আদিবাসী শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে

মিথুশিলাক মুরমু

গত ১ এপ্রিল তারিখ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি ভর্তিচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পরীক্ষায় দেশের আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা নিয়মানুযায়ী জেলা প্রশাসক কর্তৃক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী (আদিবাসী) সনদপত্র সংগ্রহ ও জমা দেয়া সাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর খুব দ্রুতই কর্তৃপক্ষ ৫ এপ্রিল রেজাল্ট প্রকাশ করেছে, যা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু আশ্চর্যান্বিত হয়েছি, আদিবাসী কোটায় আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের নামের তালিকা না দেখে, প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর নিশ্চত হয়েছি; যাদের নাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তালিকা প্রদান করেছে, তারা কেউ-ই আদিবাসী নন। যে সব নামগুলো তালিকায় স্থান পেয়েছেÑ মো. নাজমুল ইসলাম, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ; খন্দকার কাশেবা কুমকুম, মাগুরা মেডিকেল কলেজ, মো. সাকিব আবসার, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা।

প্রশ্ন হচ্ছেÑ আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের জেলা প্রশাসক কর্তৃক সনদ পেতে প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সনদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতঃপর জেলা প্রশাসক মহোদয় আবারও পুলিশ ভেরিফিকেশন পরই সনদপত্র দিয়ে থাকেন; এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। সে ক্ষেত্রে কী করে মো. নাজমুল ইসলাম, খন্দকার কাশেবা কুমকুম, মো. সাকিব আবসার আদিবাসী সনদপত্র পাচ্ছেন। কে বা কারা এটির সঙ্গে জড়িত? কীভাবে এতগুলো দায়িত্ববান প্রশাসনিক কর্মকর্তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সম্পাদিত হলো ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠি। অন্যদিকে যারা সত্যিকারের আদিবাসী হিসেবে প্রমাণিত, তাদেরই নয়ছয় বুঝিয়ে কালক্ষেপণ করে সনদপত্র দিতে গড়িমসি করে থাকেন। নিশ্চয়ই প্রভাবশালী চক্র জড়িত রয়েছে কিন্তু কেন সবচেয়ে অনগ্রসর, পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে! কাউকে পেছনে ফেলে নয়, সবাইকে নিয়েই এগুনোর প্রচেষ্টা সরকারের রয়েছে; তাহলে কী সরকারের অভ্যন্তরেই ‘ভূত’ রয়েছে! শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানোর ফুঁ-ফা দেয়া যায় কিন্তু কখনোই ভূত উৎখাত করা যায় না। আমরা ওই তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু কীভাবে তারা আদিবাসী কোটায় অন্তর্ভুক্তি হলেন, সেটি পরিষ্কার হওয়া আবশ্যক।

বিগত বছরও পর্যবেক্ষণ করেছি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত স্বাস্থ্য শিক্ষার জন্য দেশের সরকারি ডেন্টাল কলেজ ও মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে (বিডিএস) ভর্তির জন্য নির্ধারিত আদিবাসী কোটায় অ-আদিবাসী ছাত্রছাত্রী নির্বাচন করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর বিডিএস (ডেন্টাল) কোর্সে শিক্ষার্থীদের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায়, ভর্তির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিডিএস কোর্সে আদিবাসীদের জন্য পাঁচটি আসন সংরক্ষিত। এই পাঁচ আসনের মধ্যে পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের জন্য তিনটি এবং অন্য আদিবাসীদের জন্য দুটি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করার কথা। পার্বত্য এলাকার তিন আসনে সঠিক নিয়মেই শিক্ষার্থী মনোনীত হলেও অন্য আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত দুই আসনে (কোড ৭৭) মনোনয়ন দেয়া হয়েছে বাঙালি শিক্ষার্থীদের। ভর্তি পরীক্ষায় সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে ১৫ জন কৃতকার্য হলেও তাদের কাউকেই ভর্তির জন্য মনোনীত করা হয়নি।

তথ্য মতে, কৃতকার্যদের মধ্যে পাঁচজন সাঁওতাল, চারজন গারো, তিনজন মণিপুরী, দুজন ওরাঁও এবং একজন হাজং জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী ছিল। সমতল আদিবাসীদের জন্য ৭৭ কোর্ডে নির্ধারিত ২ জন আদিবাসী শিক্ষার্থীর স্থানে অ-আদিবাসী শিক্ষার্থীরা হলো-১. আবু মো. মোস্তফা কামাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট, ঢাকা এবং ২. আনজুম ফারিয়া, সিলেট এম এ জি ওসমানি মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট। এসব শিক্ষার্থীর কেউই বাংলাদেশ সরকারের গেজেটভুক্ত ৫৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর (আদিবাসী জাতিসত্তার) সদস্য নয়।

ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজি, বাংলাদেশ বর্তমানে একমাত্র আন্তর্জাতিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। ঢাকার অদূরে গাজীপুরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা চেষ্টা করলে প্রথম দর্শনেই চোখ ছানাবড়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ^বিদ্যালয়টি ওয়েবসাইটে লেখা আছে- only Muslim applicants can apply for admission in IUT. তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? বিশ^বিদ্যালয়ে থাকা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাক্টশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যা- ইলেক্ট্র্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিএ টেকনোলজিক্যাল ম্যানেজমেন্ট, ব্যাচেলর অব টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়গুলোতে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা কী পড়বে না? খ্রিস্টান ধর্মের একমাত্র বিশ^বিদ্যালয় ‘নটর ডেম বিশ^বিদ্যালয়’ তো কখনোই এ জাতীয় নোটিস লেখে না? কিংবা দেশের অভ্যন্তরে অনেক প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে; যতদূর মনে পড়ে কোথাও কোনরূপ বৈষম্য রয়েছে বলে মনে পড়ে না। উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে, কোন বিবেচনায় অমুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুপযুক্ত, সেটি কোনভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এরূপ বৈষম্য পবিত্র সংবিধানের ২৮/৩ কে লঙ্ঘন করে। সংবিধানে বর্ণিত রয়েছেÑ ‘শুধু ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’ পবিত্র সংবিধানকে ক্ষুণœ করে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের অধিকারকে ক্ষুণœ করে বাংলাদেশ কীভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হবে সেটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।

স্থানীয় ও জাতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রায়শই চোখে পড়ে উপজেলা, জেলা পর্যায়ে সরকার কর্তৃক আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার উপকরণ বিতরণ, সাইকেল বিতরণ, বৃত্তির টাকা প্রদান এবং পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতায় প্রাণিজ সম্পদও বিতরণ করা হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকেও আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। আদিবাসীদের শিক্ষিত করে তুলতে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। উদ্দেশ্য একটিইÑ অনগ্রসর, পিছিয়েপড়া এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রজন্মরা যাতে নিজ পরিবার, সমাজ, এলাকা ও দেশের জন্য অবদান রাখতে পারে। একপক্ষ উন্নয়ন হলে হবে না, সমগ্র দেশবাসীর উন্নয়ন সম্ভবপর হলেই সুখী সমৃদ্ধি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এগিয়ে যাব। হতাশার কথা হচ্ছেÑ গ্রামগঞ্জের আদিবাসী শিক্ষানুরাগী শিক্ষার্থীরা দেশের প্রফেসনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে যদি বারংবার বৈষম্যের শিকার হয়, স্বপ্ন ভেঙে যায়, সেটির নৈতিক দায়ভার সরকারকেও নিতে হবে। অবিলম্বে এ চক্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার।

বর্তমান সরকার অত্যন্ত সচেতনার সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে থাকা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রশংসিত হয়েছে। সরকার প্রধান মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনসাধারণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর অবদানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করে থাকেন; এতে আমরা সম্মানিত হই। অনগ্রসর ও পিছিয়েপড়া জাতিগুলোকে উচ্চশিক্ষা থেকে দূরে রাখার যে হীন প্রচেষ্টা চলছে, এটি নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। আদিবাসীরা কোথায় যাবে, কার কাছে অভিযোগ উত্থাপন করবে? মাননীয় সরকারপ্রধান ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আরজ, বারবার আদিবাসীদের বঞ্চনা, বৈষম্যের যে ঘটনাগুলো সংঘটিত হচ্ছে, সেটির আশু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রার্থনা করছি। এতে করে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ও সুগম হবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২ , ০৩ বৈশাখ ১৪২৮ ১৪ রমাদ্বান ১৪৪৩

আদিবাসী শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে

মিথুশিলাক মুরমু

গত ১ এপ্রিল তারিখ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি ভর্তিচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পরীক্ষায় দেশের আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা নিয়মানুযায়ী জেলা প্রশাসক কর্তৃক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী (আদিবাসী) সনদপত্র সংগ্রহ ও জমা দেয়া সাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর খুব দ্রুতই কর্তৃপক্ষ ৫ এপ্রিল রেজাল্ট প্রকাশ করেছে, যা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু আশ্চর্যান্বিত হয়েছি, আদিবাসী কোটায় আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের নামের তালিকা না দেখে, প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর নিশ্চত হয়েছি; যাদের নাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তালিকা প্রদান করেছে, তারা কেউ-ই আদিবাসী নন। যে সব নামগুলো তালিকায় স্থান পেয়েছেÑ মো. নাজমুল ইসলাম, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ; খন্দকার কাশেবা কুমকুম, মাগুরা মেডিকেল কলেজ, মো. সাকিব আবসার, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা।

প্রশ্ন হচ্ছেÑ আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের জেলা প্রশাসক কর্তৃক সনদ পেতে প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সনদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতঃপর জেলা প্রশাসক মহোদয় আবারও পুলিশ ভেরিফিকেশন পরই সনদপত্র দিয়ে থাকেন; এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। সে ক্ষেত্রে কী করে মো. নাজমুল ইসলাম, খন্দকার কাশেবা কুমকুম, মো. সাকিব আবসার আদিবাসী সনদপত্র পাচ্ছেন। কে বা কারা এটির সঙ্গে জড়িত? কীভাবে এতগুলো দায়িত্ববান প্রশাসনিক কর্মকর্তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সম্পাদিত হলো ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠি। অন্যদিকে যারা সত্যিকারের আদিবাসী হিসেবে প্রমাণিত, তাদেরই নয়ছয় বুঝিয়ে কালক্ষেপণ করে সনদপত্র দিতে গড়িমসি করে থাকেন। নিশ্চয়ই প্রভাবশালী চক্র জড়িত রয়েছে কিন্তু কেন সবচেয়ে অনগ্রসর, পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে! কাউকে পেছনে ফেলে নয়, সবাইকে নিয়েই এগুনোর প্রচেষ্টা সরকারের রয়েছে; তাহলে কী সরকারের অভ্যন্তরেই ‘ভূত’ রয়েছে! শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানোর ফুঁ-ফা দেয়া যায় কিন্তু কখনোই ভূত উৎখাত করা যায় না। আমরা ওই তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু কীভাবে তারা আদিবাসী কোটায় অন্তর্ভুক্তি হলেন, সেটি পরিষ্কার হওয়া আবশ্যক।

বিগত বছরও পর্যবেক্ষণ করেছি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত স্বাস্থ্য শিক্ষার জন্য দেশের সরকারি ডেন্টাল কলেজ ও মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে (বিডিএস) ভর্তির জন্য নির্ধারিত আদিবাসী কোটায় অ-আদিবাসী ছাত্রছাত্রী নির্বাচন করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর বিডিএস (ডেন্টাল) কোর্সে শিক্ষার্থীদের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায়, ভর্তির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিডিএস কোর্সে আদিবাসীদের জন্য পাঁচটি আসন সংরক্ষিত। এই পাঁচ আসনের মধ্যে পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের জন্য তিনটি এবং অন্য আদিবাসীদের জন্য দুটি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করার কথা। পার্বত্য এলাকার তিন আসনে সঠিক নিয়মেই শিক্ষার্থী মনোনীত হলেও অন্য আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত দুই আসনে (কোড ৭৭) মনোনয়ন দেয়া হয়েছে বাঙালি শিক্ষার্থীদের। ভর্তি পরীক্ষায় সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে ১৫ জন কৃতকার্য হলেও তাদের কাউকেই ভর্তির জন্য মনোনীত করা হয়নি।

তথ্য মতে, কৃতকার্যদের মধ্যে পাঁচজন সাঁওতাল, চারজন গারো, তিনজন মণিপুরী, দুজন ওরাঁও এবং একজন হাজং জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী ছিল। সমতল আদিবাসীদের জন্য ৭৭ কোর্ডে নির্ধারিত ২ জন আদিবাসী শিক্ষার্থীর স্থানে অ-আদিবাসী শিক্ষার্থীরা হলো-১. আবু মো. মোস্তফা কামাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট, ঢাকা এবং ২. আনজুম ফারিয়া, সিলেট এম এ জি ওসমানি মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট। এসব শিক্ষার্থীর কেউই বাংলাদেশ সরকারের গেজেটভুক্ত ৫৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর (আদিবাসী জাতিসত্তার) সদস্য নয়।

ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজি, বাংলাদেশ বর্তমানে একমাত্র আন্তর্জাতিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। ঢাকার অদূরে গাজীপুরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা চেষ্টা করলে প্রথম দর্শনেই চোখ ছানাবড়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ^বিদ্যালয়টি ওয়েবসাইটে লেখা আছে- only Muslim applicants can apply for admission in IUT. তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? বিশ^বিদ্যালয়ে থাকা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাক্টশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যা- ইলেক্ট্র্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিএ টেকনোলজিক্যাল ম্যানেজমেন্ট, ব্যাচেলর অব টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়গুলোতে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা কী পড়বে না? খ্রিস্টান ধর্মের একমাত্র বিশ^বিদ্যালয় ‘নটর ডেম বিশ^বিদ্যালয়’ তো কখনোই এ জাতীয় নোটিস লেখে না? কিংবা দেশের অভ্যন্তরে অনেক প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে; যতদূর মনে পড়ে কোথাও কোনরূপ বৈষম্য রয়েছে বলে মনে পড়ে না। উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে, কোন বিবেচনায় অমুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুপযুক্ত, সেটি কোনভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এরূপ বৈষম্য পবিত্র সংবিধানের ২৮/৩ কে লঙ্ঘন করে। সংবিধানে বর্ণিত রয়েছেÑ ‘শুধু ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’ পবিত্র সংবিধানকে ক্ষুণœ করে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের অধিকারকে ক্ষুণœ করে বাংলাদেশ কীভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হবে সেটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।

স্থানীয় ও জাতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রায়শই চোখে পড়ে উপজেলা, জেলা পর্যায়ে সরকার কর্তৃক আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার উপকরণ বিতরণ, সাইকেল বিতরণ, বৃত্তির টাকা প্রদান এবং পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতায় প্রাণিজ সম্পদও বিতরণ করা হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকেও আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। আদিবাসীদের শিক্ষিত করে তুলতে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। উদ্দেশ্য একটিইÑ অনগ্রসর, পিছিয়েপড়া এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রজন্মরা যাতে নিজ পরিবার, সমাজ, এলাকা ও দেশের জন্য অবদান রাখতে পারে। একপক্ষ উন্নয়ন হলে হবে না, সমগ্র দেশবাসীর উন্নয়ন সম্ভবপর হলেই সুখী সমৃদ্ধি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এগিয়ে যাব। হতাশার কথা হচ্ছেÑ গ্রামগঞ্জের আদিবাসী শিক্ষানুরাগী শিক্ষার্থীরা দেশের প্রফেসনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে যদি বারংবার বৈষম্যের শিকার হয়, স্বপ্ন ভেঙে যায়, সেটির নৈতিক দায়ভার সরকারকেও নিতে হবে। অবিলম্বে এ চক্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার।

বর্তমান সরকার অত্যন্ত সচেতনার সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে থাকা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রশংসিত হয়েছে। সরকার প্রধান মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনসাধারণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর অবদানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করে থাকেন; এতে আমরা সম্মানিত হই। অনগ্রসর ও পিছিয়েপড়া জাতিগুলোকে উচ্চশিক্ষা থেকে দূরে রাখার যে হীন প্রচেষ্টা চলছে, এটি নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। আদিবাসীরা কোথায় যাবে, কার কাছে অভিযোগ উত্থাপন করবে? মাননীয় সরকারপ্রধান ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আরজ, বারবার আদিবাসীদের বঞ্চনা, বৈষম্যের যে ঘটনাগুলো সংঘটিত হচ্ছে, সেটির আশু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রার্থনা করছি। এতে করে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ও সুগম হবে।

[লেখক : কলামিস্ট]