। সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণেও ‘বাণ’ মেরে প্রতিপক্ষকে কাবু করার চেষ্টা হতো বলেও কথিত আছে। এসব নানান ফন্দি! এই ‘বাণ’ খুলে দিতো এইসব ‘গাছা’। তারা বলে দিতো- তোমাদের ঘরের চালের অমুক কোণে ‘বাণ’টা আটকে আছে, সেটা মুক্ত না-করলে ওই মেয়ের আর বিয়ে হবে না। তার জন্য ভক্তদের দক্ষিণা দিতে হতো। ক্ষেত্রপালের ‘গাছা’ দৈববলে খুলে দিতো সেই ‘বাণ’, তাতে মুক্ত হতো সব বাধা!

ক্ষেত্রপালের পূজাকে ঘিরে জমে উঠতো মেলা। ছোটদের জন্য বাড়তি ফূর্তির মেলা। পূজারীর কাঁসর-ঘণ্টার সাথে সাথে আমাদের ছোটদের প্রত্যেকের হাতে বেজে উঠতো ভেঁপু। আমাদের মধ্যে কেউ ধুলিওড়ানো মাঠে ওড়াতো রঙিন ঘুড়ি- লাল-নীল-হলুদ-সবুজ। ক্ষেত্রপালের পূজা ছাড়াও অবস্থাপন্ন পরিবারগুলি আলাদাভাবে ঘরে-ঘরে আয়োজন করতো ভূমিপূজার! আমাদের বাড়ির পূজার বেদি বসাতো জল শুকিয়ে-যাওয়া পুকুরের ঘাটে। খাঁখাঁ রৌদ্দুর থেকে রেহাই পেতে বৃষ্টির বন্দনাও করা হতো। আমার মা’রও বিশ্বাস ছিলো- এই ভূমিপূজায় ধরিত্রীদেবতা খুশি হয়ে সন্তানের ও পরিবারের মঙ্গল সাধন করে থাকে। আমার বাড়তি আনন্দ হলো- পূজায় পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে থালা সাজিয়ে দেয়া হতো, সাথে থাকতো তেলেভাজা সিগ্ধডিম। ধরিত্রীদেবতা বা ভূমিদেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো এসব উপকরণ। পূজা শেষ হলে সেই উপকরণ আমাদেরকে প্রসাদ হিসেবে খেতে দিতো। আমি আর ছোটভাই নির্মল সেই ভাজা ডিমটির দিকে তাকিয়ে হাঁটুগেরে ঠাকুরের পাশে বসে থাকতাম পূজা শেষ না-হওয়া অবধি। পূজায় ব্রাহ্মণের বিলম্ব হলে আমরা একজন অন্যজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম, আর ফিস ফিস করে বলতাম- ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি শেষ করে না কেনো? আমরা কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো। পূজা শেষ হলে ডিমটা দুভাই ভাগ করে খেতাম।

সেরকম আরও একটা পূজার আয়োজনের অপেক্ষায় থাকতাম আমরা দুভাই। সেটা হলো ‘মঙ্গলচণ্ডীর পূজা’, বছরের যে কোনো সময় হয়। এখানে দেবীকে দেওয়া হতো- ক্ষীরের সন্দেশ। এই পূজাও শেষ-না-হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে বসে থাকা! অপেক্ষা ক্ষীরের সন্দেশ বা ক্ষীরের লেই খাওয়া। অন্য সময় ঝগড়াঝাটি করলেও তখন দুভাই এক। তখন আমাদের মধ্যে আর কোনো বিবাদ নেই। পূজা শেষে মা আমাদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন ক্ষিরের সন্দেশ। ছোটদের জন্য আনন্দ-আয়োজন হলেও এসব বাঙালি জনগোষ্ঠীর একাংশের লালিত সংস্কৃতি। আবার কিছু কিছু উৎসব আছে সর্বজনীন; যেমন- পহেলা বৈশাখ, নবান্নের উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি।

পুরানোকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে আহ্বান ঘটা করে আহ্বান জানানোই রেওয়াজ। চৈত্রসংক্রান্তির পরের দিন বাংলা নববর্ষ, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে ব্যবসায়ীদের জন্যও উৎসবের দিন। এদিন গ্রামের ছোট-বড় সব দোকানদার বা ব্যবসায়ীরা বকেয়া আদায়ের জন্য দোকানে-দোকানে খুলতো হালখাতা অর্থাৎ নতুন খাতা। পুরনো বছরের বকেয়া শোধ করে দিতো খরিদ্দারেরা। দোকানে-দোকানে থাকতো মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা। অনেক সময় বড়দের সঙ্গে ছোটরাও যেতো মিষ্টির লোভে! বাবার হাত ধরে আমিও দু-একবার গিয়েছি দোকানের ‘পুন্যাহ’ উৎসবে! এখনো গ্রামে, এমনকি শহরেও সেই প্রথা চালু আছে। সেদিন পার্বত্য রাজারাও পালন করে রাজস্ব আদায়ের বার্ষিক আয়োজন- পুণ্যাহ উৎসব। উনিশ শতকের মাঝামঝি সময় থেকে ‘পুণ্যাহ উৎসব’ বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন পালিত হয়ে আসছে। সাতচল্লিশের পর ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বাতিল হলে জমিদার, তালুকদারদের রাজস্ব আদায়ের এই পদ্ধতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে এখনও সে-পদ্ধতি চালু আছে। আমাদের কাছাকাছি বান্দরবানের বোমাংরাজার পুণ্যাহ দেখতে আমিও গিয়েছি। নির্দিষ্ট সময়ে রাজা রাজপোশাকে সিংহাসনে বসে থাকতেন; আর পার্বত্যঅঞ্চলে বসবাসরত অধিবাসীগণ খাজনা দিয়ে যেতো। এই উপলক্ষে নানা আয়োজন করা হয়। কথিত আছে- অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজদের দেওয়ানী লাভের পর প্রথম পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো মুর্শিদাবাদে ইংরেজদের রাজনৈতিক আবাসস্থলে। সেই পুণ্যাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি ক্লাইভ সভাপতিত্ব করেছিলেন।

এখনো গ্রামে গ্রামে পহেলা বৈশাখের দিন পুরানোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করে নিতে উৎসুক হয়ে ওঠে প্রতিটি মহল্লা। সবাই নতুন কাপড় পড়ে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। পুরো গ্রাম মহোৎসবে মেতে ওঠে। বড়দের জন্যও আনন্দের দিন। প্রত্যেক বাড়িতে নাড়ু, খই, মুড়ি-মুড়কি, আটকড়াই, বাতাসা, গজা, জিলিপি খাওয়ার উৎসব। কোনো কোনো বাড়িতে-বাড়িতে সপ্তপদী শাক-ডাটা নিরামিষ ভোজ। শুনেছি এসব নাকি ভেষজ ঔষধ- বছরান্তে একবার খেতে হয়। এতে অজানা রোগ-শোক নিরাময় হয়! কেউ বলে- তিতা খাওয়া। এই সপ্তপদের মধ্যে থাকতো- গিমাশাক, সর্ষেশাক, হলুদপাতা, পাটশাক, কলমীশাক, থানকুনিপাতা, নিমপাতা- এসব মিলে সপ্তপদ মেশানো সব্জি। তার সাথে কাঁচা কাঁঠাল, করলা, আলুরও মিশ্রণ থাকতো। বেশ উপাদেয় হতো শাক-ডাটার ব্যঞ্জন। এ সবের আয়োজন থাকতো প্রত্যেক ঘরে।

আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শঙ্খনদী। বৈশাখে নদী প্রায় শুকিয়ে যেতো। এই সময়টাকে হতো ভক্তদের বারুণী-স্নান। আর শুকনো চরে বসতো বারুণী-মেলা। মেলায় ছিলো- নাগরদোলা, জাদু, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, মোরগের লড়াই ইত্যাদির আয়োজন। বিকেল থেকে মধ্যরাত অবধি চলতো মেলা। আমরা কেউ ভেঁপু, কেউ বেলুন আর কেউ ঘুড়ির খেলায় মত্ত হতাম। দীর্ঘ নদী-চরে ঘুড়ি ওড়ানোর এই খেলা চলতো পরে আরও ৪/৫দিন। বৈশাখের দাবদাহেও আমাদের ক্ষান্তি ছিলো না। তখন গ্রীষ্মের ফল পাকতো। আমাদের ছিলো গ্রামের বড় কৃষি খামার। তরমুজ, বাঙ্গি নিজেদের ক্ষেতে গিয়ে ইচ্ছে মতো খেতাম, বন্ধুরা মিলে। পহেলা বৈশাখে সারা গ্রাম যেন উৎসবের গ্রাম, আমাদের বাঙালির গ্রাম। গ্রামে কোথাও ঢাকা শহরের বৈশাখী পান্তা-ইলিশের ব্যাপার ছিলো না। বৈশাখের পান্তা-ইলিশ শহরবাসীর সংযোজন। কারণ গ্রামের সব উপকরণ শহরে জোগাড় করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা পান্তা-ইলিশের নূতন সংস্কৃতি চালু করে। শহরের আর একটা বড় সংযোজন- মঙ্গলশোভাযাত্রা। এটা এখন পহেলা বৈশাখের প্রতীকের রূপ নিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে শান্তিযাত্রার ধারণা থেকে একসময় পহেলা বৈশাখে মঙ্গলশোভাযাত্রায় প্রচলন হয়ে যায়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ‘মঙ্গলশোভাযাত্রা’কে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা বাঙালির অর্জন, পহেলা বৈশাখের এক রূপময় স্মারক।