অসাধারণ এক চিত্রনাট্য

এম এ কবীর

রাজার এক মন্ত্রী মৃত্যুর পর পরজগতে গেলেন। তিনি যখন স্বর্গে ঢুকবেন, তখন দেবতা তাকে বললেন, স্বর্গে কিছু সংস্কারকাজ চলছে, তুমি শুধু দুই দিন নরকে থেকে এসো, এরপর স্বর্গে ঢোকো। মন্ত্রী রাজি হলেন। নরকে শয়তান তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাল। এরপর সে তাকে নরক ঘুরে দেখাতে লাগল। মন্ত্রী অবাক হয়ে দেখলেন নরক অনেক সুন্দর। খুবই আরামদায়ক সব ব্যবস্থা, থাকার জন্য সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ। খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, সুইমিংপুল, গলফ মাঠ আরও অনেক কিছু। সুস্বাদু পানীয় ছাড়াও লোভনীয় খাবারের এলাহি আয়োজন। মন্ত্রী সবকিছু দেখে মুগ্ধ। দুই দিন পর দেবতার কাছে ফিরে গিয়ে মন্ত্রী বললেন তিনি নরকেই থাকতে চান। দেবতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ভেবে বলো। সত্যি ওখানে থাকতে চাও? মন্ত্রীর জবাব, হ্যাঁ। দেবতা বললেন, তথাস্তু। যাও তাহলে। এরপর মন্ত্রী নরকে ফিরে দেখেন সবকিছু পুরো অন্য রকম। কোন সুন্দর জায়গা নেই। শুধু আগুন আর কয়লা। দৈত্যরা মানুষজনকে শাস্তি দিচ্ছে। অসংখ্য সাপ আর হিংস্র্র প্রাণী। খুবই কুৎসিত আর জঘন্য জায়গা। মন্ত্রী অবাক হয়ে শয়তানের কাছে জানতে চান, নরকের এই হাল কেন? আগে আমি কী দেখে গেলাম? শয়তান হেসে বলল, ওইটা তো ছিল একটা ক্যাম্পেইন। তোমরা যেমন নির্বাচনের আগে মানুষকে স্বর্গের স্বপ্ন দেখিয়ে পরে নরক উপহার দাও, আমিও সে রকমই করেছি।

‘গো গোতা গো’ সেøাগানে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। এক সময়ের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা এখন বিপুল পরিমাণ ঋণের ভারে জর্জরিত। খাবার, জ্বালানি, বিদ্যুৎ কেনার মতো বৈদেশিক মদ্রা আর অবশিষ্ট নেই। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ১৮.৭ শতাংশ। গত ৫৬ বছরে ১৬ বার আইএমএফের বেলআউট চেয়েছে দেশটি। দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বি দামে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে সাধারণ মানুষের। অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। কিশ্লেষকরা এ পরিস্থিতিতে ‘আরব বসন্তের শ্রীলঙ্কান সংস্করণ’ বলে অবিহিত করেছেন। ওয়াশিংটনের মিলেনিয়াম প্রজেক্টের সিনিয়র ফেলো আসাঙ্গা আবেয়াগুনাসেকেরা বলেন, ‘এটি শ্রীলঙ্কার আরব বসন্ত। কর্তৃত্ববাদী শাসন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, পারিবারিক শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের এই অভ্যুত্থানের আপনি আরব বসন্তের সম্পূর্ণ মিল পাবেন।’

রাজধানী কলম্বোয় চালের ন্যূনতম দাম কেজিপ্রতি ২০০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। গম প্রতি কেজি ১৯০ রুপি, চিনি ২৪০, নারকেল তেলের দাম লিটারে ৮৫০ রুপি। একটি ডিমের দাম ৩০ রুপি। প্রতি কেজি গুঁড়া দুধের দাম ১ হাজার ৯ রুপি। সবজির দাম প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যার পকেটে সামান্য কিছু অর্থ আছে তারা ডিজেল, কেরোসিনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন, কাগজ না থাকায় শিশুদের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে, তীব্র ওষুধ ঘাটতির কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চলছে জরুরি অবস্থা, ১২-১৩ ঘণ্টার মতো চলছে লোডশেডিং। পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। গত কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কা শাসন করছে রাজাপাকসে পরিবার। প্রেসিডেন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ প্রতিটি উঁচু পদেই তাদের দৌরাত্ম্য ও একচ্ছত্র আধিপত্য। ২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে এক দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য জনপ্রিয়তা পাওয়া প্রেসিডেন্ট গৌতব্য রাজাপাকসেরও এখন দুর্নীতির এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের পাহাড়। এরই মধ্যে ৪১ জন আইনপ্রণেতা ক্ষমতাসীন জোট থেকে ওয়াকআউট করেছেন। প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসের সম্পূর্ণ মন্ত্রিপরিষদ পদত্যাগ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছেন রাজাপাকসের ছেলে। পদ ছেড়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। এদিকে বিরোধী দল এবং দেশটির আপামর জনসাধারণ রাজাপাকসে পরিবারের সব সদস্যের পদত্যাগ এবং জাতীয় সরকার গড়ার দাবি অব্যাহত রেখেছেন।

আমাদের সময়টা ভালো যাচ্ছে না। প্রবীণরা বলেন তাদের সময় ভালো ছিল। আমরা অনেকে বলি শৈশব, বাল্যকালই ভালো ছিল। কিন্তু আমাদের এ সময়ে কোথায় যেন একটা গোলমাল লেগে গেল। মাত্র ৫০ বছর আগে এই দেশটার জন্ম। এই অল্প সময়ে দেশের মানুষেরাই তো এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই যে সবকিছুর মাঝে কী একটা গ-গোল লেগে গেছে! আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে, সাম্যের গান গাইছে না সবাই। এই গোলমাল থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজে চলেছে সবাই। দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের মেরুদ-টা একটু নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় অনেক বিষয় নিয়েই এখন আর চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় না।

অসাধারণ সব গল্প ভেসে বেড়াচ্ছে রাস্তাঘাটে, লুফে নিলেই তা থেকে তৈরি হতে পারত মনকাড়া সিনেমা, কিন্তু হায়! এখন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মানুষই তো খুঁজে পাওয়া যায় না। হাতের স্মার্টফোনে কবজি ডুবিয়ে রঙিন ভার্চুয়াল জগতে ভোজন করছেন যারা, তারা বাস্তব জগৎ নিয়ে কম চিন্তিত। বাস্তব জগতের টানাপোড়েন নেই সেখানে। নিজের যা ভালো লাগে, শুধু তাই নিয়ে থাকলেই জীবন কেটে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বাজারে আগুন, টিপ নিয়ে এক পুলিশ কনস্টেবলের মাথা ঘুরিয়ে দেয়া কর্মকা-, দারিদ্র্যের কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং-পড়–য়া শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিজ্ঞান শিক্ষককের ধর্মবিদ্বেষী গল্প। মনে হতে পারে অনেক দূরের কোনো ঘটনা। বাস্তব জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা মানুষেরা এমন অনেক কিছুই হারাচ্ছেন, যা জানা থাকলে তাদের ভাবনার জগৎটা একটু হলেও বদলে যেত। সে রকমই একটি ঘটনার দেখা মিলল মিরপুরের কচুক্ষেত এলাকার রজনীগন্ধা মার্কেটে। ঘটনাটি যদি হলিউড কিংবা বলিউডের কোন চিত্রনাট্যকার পেতেন, তাহলে লুফে নিতেন। যে ডাকাতের দল নিরাপত্তাকর্মী ও ক্লিনারের বেশে মার্কেটে চাকরি নিয়ে একসময় সুযোগ বুঝে জুয়েলারির দোকান থেকে লোপাট করে ৩০০ ভরি স্বর্ণালংকার, তাদের কাছে তারা ছুটে আসতেন। শুনতেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা। তারপর কোনো রিসোর্টে গিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে এক মাস ধরে লিখতেন ছবির চিত্রনাট্য। এরপর সেই ছবি সিনেমা হলে মুক্তি পেলে বক্স অফিস ভেঙে খান খান হয়ে যেত।

আহা! স্রেফ বাংলাদেশের মতো এক দেশে জন্মেছেন বলেই এই ডাকাতেরা সাংস্কৃতিক সুবিধাটাও নিতে পারলেন না! একসময় ‘বুচ ক্যাসেডি অ্যান্ড সানড্যান্স কিড’ নামের একটি হলিউডি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল। পল নিউম্যান আর রবার্ট রেডফোর্ডের অভিনয় দেখতে যেন উৎসব লেগে যায় প্রেক্ষাগৃহে। এ ছাড়া ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে নির্মিত ‘দ্য টাউন’, ‘ইনসাইড ম্যান’, ‘হেল অর হাই ওয়াটার’, ‘ডগ ডে আফটারনুন’, কিংবা ‘হিট’ নামের ছবিগুলোর কথা বলতে হয়। দেখা যাবে, কতটা পরিকল্পিতভাবেই না ডাকাতির জন্য তৈরি হয় একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত! আমাদের এ ডাকাত দলটিও ডাকাতিতে হাত পাকিয়েছে অন্তত এক যুগ ধরে। মূলত স্বর্ণালংকারের প্রতিই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থেকেছে। ভুয়া পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদ তৈরি করে বিভিন্ন পেশার ছদ্মবেশে তারা ডাকাতি চালিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু এ যাত্রায় তারা পার পেল না! কয়েকজন ধরা পড়ে গেল র?্যাবের হাতে! সেই সঙ্গে একটি অসাধারণ চিত্রনাট্যের পরিসমাপ্তি ঘটল। রসিকতাকে সরিয়ে রেখে এখন শুধু জিজ্ঞাসা : সবার অগোচরে এ রকম কতগুলো বাহিনী গড়ে উঠেছে, তার হিসাব কি আছে কারও কাছে? অপকর্ম করার পরেই কি শুধু এরা ধরা পড়বে, তার আগেই কি এদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কোনো উপায় জানা নেই আমাদের?

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২ , ০৩ বৈশাখ ১৪২৮ ১৪ রমাদ্বান ১৪৪৩

অসাধারণ এক চিত্রনাট্য

এম এ কবীর

রাজার এক মন্ত্রী মৃত্যুর পর পরজগতে গেলেন। তিনি যখন স্বর্গে ঢুকবেন, তখন দেবতা তাকে বললেন, স্বর্গে কিছু সংস্কারকাজ চলছে, তুমি শুধু দুই দিন নরকে থেকে এসো, এরপর স্বর্গে ঢোকো। মন্ত্রী রাজি হলেন। নরকে শয়তান তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাল। এরপর সে তাকে নরক ঘুরে দেখাতে লাগল। মন্ত্রী অবাক হয়ে দেখলেন নরক অনেক সুন্দর। খুবই আরামদায়ক সব ব্যবস্থা, থাকার জন্য সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ। খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, সুইমিংপুল, গলফ মাঠ আরও অনেক কিছু। সুস্বাদু পানীয় ছাড়াও লোভনীয় খাবারের এলাহি আয়োজন। মন্ত্রী সবকিছু দেখে মুগ্ধ। দুই দিন পর দেবতার কাছে ফিরে গিয়ে মন্ত্রী বললেন তিনি নরকেই থাকতে চান। দেবতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ভেবে বলো। সত্যি ওখানে থাকতে চাও? মন্ত্রীর জবাব, হ্যাঁ। দেবতা বললেন, তথাস্তু। যাও তাহলে। এরপর মন্ত্রী নরকে ফিরে দেখেন সবকিছু পুরো অন্য রকম। কোন সুন্দর জায়গা নেই। শুধু আগুন আর কয়লা। দৈত্যরা মানুষজনকে শাস্তি দিচ্ছে। অসংখ্য সাপ আর হিংস্র্র প্রাণী। খুবই কুৎসিত আর জঘন্য জায়গা। মন্ত্রী অবাক হয়ে শয়তানের কাছে জানতে চান, নরকের এই হাল কেন? আগে আমি কী দেখে গেলাম? শয়তান হেসে বলল, ওইটা তো ছিল একটা ক্যাম্পেইন। তোমরা যেমন নির্বাচনের আগে মানুষকে স্বর্গের স্বপ্ন দেখিয়ে পরে নরক উপহার দাও, আমিও সে রকমই করেছি।

‘গো গোতা গো’ সেøাগানে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। এক সময়ের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা এখন বিপুল পরিমাণ ঋণের ভারে জর্জরিত। খাবার, জ্বালানি, বিদ্যুৎ কেনার মতো বৈদেশিক মদ্রা আর অবশিষ্ট নেই। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ১৮.৭ শতাংশ। গত ৫৬ বছরে ১৬ বার আইএমএফের বেলআউট চেয়েছে দেশটি। দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বি দামে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে সাধারণ মানুষের। অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। কিশ্লেষকরা এ পরিস্থিতিতে ‘আরব বসন্তের শ্রীলঙ্কান সংস্করণ’ বলে অবিহিত করেছেন। ওয়াশিংটনের মিলেনিয়াম প্রজেক্টের সিনিয়র ফেলো আসাঙ্গা আবেয়াগুনাসেকেরা বলেন, ‘এটি শ্রীলঙ্কার আরব বসন্ত। কর্তৃত্ববাদী শাসন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, পারিবারিক শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের এই অভ্যুত্থানের আপনি আরব বসন্তের সম্পূর্ণ মিল পাবেন।’

রাজধানী কলম্বোয় চালের ন্যূনতম দাম কেজিপ্রতি ২০০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। গম প্রতি কেজি ১৯০ রুপি, চিনি ২৪০, নারকেল তেলের দাম লিটারে ৮৫০ রুপি। একটি ডিমের দাম ৩০ রুপি। প্রতি কেজি গুঁড়া দুধের দাম ১ হাজার ৯ রুপি। সবজির দাম প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যার পকেটে সামান্য কিছু অর্থ আছে তারা ডিজেল, কেরোসিনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন, কাগজ না থাকায় শিশুদের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে, তীব্র ওষুধ ঘাটতির কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চলছে জরুরি অবস্থা, ১২-১৩ ঘণ্টার মতো চলছে লোডশেডিং। পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। গত কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কা শাসন করছে রাজাপাকসে পরিবার। প্রেসিডেন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ প্রতিটি উঁচু পদেই তাদের দৌরাত্ম্য ও একচ্ছত্র আধিপত্য। ২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে এক দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য জনপ্রিয়তা পাওয়া প্রেসিডেন্ট গৌতব্য রাজাপাকসেরও এখন দুর্নীতির এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের পাহাড়। এরই মধ্যে ৪১ জন আইনপ্রণেতা ক্ষমতাসীন জোট থেকে ওয়াকআউট করেছেন। প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসের সম্পূর্ণ মন্ত্রিপরিষদ পদত্যাগ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছেন রাজাপাকসের ছেলে। পদ ছেড়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। এদিকে বিরোধী দল এবং দেশটির আপামর জনসাধারণ রাজাপাকসে পরিবারের সব সদস্যের পদত্যাগ এবং জাতীয় সরকার গড়ার দাবি অব্যাহত রেখেছেন।

আমাদের সময়টা ভালো যাচ্ছে না। প্রবীণরা বলেন তাদের সময় ভালো ছিল। আমরা অনেকে বলি শৈশব, বাল্যকালই ভালো ছিল। কিন্তু আমাদের এ সময়ে কোথায় যেন একটা গোলমাল লেগে গেল। মাত্র ৫০ বছর আগে এই দেশটার জন্ম। এই অল্প সময়ে দেশের মানুষেরাই তো এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই যে সবকিছুর মাঝে কী একটা গ-গোল লেগে গেছে! আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে, সাম্যের গান গাইছে না সবাই। এই গোলমাল থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজে চলেছে সবাই। দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের মেরুদ-টা একটু নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় অনেক বিষয় নিয়েই এখন আর চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় না।

অসাধারণ সব গল্প ভেসে বেড়াচ্ছে রাস্তাঘাটে, লুফে নিলেই তা থেকে তৈরি হতে পারত মনকাড়া সিনেমা, কিন্তু হায়! এখন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মানুষই তো খুঁজে পাওয়া যায় না। হাতের স্মার্টফোনে কবজি ডুবিয়ে রঙিন ভার্চুয়াল জগতে ভোজন করছেন যারা, তারা বাস্তব জগৎ নিয়ে কম চিন্তিত। বাস্তব জগতের টানাপোড়েন নেই সেখানে। নিজের যা ভালো লাগে, শুধু তাই নিয়ে থাকলেই জীবন কেটে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বাজারে আগুন, টিপ নিয়ে এক পুলিশ কনস্টেবলের মাথা ঘুরিয়ে দেয়া কর্মকা-, দারিদ্র্যের কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং-পড়–য়া শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিজ্ঞান শিক্ষককের ধর্মবিদ্বেষী গল্প। মনে হতে পারে অনেক দূরের কোনো ঘটনা। বাস্তব জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা মানুষেরা এমন অনেক কিছুই হারাচ্ছেন, যা জানা থাকলে তাদের ভাবনার জগৎটা একটু হলেও বদলে যেত। সে রকমই একটি ঘটনার দেখা মিলল মিরপুরের কচুক্ষেত এলাকার রজনীগন্ধা মার্কেটে। ঘটনাটি যদি হলিউড কিংবা বলিউডের কোন চিত্রনাট্যকার পেতেন, তাহলে লুফে নিতেন। যে ডাকাতের দল নিরাপত্তাকর্মী ও ক্লিনারের বেশে মার্কেটে চাকরি নিয়ে একসময় সুযোগ বুঝে জুয়েলারির দোকান থেকে লোপাট করে ৩০০ ভরি স্বর্ণালংকার, তাদের কাছে তারা ছুটে আসতেন। শুনতেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা। তারপর কোনো রিসোর্টে গিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে এক মাস ধরে লিখতেন ছবির চিত্রনাট্য। এরপর সেই ছবি সিনেমা হলে মুক্তি পেলে বক্স অফিস ভেঙে খান খান হয়ে যেত।

আহা! স্রেফ বাংলাদেশের মতো এক দেশে জন্মেছেন বলেই এই ডাকাতেরা সাংস্কৃতিক সুবিধাটাও নিতে পারলেন না! একসময় ‘বুচ ক্যাসেডি অ্যান্ড সানড্যান্স কিড’ নামের একটি হলিউডি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল। পল নিউম্যান আর রবার্ট রেডফোর্ডের অভিনয় দেখতে যেন উৎসব লেগে যায় প্রেক্ষাগৃহে। এ ছাড়া ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে নির্মিত ‘দ্য টাউন’, ‘ইনসাইড ম্যান’, ‘হেল অর হাই ওয়াটার’, ‘ডগ ডে আফটারনুন’, কিংবা ‘হিট’ নামের ছবিগুলোর কথা বলতে হয়। দেখা যাবে, কতটা পরিকল্পিতভাবেই না ডাকাতির জন্য তৈরি হয় একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত! আমাদের এ ডাকাত দলটিও ডাকাতিতে হাত পাকিয়েছে অন্তত এক যুগ ধরে। মূলত স্বর্ণালংকারের প্রতিই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থেকেছে। ভুয়া পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদ তৈরি করে বিভিন্ন পেশার ছদ্মবেশে তারা ডাকাতি চালিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু এ যাত্রায় তারা পার পেল না! কয়েকজন ধরা পড়ে গেল র?্যাবের হাতে! সেই সঙ্গে একটি অসাধারণ চিত্রনাট্যের পরিসমাপ্তি ঘটল। রসিকতাকে সরিয়ে রেখে এখন শুধু জিজ্ঞাসা : সবার অগোচরে এ রকম কতগুলো বাহিনী গড়ে উঠেছে, তার হিসাব কি আছে কারও কাছে? অপকর্ম করার পরেই কি শুধু এরা ধরা পড়বে, তার আগেই কি এদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কোনো উপায় জানা নেই আমাদের?

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]