মুজিবনগর সরকার ও ইতিহাসের বরপুত্র তাজউদ্দীন

শেখর ভট্টাচার্য

গড়পড়তা বাঙালি রাজনীতিবিদদের থেকে তাজউদ্দীন আহমদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি যে অধিক পরিমাণ ছিল, তা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অসাধারণ দক্ষতায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল সীমাহীন আনুগত্য। আওয়ামী লীগের আদর্শ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও নিবেদন তাকে অন্য ১০ জন রাজনীতিবিদদের থেকে পৃথক করে রেখেছে। মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। তাজউদ্দীন আহমদের ছাত্রজীবনে লেখা দিনলিপির মধ্যে ইতিহাস-অনুসন্ধানীরা খুঁজে পাবেন সময়ের চাইতে অগ্রগামী, গভীর চিন্তাশীল, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবক এক মেধাবী তরুণকে। এই মেধাবী তরুণের হাতেই এসে পড়ে জাতির দূর্দিনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে হাল ধরার গুরু দায়িত্ব। তখন তার বয়স কত? মাত্র ৪৬ বছর। জাতীয় জীবনের চরম ক্রান্তি ও গৌরবের লগ্নে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব এসে পড়ে এই চৌকস, মেধাবী ও দুর দৃষ্টিসম্পন্ন নেতার ওপরে।

তাজউদ্দীন আহমদ, ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী, লাল মাটির আলপনায় সাজানো, শাল-গজারি বনের বেষ্টনীতে দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরবর্তী এই গ্রামে যে প্রতিভাবান শিশুটি সে দিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার হাতেই যে একটি রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হবে, কে জানত? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার প্রেরণা, যখন পাকিস্তান কারাগারে বন্দী, তখন তার অবর্তমানে সর্বসম্মতভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর। তাজউদ্দীন আহমদের কথা ও তার প্রতিটি কাজের মধ্যে আমরা দেখি মাতৃভূমির মর্যাদারক্ষায় তীক্ষè, সজাগ, দূরদর্শী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ এক আত্মপ্রচারবিমুখ ত্যাগী নেতা ও মানুষকে।

তাজউদ্দীন আহমদ তার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, অদম্য সাহস ও দুরদর্শিতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সমীহ অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। বিশ্ব সভায় বাংলাদেশের সমমর্যাদার ব্যাপারে তার নিরাপস ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রতিটি দিনে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের পূর্বে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তার একটি ভাষণ প্রচারিত হয় আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে। ভাষণটি প্রচারিত হয় রাত ১০টার পর প্রচারিত এক বিশেষ সংবাদ অনুষ্ঠানে। তাজউদ্দীনের মেয়ে শারমিন আহমদের নেতা ও পিতা বইটিতে এ ভাষণের কছু অংশ স্থান পেয়েছে। ভাষণটি খেয়াল করুন। “বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি, তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের... মানুষের জন্য। এ সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসাবে... স্বাধীনতার জন্য যে মূল্য আমরা দিয়েছি, তা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হওয়ার জন্য নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিবার গোষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। “একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ তখনো শপথ গ্রহণ করেনি। তাজউদ্দীন শপথ গ্রহণের পূর্বেই তার সাহসী বার্তা ভারতসহ বিশ্বের সব মানুষের সামনে উপস্থাপন করলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চীন মার্কিন তাবেদাররা সক্রিয় ছিল। তারা কয়েকটি বিষয় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে গেছে। প্রথমটি হলো, তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার ভারতের পুতুল সরকার, এ সরকারকে দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। মুজিবনগর সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে উদাসীন। অথচ মুজিবনগর সরকার তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রতিটি কর্মে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা উত্তর সময়ে যাতে একটি উপনিবেশ থেকে আর একটি উপনিবেশে এসে দেশ উপস্থিত না হয় এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিল। আমার এ কথাটির প্রমাণ হিসেবে শ্রীমতি গান্ধীর উদ্দেশে তাজউদ্দীনের বক্তব্যটি উল্লেখ করতে পারি। কী বলেছিলেন তাজউদ্দীনঃ “... যুদ্ধের দিনে, সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতী গান্ধীকে বলেছি, বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখুনি হবে যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বর বন্ধুত্ব হয় না। ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সঙ্গে এসেছিল। সেদিন, শুনে রাখুন আমার বন্ধুরা, কোন গোপন চুক্তি ভারতের সঙ্গে হয়নি। একটাই চুক্তি হয়েছে... যেখানে লেখা ছিল আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহায়ক বাহিনী হিসেবে তোমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং যেদিন আমরা মনে করব আমাদের দেশে আর তোমাদের থাকার দরকার নেই সেই দিন তোমরা চলে যাবে। সেই চুক্তি অনুসারে যে দিন বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন যে, ৩০ মার্চের মধ্যে তোমাদের বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাবে, তখুনি মিসেস গান্ধী ১৯৭২-এর ১৫ মার্চের মধ্যে সহায়ক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।” অথচ পাকিস্তানপন্থী মোশতাক বিরামহীনভাবে প্রচার করে গেছেন তাজউদ্দীন এবং স্বাধীন বাংলা সরকার ভারতের নির্দেশনায় চালিত হচ্ছে।

মুজিবনগর সরকার তার প্রতিটি কার্যক্রম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় এবং বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালনা করেছে। মুজিবনগর মন্ত্রিসভা এবং আওয়ামী লীগের সব প্রাজ্ঞ নেতারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ওপর নির্মিত করতে চেয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। খন্দকার মোশতাক ও তার গুটিকয়েক কয়েক সহচর প্রচার করে বেড়িয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার যথেষ্ট আন্তরিক নয়। পাকিস্তান-মার্কিন গোষ্ঠী মোশতাকের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারকে ফাঁদে ফেলার বার্তা দিয়েছে ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাও নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে চাও?’ জাতির এই চরম দুঃসময়ে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, “আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেমন চাই, একইভাবে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তিও চাই।’ প্রবাসী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মজিব নগর সরকার বিষয়টিকে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে নাকচ করে দিতে মুহূর্ত কালবিলম্ব করেনি।

মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধকালীন সময়ে অজগ্র ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে। জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে যুদ্ধকালীন এ সরকার সব ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদ ও মুজিবনগর সরকারের তিনটি অন্তর্নিহিত শক্তি ছিল। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ একটি সংহত জাতি, দ্বিতীয়ত তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের বিচক্ষণ নেতৃত্ব এবং তৃতীয়ত জনযুদ্ধে সম্মিলিত হওয়ার জন্য সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তি, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণীর মানুষের অদম্য দেশ প্রেম।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিনে জাতির উদ্দেশে দেয়া তাজউদ্দীন আহমদের প্রধান ভাষণটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। যতদূর জানা যায় ভাষণটি রেকর্ড করা হয়েছিল ৬ এপ্রিল। তাজউদ্দীন আহমদের ওই ভাষণে আমরা দেখতে পাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন ওই ঘোষণাকে ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যার ফলে সেদিন কোনো ষড়যন্ত্রকারী বা বিদেশি কোনো মিডিয়া বাংলাদেশের মানুষের প্রতিরোধ যুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখাতে পারেনি। সর্বোপরি এই ভাষণের মূল সুরটি ছিল অনেক গভীরে। অর্থাৎ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ৭০-এর নির্বাচনে জিতেছে, মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হচ্ছে তবে এটা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধÑ এখানে যোগ দিয়েছে গোটা দেশের মানুষ।

একাত্তরের ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ বিবেচনায় তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার জাতির জনকের অনুপস্থিতে জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি অত্যন্ত সফলভাবে পালন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃত্ব, দেশপ্রেম এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। একাত্তরের অত্যন্ত জটিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে জাতির মুক্তিযুদ্ধে সফল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দান করা সহজ কাজ ছিল না। ষড়যন্ত্রকারীরা ফাঁদে ফেলার উদ্দেশে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, তোমরা মুক্ত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও। সেই চ্যালেঞ্জের জবাব ছিল ‘আমরা স্বাধীনতা চাই এবং মুজিবকেও চাই। স্বাধীনতা এলেই আমরা মুজিবকে ফিরে পেতে পারি।’ হলোও তা-ই, বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বাধীন দেশের মাটিতে। তারপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। জাতিকে ঘোর অমানিশা থেকে স্বাধীনতার বন্দরে পৌঁছানোর জন্য তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারকে তাই সর্বার্থে সফল একটি সরকার বলা যায়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

রবিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২২ , ০৪ বৈশাখ ১৪২৮ ১৫ রমাদ্বান ১৪৪৩

মুজিবনগর সরকার ও ইতিহাসের বরপুত্র তাজউদ্দীন

শেখর ভট্টাচার্য

গড়পড়তা বাঙালি রাজনীতিবিদদের থেকে তাজউদ্দীন আহমদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি যে অধিক পরিমাণ ছিল, তা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অসাধারণ দক্ষতায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল সীমাহীন আনুগত্য। আওয়ামী লীগের আদর্শ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও নিবেদন তাকে অন্য ১০ জন রাজনীতিবিদদের থেকে পৃথক করে রেখেছে। মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। তাজউদ্দীন আহমদের ছাত্রজীবনে লেখা দিনলিপির মধ্যে ইতিহাস-অনুসন্ধানীরা খুঁজে পাবেন সময়ের চাইতে অগ্রগামী, গভীর চিন্তাশীল, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবক এক মেধাবী তরুণকে। এই মেধাবী তরুণের হাতেই এসে পড়ে জাতির দূর্দিনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে হাল ধরার গুরু দায়িত্ব। তখন তার বয়স কত? মাত্র ৪৬ বছর। জাতীয় জীবনের চরম ক্রান্তি ও গৌরবের লগ্নে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব এসে পড়ে এই চৌকস, মেধাবী ও দুর দৃষ্টিসম্পন্ন নেতার ওপরে।

তাজউদ্দীন আহমদ, ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী, লাল মাটির আলপনায় সাজানো, শাল-গজারি বনের বেষ্টনীতে দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরবর্তী এই গ্রামে যে প্রতিভাবান শিশুটি সে দিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার হাতেই যে একটি রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হবে, কে জানত? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার প্রেরণা, যখন পাকিস্তান কারাগারে বন্দী, তখন তার অবর্তমানে সর্বসম্মতভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর। তাজউদ্দীন আহমদের কথা ও তার প্রতিটি কাজের মধ্যে আমরা দেখি মাতৃভূমির মর্যাদারক্ষায় তীক্ষè, সজাগ, দূরদর্শী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ এক আত্মপ্রচারবিমুখ ত্যাগী নেতা ও মানুষকে।

তাজউদ্দীন আহমদ তার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, অদম্য সাহস ও দুরদর্শিতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সমীহ অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। বিশ্ব সভায় বাংলাদেশের সমমর্যাদার ব্যাপারে তার নিরাপস ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রতিটি দিনে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের পূর্বে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তার একটি ভাষণ প্রচারিত হয় আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে। ভাষণটি প্রচারিত হয় রাত ১০টার পর প্রচারিত এক বিশেষ সংবাদ অনুষ্ঠানে। তাজউদ্দীনের মেয়ে শারমিন আহমদের নেতা ও পিতা বইটিতে এ ভাষণের কছু অংশ স্থান পেয়েছে। ভাষণটি খেয়াল করুন। “বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি, তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের... মানুষের জন্য। এ সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসাবে... স্বাধীনতার জন্য যে মূল্য আমরা দিয়েছি, তা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হওয়ার জন্য নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিবার গোষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। “একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ তখনো শপথ গ্রহণ করেনি। তাজউদ্দীন শপথ গ্রহণের পূর্বেই তার সাহসী বার্তা ভারতসহ বিশ্বের সব মানুষের সামনে উপস্থাপন করলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চীন মার্কিন তাবেদাররা সক্রিয় ছিল। তারা কয়েকটি বিষয় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে গেছে। প্রথমটি হলো, তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার ভারতের পুতুল সরকার, এ সরকারকে দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। মুজিবনগর সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে উদাসীন। অথচ মুজিবনগর সরকার তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রতিটি কর্মে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা উত্তর সময়ে যাতে একটি উপনিবেশ থেকে আর একটি উপনিবেশে এসে দেশ উপস্থিত না হয় এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিল। আমার এ কথাটির প্রমাণ হিসেবে শ্রীমতি গান্ধীর উদ্দেশে তাজউদ্দীনের বক্তব্যটি উল্লেখ করতে পারি। কী বলেছিলেন তাজউদ্দীনঃ “... যুদ্ধের দিনে, সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতী গান্ধীকে বলেছি, বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখুনি হবে যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বর বন্ধুত্ব হয় না। ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সঙ্গে এসেছিল। সেদিন, শুনে রাখুন আমার বন্ধুরা, কোন গোপন চুক্তি ভারতের সঙ্গে হয়নি। একটাই চুক্তি হয়েছে... যেখানে লেখা ছিল আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহায়ক বাহিনী হিসেবে তোমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং যেদিন আমরা মনে করব আমাদের দেশে আর তোমাদের থাকার দরকার নেই সেই দিন তোমরা চলে যাবে। সেই চুক্তি অনুসারে যে দিন বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন যে, ৩০ মার্চের মধ্যে তোমাদের বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাবে, তখুনি মিসেস গান্ধী ১৯৭২-এর ১৫ মার্চের মধ্যে সহায়ক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।” অথচ পাকিস্তানপন্থী মোশতাক বিরামহীনভাবে প্রচার করে গেছেন তাজউদ্দীন এবং স্বাধীন বাংলা সরকার ভারতের নির্দেশনায় চালিত হচ্ছে।

মুজিবনগর সরকার তার প্রতিটি কার্যক্রম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় এবং বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালনা করেছে। মুজিবনগর মন্ত্রিসভা এবং আওয়ামী লীগের সব প্রাজ্ঞ নেতারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ওপর নির্মিত করতে চেয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। খন্দকার মোশতাক ও তার গুটিকয়েক কয়েক সহচর প্রচার করে বেড়িয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার যথেষ্ট আন্তরিক নয়। পাকিস্তান-মার্কিন গোষ্ঠী মোশতাকের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারকে ফাঁদে ফেলার বার্তা দিয়েছে ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাও নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে চাও?’ জাতির এই চরম দুঃসময়ে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, “আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেমন চাই, একইভাবে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তিও চাই।’ প্রবাসী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মজিব নগর সরকার বিষয়টিকে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে নাকচ করে দিতে মুহূর্ত কালবিলম্ব করেনি।

মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধকালীন সময়ে অজগ্র ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে। জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে যুদ্ধকালীন এ সরকার সব ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদ ও মুজিবনগর সরকারের তিনটি অন্তর্নিহিত শক্তি ছিল। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ একটি সংহত জাতি, দ্বিতীয়ত তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের বিচক্ষণ নেতৃত্ব এবং তৃতীয়ত জনযুদ্ধে সম্মিলিত হওয়ার জন্য সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তি, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণীর মানুষের অদম্য দেশ প্রেম।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিনে জাতির উদ্দেশে দেয়া তাজউদ্দীন আহমদের প্রধান ভাষণটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। যতদূর জানা যায় ভাষণটি রেকর্ড করা হয়েছিল ৬ এপ্রিল। তাজউদ্দীন আহমদের ওই ভাষণে আমরা দেখতে পাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন ওই ঘোষণাকে ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যার ফলে সেদিন কোনো ষড়যন্ত্রকারী বা বিদেশি কোনো মিডিয়া বাংলাদেশের মানুষের প্রতিরোধ যুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখাতে পারেনি। সর্বোপরি এই ভাষণের মূল সুরটি ছিল অনেক গভীরে। অর্থাৎ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ৭০-এর নির্বাচনে জিতেছে, মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হচ্ছে তবে এটা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধÑ এখানে যোগ দিয়েছে গোটা দেশের মানুষ।

একাত্তরের ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ বিবেচনায় তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার জাতির জনকের অনুপস্থিতে জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি অত্যন্ত সফলভাবে পালন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃত্ব, দেশপ্রেম এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। একাত্তরের অত্যন্ত জটিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে জাতির মুক্তিযুদ্ধে সফল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দান করা সহজ কাজ ছিল না। ষড়যন্ত্রকারীরা ফাঁদে ফেলার উদ্দেশে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, তোমরা মুক্ত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও। সেই চ্যালেঞ্জের জবাব ছিল ‘আমরা স্বাধীনতা চাই এবং মুজিবকেও চাই। স্বাধীনতা এলেই আমরা মুজিবকে ফিরে পেতে পারি।’ হলোও তা-ই, বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বাধীন দেশের মাটিতে। তারপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। জাতিকে ঘোর অমানিশা থেকে স্বাধীনতার বন্দরে পৌঁছানোর জন্য তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারকে তাই সর্বার্থে সফল একটি সরকার বলা যায়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]