শ্রীলঙ্কার মতো হবে না বাংলাদেশ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে বর্তমানে ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, ওষুধ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করায় বাঁচার জন্য শ্রীলঙ্কার লোকজন ভারতে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে। জ্বালানি তেল কেনার পয়সা নেই, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বনিম্ন স্তরে, দৈনিক তেরো ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না, বিদ্যুৎ না থাকায় উৎপাদন বন্ধ, সাদা কাগজের অভাবে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বন্ধ, পর্যাপ্ত গ্যাস সিলিন্ডারের অভাবে রান্না হচ্ছে না। সর্বত্র অভাব আর অভাব। শ্রীলঙ্কার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্রুতগতিতে বাড়ছে। চালের কেজি ৫০০ রুপি এবং এক কেজি গুঁড়োদুধের দাম ১৯০০ রুপি; যা বাংলাদেশি টাকায় যথাক্রমে ১৪৫ টাকা ও ৫৫১ টাকা। গ্রামের দোকানদার এক কেজি দুধের প্যাকেট খুলে ১০০ গ্রাম করে বিক্রি করছে। শ্রীলঙ্কায় এমন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই মন্ত্রিসভা থেকে একযোগে ২৬ জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ঠেকাতে শ্রীলঙ্কার রাস্তায় দেশটির সেনারা অবস্থান নিয়েছে। জনগণ সরকারের জারি করা কারফিউ উপেক্ষা করে সরকারের পতন চেয়ে বিক্ষোভ করছেন।

চার-পাঁচ বছর পূর্বেও শ্রীলঙ্কার সামষ্টিক অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল, মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ৪ হাজার ডলার। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পোশাক-শিল্প প্রথম গড়ে উঠে শ্রীলঙ্কায়। পর্যটকদেরও পছন্দের জায়গা ছিল শ্রীলঙ্কা। আশির দশকের গৃহযুদ্ধ শ্রীলঙ্কার অগ্রগতি কিছুটা থামিয়ে দিলেও ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কা উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে কলম্বোর তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে পর্যটনে ধস নামে। করোনা অতিমারি এবং অতিমারি উত্তর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শ্রীলঙ্কার শুধু পর্যটন খাতে নয়, রপ্তানি এবং প্রবাসী আয়ের খাতেও ধস নামে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের নানা অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং সঠিক প্রকল্প বাছাইকরণে ব্যর্থতা। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেই মূল্য সংযোজন কর হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে ধার্য করায় ভ্যাট আদায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পায়। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করায় ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।

শ্রীলঙ্কার ঋণের হার জিডিপির ১১৯ শতাংশ; অর্থাৎ দেশটি এক বছরে যে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে, তার তুলনায় ঋণ বেশি। আইএমএফের কথা অনুযায়ী এই হার ৫৫ শতাংশের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু ব্যয়বহুল ও অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করায় তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির চেয়ে বেশি। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে শ্রীলংকা নিরানব্বই বছরের জন্য হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরটি চীনের কাছে বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছে। জঙ্গলের ভেতর নির্মিত ‘মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ কার্যত অব্যবহৃত। সাগর ভরাট করে ৬৬৫ একর ভূমির ওপর কলম্বো পোর্ট সিটি তৈরি করার জন্য চীনের এক কোম্পানি খরচ করছে ১৪০ কোটি ডলার; সবার আশঙ্কা, হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরের মতো এই পোর্ট সিটিও চীনের মালিকানায় চলে যাবে।

দেশটির রিজার্ভ সংকটের পেছনে আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি, শ্রীলঙ্কায় বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি, রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, ঋণ শোধ করতেই তাদের পুনরায় ঋণ করতে হচ্ছে, প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার কোন বৈদেশিক মুদ্রাই নেই। বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ এ বছর পরিশোধ করতে পারবে না বলে শ্রীলঙ্কা ঋণদাতাদের জানিয়ে দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেও অনেকগুলো ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, প্রবাসী আয় কমে গেছে, আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। শীঘ্রই বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর বিদেশি পাওনার কিস্তি-পরিশোধ শুরু হবে, প্রকল্পগুলো থেকে অনুমিত আয় নির্ধারিত সময়ে ফেরত না এলে শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। বর্তমান সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রোরেল, রামু-কক্সবাজার রেললাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর। সরকারের ধারণা, মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে দেশের সার্বিক চিত্র বদলে যাবে- মাথাপিছু আয় এবং প্রবৃদ্ধিও বেড়ে যাবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভিন্ন মতও আছে।

পদ্মা সেতুতে রেললাইন সংযোজন, রামু-কক্সবাজার রেললাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি এবং রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। পদ্মা নদীর উপর সড়ক সেতু নির্মাণের পর রেল-সংযোগ জরুরি ছিলো না বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগসহ ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণে চীন প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। উদ্ভূত রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই বললেই চলে; তাই বিশেষজ্ঞদের মতে এই মুহূর্তে মায়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন সংস্থাপন অর্থহীন; কারণ এ প্রকল্প থেকে শীঘ্রই কোন রিটার্ন আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সম্পর্ক খারাপ থাকা সত্ত্বেও জরুরি প্রয়োজনে মায়ানমার থেকে আমাদের চাল আর পেঁয়াজ আনতে হয়েছে; এছাড়াও এ রেলপথ চালু হলে দুর্গম এলাকার লোকজনের চলাচল সহজ ও উন্মুক্ত হবে। অন্যদিকে পদ্মা ব্রিজে রেললাইন হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৩টি জেলার সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপন হবে। বর্তমান বিশ্বে রেলের গুরুত্ব বাড়ছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপ, চীন, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে দ্রুতগামী রেল বিমানের বিকল্প হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এ প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এ প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য; কারণ পারমাণবিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম এবং পরিবেশবান্ধব। আমাদের গ্যাসের মজুত দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, এখন আমাদের বিদ্যুৎনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে; তাই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোও বর্ধিষ্ণু অর্থনৈতিক কর্মকা-ের জন্য অপরিহার্য। দেশে উত্তোলিত গ্যাস চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত বিধায় বিকল্প হিসেবে আমদানিকৃত তরল প্রাকৃতিক গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের নিমিত্তে এলএনজি টার্মিনালের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোও জাতীয় স্বার্থে গৃহীত ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

মেগা প্রকল্প ছাড়াও বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার মতো চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার; অর্থাৎ রপ্তানির চেয়ে আমাদানি ব্যয় বেশি। প্রবাসী আয়ও কমছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২৭০ কোটি ডলার বা ২০.৯১ শতাংশ। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের দৈনন্দিন লেনদেন সামলাতে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়মিত ধর্ণা দিচ্ছে এবং এতে রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ছে। মেগা প্রকল্পগুলো কয়েক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হলে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে এবং এতে রিজার্ভের উপর চাপ বাড়তে থাকবে। করোনার সময় রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না হলেও সরকারকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার টিকা আমদানি করতে হয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখার জন্য প্রণোদনা হিসেবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করতে হয়েছে।

নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো এত দুর্বল নয়। শ্রীলঙ্কার ১১ শতাংশ মূল্যস্ফীতির তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি মাত্র ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বাড়তে পারে মর্মে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার দুই বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো ৪৪ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ২১ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির মূল্যায়নে বাংলাদেশের ঋণমান বা ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা সন্তোষজনক। আইএমএফ কর্তৃক নির্ধারিত ঋণ পরিশোধ সক্ষমতার সব ঝুঁকি সূচকের সর্বোচ্চ সীমার অনেক নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ভারত এবং চীন ঋণ সহায়তা দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু বাংলাদেশ তাদের ঋণের আবেদনে এবার সাড়া দেয়নি। আইএমএফের কঠিন শর্তে ঋণ নেয়া ছাড়া শ্রীলঙ্কার আর কোন গত্যন্তর নেই। শ্রীলঙ্কার ঋণের হার তাদের জিডিপির ১১৯ শতাংশের বিপরীতে বাংলাদেশের ঋণের হার জিডিপির ৩৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৬১ শতাংশের সঙ্গে তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ ১৬ শতাংশ, ২০ শতাংশ পর্যন্ত ঝুঁকিমুক্ত বিবেচনা করা হয়। আইএমএফের সতর্কবাণী অনুযায়ী এই হার ৫৫ শতাংশে পৌঁছানোর আগেই বাংলাদেশ সজাগ হওয়ার সময় পাবে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দর বেড়েছে, বিশেষ করে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি আমাদের আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমদানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামালের আমদানি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- আবার সচল করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের রপ্তানিতে স্থবিরতা নেমে আসেনি, আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে; চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৩০.৩৪ শতাংশ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার প্রবল সমর্থন না থাকলে ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে এত সাহসী ভূমিকা নেয়া সম্ভব হতো না। রাশিয়া নৌবহর পাঠিয়েছিল বলেই আমেরিকার সপ্তম নৌবহর থেমে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম নৌবন্দরকে ডুবোজাহাজ এবং মাইন মুক্ত করতে রাশিয়ার কয়েকজন নৌসেনা প্রাণও দিয়েছেন। তাই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশকে নিরপেক্ষ থাকতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের গার্মেন্টসের প্রায় সবই বিক্রি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ থাকা আমেরিকা ও ইউরোপ কতটুকু মেনে নেবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আফগানিস্তান আক্রমণের সময় নিরপেক্ষতা অবলম্বনকারী দেশকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা হবে মর্মে প্রেসিডেন্ট বুশ হুঁশিয়ারি করেছিলেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের ইমরান খান সরকারের পতন হয়েছে বলে ইমরান খান বারবার উল্লেখ করেছেন। আরেকটি বিপদও বাংলাদেশ সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছেÑ জনঅসন্তোষ রুখতে সরকার যেভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে, বিদেশ থেকে বেশি দামে পণ্য কিনে কম দামে জনগণের কাছে বিক্রি করছে তাতে সরকারের অর্থ সংকটের সৃষ্টি হতে পারে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২২ , ০৪ বৈশাখ ১৪২৮ ১৫ রমাদ্বান ১৪৪৩

শ্রীলঙ্কার মতো হবে না বাংলাদেশ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে বর্তমানে ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, ওষুধ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করায় বাঁচার জন্য শ্রীলঙ্কার লোকজন ভারতে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে। জ্বালানি তেল কেনার পয়সা নেই, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বনিম্ন স্তরে, দৈনিক তেরো ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না, বিদ্যুৎ না থাকায় উৎপাদন বন্ধ, সাদা কাগজের অভাবে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বন্ধ, পর্যাপ্ত গ্যাস সিলিন্ডারের অভাবে রান্না হচ্ছে না। সর্বত্র অভাব আর অভাব। শ্রীলঙ্কার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্রুতগতিতে বাড়ছে। চালের কেজি ৫০০ রুপি এবং এক কেজি গুঁড়োদুধের দাম ১৯০০ রুপি; যা বাংলাদেশি টাকায় যথাক্রমে ১৪৫ টাকা ও ৫৫১ টাকা। গ্রামের দোকানদার এক কেজি দুধের প্যাকেট খুলে ১০০ গ্রাম করে বিক্রি করছে। শ্রীলঙ্কায় এমন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই মন্ত্রিসভা থেকে একযোগে ২৬ জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ঠেকাতে শ্রীলঙ্কার রাস্তায় দেশটির সেনারা অবস্থান নিয়েছে। জনগণ সরকারের জারি করা কারফিউ উপেক্ষা করে সরকারের পতন চেয়ে বিক্ষোভ করছেন।

চার-পাঁচ বছর পূর্বেও শ্রীলঙ্কার সামষ্টিক অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল, মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ৪ হাজার ডলার। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পোশাক-শিল্প প্রথম গড়ে উঠে শ্রীলঙ্কায়। পর্যটকদেরও পছন্দের জায়গা ছিল শ্রীলঙ্কা। আশির দশকের গৃহযুদ্ধ শ্রীলঙ্কার অগ্রগতি কিছুটা থামিয়ে দিলেও ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কা উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে কলম্বোর তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে পর্যটনে ধস নামে। করোনা অতিমারি এবং অতিমারি উত্তর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শ্রীলঙ্কার শুধু পর্যটন খাতে নয়, রপ্তানি এবং প্রবাসী আয়ের খাতেও ধস নামে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের নানা অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং সঠিক প্রকল্প বাছাইকরণে ব্যর্থতা। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেই মূল্য সংযোজন কর হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে ধার্য করায় ভ্যাট আদায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পায়। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করায় ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।

শ্রীলঙ্কার ঋণের হার জিডিপির ১১৯ শতাংশ; অর্থাৎ দেশটি এক বছরে যে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে, তার তুলনায় ঋণ বেশি। আইএমএফের কথা অনুযায়ী এই হার ৫৫ শতাংশের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু ব্যয়বহুল ও অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করায় তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির চেয়ে বেশি। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে শ্রীলংকা নিরানব্বই বছরের জন্য হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরটি চীনের কাছে বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছে। জঙ্গলের ভেতর নির্মিত ‘মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ কার্যত অব্যবহৃত। সাগর ভরাট করে ৬৬৫ একর ভূমির ওপর কলম্বো পোর্ট সিটি তৈরি করার জন্য চীনের এক কোম্পানি খরচ করছে ১৪০ কোটি ডলার; সবার আশঙ্কা, হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরের মতো এই পোর্ট সিটিও চীনের মালিকানায় চলে যাবে।

দেশটির রিজার্ভ সংকটের পেছনে আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি, শ্রীলঙ্কায় বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি, রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, ঋণ শোধ করতেই তাদের পুনরায় ঋণ করতে হচ্ছে, প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার কোন বৈদেশিক মুদ্রাই নেই। বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ এ বছর পরিশোধ করতে পারবে না বলে শ্রীলঙ্কা ঋণদাতাদের জানিয়ে দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেও অনেকগুলো ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, প্রবাসী আয় কমে গেছে, আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। শীঘ্রই বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর বিদেশি পাওনার কিস্তি-পরিশোধ শুরু হবে, প্রকল্পগুলো থেকে অনুমিত আয় নির্ধারিত সময়ে ফেরত না এলে শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। বর্তমান সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রোরেল, রামু-কক্সবাজার রেললাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর। সরকারের ধারণা, মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে দেশের সার্বিক চিত্র বদলে যাবে- মাথাপিছু আয় এবং প্রবৃদ্ধিও বেড়ে যাবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভিন্ন মতও আছে।

পদ্মা সেতুতে রেললাইন সংযোজন, রামু-কক্সবাজার রেললাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি এবং রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। পদ্মা নদীর উপর সড়ক সেতু নির্মাণের পর রেল-সংযোগ জরুরি ছিলো না বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগসহ ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণে চীন প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। উদ্ভূত রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই বললেই চলে; তাই বিশেষজ্ঞদের মতে এই মুহূর্তে মায়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন সংস্থাপন অর্থহীন; কারণ এ প্রকল্প থেকে শীঘ্রই কোন রিটার্ন আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সম্পর্ক খারাপ থাকা সত্ত্বেও জরুরি প্রয়োজনে মায়ানমার থেকে আমাদের চাল আর পেঁয়াজ আনতে হয়েছে; এছাড়াও এ রেলপথ চালু হলে দুর্গম এলাকার লোকজনের চলাচল সহজ ও উন্মুক্ত হবে। অন্যদিকে পদ্মা ব্রিজে রেললাইন হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৩টি জেলার সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপন হবে। বর্তমান বিশ্বে রেলের গুরুত্ব বাড়ছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপ, চীন, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে দ্রুতগামী রেল বিমানের বিকল্প হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এ প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এ প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য; কারণ পারমাণবিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম এবং পরিবেশবান্ধব। আমাদের গ্যাসের মজুত দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, এখন আমাদের বিদ্যুৎনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে; তাই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোও বর্ধিষ্ণু অর্থনৈতিক কর্মকা-ের জন্য অপরিহার্য। দেশে উত্তোলিত গ্যাস চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত বিধায় বিকল্প হিসেবে আমদানিকৃত তরল প্রাকৃতিক গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের নিমিত্তে এলএনজি টার্মিনালের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোও জাতীয় স্বার্থে গৃহীত ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

মেগা প্রকল্প ছাড়াও বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার মতো চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার; অর্থাৎ রপ্তানির চেয়ে আমাদানি ব্যয় বেশি। প্রবাসী আয়ও কমছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২৭০ কোটি ডলার বা ২০.৯১ শতাংশ। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের দৈনন্দিন লেনদেন সামলাতে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়মিত ধর্ণা দিচ্ছে এবং এতে রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ছে। মেগা প্রকল্পগুলো কয়েক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হলে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে এবং এতে রিজার্ভের উপর চাপ বাড়তে থাকবে। করোনার সময় রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না হলেও সরকারকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার টিকা আমদানি করতে হয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখার জন্য প্রণোদনা হিসেবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করতে হয়েছে।

নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো এত দুর্বল নয়। শ্রীলঙ্কার ১১ শতাংশ মূল্যস্ফীতির তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি মাত্র ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বাড়তে পারে মর্মে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার দুই বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো ৪৪ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ২১ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির মূল্যায়নে বাংলাদেশের ঋণমান বা ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা সন্তোষজনক। আইএমএফ কর্তৃক নির্ধারিত ঋণ পরিশোধ সক্ষমতার সব ঝুঁকি সূচকের সর্বোচ্চ সীমার অনেক নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ভারত এবং চীন ঋণ সহায়তা দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু বাংলাদেশ তাদের ঋণের আবেদনে এবার সাড়া দেয়নি। আইএমএফের কঠিন শর্তে ঋণ নেয়া ছাড়া শ্রীলঙ্কার আর কোন গত্যন্তর নেই। শ্রীলঙ্কার ঋণের হার তাদের জিডিপির ১১৯ শতাংশের বিপরীতে বাংলাদেশের ঋণের হার জিডিপির ৩৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৬১ শতাংশের সঙ্গে তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ ১৬ শতাংশ, ২০ শতাংশ পর্যন্ত ঝুঁকিমুক্ত বিবেচনা করা হয়। আইএমএফের সতর্কবাণী অনুযায়ী এই হার ৫৫ শতাংশে পৌঁছানোর আগেই বাংলাদেশ সজাগ হওয়ার সময় পাবে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দর বেড়েছে, বিশেষ করে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি আমাদের আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমদানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামালের আমদানি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- আবার সচল করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের রপ্তানিতে স্থবিরতা নেমে আসেনি, আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে; চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৩০.৩৪ শতাংশ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার প্রবল সমর্থন না থাকলে ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে এত সাহসী ভূমিকা নেয়া সম্ভব হতো না। রাশিয়া নৌবহর পাঠিয়েছিল বলেই আমেরিকার সপ্তম নৌবহর থেমে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম নৌবন্দরকে ডুবোজাহাজ এবং মাইন মুক্ত করতে রাশিয়ার কয়েকজন নৌসেনা প্রাণও দিয়েছেন। তাই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশকে নিরপেক্ষ থাকতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের গার্মেন্টসের প্রায় সবই বিক্রি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ থাকা আমেরিকা ও ইউরোপ কতটুকু মেনে নেবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আফগানিস্তান আক্রমণের সময় নিরপেক্ষতা অবলম্বনকারী দেশকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা হবে মর্মে প্রেসিডেন্ট বুশ হুঁশিয়ারি করেছিলেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের ইমরান খান সরকারের পতন হয়েছে বলে ইমরান খান বারবার উল্লেখ করেছেন। আরেকটি বিপদও বাংলাদেশ সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছেÑ জনঅসন্তোষ রুখতে সরকার যেভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে, বিদেশ থেকে বেশি দামে পণ্য কিনে কম দামে জনগণের কাছে বিক্রি করছে তাতে সরকারের অর্থ সংকটের সৃষ্টি হতে পারে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]