রক্তের আলো

সাদ কামালী

লাল সন্ধ্যা যখন আলকাতরার মতো আঠালো এবং জমাট হয়ে ওঠে, উদ্যানের ফাঁকফোকর থেকে লুকানো অন্ধকারও বেরিয়ে পড়ে এবং সেই অন্ধকারের মধ্যে উঠে দাঁড়ালে যখন ছায়া পড়ে না, তখন অনু স্বগতোক্তির স্বরে ঘোষণা করলো, খুন করবো, অন্তত একটা। আলেয়াও উঠে দাঁড়িয়েছিল, এবার কাঁধের ওপর হাত রাখলে অনু সেই হাত সরিয়ে দেয়। মুখের ওপর শাড়ি চেপে ধরে আলেয়া শব্দ রোধ করে, কিন্তু চোখের জল তো আর প্রতিরোধ মানে না। অনু এই জল দেখতে পায় না, তবুও সংবেদনশীল অন্ধকারের সংক্রামে তার চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। আলেয়াকে জড়িয়ে ধরে ওই আর্দ্রতাকে বিগলিত হতে দেয়। রাত্রি আরো জমাট বাঁধে। উদ্যানের ভিতর দু’একটি পোস্টে আলো জ্বলে, অধিকাংশই অন্ধকারে ডোবা। ফলে ফাঁকফোঁকর দিয়ে আলোর তরঙ্গ প্রবেশ করতে পারলেও ব্যাপক অন্ধকার তাতে অক্ষুণœই থাকে। বরং ওই আলোর ব্যভিচারী ছোঁয়া বিবর্ণতাকে প্রমাণ করে। অনু আবার বলে, আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আলেয়া কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে বলে, ভালো আমারও লাগে না, তবুও। তবুও আমি পারছি না। অনু প্রায় চিৎকার করে ওঠে। আলেয়া টের পায় অনু’র হাত কাঁপছে। উদ্যান থেকে বের হয়েও তেমন আলো বা জমজমাট লোকালয় দেখতে পায় না। এর মধ্যেই যেন রাতের অন্তিম বিহ্বলতা গ্রাস করে ফেলেছে। হাতের কব্জি ঘুরিয়ে অনু একবার ঘড়ি দেখতে গিয়েও দেখে না। বরং ওই সোনালি ধাতবের ওপর বিরল কোনো আলোর রেখা চমকে উঠলে তার বিরক্ত লাগে। তখন আলেয়া বলে, রিকশা ছাড়া আজ সবই দুপুর থেকে বন্ধ। অনু তখন প্রায় অনুরোধ করে, চলো হেঁটে যাই, কয়েক ঘণ্টা সময় তো পার হবে। আলেয়া অনুর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু অনু মত পাল্টায়, না, রিকশায় চলো, বেশ লাগবে। আলেয়া তখন চোখ তুলে তাকালে অনু বলে, ও টাকার ব্যবস্থা হবে।

শহর এবং সড়কের বিরল নীরবতায় দু’জন নিঃশব্দে বসে থাকে রিকশায়, কখনো ঝাঁকি খেয়েও বলে না রিকশা সাবধানে চলো। যখন উল্টা দিক থেকে বিকট আওয়াজে দু’টি মাইক্রোবাস অতিক্রম করে যায় এবং গাড়ির কাঁচে সংবাদপত্র লেখা দেখে তখন অনু গালি দিয়ে ওঠে, আলেয়া হাতে চাপ দেয়। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। তার খুব বলতে ইচ্ছে করে, জিভের ওপর কিছু শব্দ নিয়ে ব্যাকুলও হয় কিন্তু কিছুই উচ্চারণ করতে পারে না। যদি সে বলতো, কেন তুমি এত অস্থির হচ্ছো, দু’একটা খুন করে তোমার কী লাভ হবে, অথবা যদি বলা যায় খুন করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে হয়তো এই যাত্রাটুকুও নষ্ট হয়ে যাবে, এ নীরবতার আনন্দটুকু মাটি হবে। অনু’র বাম হাতের মধ্যমার ওপর শুকনো একটা কাটা দাগ আছে। সেই দাগের ওপর আলেয়া চাপ দেয়। অনু তখন বলে, কাল সারা রাত ‘মহাপৃথিবী’ এবং ‘ঙৎঢ়যবঁং’ শেষ করলাম। তারপর রাত তিনটা কুড়ি মিনিটে চেষ্টা করলাম লিখতে। ভোর পর্যন্ত কিছু শুরু করতে না পেরে অর্ফিউস থেকে একটা সনেট অনুবাদ করে ফেলি। কিন্তু হাসনাত কবিতাটি একবার পড়েই ফেরত দিয়ে বলে, তুমি খুব টিপিক্যাল, তোমার সব কবিতাই একই রকম লাগে। আলেয়া বলে, ওরা কবিতা বুঝলে আর রিল্কে পড়লে কি আর ওই সব পাতা সম্পাদনা করতে পারতো! নাপিত ডাক্তারদের ওপর রাগ করার কোনো মানে হয় না। অনু হয়তো আলেয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারে, সে রিকশার ওই অপরিসর আসনের মধ্যেই ঘুরে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, তুমি ভাবছো আমি একটা ক্ষ্যাপা, পাগল? আলেয়া উত্তর দেয় না। সে আঙুলের শুকনো কাটা দাগের ওপর চোখ রেখে অনু’র সেই অনুভূতির বর্ণনা পুনরায় মনে করার চেষ্টা করে। টি.এস.সি’র ক্যাফেটেরিয়ায় অনু একা বসে ছিল, আলেয়া কাছে আসতেই দেখায় হাতের ব্যান্ডেজ। তারপর কেমন উজ্জ্বল আর অভিভূত চোখে বলে তার আনন্দের কথা। পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে খুব গভীর হয়ে কেটে সারা শরীর শিহরিত হয়ে প্রচুর রক্ত বের হয়, চুলা জ্বলছিল। সেই আগুনের ছায়া পড়ে রক্তের ওপর। শরীর কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে। রক্ত, আগুন এবং শিহরন এমন মুগ্ধ বিহ্বল করে যে সেই ঘোর সহজে কাটে না। তারপর সহসা আলেয়ার হাত ধরে নিচু স্বরে বলেছিল, বিশ্বাস করো সেক্সেও অমন আনন্দ হয়নি। আলেয়া চারপাশ তাকিয়ে ব্যান্ডেজ করা আঙুলে চুমো খেয়ে পাশে বসে। অনু’র চোখে জল টলটল করে। আলেয়ার চোখও জলের সংক্রামে ভিজে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অনু একটা কবিতা পড়ে। পুরো কবিতা নয়, অংশবিশেষ যার প্রথম পঙ্ক্তি আলেয়া এখনো মনে করতে পারে। সে কি এখন জিজ্ঞেস করবে অনু’র সেই কবিতাটি মনে আছে কিনা- যার প্রথম পঙ্ক্তি ‘আগুনের ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় বিহ্বল মেঘ রমণ আনন্দে কাঁদে। আমার বালক বয়স তখন যুবা হয়, এরকমই।’

সেই আঙুলে সেলাই লেগেছিল, তিন মাস ব্যান্ডেজের তলায় আঙুলটা ফ্যাকাশে মরা ঘাস হযে গিয়েছিল। কিন্তু আলেয়া ক্ষুব্ধ অনুকে কোনোভাবেই ঘাঁটাতে চায় না, খুব সতর্ক ভাবে সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। রিকশা যখন মগবাজারের মোড়ে এসে পৌঁছে তখন সে বলে, রিকশা ছেড়ে দিই, হেঁটে যাই চলো। অনু বিনা বাক্যে রিকশা থেকে নেমে হাতের ঘড়িটা খুলে রিকশাওয়ালাকে দেখায়। রিকশাওয়ালা কিছু বুঝতে পারে না, তখন অনু বলে, একদম নতুন ঘড়ি, আমার বউ আমাকে দিয়েছে, ভাড়া বাবদ নিয়ে নেও। আলেয়া রিকশা থেকে নেমে মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ ভাই, অনেক টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। রিকশাওয়ালা অবাক এবং দ্বিধার সাথে ঘড়িটি নিয়ে চলে যায়। গলির ভিতর আলেয়াকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আলেয়া গেটের ওপর হাত রেখে বলে, এরকম বন্ধ থাকলে কালকেও অফিসে যাব না। বাসায় চলে এসো। অনু মুখে কিছু বলল না। সে অন্তত এটুকু বুঝতে পারে, আগামীকাল আসবার আমন্ত্রণ মানে বর্তমানের প্রত্যাখ্যান। সে চোখ তুলতে পারল না, চোখের পাতা আকস্মিক অপমানে ভারি হয়ে যায়। তখন তার চোখ ওই নত অবস্থাতেই আরো একবার জ্বলে ওঠে। খুনের সিদ্ধান্ত তখন আরো দৃঢ় হয়। হাত নিশপিশ করে। সে ছুটে বেরিয়ে যায়। আলেয়া একটু থমকে দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে চলে আসে। যদি অনু ছুটে না যেত তবে আলেয়ার ভারি নিঃশ্বাসে তার বুকের চুল কেঁপে উঠতই। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে গিয়ে কাজলও লেপ্টে যায়। যদিও অন্ধকারে চোখের ওই কালো দাগ দেখা যায় না। কিন্তু আলেয়া দেখতে পায়, আলোতে বসেও বাইরের অন্ধকারে, জানালার গ্রিলে কাউকে দেখে, দেখে সহসা চমকালেও বুঝতে দেরি হয় না কে ওখানে। ঘড়ির ওপর চোখ ফেলে সে আবার তাকায়, রাত আড়াইটা বাজে। অনু এখনো হলে ফেরেনি। হয়তো তখন থেকেই চোখে চোখ ফেলার জন্য অপেক্ষা করছিল। অনু জানালার কার্নিশ থেকে বারান্দায় উঠে এলে আলেয়া দরজা খুলে দেয়।

তোফায়েল আহমেদ সকালে নাস্তার টেবিলে অনুকে দেখে অবাক হয়, সবকিছু কি চলছে? তাহলে আলেয়া অফিসে যাবে না? মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে বলে, তুমি কি এখনো হলে থাকো? অনু চায়ের কাপ নামিয়ে আলেয়াকে বলে, তোমরা কি চায়েও চিনি দাও না? আলেয়ার ঠোঁটে চিকন একটা হাসি মিলিয়ে যায়। তোফায়েল তখন গম্ভীর করে বলে, চিনি তোমার সামনেই রাখা আছে, যতটা লাগে নাও। আলেয়া তখন হাসি ছড়িয়ে জানায় আজো অফিসে যাচ্ছে না আব্বা, রিকশা চড়তে ভয় করে। তুমি একটু অফিসে ফোন করে দিও। তোফায়েল তবুও অনুকেই বলে, তুমি এখন কী করবে ভাবছ? অনুও জড়তাহীন স্বরে দ্রুত বললো, কিছুই ভাবছি না। ওর কবিতার বই বের হওয়ার কথা ছিল, আলেয়া তোফায়েল আহমেদকে জানায়। আর অনু’র দৃষ্টি বিঁধে থাকে চায়ের গরম ধোঁয়ার ওপর। তখনও কি আরো একবার খুন করার ইচ্ছা জাগে!

সারাদিন গড়িয়ে সন্ধ্যায় যখন ছাদে গিয়ে ওঠে, তখনও বেশি কথায় তারা বিগলিত হয় না। পরস্পর মুখের দিকে চেয়েই সময় অতিক্রম করে। দিগন্তে কিছু মেঘের দাগ থাকলেও মাথার ওপরের আকাশ চাঁদ ও নক্ষত্রের ভিড়ে নিবিড়। আকাশের ওপর চোখ রেখে আলেয়া বলে, তোমার কেন মনে হয় ভালো লিখছ না? অনু নিঃশব্দ এবং নিষ্পলক। আলেয়া আবার বলে, কেন ভালো লিখতে পারছ না? অনেক সময় পর দু’আঙুল দিয়ে তারার গায়ে টোকা দিতে দিতে একটা টোকা সে আলেয়ার কপালে দেয়, বেশ জোরে। আলেয়া আহ্ শব্দ ক’রে মাথা পিছিয়ে নেয়। অনু বলে, একটা পঙ্ক্তিও আমাকে শিহরিত করে না, স্নায়ুতে অনুভব করি না। কোনো কিছুতেই আর আলোড়িত হতে পারছি না।

শুক্লপক্ষের চাঁদ খুব দ্রুত ক্ষয়ে যায়। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু মেঘ অসহায় বিচলিত হয়ে শুধু তারায় তারায় ছুটোছুটি করে। দিগন্ত থেকেও কিছু মেঘ উঠে আসে। ক্রমশ মেঘ জটিল হয়ে উঠতে থাকলে বৈশাখের বাতাস তাদের উস্কে দেয়। বাতাসের সেই কূট চালে নক্ষত্র তলিয়ে অন্ধকার নিবিড় ক’রে তোলে। বাতাসের বেগও বাড়ে। আলেয়া উঠে দাঁড়ায়, অনুও। কিন্তু সেই পূর্বাভাসের মুখে অনু বলে, শুধু রক্ত আমাকে আকুল করে তোলে। রক্তের ওপর আলোর ছায়া পড়লে...! অনু থেমে যায়। হঠাৎই মনে হওয়ার মতো করে বলে, শরীরে, নিজের ¯œায়ুতে তীব্র উপলব্ধির অভিজ্ঞতা অর্জনের নেশা আমাকে দিয়ে অনেক কিছু করাল। রস আনন্দের অনুভূতি ছাড়া পদ্যের একটি পঙ্ক্তি কি তৈরি হয়! রক্তপাতেও তো আনন্দ পাই আমি! আকাশের প্রান্তে দিনের সূর্য মূর্ত হওয়ার আগে রঙ ছড়িয়ে দেয়। ওই রঙের শৃঙ্গারে আকাশকে আনন্দ বেদনায় রঙিন করে তোলে, একটি নতুন দিনের সূচনা হয়, এই আনন্দ বেদনার অভিঘাত কবিতার জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে।

তিনদিন আলেয়া অনুর কোনো দর্শন, এমনকি খবরও পায় না। চতুর্থ দিন সে রিকশা

নিয়ে হলের পথে রওয়ানা হয়। ক্যাম্পাসের মধ্যে এসে গা কেমন ছমছম করে, ঝোপ-জঙ্গলের মতো জায়গায় জায়গায় পুলিশের গাড়ি। অনুর হলের মুখেও পুলিশ তখন। আলেয়া রিকশা থেকে নেমে এলিভেটরের বোতাম টিপে দেয়। কিন্তু সবুজ বাতি জ্বলে কোনো সঙ্কেত দিল না। পিছন থেকে কেউ বললো, সিঁড়ি দিয়ে যান। আলেয়া নির্বিঘেœ সিঁড়ি বেয়ে অনুর দরজায় এসে দম নেয়। এই প্রথম তাকে কেউ জিজ্ঞেস করলো না আমি কোথায় যাচ্ছি। কেউ বললো না, আপনি গেস্ট রুমে বসুন, ডেকে পাঠাচ্ছি। আলেয়াকে দেখে অনু বিছানায় শুয়েই খুব উজ্জ্বল করে হেসে ওঠে। সেই হাসি দেখে আলেয়ার চোখে জল আসে। অনুর লাল চোখের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত রাখে, বেশ জ্বর। অনু আলেয়ার হাত জড়িয়ে ধরে চুমো খায়। তারপর বালিশের পাশ থেকে এক তোড়া কাগজ ওর দিকে এগিয়ে ধরে। আলেয়া মৃদু হেসে নিঃশব্দে পড়তে শুরু করে। অনু গভীর আগ্রহে আলেয়ার চোখের ওপর চোখ মেলে রেখেছে। কখনো সেই চোখের তারা জ্বলে, ম্রিয়মাণ হয়, বিস্ময় ও ঘৃণাও জাগে। এই নীরব অভিব্যক্তি দেখেই তার প্রথম পাঠকের প্রতিক্রিয়া অনুমান করে নেয়। পড়া শেষে আলেয়া যখন কিছু বলতে যাবে তখন অনু তাকে থামিয়ে বলে ক্ষিদে লেগেছে। আলেয়া বলে, সকালে নাস্তা খাওনি? -আজ চারদিন খাইনি। অনুর চোখ দেখে আলেয়া লাফ দিয়ে উঠে বলে, অসভ্য। অনু হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে সে নিজেই মৃদু হাহাকার করে। আলেয়া চমকে দেখে অনুর বাম হাতে ব্যান্ডেজ। তখন অনু বলে, তুমি কি ভাবলে এমনিতেই, অনেক কষ্টে এসব লেখা। আলেয়ার চোখ চিবুক ঠোঁট ঘিরে ছায়া ঘন হয়ে ওঠে। বুক কেঁপে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।

তখন ঘরে ঢোকে অনুর বন্ধু, ঘরের প্রকৃত প্রাপক শফি। সে আলেয়াকে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, এসেছেন ভালো হলো, দেখেন কেমন পাগলামি। আলেয়া কাতরভাবে বলে, বাধা দিতে পারলেন না? শফি বলে, আমার সামনে তো ঘটেনি, ছুরি দিয়ে কেটে টিপে টিপে রক্ত বের করেছে। ব্যথায় এখন গায়ে জ্বর। তিন দিনে তিনবার হাত কেটে এক পাউন্ড রক্ত ফেলেছে। আলেয়া মুখে আঁচল চাপা দেয়, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। অনু উঠে পিছন থেকে আলেয়াকে জড়িয়ে ধরে। শফি বেরিয়ে যায়। আলেয়া অথৈ জলের মধ্যে ডুবতে ডুবতে বলে, আমার গা ছুঁয়ে একটা কথা দাও। অনুর ঠোঁটে প্রশান্ত হাসি। উদাসভাবে বলে, কথা দিলেও সে-কথা অমান্য করতে আমার অসুবিধা হয় না। আলেয়া তখন ঘুরে চোখের ওপর চোখ রেখে বলে, যদি কাউকে তোমার খুন করতে ইচ্ছে করে তবে আমাকেই আগে করো। যেভাবে করলে তোমার ভিতর শিহরন জাগবে সেভাবেই করো। আলেয়ার চিবুক হাত দিয়ে উঁচু ক’রে অনু বলে, হ্যাঁ তোমার কথা রাখতে পারি।

হ্যাঁ রাখবে, কোথায় কখন খুন করতে চাও বলো, সেভাবেই আমি তৈরি থাকবো। আলেয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দু’দিন পর শফি তাকে ফোনে জানায় অনু নিজের কনিষ্ঠা আঙুল অর্ধেক কেটে ফেলেছে। ওর ধারণা কোনো ভালো কাজে আসে না এই আঙুলের অর্ধভাগ। বরং এর থেকে সে তৈরি করতে পারবে কিছু পঙ্ক্তি। আলেয়া কিছুক্ষণ নির্বাক থেমে শফিকে অনুরোধ করে অনুর সঙ্গে থাকতে, সে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে বিকালে আসবে। বিকালে হলে এসে সে অবাক হয়। অনু খুব উৎফুল্ল। অনেকের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। তামাকের গন্ধ ও ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার, বাম হাতে এখন শুধু ব্যান্ডেজ নয়, গলাতেও ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয় না। বাম হাত সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার করণীয় কিছু নাই। আলেয়াকে দেখে আড্ডার বন্ধুরা যেন মহাখুশি হয়ে ওঠে। শফি সেখানে নাই। অনুকে নিয়ে বের হওয়া সম্ভব বলে মনে হলো না। গভীর চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি তো কথা রাখলে না! অনু বলে, হ্যাঁ রাখবো। আলেয়া বললো, আজ রাতে। অনুর কণ্ঠের তরলতা হাঠাৎ উবে যায়, বলে, আজ রাতেই।

বিকাল থেকেই আলেয়ার মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সে নিশ্চিত অনু আসবে। পেঁয়াজ কাটার ছুরির পরিবর্তে হয়তো আরো ভারি কোনো চাপাতি নিয়েও আসতে পারে। কণ্ঠনালী যখন ওই চাপাতির কোপে দু’ভাগ হয়ে যাবে তখন অবশ্যম্ভাবী রক্তের উষ্ণ স্রোতে অনু কেঁপে উঠবে সেই রক্তের ওপর মোমবাতির আলো পড়ে যে-বর্ণবৈভব ঘটাবে তাতে আলোড়িত হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হবে অমর পঙ্ক্তি। প্রেরণা তো প্রয়োজন, তা সে অসম্ভব যে-কোনো উৎস থেকেই হোক না কেন! ঘোর তৈরি না হলে কি সৃষ্টি সম্ভব! আলেয়া এভাবে অনিবার্যতা তৈরি করে, অনুর জন্য যৌক্তিক প্রেক্ষাপট তৈরি করতে করতে নিজের শরীরেরও একটু যতœ নেয়। পরিষ্কার করে গোসল সেরে ধবধবে সাদা শাড়ি পরে। ঘর থেকে কিছু ময়লা পরিষ্কার করে, কত রকম চিঠি সে সযতেœ তুলে রেখেছিল সে-সব দূর করে দেয়। তোফায়েল আহমেদ বসার ঘরে ব্যবসার মিটিং করছে। কোনো কাজে সে উপরে উঠে এলে আলেয়াকে তার মা’র ছবির সামনে সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেও একটু দাঁড়ায়। একটা ভারি নিশ্বাস ছেড়ে সে বলে, কী মা! আলেয়া ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, মা’র ছবিটা কেমন বাদামী হয়ে যাচ্ছে! তোফায়েল আহমেদ মাথা দুলিয়ে ঘর থেকে নিচে নেমে আসে।

জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে আলেয়া শুয়ে রইলো। আজ রাত্রিতেও মেঘ জমেছে। এই জ্যোৎ¯œা আর থাকবে না। দু’একটি বিক্ষিপ্ত মেঘ একসময় ধীর ধীরে আকাশের সকল সীমানা গ্রাস করে ফেলবে। তারপর সেই মেঘ নিজের চাপেই ক্রুদ্ধ হয়ে গলে পড়তে শুরু করবে।

অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টির তীব্র ফলা অনুকে বিব্রত করতে পারে না, আলেয়া দেখে পাইপ বেয়ে বৃষ্টি এবং অনু দুই বিপরীত যাত্রী। বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে আর অনু বেয়ে উঠছে। অনু’র মুখে হাসি। সে আলেয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আলেয়া সেই বাড়ানো হাত ধরতে গিয়ে দেখে সে হাতে ছুরি। আলেয়া ধরতে পারে না। অনু হেসে বলে, ভয় পেয়ে গেলে? আলেয়া খোলা চুল পিছনে ফেলে শরীর ঝুলিয়ে অনুর হাতের কব্জি ধরে ফেলে। আলেয়ার শরীরের ভরকে ভরসা করে বারান্দায় উঠে আসে। শরীর ভেজা, হাঁফাচ্ছে, অথচ সে ঝরঝর করে হাসছে। আলেয়া দেখে তার বাঁ হাতে এখন ব্যান্ডেজ নাই, কোনো কাটা দাগেরও চিহ্ন দেখা যায় না। অনু আলেয়াকে কোলে তুলে বিছানার ওপর শুইয়ে দেয়। কী এক অভূতপূর্ব সুখে আলেয়ার চোখ বুজে আসে। অনু একে একে সব পোশাক খুলে নেয়। ছুরির শীতল তীক্ষè স্পর্শে আলেয়া একবার চোখ মেলে। অনু’র বিস্ফারিত চকচকে চোখ দু’টি ছুরির ধারের ওপর নিবদ্ধ। আলেয়া তবুও বলে, তোমার কলম কাগজ কই! অনু যেন সে-কথা শুনতে পায় না। সে নিচু হয়ে আলেয়ার ঘাড়ে চুমু খায়, তার ঠোঁট নিচে নেমে আসে। আলেয়া বাধা দেয় না, ছুরি বসাও, অনু শক্ত করে ছুরি ধরে জেগে ওঠা কণ্ঠনালীর ওপর বসিয়ে দেয়। আলেয়ার কানে তখন ধুপধুপ আওয়াজ আসে, প্রথম সে ভেবেছে হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ। কিন্তু ক্রমে সেই আওয়াজ বেড়ে গেলে বড়ো বিরক্ত হয়। অনু হয়তো ওই শব্দে ঘোরমুক্ত হবে, এবং কোনো কাজেই আসবে না এই রক্তপ্রবাহ। তখন হয়তো ওকে আরো একটা খুন করতে হবে। কিন্তু সে টের পাচ্ছে এখনও বেঁচে আছে, শুধু বেঁচে কেন তেমন ব্যথাও অনুভব করছে না, শুধু একরকম অবশ বোধ ছাড়া। ক্রমশ শব্দের বাড়াবাড়িতে আর চোখ বুজে থাকতে পারে না। চোখ খুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

বুঝে উঠতে তার সময় লাগে। কাঁধের ওপর হাত ঘুরিয়ে আনে, ঘামে প্যাচপ্যাচ করছে, শাড়িও ঠিক আছে। কেউ দরজা ধাককাচ্ছে! দরজা খুলেই সে তোফায়েল আহমেদের মুখোমুখি হলো। এত ভোরে কখনো তার ঘুম ভাঙে না। আলেয়ার চোখে বিস্ময়, তোফায়েল বলে, নিচে তোমার এক বন্ধু এসেছে, খুব দরকার নাকি। আলেয়া প্রায় ছুটে নেমে আসে, শফি মাথা নিচু করে বসে আছে। আলেয়ার উপস্থিতি টের পেয়ে সে ওই মাথা ঝুলিয়ে রেখেই বলে, কাল মধ্যরাতে অনু ভাইয়ের শরীর অপরাজেয় বাংলার বেদীতে পাওয়া গেছে। আলেয়ার উদ্বিগ্ন বিপন্ন দৃষ্টির সামনে শফি কিছু অস্থির সময় অতিক্রম করে, জলের অবিরল চাপে তার কণ্ঠ ডুবে যায়, আর কিছুই বলতে পারে না ॥

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ , ০১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমাদ্বান ১৪৪৩

রক্তের আলো

সাদ কামালী

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

লাল সন্ধ্যা যখন আলকাতরার মতো আঠালো এবং জমাট হয়ে ওঠে, উদ্যানের ফাঁকফোকর থেকে লুকানো অন্ধকারও বেরিয়ে পড়ে এবং সেই অন্ধকারের মধ্যে উঠে দাঁড়ালে যখন ছায়া পড়ে না, তখন অনু স্বগতোক্তির স্বরে ঘোষণা করলো, খুন করবো, অন্তত একটা। আলেয়াও উঠে দাঁড়িয়েছিল, এবার কাঁধের ওপর হাত রাখলে অনু সেই হাত সরিয়ে দেয়। মুখের ওপর শাড়ি চেপে ধরে আলেয়া শব্দ রোধ করে, কিন্তু চোখের জল তো আর প্রতিরোধ মানে না। অনু এই জল দেখতে পায় না, তবুও সংবেদনশীল অন্ধকারের সংক্রামে তার চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। আলেয়াকে জড়িয়ে ধরে ওই আর্দ্রতাকে বিগলিত হতে দেয়। রাত্রি আরো জমাট বাঁধে। উদ্যানের ভিতর দু’একটি পোস্টে আলো জ্বলে, অধিকাংশই অন্ধকারে ডোবা। ফলে ফাঁকফোঁকর দিয়ে আলোর তরঙ্গ প্রবেশ করতে পারলেও ব্যাপক অন্ধকার তাতে অক্ষুণœই থাকে। বরং ওই আলোর ব্যভিচারী ছোঁয়া বিবর্ণতাকে প্রমাণ করে। অনু আবার বলে, আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আলেয়া কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে বলে, ভালো আমারও লাগে না, তবুও। তবুও আমি পারছি না। অনু প্রায় চিৎকার করে ওঠে। আলেয়া টের পায় অনু’র হাত কাঁপছে। উদ্যান থেকে বের হয়েও তেমন আলো বা জমজমাট লোকালয় দেখতে পায় না। এর মধ্যেই যেন রাতের অন্তিম বিহ্বলতা গ্রাস করে ফেলেছে। হাতের কব্জি ঘুরিয়ে অনু একবার ঘড়ি দেখতে গিয়েও দেখে না। বরং ওই সোনালি ধাতবের ওপর বিরল কোনো আলোর রেখা চমকে উঠলে তার বিরক্ত লাগে। তখন আলেয়া বলে, রিকশা ছাড়া আজ সবই দুপুর থেকে বন্ধ। অনু তখন প্রায় অনুরোধ করে, চলো হেঁটে যাই, কয়েক ঘণ্টা সময় তো পার হবে। আলেয়া অনুর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু অনু মত পাল্টায়, না, রিকশায় চলো, বেশ লাগবে। আলেয়া তখন চোখ তুলে তাকালে অনু বলে, ও টাকার ব্যবস্থা হবে।

শহর এবং সড়কের বিরল নীরবতায় দু’জন নিঃশব্দে বসে থাকে রিকশায়, কখনো ঝাঁকি খেয়েও বলে না রিকশা সাবধানে চলো। যখন উল্টা দিক থেকে বিকট আওয়াজে দু’টি মাইক্রোবাস অতিক্রম করে যায় এবং গাড়ির কাঁচে সংবাদপত্র লেখা দেখে তখন অনু গালি দিয়ে ওঠে, আলেয়া হাতে চাপ দেয়। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। তার খুব বলতে ইচ্ছে করে, জিভের ওপর কিছু শব্দ নিয়ে ব্যাকুলও হয় কিন্তু কিছুই উচ্চারণ করতে পারে না। যদি সে বলতো, কেন তুমি এত অস্থির হচ্ছো, দু’একটা খুন করে তোমার কী লাভ হবে, অথবা যদি বলা যায় খুন করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে হয়তো এই যাত্রাটুকুও নষ্ট হয়ে যাবে, এ নীরবতার আনন্দটুকু মাটি হবে। অনু’র বাম হাতের মধ্যমার ওপর শুকনো একটা কাটা দাগ আছে। সেই দাগের ওপর আলেয়া চাপ দেয়। অনু তখন বলে, কাল সারা রাত ‘মহাপৃথিবী’ এবং ‘ঙৎঢ়যবঁং’ শেষ করলাম। তারপর রাত তিনটা কুড়ি মিনিটে চেষ্টা করলাম লিখতে। ভোর পর্যন্ত কিছু শুরু করতে না পেরে অর্ফিউস থেকে একটা সনেট অনুবাদ করে ফেলি। কিন্তু হাসনাত কবিতাটি একবার পড়েই ফেরত দিয়ে বলে, তুমি খুব টিপিক্যাল, তোমার সব কবিতাই একই রকম লাগে। আলেয়া বলে, ওরা কবিতা বুঝলে আর রিল্কে পড়লে কি আর ওই সব পাতা সম্পাদনা করতে পারতো! নাপিত ডাক্তারদের ওপর রাগ করার কোনো মানে হয় না। অনু হয়তো আলেয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারে, সে রিকশার ওই অপরিসর আসনের মধ্যেই ঘুরে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, তুমি ভাবছো আমি একটা ক্ষ্যাপা, পাগল? আলেয়া উত্তর দেয় না। সে আঙুলের শুকনো কাটা দাগের ওপর চোখ রেখে অনু’র সেই অনুভূতির বর্ণনা পুনরায় মনে করার চেষ্টা করে। টি.এস.সি’র ক্যাফেটেরিয়ায় অনু একা বসে ছিল, আলেয়া কাছে আসতেই দেখায় হাতের ব্যান্ডেজ। তারপর কেমন উজ্জ্বল আর অভিভূত চোখে বলে তার আনন্দের কথা। পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে খুব গভীর হয়ে কেটে সারা শরীর শিহরিত হয়ে প্রচুর রক্ত বের হয়, চুলা জ্বলছিল। সেই আগুনের ছায়া পড়ে রক্তের ওপর। শরীর কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে। রক্ত, আগুন এবং শিহরন এমন মুগ্ধ বিহ্বল করে যে সেই ঘোর সহজে কাটে না। তারপর সহসা আলেয়ার হাত ধরে নিচু স্বরে বলেছিল, বিশ্বাস করো সেক্সেও অমন আনন্দ হয়নি। আলেয়া চারপাশ তাকিয়ে ব্যান্ডেজ করা আঙুলে চুমো খেয়ে পাশে বসে। অনু’র চোখে জল টলটল করে। আলেয়ার চোখও জলের সংক্রামে ভিজে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অনু একটা কবিতা পড়ে। পুরো কবিতা নয়, অংশবিশেষ যার প্রথম পঙ্ক্তি আলেয়া এখনো মনে করতে পারে। সে কি এখন জিজ্ঞেস করবে অনু’র সেই কবিতাটি মনে আছে কিনা- যার প্রথম পঙ্ক্তি ‘আগুনের ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় বিহ্বল মেঘ রমণ আনন্দে কাঁদে। আমার বালক বয়স তখন যুবা হয়, এরকমই।’

সেই আঙুলে সেলাই লেগেছিল, তিন মাস ব্যান্ডেজের তলায় আঙুলটা ফ্যাকাশে মরা ঘাস হযে গিয়েছিল। কিন্তু আলেয়া ক্ষুব্ধ অনুকে কোনোভাবেই ঘাঁটাতে চায় না, খুব সতর্ক ভাবে সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। রিকশা যখন মগবাজারের মোড়ে এসে পৌঁছে তখন সে বলে, রিকশা ছেড়ে দিই, হেঁটে যাই চলো। অনু বিনা বাক্যে রিকশা থেকে নেমে হাতের ঘড়িটা খুলে রিকশাওয়ালাকে দেখায়। রিকশাওয়ালা কিছু বুঝতে পারে না, তখন অনু বলে, একদম নতুন ঘড়ি, আমার বউ আমাকে দিয়েছে, ভাড়া বাবদ নিয়ে নেও। আলেয়া রিকশা থেকে নেমে মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ ভাই, অনেক টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। রিকশাওয়ালা অবাক এবং দ্বিধার সাথে ঘড়িটি নিয়ে চলে যায়। গলির ভিতর আলেয়াকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আলেয়া গেটের ওপর হাত রেখে বলে, এরকম বন্ধ থাকলে কালকেও অফিসে যাব না। বাসায় চলে এসো। অনু মুখে কিছু বলল না। সে অন্তত এটুকু বুঝতে পারে, আগামীকাল আসবার আমন্ত্রণ মানে বর্তমানের প্রত্যাখ্যান। সে চোখ তুলতে পারল না, চোখের পাতা আকস্মিক অপমানে ভারি হয়ে যায়। তখন তার চোখ ওই নত অবস্থাতেই আরো একবার জ্বলে ওঠে। খুনের সিদ্ধান্ত তখন আরো দৃঢ় হয়। হাত নিশপিশ করে। সে ছুটে বেরিয়ে যায়। আলেয়া একটু থমকে দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে চলে আসে। যদি অনু ছুটে না যেত তবে আলেয়ার ভারি নিঃশ্বাসে তার বুকের চুল কেঁপে উঠতই। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে গিয়ে কাজলও লেপ্টে যায়। যদিও অন্ধকারে চোখের ওই কালো দাগ দেখা যায় না। কিন্তু আলেয়া দেখতে পায়, আলোতে বসেও বাইরের অন্ধকারে, জানালার গ্রিলে কাউকে দেখে, দেখে সহসা চমকালেও বুঝতে দেরি হয় না কে ওখানে। ঘড়ির ওপর চোখ ফেলে সে আবার তাকায়, রাত আড়াইটা বাজে। অনু এখনো হলে ফেরেনি। হয়তো তখন থেকেই চোখে চোখ ফেলার জন্য অপেক্ষা করছিল। অনু জানালার কার্নিশ থেকে বারান্দায় উঠে এলে আলেয়া দরজা খুলে দেয়।

তোফায়েল আহমেদ সকালে নাস্তার টেবিলে অনুকে দেখে অবাক হয়, সবকিছু কি চলছে? তাহলে আলেয়া অফিসে যাবে না? মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে বলে, তুমি কি এখনো হলে থাকো? অনু চায়ের কাপ নামিয়ে আলেয়াকে বলে, তোমরা কি চায়েও চিনি দাও না? আলেয়ার ঠোঁটে চিকন একটা হাসি মিলিয়ে যায়। তোফায়েল তখন গম্ভীর করে বলে, চিনি তোমার সামনেই রাখা আছে, যতটা লাগে নাও। আলেয়া তখন হাসি ছড়িয়ে জানায় আজো অফিসে যাচ্ছে না আব্বা, রিকশা চড়তে ভয় করে। তুমি একটু অফিসে ফোন করে দিও। তোফায়েল তবুও অনুকেই বলে, তুমি এখন কী করবে ভাবছ? অনুও জড়তাহীন স্বরে দ্রুত বললো, কিছুই ভাবছি না। ওর কবিতার বই বের হওয়ার কথা ছিল, আলেয়া তোফায়েল আহমেদকে জানায়। আর অনু’র দৃষ্টি বিঁধে থাকে চায়ের গরম ধোঁয়ার ওপর। তখনও কি আরো একবার খুন করার ইচ্ছা জাগে!

সারাদিন গড়িয়ে সন্ধ্যায় যখন ছাদে গিয়ে ওঠে, তখনও বেশি কথায় তারা বিগলিত হয় না। পরস্পর মুখের দিকে চেয়েই সময় অতিক্রম করে। দিগন্তে কিছু মেঘের দাগ থাকলেও মাথার ওপরের আকাশ চাঁদ ও নক্ষত্রের ভিড়ে নিবিড়। আকাশের ওপর চোখ রেখে আলেয়া বলে, তোমার কেন মনে হয় ভালো লিখছ না? অনু নিঃশব্দ এবং নিষ্পলক। আলেয়া আবার বলে, কেন ভালো লিখতে পারছ না? অনেক সময় পর দু’আঙুল দিয়ে তারার গায়ে টোকা দিতে দিতে একটা টোকা সে আলেয়ার কপালে দেয়, বেশ জোরে। আলেয়া আহ্ শব্দ ক’রে মাথা পিছিয়ে নেয়। অনু বলে, একটা পঙ্ক্তিও আমাকে শিহরিত করে না, স্নায়ুতে অনুভব করি না। কোনো কিছুতেই আর আলোড়িত হতে পারছি না।

শুক্লপক্ষের চাঁদ খুব দ্রুত ক্ষয়ে যায়। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু মেঘ অসহায় বিচলিত হয়ে শুধু তারায় তারায় ছুটোছুটি করে। দিগন্ত থেকেও কিছু মেঘ উঠে আসে। ক্রমশ মেঘ জটিল হয়ে উঠতে থাকলে বৈশাখের বাতাস তাদের উস্কে দেয়। বাতাসের সেই কূট চালে নক্ষত্র তলিয়ে অন্ধকার নিবিড় ক’রে তোলে। বাতাসের বেগও বাড়ে। আলেয়া উঠে দাঁড়ায়, অনুও। কিন্তু সেই পূর্বাভাসের মুখে অনু বলে, শুধু রক্ত আমাকে আকুল করে তোলে। রক্তের ওপর আলোর ছায়া পড়লে...! অনু থেমে যায়। হঠাৎই মনে হওয়ার মতো করে বলে, শরীরে, নিজের ¯œায়ুতে তীব্র উপলব্ধির অভিজ্ঞতা অর্জনের নেশা আমাকে দিয়ে অনেক কিছু করাল। রস আনন্দের অনুভূতি ছাড়া পদ্যের একটি পঙ্ক্তি কি তৈরি হয়! রক্তপাতেও তো আনন্দ পাই আমি! আকাশের প্রান্তে দিনের সূর্য মূর্ত হওয়ার আগে রঙ ছড়িয়ে দেয়। ওই রঙের শৃঙ্গারে আকাশকে আনন্দ বেদনায় রঙিন করে তোলে, একটি নতুন দিনের সূচনা হয়, এই আনন্দ বেদনার অভিঘাত কবিতার জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে।

তিনদিন আলেয়া অনুর কোনো দর্শন, এমনকি খবরও পায় না। চতুর্থ দিন সে রিকশা

নিয়ে হলের পথে রওয়ানা হয়। ক্যাম্পাসের মধ্যে এসে গা কেমন ছমছম করে, ঝোপ-জঙ্গলের মতো জায়গায় জায়গায় পুলিশের গাড়ি। অনুর হলের মুখেও পুলিশ তখন। আলেয়া রিকশা থেকে নেমে এলিভেটরের বোতাম টিপে দেয়। কিন্তু সবুজ বাতি জ্বলে কোনো সঙ্কেত দিল না। পিছন থেকে কেউ বললো, সিঁড়ি দিয়ে যান। আলেয়া নির্বিঘেœ সিঁড়ি বেয়ে অনুর দরজায় এসে দম নেয়। এই প্রথম তাকে কেউ জিজ্ঞেস করলো না আমি কোথায় যাচ্ছি। কেউ বললো না, আপনি গেস্ট রুমে বসুন, ডেকে পাঠাচ্ছি। আলেয়াকে দেখে অনু বিছানায় শুয়েই খুব উজ্জ্বল করে হেসে ওঠে। সেই হাসি দেখে আলেয়ার চোখে জল আসে। অনুর লাল চোখের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত রাখে, বেশ জ্বর। অনু আলেয়ার হাত জড়িয়ে ধরে চুমো খায়। তারপর বালিশের পাশ থেকে এক তোড়া কাগজ ওর দিকে এগিয়ে ধরে। আলেয়া মৃদু হেসে নিঃশব্দে পড়তে শুরু করে। অনু গভীর আগ্রহে আলেয়ার চোখের ওপর চোখ মেলে রেখেছে। কখনো সেই চোখের তারা জ্বলে, ম্রিয়মাণ হয়, বিস্ময় ও ঘৃণাও জাগে। এই নীরব অভিব্যক্তি দেখেই তার প্রথম পাঠকের প্রতিক্রিয়া অনুমান করে নেয়। পড়া শেষে আলেয়া যখন কিছু বলতে যাবে তখন অনু তাকে থামিয়ে বলে ক্ষিদে লেগেছে। আলেয়া বলে, সকালে নাস্তা খাওনি? -আজ চারদিন খাইনি। অনুর চোখ দেখে আলেয়া লাফ দিয়ে উঠে বলে, অসভ্য। অনু হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে সে নিজেই মৃদু হাহাকার করে। আলেয়া চমকে দেখে অনুর বাম হাতে ব্যান্ডেজ। তখন অনু বলে, তুমি কি ভাবলে এমনিতেই, অনেক কষ্টে এসব লেখা। আলেয়ার চোখ চিবুক ঠোঁট ঘিরে ছায়া ঘন হয়ে ওঠে। বুক কেঁপে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।

তখন ঘরে ঢোকে অনুর বন্ধু, ঘরের প্রকৃত প্রাপক শফি। সে আলেয়াকে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, এসেছেন ভালো হলো, দেখেন কেমন পাগলামি। আলেয়া কাতরভাবে বলে, বাধা দিতে পারলেন না? শফি বলে, আমার সামনে তো ঘটেনি, ছুরি দিয়ে কেটে টিপে টিপে রক্ত বের করেছে। ব্যথায় এখন গায়ে জ্বর। তিন দিনে তিনবার হাত কেটে এক পাউন্ড রক্ত ফেলেছে। আলেয়া মুখে আঁচল চাপা দেয়, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। অনু উঠে পিছন থেকে আলেয়াকে জড়িয়ে ধরে। শফি বেরিয়ে যায়। আলেয়া অথৈ জলের মধ্যে ডুবতে ডুবতে বলে, আমার গা ছুঁয়ে একটা কথা দাও। অনুর ঠোঁটে প্রশান্ত হাসি। উদাসভাবে বলে, কথা দিলেও সে-কথা অমান্য করতে আমার অসুবিধা হয় না। আলেয়া তখন ঘুরে চোখের ওপর চোখ রেখে বলে, যদি কাউকে তোমার খুন করতে ইচ্ছে করে তবে আমাকেই আগে করো। যেভাবে করলে তোমার ভিতর শিহরন জাগবে সেভাবেই করো। আলেয়ার চিবুক হাত দিয়ে উঁচু ক’রে অনু বলে, হ্যাঁ তোমার কথা রাখতে পারি।

হ্যাঁ রাখবে, কোথায় কখন খুন করতে চাও বলো, সেভাবেই আমি তৈরি থাকবো। আলেয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দু’দিন পর শফি তাকে ফোনে জানায় অনু নিজের কনিষ্ঠা আঙুল অর্ধেক কেটে ফেলেছে। ওর ধারণা কোনো ভালো কাজে আসে না এই আঙুলের অর্ধভাগ। বরং এর থেকে সে তৈরি করতে পারবে কিছু পঙ্ক্তি। আলেয়া কিছুক্ষণ নির্বাক থেমে শফিকে অনুরোধ করে অনুর সঙ্গে থাকতে, সে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে বিকালে আসবে। বিকালে হলে এসে সে অবাক হয়। অনু খুব উৎফুল্ল। অনেকের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। তামাকের গন্ধ ও ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার, বাম হাতে এখন শুধু ব্যান্ডেজ নয়, গলাতেও ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয় না। বাম হাত সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার করণীয় কিছু নাই। আলেয়াকে দেখে আড্ডার বন্ধুরা যেন মহাখুশি হয়ে ওঠে। শফি সেখানে নাই। অনুকে নিয়ে বের হওয়া সম্ভব বলে মনে হলো না। গভীর চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি তো কথা রাখলে না! অনু বলে, হ্যাঁ রাখবো। আলেয়া বললো, আজ রাতে। অনুর কণ্ঠের তরলতা হাঠাৎ উবে যায়, বলে, আজ রাতেই।

বিকাল থেকেই আলেয়ার মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সে নিশ্চিত অনু আসবে। পেঁয়াজ কাটার ছুরির পরিবর্তে হয়তো আরো ভারি কোনো চাপাতি নিয়েও আসতে পারে। কণ্ঠনালী যখন ওই চাপাতির কোপে দু’ভাগ হয়ে যাবে তখন অবশ্যম্ভাবী রক্তের উষ্ণ স্রোতে অনু কেঁপে উঠবে সেই রক্তের ওপর মোমবাতির আলো পড়ে যে-বর্ণবৈভব ঘটাবে তাতে আলোড়িত হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হবে অমর পঙ্ক্তি। প্রেরণা তো প্রয়োজন, তা সে অসম্ভব যে-কোনো উৎস থেকেই হোক না কেন! ঘোর তৈরি না হলে কি সৃষ্টি সম্ভব! আলেয়া এভাবে অনিবার্যতা তৈরি করে, অনুর জন্য যৌক্তিক প্রেক্ষাপট তৈরি করতে করতে নিজের শরীরেরও একটু যতœ নেয়। পরিষ্কার করে গোসল সেরে ধবধবে সাদা শাড়ি পরে। ঘর থেকে কিছু ময়লা পরিষ্কার করে, কত রকম চিঠি সে সযতেœ তুলে রেখেছিল সে-সব দূর করে দেয়। তোফায়েল আহমেদ বসার ঘরে ব্যবসার মিটিং করছে। কোনো কাজে সে উপরে উঠে এলে আলেয়াকে তার মা’র ছবির সামনে সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেও একটু দাঁড়ায়। একটা ভারি নিশ্বাস ছেড়ে সে বলে, কী মা! আলেয়া ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, মা’র ছবিটা কেমন বাদামী হয়ে যাচ্ছে! তোফায়েল আহমেদ মাথা দুলিয়ে ঘর থেকে নিচে নেমে আসে।

জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে আলেয়া শুয়ে রইলো। আজ রাত্রিতেও মেঘ জমেছে। এই জ্যোৎ¯œা আর থাকবে না। দু’একটি বিক্ষিপ্ত মেঘ একসময় ধীর ধীরে আকাশের সকল সীমানা গ্রাস করে ফেলবে। তারপর সেই মেঘ নিজের চাপেই ক্রুদ্ধ হয়ে গলে পড়তে শুরু করবে।

অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টির তীব্র ফলা অনুকে বিব্রত করতে পারে না, আলেয়া দেখে পাইপ বেয়ে বৃষ্টি এবং অনু দুই বিপরীত যাত্রী। বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে আর অনু বেয়ে উঠছে। অনু’র মুখে হাসি। সে আলেয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আলেয়া সেই বাড়ানো হাত ধরতে গিয়ে দেখে সে হাতে ছুরি। আলেয়া ধরতে পারে না। অনু হেসে বলে, ভয় পেয়ে গেলে? আলেয়া খোলা চুল পিছনে ফেলে শরীর ঝুলিয়ে অনুর হাতের কব্জি ধরে ফেলে। আলেয়ার শরীরের ভরকে ভরসা করে বারান্দায় উঠে আসে। শরীর ভেজা, হাঁফাচ্ছে, অথচ সে ঝরঝর করে হাসছে। আলেয়া দেখে তার বাঁ হাতে এখন ব্যান্ডেজ নাই, কোনো কাটা দাগেরও চিহ্ন দেখা যায় না। অনু আলেয়াকে কোলে তুলে বিছানার ওপর শুইয়ে দেয়। কী এক অভূতপূর্ব সুখে আলেয়ার চোখ বুজে আসে। অনু একে একে সব পোশাক খুলে নেয়। ছুরির শীতল তীক্ষè স্পর্শে আলেয়া একবার চোখ মেলে। অনু’র বিস্ফারিত চকচকে চোখ দু’টি ছুরির ধারের ওপর নিবদ্ধ। আলেয়া তবুও বলে, তোমার কলম কাগজ কই! অনু যেন সে-কথা শুনতে পায় না। সে নিচু হয়ে আলেয়ার ঘাড়ে চুমু খায়, তার ঠোঁট নিচে নেমে আসে। আলেয়া বাধা দেয় না, ছুরি বসাও, অনু শক্ত করে ছুরি ধরে জেগে ওঠা কণ্ঠনালীর ওপর বসিয়ে দেয়। আলেয়ার কানে তখন ধুপধুপ আওয়াজ আসে, প্রথম সে ভেবেছে হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ। কিন্তু ক্রমে সেই আওয়াজ বেড়ে গেলে বড়ো বিরক্ত হয়। অনু হয়তো ওই শব্দে ঘোরমুক্ত হবে, এবং কোনো কাজেই আসবে না এই রক্তপ্রবাহ। তখন হয়তো ওকে আরো একটা খুন করতে হবে। কিন্তু সে টের পাচ্ছে এখনও বেঁচে আছে, শুধু বেঁচে কেন তেমন ব্যথাও অনুভব করছে না, শুধু একরকম অবশ বোধ ছাড়া। ক্রমশ শব্দের বাড়াবাড়িতে আর চোখ বুজে থাকতে পারে না। চোখ খুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

বুঝে উঠতে তার সময় লাগে। কাঁধের ওপর হাত ঘুরিয়ে আনে, ঘামে প্যাচপ্যাচ করছে, শাড়িও ঠিক আছে। কেউ দরজা ধাককাচ্ছে! দরজা খুলেই সে তোফায়েল আহমেদের মুখোমুখি হলো। এত ভোরে কখনো তার ঘুম ভাঙে না। আলেয়ার চোখে বিস্ময়, তোফায়েল বলে, নিচে তোমার এক বন্ধু এসেছে, খুব দরকার নাকি। আলেয়া প্রায় ছুটে নেমে আসে, শফি মাথা নিচু করে বসে আছে। আলেয়ার উপস্থিতি টের পেয়ে সে ওই মাথা ঝুলিয়ে রেখেই বলে, কাল মধ্যরাতে অনু ভাইয়ের শরীর অপরাজেয় বাংলার বেদীতে পাওয়া গেছে। আলেয়ার উদ্বিগ্ন বিপন্ন দৃষ্টির সামনে শফি কিছু অস্থির সময় অতিক্রম করে, জলের অবিরল চাপে তার কণ্ঠ ডুবে যায়, আর কিছুই বলতে পারে না ॥