বৈশাখী ব্যবসার পালে হাওয়া লেগেছে কোথাও, কোথাও নেই

করোনার চোখ রাঙানিতে গত দুই বছর উৎসব ছিল বিবর্ণ। জনজীবন হয়ে গেছিল বিপর্যস্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল না প্রাণ। হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিছুদিন হলো অতিমারীর তেজ কমতে থাকায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে মানুষ, আতঙ্ক কমে গিয়ে আনন্দ উৎসবে যোগ দিচ্ছে সচেতনতার সঙ্গে। ব্যবসার পালে দোলা লেগেছে বৈশাখ আর ঈদকে ঘিরে।

উৎসব-আনন্দের সঙ্গে ব্যবসা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। গত দুই বছর উৎসবে আনন্দ ছিল না, মানুষ ঘরবন্দী থাকায় কেনাকাটা ছিল শূন্য।

‘সেই শূন্যতা কাটিয়ে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে ব্যবসা’ বলে জানালেন ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) সভাপতি ও বুটিক শপ ‘অঞ্জন’-এর স্বত্বাধিকারী শাহীন আহমদ।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বুটিকশপগুলোর কাজ সারাবছরই কম-বেশি থাকে। বৈশাখে যে পরিমাণ ব্যবসা হওয়ার কথা ছিল তার কিছুটা হয়েছে। আমাদের প্রস্তুতি কম ছিল, বিক্রি কম হয়েছে। রোজা আর ঈদের সময় বৈশাখে যে জমজমাট ব্যবসা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি।’

আজিজ সুপার মার্কেটের তৈরি পোশাকের দোকান ‘বিসর্গ’র স্বত্বাধিকারী স্বপন শিকদার বলছেন ব্যাবসার পালে হাওয়ার লাগার কথা। ‘ঈদ ও পহেলা বৈশাখে দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যের বেচাকেনা বাড়ছে। যারা করোনার কারণে বিভিন্ন বিধিনিষেধের মুখে ঘরবন্দী ছিলেন তারাও এখন ছুটছেন এক মার্কেট থেকে আরেক মার্কেটে।

তিনি বলেন, ‘১৯ সালের চেয়েও এবার বৈশাখে ব্যবসা ভালো হয়েছে। রোজা আর ঈদের জন্য ব্যবসাযীরা অনেকেই বৈশাখের কোন প্রস্তুতি নিতে পারেননি। কিন্তু যারা নিয়েছেন তারা ভালো ব্যবসা করেছেন। যদি কেউ বলে ব্যবসা হচ্ছে না, তাহলে আমি তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বলবো।’

স্বপন শিকদার ও শাহীন আহমদের কথার ঠিক উল্টো বর্ণনা শোনা গেলো ‘অতঃপর’ বুটিকসের রানা আহমেদ, ‘ব্যতিক্রম’ এর কামাল হোসেন, ‘ক্লাসি’র ম্যানেজার মো. ইমনের মুখে।

‘অতঃপর’ বুটিকসের রানা আহমেদ বলেন, ‘বৈশাখে একদমই ব্যবসা হয়নি।’ কেন হলো না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। একে তো রোজা তারওপর সামনে ঈদ। ঈদকে সামনে রেখে বৈশাখকে

প্রায়োরিটি (গুরুত্ব) দেবে না এটাই তো স্বাভাি বক।’

দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারী বা বুটিক ফাশন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন- ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) পরিচালক ও আজিজ সুপার মার্কেটের ‘ব্যতিক্রম’ দোকানের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেন ব্যবসা না হওয়ার চাইতে বিরক্ত ব্যবসা নিয়ে সরকার, রাজনীতিবিদদের কর্মকা- নিয়ে।

কামাল হোসেন বলেন, ‘ব্যবসাই তো নাই। ব্যস্ততার কারণে আপনার সঙ্গে এ সময় কথা বলার কথাই না। আমাদের প্রচুর হোলসেল যায়। এখন একেবারেই যাচ্ছে না তা কিন্তু নয়। যা যাচ্ছে তা নরমাল। বৈশাখে ব্যবসা হয়নি ঈদে হবে এখন পর্যন্ত সেই আশায় আছি।’

দেশীয় পোশাকের ফ্যাশন হাউজ ‘দেশাল’ এর চিত্র দুই জায়গায় দুই রকম। বৈশাখে বসুন্ধরা সিটি মার্কেটে তাদের ২০১৯ সালের মতো ব্যবসা হয়েছে বলে একজন বিক্রয় কর্মী জানালেও আজিজ সুপার মার্কেটের ম্যানেজার দেবাশীষ মজুমদার বলেন, তাদের ‘এখানে এবার একবারেই ব্যবসা হয়নি।’

আজিজ সুপার মার্কেট মূলত বিশেষ দিনের পোশাকে বাঙালিয়ানাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের পোশাক প্রস্তুত করে থাকে। গেঞ্জি থেকে শুরু করে পাঞ্জাবি, শার্ট ও মেয়েদের নানা পোশাকে রাখে বাংলার বৈচিত্র্য। এবার রোজার কারণে বাচ্চাদের কিছু পোশাক, পাঞ্জাবি, শাড়ি, কুর্তি বিক্রি হলেও গেঞ্জি বিক্রি কম হয়েছে বলে জানায় এখানকার অনেক ব্যবসায়ী।

আজিজ সুপার মার্কেটে ব্যবসা কম হলেও বসুন্ধরা সিটির ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট। বসুন্ধরা সিটির দেশি দশ, আড়ং, এসপ্লাস, বুননসহ বেশ কয়েকটি পোশাকের দোকানে গিয়ে ক্রেতাসমাগম দেখা যায়। আর বৈশাখে তাদের ব্যবসা বেশ ভালো বলে জানান তারা।

নববর্ষকে বসুন্ধরা সিটির ব্যবসায়ীদের মুখে চওড়া হাসি এনে দিলেও আজিজ সুপার মার্কেটের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীরা এখন পর্যন্ত আশায় আছেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বৈশাখে ব্যবসা ভালো হবে না এটা তো আমি আগেই বলেছি। পহেলা বৈশাখে আমাদের পাঁচ-ছয় হাজার কোটি টাকার বাজার ছিল যার টোটালটাই আমাদের দেশীয় অর্থনীতি। এবার নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে আমাদের ব্যবসায়ীরা।

তিনি বলেন, ‘মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে, মানুষের মধ্যে শঙ্কা কাজ করে। করোনার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে তাদের আয় রোজগার কমছে। এখন ভোগ্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে স্বস্তির ভাবটা নেই বললেই চলে। আশা করছি ঈদটা ভালো করবো।’

তবে এখন পর্যন্ত যে লক্ষণ বাজারে খুব বেশি কেনাকাটা নেই জানিয়ে এই ব্যবসাযী নেতা বলেন, ‘এখনও কিন্তু মানুষ বাজারে আসছে না। তারপরও আমরা আশায় আছি। ১৫ রোজার পর থেকে ভালো ব্যবসা হবে। যদি এবার ব্যবসা না হয় তাহলে আমরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’

শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২ , ০৩ বৈশাখ ১৪২৮ ১৪ রমাদ্বান ১৪৪৩

বৈশাখী ব্যবসার পালে হাওয়া লেগেছে কোথাও, কোথাও নেই

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

করোনার চোখ রাঙানিতে গত দুই বছর উৎসব ছিল বিবর্ণ। জনজীবন হয়ে গেছিল বিপর্যস্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল না প্রাণ। হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিছুদিন হলো অতিমারীর তেজ কমতে থাকায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে মানুষ, আতঙ্ক কমে গিয়ে আনন্দ উৎসবে যোগ দিচ্ছে সচেতনতার সঙ্গে। ব্যবসার পালে দোলা লেগেছে বৈশাখ আর ঈদকে ঘিরে।

উৎসব-আনন্দের সঙ্গে ব্যবসা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। গত দুই বছর উৎসবে আনন্দ ছিল না, মানুষ ঘরবন্দী থাকায় কেনাকাটা ছিল শূন্য।

‘সেই শূন্যতা কাটিয়ে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে ব্যবসা’ বলে জানালেন ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) সভাপতি ও বুটিক শপ ‘অঞ্জন’-এর স্বত্বাধিকারী শাহীন আহমদ।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বুটিকশপগুলোর কাজ সারাবছরই কম-বেশি থাকে। বৈশাখে যে পরিমাণ ব্যবসা হওয়ার কথা ছিল তার কিছুটা হয়েছে। আমাদের প্রস্তুতি কম ছিল, বিক্রি কম হয়েছে। রোজা আর ঈদের সময় বৈশাখে যে জমজমাট ব্যবসা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি।’

আজিজ সুপার মার্কেটের তৈরি পোশাকের দোকান ‘বিসর্গ’র স্বত্বাধিকারী স্বপন শিকদার বলছেন ব্যাবসার পালে হাওয়ার লাগার কথা। ‘ঈদ ও পহেলা বৈশাখে দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যের বেচাকেনা বাড়ছে। যারা করোনার কারণে বিভিন্ন বিধিনিষেধের মুখে ঘরবন্দী ছিলেন তারাও এখন ছুটছেন এক মার্কেট থেকে আরেক মার্কেটে।

তিনি বলেন, ‘১৯ সালের চেয়েও এবার বৈশাখে ব্যবসা ভালো হয়েছে। রোজা আর ঈদের জন্য ব্যবসাযীরা অনেকেই বৈশাখের কোন প্রস্তুতি নিতে পারেননি। কিন্তু যারা নিয়েছেন তারা ভালো ব্যবসা করেছেন। যদি কেউ বলে ব্যবসা হচ্ছে না, তাহলে আমি তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বলবো।’

স্বপন শিকদার ও শাহীন আহমদের কথার ঠিক উল্টো বর্ণনা শোনা গেলো ‘অতঃপর’ বুটিকসের রানা আহমেদ, ‘ব্যতিক্রম’ এর কামাল হোসেন, ‘ক্লাসি’র ম্যানেজার মো. ইমনের মুখে।

‘অতঃপর’ বুটিকসের রানা আহমেদ বলেন, ‘বৈশাখে একদমই ব্যবসা হয়নি।’ কেন হলো না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। একে তো রোজা তারওপর সামনে ঈদ। ঈদকে সামনে রেখে বৈশাখকে

প্রায়োরিটি (গুরুত্ব) দেবে না এটাই তো স্বাভাি বক।’

দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারী বা বুটিক ফাশন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন- ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) পরিচালক ও আজিজ সুপার মার্কেটের ‘ব্যতিক্রম’ দোকানের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেন ব্যবসা না হওয়ার চাইতে বিরক্ত ব্যবসা নিয়ে সরকার, রাজনীতিবিদদের কর্মকা- নিয়ে।

কামাল হোসেন বলেন, ‘ব্যবসাই তো নাই। ব্যস্ততার কারণে আপনার সঙ্গে এ সময় কথা বলার কথাই না। আমাদের প্রচুর হোলসেল যায়। এখন একেবারেই যাচ্ছে না তা কিন্তু নয়। যা যাচ্ছে তা নরমাল। বৈশাখে ব্যবসা হয়নি ঈদে হবে এখন পর্যন্ত সেই আশায় আছি।’

দেশীয় পোশাকের ফ্যাশন হাউজ ‘দেশাল’ এর চিত্র দুই জায়গায় দুই রকম। বৈশাখে বসুন্ধরা সিটি মার্কেটে তাদের ২০১৯ সালের মতো ব্যবসা হয়েছে বলে একজন বিক্রয় কর্মী জানালেও আজিজ সুপার মার্কেটের ম্যানেজার দেবাশীষ মজুমদার বলেন, তাদের ‘এখানে এবার একবারেই ব্যবসা হয়নি।’

আজিজ সুপার মার্কেট মূলত বিশেষ দিনের পোশাকে বাঙালিয়ানাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের পোশাক প্রস্তুত করে থাকে। গেঞ্জি থেকে শুরু করে পাঞ্জাবি, শার্ট ও মেয়েদের নানা পোশাকে রাখে বাংলার বৈচিত্র্য। এবার রোজার কারণে বাচ্চাদের কিছু পোশাক, পাঞ্জাবি, শাড়ি, কুর্তি বিক্রি হলেও গেঞ্জি বিক্রি কম হয়েছে বলে জানায় এখানকার অনেক ব্যবসায়ী।

আজিজ সুপার মার্কেটে ব্যবসা কম হলেও বসুন্ধরা সিটির ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট। বসুন্ধরা সিটির দেশি দশ, আড়ং, এসপ্লাস, বুননসহ বেশ কয়েকটি পোশাকের দোকানে গিয়ে ক্রেতাসমাগম দেখা যায়। আর বৈশাখে তাদের ব্যবসা বেশ ভালো বলে জানান তারা।

নববর্ষকে বসুন্ধরা সিটির ব্যবসায়ীদের মুখে চওড়া হাসি এনে দিলেও আজিজ সুপার মার্কেটের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীরা এখন পর্যন্ত আশায় আছেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বৈশাখে ব্যবসা ভালো হবে না এটা তো আমি আগেই বলেছি। পহেলা বৈশাখে আমাদের পাঁচ-ছয় হাজার কোটি টাকার বাজার ছিল যার টোটালটাই আমাদের দেশীয় অর্থনীতি। এবার নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে আমাদের ব্যবসায়ীরা।

তিনি বলেন, ‘মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে, মানুষের মধ্যে শঙ্কা কাজ করে। করোনার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে তাদের আয় রোজগার কমছে। এখন ভোগ্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে স্বস্তির ভাবটা নেই বললেই চলে। আশা করছি ঈদটা ভালো করবো।’

তবে এখন পর্যন্ত যে লক্ষণ বাজারে খুব বেশি কেনাকাটা নেই জানিয়ে এই ব্যবসাযী নেতা বলেন, ‘এখনও কিন্তু মানুষ বাজারে আসছে না। তারপরও আমরা আশায় আছি। ১৫ রোজার পর থেকে ভালো ব্যবসা হবে। যদি এবার ব্যবসা না হয় তাহলে আমরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’