কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্মে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা

কক্সবাজারে ফের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। প্রতিনিয়ত একের পর এক খুন, ধর্ষণ, মাদক কারবার, ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়ে চলছে। শহর ও শহরতলীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা, জবর দখল, হত্যাচেষ্টা ও নারীকে আদালত চত্বর থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণসহ আরও একাধিক ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা অবনতির বিষয়টি সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এতে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ প্রায় অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। সবমিলিয়ে কক্সবাজার জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। যার কারনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্যটনের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক নেতাসহ সারা দেশের সাধারণ ভ্রমণ পিপাসুরা। এ সমস্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোপের মুখে পড়েছে পুলিশ।

গত ১২ দিনে কক্সবাজার এর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মানুষ এতো নির্দয় নিষ্ঠুর হতে পারে? আধিপত্য বিস্তারের জন্য আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এভাবে অবনতি ঘটাতে পারে? এই পরিস্থিতি দেখে খোদ উদ্বিগ্ন সচেতন মহল।

গত ৬ এপ্রিল বিকেলে সদর উপজেলার পিএম খালীতে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে মোর্শেদ নামের এক যুবককে। এর এক সপ্তাহ না পেরোতেই বিজিবি ক্যাম্প আম গাছতলা এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আবুল কালাম নামের এক ব্যক্তি খুন হলেন। গত ১২ এপ্রিল রাতে তিনি ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন। তিনি মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের বাসিন্দা। নিহত কালাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন।

কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলায় নামাজে যাওয়ার পথে ছুরিকাঘাতে এক যুবক খুন হয়েছে। সোমবার (১১ এপ্রিল) ভোরে উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের খোদাই বাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত তারেকুল ইসলাম (১৭) ইসলামাবাদ ইউনিয়নের ওয়াহেদর পাড়ার মৃত ছগির আহমদের ছেলে।

জানাগেছে, দীর্ঘদিন ধরে তারেকুল ওই এলাকার দিবা ব্রিক ফিল্ডের পশ্চিম পার্শ্বে দোকানদারি করতেন। সোমবার ভোররাতে সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার পথে কে বা কারা তাকে ছুরিকাঘাত করে। পথচারীরা মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কক্সবাজারের চৌফলদন্ডী ব্রিজের নিচ থেকে সায়েম (২২) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার (১১ এপ্রিল) সকালে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে মর্গে প্রেরণ করে। নিহত যুবক খুরুশকুল তেতৈয়া গুইল্যাবাপের পাড়া এলাকার আবু ছৈয়দের ছেলে। সে পেশায় সিএনজি অটোরিক্সা চালক। পরিবারের দাবী তাকে হত্যা করা হয়েছে। গেল ৬ এপ্রিল কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালীতে রোজাদার মোরশেদ বলীকে ইফতারের পূর্ব মূহুর্তে দুর্বৃত্তরা শত শত মানুষের সামনে মারধর করে হত্যা করেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। ‘আমি রোজাদার এখন আমাকে মেরো না। মারতে চাইলে ইফতারের পরে মারো। এরকম আকুতির পরেও নাকি ওই দুর্বৃত্তরা তাকে রেহাই দেয়নি। সর্বশেষ ৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার চকরিয়া উপজেলার হারবাং মোবাইলে গেম খেলাকে কেন্দ্র করে ইউনুছ নামের এক দিন মজুরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) পিএমখালীতে ফুটবল খেলার প্রাইজমানির টাকা ভাগভাটোয়ারা নিয়ে ছুরিকাঘাতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত যুবকের নাম মো: জাহাঙ্গীর। শুক্রবার (৮ এপ্রিল) রাতে শহরের ঝাউতলা এলাকার সাইফুল ইসলাম রিগ্যান নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাত করে কিশোর গ্যাং। এ ঘটনার প্রতিবাদে শহরের প্রধান সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে ঝাউতলাবাসী। ২৮ মার্চ কক্সবাজার শহরের সিটি কলেজের সামনে কিশোর গ্যাং এর হাতে নির্মমভাবে খুন হয় চট্টগ্রাম হাজী মহসিন কলেজের ছাত্র রিদুয়ান।

বৃহষ্পতিবার টেকনাফে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পাড়ার মানুষ। এর আগে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জহির উল্লাহ সিকদারকে। তার আগে পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি পদচারণা যেখানে বেশি থাকে ঠিক সেই স্থান সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল মোনাফ সিকদারকে।

মোরশেদ বলীর স্বজনদের দাবী এলাকায় সে যে কোনো অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করত। সম্প্রতি একটি স্কিম নিয়ে মোরশেদ অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করায় প্রতিপক্ষের লোকজন তার উপর ক্ষিপ্ত হয়। তারা আরও জানান, সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মনোনীত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম আলাল ও প্রাক্তন ছাত্রলীগ কমিটির নেতা আব্দুল মালেক এবং বিএনপি নেতা মাহমুদুল হক মেম্বারের নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা মোরশেদকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে খুন করে।

মোরশেদ আলী (৩৮) কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের মাস্টার ওমর আলীর পুত্র। এই হত্যার ঘটনায় শনিবার (১৩ এপ্রিল) বিকেল পর্যন্ত দিদার আলম নামের এক ব্যক্তিসহ তিনজনকে পুলিশ আটক করেছে পুলিশ। কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালীতে ফুটবল খেলার প্রাইজমানির টাকা ভাগভাটোয়ারা নিয়ে ছুরিকাঘাতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত যুবকের নাম জাহাঙ্গীর (২২) সে পিএমখালী ৪ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম জুমছড়ি এলাকার ছৈয়দুল হকের ছেলে। ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয় পরে ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

গত ২৮ মার্চ কক্সবাজার সিটি কলেজ গেইটে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা ছুরিকাঘাত করে চট্টগ্রাম হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র রিদুয়ানকে খুন করে। ওই ঘটনা স্থলের খুব কাছে অবস্থিত কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ি। ৮ এপ্রিল চকরিয়ায় মোবাইলে গেইম খেলার মত তুচ্ছ ঘটনার বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের লোকজন পিঠিয়ে হত্যা করে মো. ইউনুছ (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে। চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মইক্কাঘোনা গ্রামে ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত দিন মজুর ইউনুস ওই গ্রামের দিল মোহাম্মদের পুত্র।

আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দীন বলেন, কিশোর গ্যাং যেন এখন একটি আতংকের নাম। বেপরোয়া কিশোর গ্যাং এর হাতে ইতিমধ্যে পুলিশসহ অনেকেই খুন হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছে অনেকেই। ধর্ষিত হয়েছেন অনেক নারী। এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেও অনেকেই ভয় পায়। তিনি পর্যটন শহর কক্সবাজারকে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে মুক্ত রাখতে এখনই শক্ত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহবান জানান।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কক্সবাজার চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, পর্যটন নগরী হিসাবে চলমান অপরাধকা-গুলো উদ্বেগজনক। সঠিক সময়ে সঠিক বিচার না হওয়ায় অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধীরা যেনো বেপরোয়া হতে না পারে সেই পথ খোঁজা দরকার। পুলিশ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে আরও আন্তরিক হওয়া সময়ের দাবি।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান সংঘটিত অনেক ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন দাবি করে বলেন, যখন যেখানে যে ঘটনা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক ঘটনার তদন্ত চলমান, তাই আইনশৃঙ্খলা যে একেবারে অবনতি হয়েছে তা বলা যাবে না। জেলা ও পর্যটন এলাকা হিসাবে জনসংখ্যা এবং পর্যটকের উপস্থিতি মতে পুলিশের লোকবল কম। এরপরও অপরাধ ও অপরাধী নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা থাকে। পর্যটন এলাকা কেন্দ্রিক অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে।

উল্লেখ্য যে, পর্যটন নগরীতে নোংরা রাজনীতি ও জায়গা জমির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। তুচ্ছ ঘটনায় বখে যাওয়া কিশোরদের এক গ্রুপ হামলে পড়ছে অন্য গ্রুপের সদস্যদের উপর। ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়ার বাইরেও ঘটছে খুনের ঘটনা। অল্প বয়সী এই কিশোরদের হাতে লাগছে রক্তের দাগ। অস্থির হয়ে উঠছে সমাজের পরিবেশ। তাদের থাবা থেকে বাদ পড়ছে না জন্মদাতা বাবা-মা এমনকি শিক্ষকও।

সচেতন মহলের দাবি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য দায়ি কক্সবাজার জেলা পুলিশের দায়সারা ভাব এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের গুটিকয়েক নেতাদের আশকারায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠার কারণে আইন কানুন কিছুই তোয়াক্কা না করে একের পর এক অপরাধের জন্ম দিচ্ছে কিশোর গ্যাং ও জেল ফেরত অপরাধীরা।

সোমবার, ১৮ এপ্রিল ২০২২ , ০৫ বৈশাখ ১৪২৮ ১৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্মে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা

প্রতিনিধি, কক্সবাজার

কক্সবাজারে ফের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। প্রতিনিয়ত একের পর এক খুন, ধর্ষণ, মাদক কারবার, ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়ে চলছে। শহর ও শহরতলীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা, জবর দখল, হত্যাচেষ্টা ও নারীকে আদালত চত্বর থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণসহ আরও একাধিক ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা অবনতির বিষয়টি সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এতে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ প্রায় অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। সবমিলিয়ে কক্সবাজার জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। যার কারনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্যটনের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক নেতাসহ সারা দেশের সাধারণ ভ্রমণ পিপাসুরা। এ সমস্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোপের মুখে পড়েছে পুলিশ।

গত ১২ দিনে কক্সবাজার এর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মানুষ এতো নির্দয় নিষ্ঠুর হতে পারে? আধিপত্য বিস্তারের জন্য আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এভাবে অবনতি ঘটাতে পারে? এই পরিস্থিতি দেখে খোদ উদ্বিগ্ন সচেতন মহল।

গত ৬ এপ্রিল বিকেলে সদর উপজেলার পিএম খালীতে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে মোর্শেদ নামের এক যুবককে। এর এক সপ্তাহ না পেরোতেই বিজিবি ক্যাম্প আম গাছতলা এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আবুল কালাম নামের এক ব্যক্তি খুন হলেন। গত ১২ এপ্রিল রাতে তিনি ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন। তিনি মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের বাসিন্দা। নিহত কালাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন।

কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলায় নামাজে যাওয়ার পথে ছুরিকাঘাতে এক যুবক খুন হয়েছে। সোমবার (১১ এপ্রিল) ভোরে উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের খোদাই বাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত তারেকুল ইসলাম (১৭) ইসলামাবাদ ইউনিয়নের ওয়াহেদর পাড়ার মৃত ছগির আহমদের ছেলে।

জানাগেছে, দীর্ঘদিন ধরে তারেকুল ওই এলাকার দিবা ব্রিক ফিল্ডের পশ্চিম পার্শ্বে দোকানদারি করতেন। সোমবার ভোররাতে সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার পথে কে বা কারা তাকে ছুরিকাঘাত করে। পথচারীরা মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কক্সবাজারের চৌফলদন্ডী ব্রিজের নিচ থেকে সায়েম (২২) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার (১১ এপ্রিল) সকালে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে মর্গে প্রেরণ করে। নিহত যুবক খুরুশকুল তেতৈয়া গুইল্যাবাপের পাড়া এলাকার আবু ছৈয়দের ছেলে। সে পেশায় সিএনজি অটোরিক্সা চালক। পরিবারের দাবী তাকে হত্যা করা হয়েছে। গেল ৬ এপ্রিল কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালীতে রোজাদার মোরশেদ বলীকে ইফতারের পূর্ব মূহুর্তে দুর্বৃত্তরা শত শত মানুষের সামনে মারধর করে হত্যা করেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। ‘আমি রোজাদার এখন আমাকে মেরো না। মারতে চাইলে ইফতারের পরে মারো। এরকম আকুতির পরেও নাকি ওই দুর্বৃত্তরা তাকে রেহাই দেয়নি। সর্বশেষ ৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার চকরিয়া উপজেলার হারবাং মোবাইলে গেম খেলাকে কেন্দ্র করে ইউনুছ নামের এক দিন মজুরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) পিএমখালীতে ফুটবল খেলার প্রাইজমানির টাকা ভাগভাটোয়ারা নিয়ে ছুরিকাঘাতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত যুবকের নাম মো: জাহাঙ্গীর। শুক্রবার (৮ এপ্রিল) রাতে শহরের ঝাউতলা এলাকার সাইফুল ইসলাম রিগ্যান নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাত করে কিশোর গ্যাং। এ ঘটনার প্রতিবাদে শহরের প্রধান সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে ঝাউতলাবাসী। ২৮ মার্চ কক্সবাজার শহরের সিটি কলেজের সামনে কিশোর গ্যাং এর হাতে নির্মমভাবে খুন হয় চট্টগ্রাম হাজী মহসিন কলেজের ছাত্র রিদুয়ান।

বৃহষ্পতিবার টেকনাফে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পাড়ার মানুষ। এর আগে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জহির উল্লাহ সিকদারকে। তার আগে পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি পদচারণা যেখানে বেশি থাকে ঠিক সেই স্থান সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল মোনাফ সিকদারকে।

মোরশেদ বলীর স্বজনদের দাবী এলাকায় সে যে কোনো অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করত। সম্প্রতি একটি স্কিম নিয়ে মোরশেদ অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করায় প্রতিপক্ষের লোকজন তার উপর ক্ষিপ্ত হয়। তারা আরও জানান, সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মনোনীত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম আলাল ও প্রাক্তন ছাত্রলীগ কমিটির নেতা আব্দুল মালেক এবং বিএনপি নেতা মাহমুদুল হক মেম্বারের নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা মোরশেদকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে খুন করে।

মোরশেদ আলী (৩৮) কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের মাস্টার ওমর আলীর পুত্র। এই হত্যার ঘটনায় শনিবার (১৩ এপ্রিল) বিকেল পর্যন্ত দিদার আলম নামের এক ব্যক্তিসহ তিনজনকে পুলিশ আটক করেছে পুলিশ। কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালীতে ফুটবল খেলার প্রাইজমানির টাকা ভাগভাটোয়ারা নিয়ে ছুরিকাঘাতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত যুবকের নাম জাহাঙ্গীর (২২) সে পিএমখালী ৪ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম জুমছড়ি এলাকার ছৈয়দুল হকের ছেলে। ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয় পরে ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

গত ২৮ মার্চ কক্সবাজার সিটি কলেজ গেইটে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা ছুরিকাঘাত করে চট্টগ্রাম হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র রিদুয়ানকে খুন করে। ওই ঘটনা স্থলের খুব কাছে অবস্থিত কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ি। ৮ এপ্রিল চকরিয়ায় মোবাইলে গেইম খেলার মত তুচ্ছ ঘটনার বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের লোকজন পিঠিয়ে হত্যা করে মো. ইউনুছ (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে। চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মইক্কাঘোনা গ্রামে ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত দিন মজুর ইউনুস ওই গ্রামের দিল মোহাম্মদের পুত্র।

আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দীন বলেন, কিশোর গ্যাং যেন এখন একটি আতংকের নাম। বেপরোয়া কিশোর গ্যাং এর হাতে ইতিমধ্যে পুলিশসহ অনেকেই খুন হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছে অনেকেই। ধর্ষিত হয়েছেন অনেক নারী। এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেও অনেকেই ভয় পায়। তিনি পর্যটন শহর কক্সবাজারকে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে মুক্ত রাখতে এখনই শক্ত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহবান জানান।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কক্সবাজার চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, পর্যটন নগরী হিসাবে চলমান অপরাধকা-গুলো উদ্বেগজনক। সঠিক সময়ে সঠিক বিচার না হওয়ায় অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধীরা যেনো বেপরোয়া হতে না পারে সেই পথ খোঁজা দরকার। পুলিশ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে আরও আন্তরিক হওয়া সময়ের দাবি।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান সংঘটিত অনেক ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন দাবি করে বলেন, যখন যেখানে যে ঘটনা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক ঘটনার তদন্ত চলমান, তাই আইনশৃঙ্খলা যে একেবারে অবনতি হয়েছে তা বলা যাবে না। জেলা ও পর্যটন এলাকা হিসাবে জনসংখ্যা এবং পর্যটকের উপস্থিতি মতে পুলিশের লোকবল কম। এরপরও অপরাধ ও অপরাধী নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা থাকে। পর্যটন এলাকা কেন্দ্রিক অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে।

উল্লেখ্য যে, পর্যটন নগরীতে নোংরা রাজনীতি ও জায়গা জমির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। তুচ্ছ ঘটনায় বখে যাওয়া কিশোরদের এক গ্রুপ হামলে পড়ছে অন্য গ্রুপের সদস্যদের উপর। ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়ার বাইরেও ঘটছে খুনের ঘটনা। অল্প বয়সী এই কিশোরদের হাতে লাগছে রক্তের দাগ। অস্থির হয়ে উঠছে সমাজের পরিবেশ। তাদের থাবা থেকে বাদ পড়ছে না জন্মদাতা বাবা-মা এমনকি শিক্ষকও।

সচেতন মহলের দাবি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য দায়ি কক্সবাজার জেলা পুলিশের দায়সারা ভাব এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের গুটিকয়েক নেতাদের আশকারায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠার কারণে আইন কানুন কিছুই তোয়াক্কা না করে একের পর এক অপরাধের জন্ম দিচ্ছে কিশোর গ্যাং ও জেল ফেরত অপরাধীরা।