চাই সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বর্জ্যরে আধুনিক ও নিরাপদ অপসারণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা। ক্ষুদ্র আয়তনের দেশটিতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা। চলমান উন্নয়নের ধারায় ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, শিল্পকারখানা, কৃষিক্ষেত্র, শোধনাগার, কসাইখানা এবং উন্মুক্ত স্থান থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ কঠিন ও তরল আবর্জনা প্রতিনিয়ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলছে।

রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনা, হাটবাজারের পচনশীল শাকসবজি, কলকারখানার তৈলাক্ত পদার্থ, কসাইখানার রক্ত, ছাপাখানার রং, হাসপাতালের বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থের নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত না হওয়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হয়ে উঠছে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং আধুনিক জীবনযাপনে ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, প্যাকেটজাত খাবারের কৌটা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিধি বিস্তৃত করে চলছে। ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকায় কঠিন বর্জ্য অপসারণে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নেই।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মহানগরের ২০ মিলিয়ন মানুষের বিপুল পরিমাণ গৃহস্থালি বর্জ্য প্রতিনিয়ত এখানে সেখানে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা থেকে উৎপন্ন বর্জ্যরে পরিমাণও বিপুল। ঢাকা মেগাসিটিতে প্রতিদিন প্রায় ৫০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মাত্র অর্ধেকের কিছু বেশি পরিমাণ বর্জ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে শহরের দূরে স্তূপ করে রাখা হয়। বাকিটা খোলা ডাস্টবিনে অথবা রাস্তার পাশে স্তূপাকৃত হয়ে পড়ে থাকে। অপচনশীল কঠিন পদার্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছে।

কঠিন ও তরল উভয় বর্জ্যরে ক্ষেত্রেই রোগ বিস্তারকারী ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ত ধাতব পদার্থসমূহ জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে কঠিন বর্জ্য পরিচালন ব্যবস্থা আজও মানুষের শ্রমনির্ভর। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোটবড় শহরগুলোতে এখনও মানুষ কঠিন ও আধা কঠিন আবর্জনা সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে ফেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর্জ্যরে তুলনায় ডাস্টবিনের সংখ্যাও অপ্রতুল। মানুষের অজ্ঞতা ও অসাবধানতার কারণে ডাস্টবিনগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। বর্ষা মৌসুমে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। কঠিন বর্জ্য রাস্তার পার্শ্বস্থ ড্রেনে পড়ে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাকে একেবারে অচল করে দেয়। দেশের বেশির ভাগ স্থানে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত সিউয়ার এবং ড্রেন নেই। ফলে সিউয়েজের নিরাপদ অপসারণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরে খাল, নদীর মতো প্রাকৃতিক জলাধারগুলো শুকিয়ে গেছে অথবা অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। ফলে তরল বর্জ্যরে অপসারণের স্বাভাবিক বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

গ্রামগঞ্জের তরলবর্জ্য অপসারণ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আরও নাজুক। গৃহস্থালি বর্জ্য নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তা ঘরবাড়ির আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। এসব দূষিত তরল বর্জ্য কালক্রমে পুকুর, খাল অথবা নদীতে গিয়ে পড়ে এবং নদীদূষণের কারণ হয়। ভূপৃষ্ঠস্থ দূষিত পানির প্রভাবে সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানিও ধীরে ধীরে দূষিত হতে থাকে। এসব পানি পান করে পানিবাহিত রোগের বিস্তার ঘটে। শহরাঞ্চলের ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাসকারী লাখো কোটি মানুষের জন্য সেনিটেশন ব্যবস্থা নেই। এসব ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসন করা ছাড়া সেখানকার পয়ঃনিষ্কাশন সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

একটি এলাকার কঠিন, আধা কঠিন ও তরল বর্জ্যকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা বর্জ্য পরিচালন। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন আবর্জনা সংগ্রহ, স্থানান্তর, প্রক্রিয়াকরণ এবং চূড়ান্ত অপসারণ কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পাদন করা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য। একটি পরিসংখ্যান মতে সারা দেশে যেখানে বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ১.৪, সেখানে শহরাঞ্চলে বেড়ে চলেছে শতকরা ৩.৪ হারে। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে বর্তমান সময়ের দ্বিগুণ। বর্জ্যকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করা হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষার অন্যতম প্রধান উপায়। পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার বিকল্প নেই। এলাকার জনস্বাস্থ্য, কারিগরি এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সফল কার্যকারিতা নির্ভর করে। আঞ্চলিক পরিবেশ এবং এলাকার জনগণের প্রাত্যহিক জীবনযাপন পদ্ধতি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

বর্জ্যরে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিতকরণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করে অপসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি শহরে বন্দরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক হেভি লোডার সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়ে। শহরের কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন ভোরে ঢাকনাযুক্ত বিশেষ ট্রাকে সংগ্রহ করে নিরাপদ অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহের জন্য রাস্তার পাশে ঢাকনাযুক্ত সঠিক মাপের ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে। জনগণকেও প্লাস্টিক ব্যাগে আবদ্ধ করে কঠিন বর্জ্য উক্ত ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা একত্রকরণের জন্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা স্থানীয়ভাবে জনশক্তি নিয়োগে সহায়তা করতে পারে। জনগণ ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কর হিসাবে দেয়। এর বিনিময়ে সেবা পাওয়া তাদের নাগরিক অধিকার।

তরল বর্জ্য অপসারণের নিমিত্তে ওয়াসাকে সঠিক মাপের উন্মুক্ত ড্রেন ও ভূগর্ভস্থ সিউয়ার নির্মাণ করতে হবে। বাসাবাড়ির অভ্যন্তরীণ ড্রেনকে এইসব সিউয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ঘরবাড়িতে সেপটিক ট্যাংক ও হাউস ড্রেন নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি। এসব ড্রেনকে সঠিকভাবে মেইন সিউয়ারের সঙ্গে সংযোগ দিতে হবে। নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য জনবল কাঠামো বিস্তৃত করতে হবে। বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি সহজে নিষ্কাশিত হওয়ার জন্য রাখতে হবে স্টর্ম সিউয়ার। দখল হয়ে যাওয়া নদী ও খাল উদ্ধার করে তা পুনর্খননের ব্যবস্থা নিতে হবে।

বর্জ্যরে মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ থাকে জৈব পদার্থ এবং শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ জলীয় কণা বিদ্যমান থাকে। কাজেই বর্জ্যকে নিরাপদ স্থানে অপসারণ করার পূর্বে বর্জ্যরে স্বাস্থ্যসম্মত বিশোধন (ট্রিটমেন্ট) করা জরুরি। কঠিন বর্জ্যকে পুনরাবর্তন (রিসাইক্লিং) করার জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত প্রকল্প হাতে নেয়া আবশ্যক। এর অন্যথা হলে যে কী পরিস্থিতি হতে পারে, তা আজ ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার বেহাল অবস্থা দেখে বোঝা যায়। শিল্প কলকারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্যরে অনিয়ন্ত্রিত বিশোধন ছাড়াই অবাধে বুড়িগঙ্গায় ফেলার ফলে নদীর পানি কালো, বিষাক্ত, ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। পচা পানির গন্ধে নদীর পাশ দিয়েও হাঁটা যায় না। তরল বর্জ্য যাতে পরিবেশ ঝুঁকির কারণ না হয় সে জন্য পর্যাপ্ত উন্নত ডিজাইনের সিউয়ার ও উন্মুুক্ত ড্রেন লাইন স্থাপনসহ সিউয়েজ পরিশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২ , ০৩ বৈশাখ ১৪২৮ ১৪ রমাদ্বান ১৪৪৩

চাই সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বর্জ্যরে আধুনিক ও নিরাপদ অপসারণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা। ক্ষুদ্র আয়তনের দেশটিতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা। চলমান উন্নয়নের ধারায় ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, শিল্পকারখানা, কৃষিক্ষেত্র, শোধনাগার, কসাইখানা এবং উন্মুক্ত স্থান থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ কঠিন ও তরল আবর্জনা প্রতিনিয়ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলছে।

রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনা, হাটবাজারের পচনশীল শাকসবজি, কলকারখানার তৈলাক্ত পদার্থ, কসাইখানার রক্ত, ছাপাখানার রং, হাসপাতালের বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থের নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত না হওয়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হয়ে উঠছে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং আধুনিক জীবনযাপনে ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, প্যাকেটজাত খাবারের কৌটা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিধি বিস্তৃত করে চলছে। ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকায় কঠিন বর্জ্য অপসারণে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নেই।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মহানগরের ২০ মিলিয়ন মানুষের বিপুল পরিমাণ গৃহস্থালি বর্জ্য প্রতিনিয়ত এখানে সেখানে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা থেকে উৎপন্ন বর্জ্যরে পরিমাণও বিপুল। ঢাকা মেগাসিটিতে প্রতিদিন প্রায় ৫০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মাত্র অর্ধেকের কিছু বেশি পরিমাণ বর্জ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে শহরের দূরে স্তূপ করে রাখা হয়। বাকিটা খোলা ডাস্টবিনে অথবা রাস্তার পাশে স্তূপাকৃত হয়ে পড়ে থাকে। অপচনশীল কঠিন পদার্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছে।

কঠিন ও তরল উভয় বর্জ্যরে ক্ষেত্রেই রোগ বিস্তারকারী ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ত ধাতব পদার্থসমূহ জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে কঠিন বর্জ্য পরিচালন ব্যবস্থা আজও মানুষের শ্রমনির্ভর। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোটবড় শহরগুলোতে এখনও মানুষ কঠিন ও আধা কঠিন আবর্জনা সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে ফেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর্জ্যরে তুলনায় ডাস্টবিনের সংখ্যাও অপ্রতুল। মানুষের অজ্ঞতা ও অসাবধানতার কারণে ডাস্টবিনগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। বর্ষা মৌসুমে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। কঠিন বর্জ্য রাস্তার পার্শ্বস্থ ড্রেনে পড়ে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাকে একেবারে অচল করে দেয়। দেশের বেশির ভাগ স্থানে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত সিউয়ার এবং ড্রেন নেই। ফলে সিউয়েজের নিরাপদ অপসারণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরে খাল, নদীর মতো প্রাকৃতিক জলাধারগুলো শুকিয়ে গেছে অথবা অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। ফলে তরল বর্জ্যরে অপসারণের স্বাভাবিক বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

গ্রামগঞ্জের তরলবর্জ্য অপসারণ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আরও নাজুক। গৃহস্থালি বর্জ্য নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তা ঘরবাড়ির আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। এসব দূষিত তরল বর্জ্য কালক্রমে পুকুর, খাল অথবা নদীতে গিয়ে পড়ে এবং নদীদূষণের কারণ হয়। ভূপৃষ্ঠস্থ দূষিত পানির প্রভাবে সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানিও ধীরে ধীরে দূষিত হতে থাকে। এসব পানি পান করে পানিবাহিত রোগের বিস্তার ঘটে। শহরাঞ্চলের ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাসকারী লাখো কোটি মানুষের জন্য সেনিটেশন ব্যবস্থা নেই। এসব ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসন করা ছাড়া সেখানকার পয়ঃনিষ্কাশন সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

একটি এলাকার কঠিন, আধা কঠিন ও তরল বর্জ্যকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা বর্জ্য পরিচালন। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন আবর্জনা সংগ্রহ, স্থানান্তর, প্রক্রিয়াকরণ এবং চূড়ান্ত অপসারণ কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পাদন করা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য। একটি পরিসংখ্যান মতে সারা দেশে যেখানে বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ১.৪, সেখানে শহরাঞ্চলে বেড়ে চলেছে শতকরা ৩.৪ হারে। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে বর্তমান সময়ের দ্বিগুণ। বর্জ্যকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করা হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষার অন্যতম প্রধান উপায়। পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার বিকল্প নেই। এলাকার জনস্বাস্থ্য, কারিগরি এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সফল কার্যকারিতা নির্ভর করে। আঞ্চলিক পরিবেশ এবং এলাকার জনগণের প্রাত্যহিক জীবনযাপন পদ্ধতি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

বর্জ্যরে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিতকরণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করে অপসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি শহরে বন্দরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক হেভি লোডার সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়ে। শহরের কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন ভোরে ঢাকনাযুক্ত বিশেষ ট্রাকে সংগ্রহ করে নিরাপদ অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহের জন্য রাস্তার পাশে ঢাকনাযুক্ত সঠিক মাপের ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে। জনগণকেও প্লাস্টিক ব্যাগে আবদ্ধ করে কঠিন বর্জ্য উক্ত ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা একত্রকরণের জন্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা স্থানীয়ভাবে জনশক্তি নিয়োগে সহায়তা করতে পারে। জনগণ ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কর হিসাবে দেয়। এর বিনিময়ে সেবা পাওয়া তাদের নাগরিক অধিকার।

তরল বর্জ্য অপসারণের নিমিত্তে ওয়াসাকে সঠিক মাপের উন্মুক্ত ড্রেন ও ভূগর্ভস্থ সিউয়ার নির্মাণ করতে হবে। বাসাবাড়ির অভ্যন্তরীণ ড্রেনকে এইসব সিউয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ঘরবাড়িতে সেপটিক ট্যাংক ও হাউস ড্রেন নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি। এসব ড্রেনকে সঠিকভাবে মেইন সিউয়ারের সঙ্গে সংযোগ দিতে হবে। নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য জনবল কাঠামো বিস্তৃত করতে হবে। বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি সহজে নিষ্কাশিত হওয়ার জন্য রাখতে হবে স্টর্ম সিউয়ার। দখল হয়ে যাওয়া নদী ও খাল উদ্ধার করে তা পুনর্খননের ব্যবস্থা নিতে হবে।

বর্জ্যরে মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ থাকে জৈব পদার্থ এবং শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ জলীয় কণা বিদ্যমান থাকে। কাজেই বর্জ্যকে নিরাপদ স্থানে অপসারণ করার পূর্বে বর্জ্যরে স্বাস্থ্যসম্মত বিশোধন (ট্রিটমেন্ট) করা জরুরি। কঠিন বর্জ্যকে পুনরাবর্তন (রিসাইক্লিং) করার জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত প্রকল্প হাতে নেয়া আবশ্যক। এর অন্যথা হলে যে কী পরিস্থিতি হতে পারে, তা আজ ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার বেহাল অবস্থা দেখে বোঝা যায়। শিল্প কলকারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্যরে অনিয়ন্ত্রিত বিশোধন ছাড়াই অবাধে বুড়িগঙ্গায় ফেলার ফলে নদীর পানি কালো, বিষাক্ত, ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। পচা পানির গন্ধে নদীর পাশ দিয়েও হাঁটা যায় না। তরল বর্জ্য যাতে পরিবেশ ঝুঁকির কারণ না হয় সে জন্য পর্যাপ্ত উন্নত ডিজাইনের সিউয়ার ও উন্মুুক্ত ড্রেন লাইন স্থাপনসহ সিউয়েজ পরিশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]