বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন

একাত্তরের ১৮ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস। সেদিনই প্রথম বিদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেদিন দুপুর ১২টায় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার ৯ নম্বর সার্কাস এভিনিউতে পাকিস্তান দূতাবাস পরিবর্তিত হয়ে উঠে বাংলাদেশ দূতাবাস।

আগেরদিন ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ নেয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। আর ১৮ এপ্রিলে কলকাতার পাকিস্তান উপ-দূতাবাসের ৬৫ জন বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ হোসেন আলীর নেতৃত্বে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের উপ-দূতাবাসের নাম রাখা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক মিশন। প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কলকাতার পাকিস্তানের উপ-দূতাবাস।

অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় কলকাতার সার্কাস এভিনিউতে অবস্থিত পাক দূতাবাস থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের লাল সবুজ খচিত পতাকা উড়ান ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী।

কলকাতার পাকিস্তান মিশনে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর মধ্যে দিয়ে বিশ্বে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের কোন দূতাবাসের যাত্রা শুরু হয়। কলকাতার পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদত্যাগ এবং পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষাবলম্বন করার খবর প্রকাশিত হলে দেশে এবং বিদেশে প্রচ- আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

অজস্র সংগঠন এবং বাঙালিরা আবেগ আপ্লুত হয়ে জড়ো হয় দূতাবাসের সামনে। তারা সার্কাস এভিনিউতে মিছিল নিয়ে এসে ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীকে স্বাগত জানায়। এ সময় এক আবেগ আপ্লুত দৃশ্যের অবতারণা হয়। হোসেন আলীর স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে।

হোসেন আলী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষাবলম্বন করায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে পাঠান। এরপর হোসেন আলী কলকাতা বেতারে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের পৈশাচিক গণহত্যা, অত্যাচার ও নিপীড়নের বর্ণনা দেন।

ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর ডায়েরি থেকে জানা যায় ৩০ মার্চেই তিনি পাকিস্তান মিশনকে বাংলাদেশ মিশনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ নিলে তিনি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করবেন। অন্যদিকে ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এবং ১২ এপ্রিল যশোরের নড়াইল মহকুমার প্রশাসক কামালউদ্দিন সিদ্দিকি হোসেন আলীর সঙ্গে দেখা করে তাকে প্রবাসী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অনুরোধ করেন। এদিকে ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পার্ক সার্কাস মাঠে দেখা করেন হোসেন আলী। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএসএফের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। দেখা হওয়ার পর তারা নিকটস্থ গেলর্ড রেস্টুরেন্ট আলোচনায় বসেন।

তখন তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তান দূতাবাসের সব বাঙালি কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিয়ে প্রবাসী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অনুরোধ করেন। এদিকে হোসেন আলী জানতেন না এর একদিন পরেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু এর মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে বললেন, ১৮ তারিখ যেন পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়।

হোসেন আলী বৈঠক শেষে পরদিন নিজের দূতাবাসে ফিরে এসে বাঙালি কর্মকর্তাদের তা জানান। বাঙালিরা সবাই আনুগত্য প্রকাশের ব্যাপারে সম্মতি দেন।

এদিন সকালে কলকাতার পাকিস্তান দূতাবাসে সাত লাখ টাকা জমা ছিল। হোসেন আলী সাত লাখ টাকার মধ্যে চার লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেন এবং বাকি তিন লাখ টাকা নিজের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে জমা করেন। রাতে নিজের গাড়ির চালকের কাছ থেকে চাবি বুঝে নেন। সেদিন রাতেই দূতাবাসের প্রেস সচিব একটি বাংলাদেশের পতাকা সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল পতাকাটি বড়। হোসেন আলীর স্ত্রী এরপর পতাকাটা ঠিক করে নেন।

সকাল থেকে বিএসএফের ডিজিকে এফ রুস্তমজী, বিএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাজগোপাল, গোলাক মজুমদার ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল নরেন্দর সিংহ মিশনের চারপাশে গোপনে উপস্থিত ছিলেন অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য।

১৮ এপ্রিল সকাল সাতটার মধ্যেই দূতাবাসের সব বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়ো হয়েছিলেন। এ সময় হোসেন আলী ঘোষণা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হবে। এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে অবাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিলো। অনেকেই এই সিদ্ধান্তে সায় দিলেন না। তখন উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিবের সঙ্গে কথা বলেন হোসেন আলী।

ঠিক তখনই প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড়ের কারণে দূতাবাসের ছাদে টাঙানো পাকিস্তানের পতাকা ছিঁড়ে অর্ধেক মাটিতে পড়ে যায়। ঠিক তখন হোসেন আলী পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে দেন। এরপর বিএসএফের সদস্যরা কে এফ রুস্তমজীর নির্দেশে দূতাবাসের নামফলকের জায়গায় পাকিস্তানের নাম সরিয়ে বাংলাদেশের নাম বসিয়ে দেয়।

এরপর হোসেন আলী দূতাবাসে তার কক্ষের দেয়াল থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও কবি ইকবালের ছবি সরিয়ে সে জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি টাঙিয়ে দেন।

এদিকে খবর শুনে দলে দলে সাংবাদিকেরা আসতে থাকে সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশ দূতাবাসে। দুপুর একটার দিকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে হোসেন আলী বলেন, ‘আমি এখন থেকে বাংলাদেশের সরকারের আনুগত্য পালন করবো।’

১৮ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সব মন্ত্রীদের দায়িত্ব ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ওপর দপ্তর হস্তান্তর করেছিল।

এদিকে ১৮ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল। এর আগে ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান হানাদাররা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেল লাইন ধরে উত্তর দিকে এগোতে থাকে। এ সময় মেজর শাফায়াত জামিল ১১ নম্বর প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে আগের প্লাটুনের সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল তার থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরিখায় অবস্থান করছিলেন। বেলা ১১টার দিকে শুরু হয় আচমকা হানাদার বাহিনীর গোলাবর্ষণ। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছিল অঝোর বৃষ্টি। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মোগরা বাজার ও গঙ্গা সাগর পাড়ে হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়েই গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে বেলা ১২টার দিকে পশ্চিম দিক থেকে শুরু হয় সরাসরি আক্রমণ। তখন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদারদের গুলি ও গোলার মুখে দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তখন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালান। এ সময় হঠাৎ দুটো গুলি এসে লাগে তার শরীরে। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন তিনি।

এদিন ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতা লর্ড ব্র্যাকওয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তানে হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধর্ষণের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসন যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে তা হিটলারের পরবর্তী সময়কার চরম নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপিত হয়েছে।’ তিনি যুক্তরাজ্যকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন জোগানোর জন্য আহ্বান জানান। একই সঙ্গে ঔপনেবেশিক স্বাধীনতা সম্মেলন আন্দোলনে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দানের অনুরোধ করেন।

এদিন পাঁচ হাজারের বেশি বাঙালি অধিবাসী লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে গণহত্যা ও যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ করে। বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের পর সমাবেশকারীরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিট বরাবর এক স্মারকলিপি দেয়। যেখানে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান ও গণহত্যা বন্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসকদের চাপ দিতে যুক্তরাজ্য সরকারকে আহ্বান জানায়।

১৮ এপ্রিল ঢাকায় পাকিস্তান নেজামে ইসলামের সহ-সভাপতি সৈয়দ মাহমুদ আল মোস্তফা আল মাদানীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গর্ভনর টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা সরকারের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করবে বলে টিক্কা খানকে আশ্বাস দেন।

আরও খবর
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালিত
৭ হাজার শিক্ষকের এমপিওভুক্তির জটিলতার অবসান
রাজধানীতে তারের জঞ্জাল দূর করতে সমন্বয়ের তাগিদ
র‌্যাগ ডের নামে বুলিং-অশ্লীলতা বন্ধে আদালতের নির্দেশ
ধুনটে অবৈধ পুকুর খননে ফসলি জমিতে ভূমি ধস
মুগদার সেই তরুণীকে কানাডা সরকারের হাতে তুলে দিল হাইকোর্ট
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, আবিষ্কৃত প্রাচীন অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ, ইটের দেয়াল
লক্ষ্য চব্বিশের রোডম্যাপ সোনিয়া-রাহুলের সঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের বৈঠক ঘিরে জল্পনা
জেএমবির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তারজেএমবির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার
রংপুর নগরীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেহাল দশা

সোমবার, ১৮ এপ্রিল ২০২২ , ০৫ বৈশাখ ১৪২৮ ১৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

১৮ এপ্রিল ১৯৭১

বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একাত্তরের ১৮ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস। সেদিনই প্রথম বিদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেদিন দুপুর ১২টায় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার ৯ নম্বর সার্কাস এভিনিউতে পাকিস্তান দূতাবাস পরিবর্তিত হয়ে উঠে বাংলাদেশ দূতাবাস।

আগেরদিন ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ নেয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। আর ১৮ এপ্রিলে কলকাতার পাকিস্তান উপ-দূতাবাসের ৬৫ জন বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ হোসেন আলীর নেতৃত্বে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের উপ-দূতাবাসের নাম রাখা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক মিশন। প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কলকাতার পাকিস্তানের উপ-দূতাবাস।

অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় কলকাতার সার্কাস এভিনিউতে অবস্থিত পাক দূতাবাস থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের লাল সবুজ খচিত পতাকা উড়ান ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী।

কলকাতার পাকিস্তান মিশনে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর মধ্যে দিয়ে বিশ্বে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের কোন দূতাবাসের যাত্রা শুরু হয়। কলকাতার পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদত্যাগ এবং পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষাবলম্বন করার খবর প্রকাশিত হলে দেশে এবং বিদেশে প্রচ- আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

অজস্র সংগঠন এবং বাঙালিরা আবেগ আপ্লুত হয়ে জড়ো হয় দূতাবাসের সামনে। তারা সার্কাস এভিনিউতে মিছিল নিয়ে এসে ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীকে স্বাগত জানায়। এ সময় এক আবেগ আপ্লুত দৃশ্যের অবতারণা হয়। হোসেন আলীর স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে।

হোসেন আলী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষাবলম্বন করায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে পাঠান। এরপর হোসেন আলী কলকাতা বেতারে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের পৈশাচিক গণহত্যা, অত্যাচার ও নিপীড়নের বর্ণনা দেন।

ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর ডায়েরি থেকে জানা যায় ৩০ মার্চেই তিনি পাকিস্তান মিশনকে বাংলাদেশ মিশনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ নিলে তিনি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করবেন। অন্যদিকে ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এবং ১২ এপ্রিল যশোরের নড়াইল মহকুমার প্রশাসক কামালউদ্দিন সিদ্দিকি হোসেন আলীর সঙ্গে দেখা করে তাকে প্রবাসী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অনুরোধ করেন। এদিকে ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পার্ক সার্কাস মাঠে দেখা করেন হোসেন আলী। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএসএফের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। দেখা হওয়ার পর তারা নিকটস্থ গেলর্ড রেস্টুরেন্ট আলোচনায় বসেন।

তখন তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তান দূতাবাসের সব বাঙালি কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিয়ে প্রবাসী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অনুরোধ করেন। এদিকে হোসেন আলী জানতেন না এর একদিন পরেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু এর মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে বললেন, ১৮ তারিখ যেন পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়।

হোসেন আলী বৈঠক শেষে পরদিন নিজের দূতাবাসে ফিরে এসে বাঙালি কর্মকর্তাদের তা জানান। বাঙালিরা সবাই আনুগত্য প্রকাশের ব্যাপারে সম্মতি দেন।

এদিন সকালে কলকাতার পাকিস্তান দূতাবাসে সাত লাখ টাকা জমা ছিল। হোসেন আলী সাত লাখ টাকার মধ্যে চার লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেন এবং বাকি তিন লাখ টাকা নিজের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে জমা করেন। রাতে নিজের গাড়ির চালকের কাছ থেকে চাবি বুঝে নেন। সেদিন রাতেই দূতাবাসের প্রেস সচিব একটি বাংলাদেশের পতাকা সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল পতাকাটি বড়। হোসেন আলীর স্ত্রী এরপর পতাকাটা ঠিক করে নেন।

সকাল থেকে বিএসএফের ডিজিকে এফ রুস্তমজী, বিএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাজগোপাল, গোলাক মজুমদার ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল নরেন্দর সিংহ মিশনের চারপাশে গোপনে উপস্থিত ছিলেন অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য।

১৮ এপ্রিল সকাল সাতটার মধ্যেই দূতাবাসের সব বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়ো হয়েছিলেন। এ সময় হোসেন আলী ঘোষণা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হবে। এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে অবাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিলো। অনেকেই এই সিদ্ধান্তে সায় দিলেন না। তখন উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিবের সঙ্গে কথা বলেন হোসেন আলী।

ঠিক তখনই প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড়ের কারণে দূতাবাসের ছাদে টাঙানো পাকিস্তানের পতাকা ছিঁড়ে অর্ধেক মাটিতে পড়ে যায়। ঠিক তখন হোসেন আলী পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে দেন। এরপর বিএসএফের সদস্যরা কে এফ রুস্তমজীর নির্দেশে দূতাবাসের নামফলকের জায়গায় পাকিস্তানের নাম সরিয়ে বাংলাদেশের নাম বসিয়ে দেয়।

এরপর হোসেন আলী দূতাবাসে তার কক্ষের দেয়াল থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও কবি ইকবালের ছবি সরিয়ে সে জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি টাঙিয়ে দেন।

এদিকে খবর শুনে দলে দলে সাংবাদিকেরা আসতে থাকে সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশ দূতাবাসে। দুপুর একটার দিকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে হোসেন আলী বলেন, ‘আমি এখন থেকে বাংলাদেশের সরকারের আনুগত্য পালন করবো।’

১৮ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সব মন্ত্রীদের দায়িত্ব ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ওপর দপ্তর হস্তান্তর করেছিল।

এদিকে ১৮ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল। এর আগে ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান হানাদাররা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেল লাইন ধরে উত্তর দিকে এগোতে থাকে। এ সময় মেজর শাফায়াত জামিল ১১ নম্বর প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে আগের প্লাটুনের সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল তার থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরিখায় অবস্থান করছিলেন। বেলা ১১টার দিকে শুরু হয় আচমকা হানাদার বাহিনীর গোলাবর্ষণ। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছিল অঝোর বৃষ্টি। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মোগরা বাজার ও গঙ্গা সাগর পাড়ে হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়েই গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে বেলা ১২টার দিকে পশ্চিম দিক থেকে শুরু হয় সরাসরি আক্রমণ। তখন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদারদের গুলি ও গোলার মুখে দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তখন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালান। এ সময় হঠাৎ দুটো গুলি এসে লাগে তার শরীরে। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন তিনি।

এদিন ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতা লর্ড ব্র্যাকওয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তানে হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধর্ষণের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসন যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে তা হিটলারের পরবর্তী সময়কার চরম নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপিত হয়েছে।’ তিনি যুক্তরাজ্যকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন জোগানোর জন্য আহ্বান জানান। একই সঙ্গে ঔপনেবেশিক স্বাধীনতা সম্মেলন আন্দোলনে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দানের অনুরোধ করেন।

এদিন পাঁচ হাজারের বেশি বাঙালি অধিবাসী লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে গণহত্যা ও যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ করে। বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের পর সমাবেশকারীরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিট বরাবর এক স্মারকলিপি দেয়। যেখানে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান ও গণহত্যা বন্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসকদের চাপ দিতে যুক্তরাজ্য সরকারকে আহ্বান জানায়।

১৮ এপ্রিল ঢাকায় পাকিস্তান নেজামে ইসলামের সহ-সভাপতি সৈয়দ মাহমুদ আল মোস্তফা আল মাদানীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গর্ভনর টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা সরকারের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করবে বলে টিক্কা খানকে আশ্বাস দেন।