সাম্রাজ্যবাদের গেমপ্ল্যানের অংশ সাম্প্রদায়িকতা

গৌতম রায়

সিপিআইয়ের (এম) পার্টি কংগ্রেস শেষ হলো। আরএসএসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ডাক এ কংগ্রেসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে সিপিআইয়ের (এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য তথা তাদের পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক শাখার সম্পাদক মহ. সেলিম বলেন; মমতার আরএসএস ছক সফল হবে না।

বামপন্থিদের পক্ষ থেকে তৃণমূল দল তৈরির পেছনে আরএসএসের ভূমিকার বিষয়ে অনেক সময়ে অভিযোগ করা হয়। বস্তুত রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকাল থেকেই কংগ্রেসের ভেতরে আরএসএসের যে ধরনের অদৃশ্য হাতের খেলা শুরু হয়েছিল, যার দরুন নেহরু ঘরানার অর্থনীতি থেকে, এমন কি পররাষ্ট্রনীতি থেকেও রাজীবের আমলে যে সরে আসার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, সেই যোগসূত্রের সঙ্গে মমতার কোন সংযোগ গড়ে উঠেছিল কি না, সেই প্রসঙ্গটিকেও কিন্তু এককথায় উড়িয়ে দেয়া যায় না। রাজীববৃত্তের যে ঘনিষ্ঠ লোকজন, যেমন শ্যাম পিত্রোদা, অরুণ সিং, অরুণ নেহরু প্রমুখ যাদের সঙ্গে আরএসএস সংযোগের কথা শোনা যায়, পরে যারা রাজীব বিরোধিতার ক্ষেত্রে বিজেপির অনেকটাই কাছাকাছি এসেছিলেন, সেসব লোকজনদের সঙ্গে মমতার সখ্যতার প্রসঙ্গটি এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা দরকার।

আন্তর্জাতিক স্তরে বামপন্থার কোণঠাসা হওয়া শুরু আটের দশকের শেষ দিকে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপে বামপন্থার সংকটের ভেতর দিয়ে। সেই সংকটকালেই কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে দক্ষিণপন্থার নতুন করে শক্তিশালী হয়ে ওঠার উপক্রমের শুরু। সেই তালে তালেই কিন্তু নিছক একজন শাসক দলের সাংসদ হয়েই বামপন্থা এবং বামপন্থিবিরোধী শক্তির প্রতীক হিসেবে মমতাকে প্রজেক্ট করা শুরু। অরুণ নেহরু, অরুণ সিংয়েরা যেমন রাজীববৃত্তের ভেতরে থেকেছিল আরএসএসের ঘরের লোক হিসেবেই, ঠিক তেমনভাবেই সঙ্ঘেলের গোপন বন্ধু হিসেবে নরসিংহ রাও ক্যাবিনেটে অবস্থান করেছিলেন মমতা। তাই ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে-পরে কখনোই আমরা মমতার গলা থেকে একটাও আওয়াজ পাই না, অথচ রাও মন্ত্রিসভার রেলমন্ত্রী সি কে জাফর শরিফের ঘরের সামনে অবস্থানে বসে প্রচারের আলোটা নিজের দিকে টেনে নিতে ছাড়েননি তিনি।

কংগ্রেস যখন উদার অর্থনীতির মোহিনীমায়ার আকর্ষণে নেহরু ঘরানার অর্থনৈতিক চিন্তাকে অস্বীকারের পথে হাঁটতে শুরু করল, আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তখন দক্ষিণপন্থার প্রসার বেশ ভালোভাবেই ঘটতে শুরু করেছে। আর ঠিক সেই সময়েই তার নিজের প্রতি নানা বঞ্চনার অভিযোগ তুলে মমতার কংগ্রেস ত্যাগ এবং নিজের আঞ্চলিক দল গঠন। তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির সময়কাল থেকেই পর্দার আড়াল থেকে মমতাকে সব রকম সাহায্য দিয়ে গিয়েছে আরএসএস। তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধীকরণের ক্ষেত্রেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা মমতা পেয়েছিলেন।

নতুন দল তৈরির অব্যবহিত পরেই কিন্তু আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সঙ্গে ভোটের গাঁটছড়া বাঁধেননি মমতা। গোটা দেশের দক্ষিণপন্থা তখন বামেদের প্রকৃত বিকল্প মমতাÑ এ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। ভারতের বৃহৎ পুঁজির মালিকেরা জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তখন কংগ্রেসের প্রতি ’৪৭ সাল পরবর্তী তাদের যে অচলাভক্তি, সেটিকে পুনর্বিবেচনা করবার কথা ভাবতে শুরু করেছে। মধ্যস্বত্ব¡ভোগী ফোড়ে সম্প্রদায়, যারা এতকাল আরএসএস যখনই যে রাজনৈতিক দল তৈরি করেছে, সেই দলের প্রতি সমর্থন উজার করে দিয়েছে, তারাও তখন নরসিংহ রাও সরকারের বাজার অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের বৃহৎ বুর্জোয়াতে পরিণত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ফলে আরএসএস-বিজেপির সহযোগী আর্থিক শক্তিগুলো এ সময়ে সঙ্ঘেল গেমপ্ল্যান অনুযায়ী দক্ষিণপন্থাকে শক্তিশালী করতে মমতাকে সব ধরনের সাহায্য করতে শুরু করে দিয়েছে।

এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই কিন্তু মমতার সঙ্গে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নির্বাচনী সমঝোতা তৈরি হয়। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মমতার প্রতি আরএসএসের পরিপূর্ণ আস্থার জেরেই কিন্তু সে সময়ে বিজেপির সঙ্গে মমতা বা তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। আর বামপন্থিদের ভেতরে বিভেদ তৈরিতে এ সময়ে দক্ষিণপন্থা কতখানি সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল, তা সহজেই বোঝা যায় দমদম লোকসভা কেন্দ্রের মতো বিমেদের দুর্জয় ঘাঁটিতে বিজেপির তপন সিকদারের জেতার ভেতর দিয়ে। জ্যোতি বসুর মতো মানুষকেও সেদিন জীবৎকালে দমদম পুনরুদ্ধার দেখে যাওয়ার ইচ্ছের কথা প্রকাশ্যে বলতে হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক স্তরের যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি একটা সময়ে ভারত থেকে বামপন্থিদের নিকেশ করবার সংকল্প নিয়ে মমতাকে ছদ্ম বামপন্থি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তারাই এখন ‘ইভিল’ তত্ত্ব হাজির করেছে। এ ইভল তত্ত্ববিদেরা বিজেপিকে দেখাচ্ছে ‘গ্রেটার ইভিল’ বলে, আর মমতাকে দেখাচ্ছে, ‘লেসার ইভল’ বলে। এদের মতে, ‘গ্রটার ইভিল’ কে রুখতে ‘লেসার ইভিল’ই শ্রেয়। এদের কাছে বামপন্থিরা কোন ধর্তব্যের ভেতরেই আসছে না। ইভিলের মধ্যে সংঘাত বলে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ‘টগর বোস্টমি’র মতোই এরা বৃহৎত্তর ক্ষতি রুখতে, ক্ষুদ্রতর ক্ষতির পক্ষে যুক্তি খাড়া করে গত ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই মমতার, থুড়ি, আরএসএসের পক্ষে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সামাজিক প্রযুক্তি চালিয়ে যাচ্ছে। এ শক্তি কংগ্রেস-বিজেপির নয়া উদার অর্থনীতির গোড়া সমর্থক। কংগ্রেস রাজীব গান্ধীর আমল থেকেই যে নেহরায়ানার অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করেছিল, সেই কর্মকা-ের এরা উগ্র সমর্থক। বাইরে এরা একটা প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ লেবাস সেঁটে থাকে। বামফ্রন্ট ভুক্ত বামপন্থিদের রাক্ষস, খোক্ষস, শয়তান, হেওয়াইনের সঙ্গে একাসনে বসানোটাই এসব তথাকথিত প্রগতিশীল দের একমাত্র কাজ।

বিজেপির মস্তিষ্ক আরএসএস, শুধু একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সংগঠন নয়। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বাজার দখলের স্বার্থে ধর্মান্ধতা, জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবাদ, ভাষাভিত্তিক বিদ্বেষ, লিঙ্গ বিদ্বেষ ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে অরাজকতা তৈরি করছে, আরএসএস ভারতে তার সব থেকে নির্ভরযোগ্য এজেন্ট। ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় স্থায়ী করতে মমতার মতো ব্যক্তি স্বার্থবাহী লোকেদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। বামপন্থিদের প্রতিহত করতে মমতাকে ভোট রাজনীতিতে জয়ী করিয়েছে।

মমতার এ যে ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘু মুসলমান প্রেমের নামে সংখ্যালঘু হত্যাকারী আরএসএসের গোপন বন্ধু হিসেবে কাজ করাÑ এ সহজ-সরল সত্যটা মানুষের সামনে তুলে ধরা এখন সব থেকে বড় রাজনৈতিক কাজ। ইভিল তত্ত্বের নামে বিজেপি বিরোধিতার ছদ্মবেশে, বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএসের গোপন সহযোগী মমতাকে প্রমোট করবার যে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীলদের অভিসন্ধি, সেটাকে মানুষের সামনে তুলে ধরাও এখন ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম প্রধান শর্ত।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

সোমবার, ১৮ এপ্রিল ২০২২ , ০৫ বৈশাখ ১৪২৮ ১৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

সাম্রাজ্যবাদের গেমপ্ল্যানের অংশ সাম্প্রদায়িকতা

গৌতম রায়

সিপিআইয়ের (এম) পার্টি কংগ্রেস শেষ হলো। আরএসএসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ডাক এ কংগ্রেসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে সিপিআইয়ের (এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য তথা তাদের পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক শাখার সম্পাদক মহ. সেলিম বলেন; মমতার আরএসএস ছক সফল হবে না।

বামপন্থিদের পক্ষ থেকে তৃণমূল দল তৈরির পেছনে আরএসএসের ভূমিকার বিষয়ে অনেক সময়ে অভিযোগ করা হয়। বস্তুত রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকাল থেকেই কংগ্রেসের ভেতরে আরএসএসের যে ধরনের অদৃশ্য হাতের খেলা শুরু হয়েছিল, যার দরুন নেহরু ঘরানার অর্থনীতি থেকে, এমন কি পররাষ্ট্রনীতি থেকেও রাজীবের আমলে যে সরে আসার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, সেই যোগসূত্রের সঙ্গে মমতার কোন সংযোগ গড়ে উঠেছিল কি না, সেই প্রসঙ্গটিকেও কিন্তু এককথায় উড়িয়ে দেয়া যায় না। রাজীববৃত্তের যে ঘনিষ্ঠ লোকজন, যেমন শ্যাম পিত্রোদা, অরুণ সিং, অরুণ নেহরু প্রমুখ যাদের সঙ্গে আরএসএস সংযোগের কথা শোনা যায়, পরে যারা রাজীব বিরোধিতার ক্ষেত্রে বিজেপির অনেকটাই কাছাকাছি এসেছিলেন, সেসব লোকজনদের সঙ্গে মমতার সখ্যতার প্রসঙ্গটি এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা দরকার।

আন্তর্জাতিক স্তরে বামপন্থার কোণঠাসা হওয়া শুরু আটের দশকের শেষ দিকে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপে বামপন্থার সংকটের ভেতর দিয়ে। সেই সংকটকালেই কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে দক্ষিণপন্থার নতুন করে শক্তিশালী হয়ে ওঠার উপক্রমের শুরু। সেই তালে তালেই কিন্তু নিছক একজন শাসক দলের সাংসদ হয়েই বামপন্থা এবং বামপন্থিবিরোধী শক্তির প্রতীক হিসেবে মমতাকে প্রজেক্ট করা শুরু। অরুণ নেহরু, অরুণ সিংয়েরা যেমন রাজীববৃত্তের ভেতরে থেকেছিল আরএসএসের ঘরের লোক হিসেবেই, ঠিক তেমনভাবেই সঙ্ঘেলের গোপন বন্ধু হিসেবে নরসিংহ রাও ক্যাবিনেটে অবস্থান করেছিলেন মমতা। তাই ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে-পরে কখনোই আমরা মমতার গলা থেকে একটাও আওয়াজ পাই না, অথচ রাও মন্ত্রিসভার রেলমন্ত্রী সি কে জাফর শরিফের ঘরের সামনে অবস্থানে বসে প্রচারের আলোটা নিজের দিকে টেনে নিতে ছাড়েননি তিনি।

কংগ্রেস যখন উদার অর্থনীতির মোহিনীমায়ার আকর্ষণে নেহরু ঘরানার অর্থনৈতিক চিন্তাকে অস্বীকারের পথে হাঁটতে শুরু করল, আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তখন দক্ষিণপন্থার প্রসার বেশ ভালোভাবেই ঘটতে শুরু করেছে। আর ঠিক সেই সময়েই তার নিজের প্রতি নানা বঞ্চনার অভিযোগ তুলে মমতার কংগ্রেস ত্যাগ এবং নিজের আঞ্চলিক দল গঠন। তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির সময়কাল থেকেই পর্দার আড়াল থেকে মমতাকে সব রকম সাহায্য দিয়ে গিয়েছে আরএসএস। তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধীকরণের ক্ষেত্রেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা মমতা পেয়েছিলেন।

নতুন দল তৈরির অব্যবহিত পরেই কিন্তু আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সঙ্গে ভোটের গাঁটছড়া বাঁধেননি মমতা। গোটা দেশের দক্ষিণপন্থা তখন বামেদের প্রকৃত বিকল্প মমতাÑ এ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। ভারতের বৃহৎ পুঁজির মালিকেরা জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তখন কংগ্রেসের প্রতি ’৪৭ সাল পরবর্তী তাদের যে অচলাভক্তি, সেটিকে পুনর্বিবেচনা করবার কথা ভাবতে শুরু করেছে। মধ্যস্বত্ব¡ভোগী ফোড়ে সম্প্রদায়, যারা এতকাল আরএসএস যখনই যে রাজনৈতিক দল তৈরি করেছে, সেই দলের প্রতি সমর্থন উজার করে দিয়েছে, তারাও তখন নরসিংহ রাও সরকারের বাজার অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের বৃহৎ বুর্জোয়াতে পরিণত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ফলে আরএসএস-বিজেপির সহযোগী আর্থিক শক্তিগুলো এ সময়ে সঙ্ঘেল গেমপ্ল্যান অনুযায়ী দক্ষিণপন্থাকে শক্তিশালী করতে মমতাকে সব ধরনের সাহায্য করতে শুরু করে দিয়েছে।

এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই কিন্তু মমতার সঙ্গে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নির্বাচনী সমঝোতা তৈরি হয়। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মমতার প্রতি আরএসএসের পরিপূর্ণ আস্থার জেরেই কিন্তু সে সময়ে বিজেপির সঙ্গে মমতা বা তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। আর বামপন্থিদের ভেতরে বিভেদ তৈরিতে এ সময়ে দক্ষিণপন্থা কতখানি সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল, তা সহজেই বোঝা যায় দমদম লোকসভা কেন্দ্রের মতো বিমেদের দুর্জয় ঘাঁটিতে বিজেপির তপন সিকদারের জেতার ভেতর দিয়ে। জ্যোতি বসুর মতো মানুষকেও সেদিন জীবৎকালে দমদম পুনরুদ্ধার দেখে যাওয়ার ইচ্ছের কথা প্রকাশ্যে বলতে হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক স্তরের যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি একটা সময়ে ভারত থেকে বামপন্থিদের নিকেশ করবার সংকল্প নিয়ে মমতাকে ছদ্ম বামপন্থি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তারাই এখন ‘ইভিল’ তত্ত্ব হাজির করেছে। এ ইভল তত্ত্ববিদেরা বিজেপিকে দেখাচ্ছে ‘গ্রেটার ইভিল’ বলে, আর মমতাকে দেখাচ্ছে, ‘লেসার ইভল’ বলে। এদের মতে, ‘গ্রটার ইভিল’ কে রুখতে ‘লেসার ইভিল’ই শ্রেয়। এদের কাছে বামপন্থিরা কোন ধর্তব্যের ভেতরেই আসছে না। ইভিলের মধ্যে সংঘাত বলে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ‘টগর বোস্টমি’র মতোই এরা বৃহৎত্তর ক্ষতি রুখতে, ক্ষুদ্রতর ক্ষতির পক্ষে যুক্তি খাড়া করে গত ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই মমতার, থুড়ি, আরএসএসের পক্ষে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সামাজিক প্রযুক্তি চালিয়ে যাচ্ছে। এ শক্তি কংগ্রেস-বিজেপির নয়া উদার অর্থনীতির গোড়া সমর্থক। কংগ্রেস রাজীব গান্ধীর আমল থেকেই যে নেহরায়ানার অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করেছিল, সেই কর্মকা-ের এরা উগ্র সমর্থক। বাইরে এরা একটা প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ লেবাস সেঁটে থাকে। বামফ্রন্ট ভুক্ত বামপন্থিদের রাক্ষস, খোক্ষস, শয়তান, হেওয়াইনের সঙ্গে একাসনে বসানোটাই এসব তথাকথিত প্রগতিশীল দের একমাত্র কাজ।

বিজেপির মস্তিষ্ক আরএসএস, শুধু একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সংগঠন নয়। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বাজার দখলের স্বার্থে ধর্মান্ধতা, জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবাদ, ভাষাভিত্তিক বিদ্বেষ, লিঙ্গ বিদ্বেষ ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে অরাজকতা তৈরি করছে, আরএসএস ভারতে তার সব থেকে নির্ভরযোগ্য এজেন্ট। ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় স্থায়ী করতে মমতার মতো ব্যক্তি স্বার্থবাহী লোকেদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। বামপন্থিদের প্রতিহত করতে মমতাকে ভোট রাজনীতিতে জয়ী করিয়েছে।

মমতার এ যে ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘু মুসলমান প্রেমের নামে সংখ্যালঘু হত্যাকারী আরএসএসের গোপন বন্ধু হিসেবে কাজ করাÑ এ সহজ-সরল সত্যটা মানুষের সামনে তুলে ধরা এখন সব থেকে বড় রাজনৈতিক কাজ। ইভিল তত্ত্বের নামে বিজেপি বিরোধিতার ছদ্মবেশে, বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএসের গোপন সহযোগী মমতাকে প্রমোট করবার যে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীলদের অভিসন্ধি, সেটাকে মানুষের সামনে তুলে ধরাও এখন ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম প্রধান শর্ত।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]