বিএসইসির টনিকেও নিস্তেজ পুঁজিবাজার

জাহিদুল ইসলাম সুজন

অব্যাহত বিক্রয় চাপে ক্রমেই তারল্য শূন্য হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজার। টানা দর পতনে বিগত ১১ কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক কমেছে প্রায় ২৯০ পয়েন্ট। এদিকে, গতকাল সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে ডিএসইর ৩৪৭টি কোম্পানি ও ফান্ডের দর কমেছে। পাশাপাশি হাজার কোটি টাকার দৈনিক লেনদেন নেমে এসেছে ৪’শ কোটি টাকার নিচে। যা গত ২০২১ সালের এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন।

করোনা মহামারীতে দেশের পুঁজিবাজারে নতুন নতুন রেকর্ড গড়লেও গত ৫ মাস যাতব দর পতনে চলছে। তবে, ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলার পর পুঁজিবাজারের দর পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। যদিও দর পতন বন্ধে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে তারল্য সরবরাহ বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তা কাজে আসেনি। নতুন বিনিয়োগ না আসায় নিস্তেজ হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজার।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগানে পরিমান অনেক বেশি। নতুন নতুন প্রডাক্টের মাধ্যমে বাজার থেকে তারল্য অন্য খাতে হস্থান্তর করা হলেও নতুন বিনিয়োগ না আসায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও টানা দর পতনে লোকসানে থাকা বিনিয়োগকারীরা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ পলিসি অনুসরণ করায় বাজারে দর পতন দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ইস্যু ম্যানেজার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাজারে আনুমানিক তারল্যের পরিমাণ ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সুকুক বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে আড়াই থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে, বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রত্যেক ঈদে বিনিয়োগকারীরা প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মত নিজেদের প্রয়োজনে উত্তোলন করে। দর পতন দীর্ঘায়িত হওয়ায় যা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর থেকে পুঁজিবাজার ধস দেখা দেয়ায় বাজারে তারল্য বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি নানা চেষ্টা করেছে। এই লক্ষ্যে প্রথমে ব্যাংক, পরে মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি, এরপর মার্চেন্ট ব্যাংক, স্টক ডিলারসহ বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠক হয়। গত ৯, ১০ ও ৩০ মার্চের এই বৈঠক শেষে সব পক্ষই বাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করে।

৩৩টি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলা হয়, যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে, তারা কয়েক দিনের মধ্যে ২ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াবে। এতে শেয়ারবাজারে তারল্যপ্রবাহ বাড়বে। ব্যাংকগুলোর জন্য ঘোষিত ২০০ কোটি টাকার ফান্ড এখনও যেসব ব্যাংক গঠন করেনি, তারা তা করবেন বলে সভা শেষে জানানো হয়। এরপর সক্ষমতা অনুযায়ী তারা বিনিয়োগ করবেন বলে নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া যারা ফান্ড গঠন করে এখনও বিনিয়োগ করেননি, তারা বিনিয়োগ করবেন বলে বলা হয়। পরদিন মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে বৈঠক শেষেও বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করা হয়। পাশাপাশি দর পতন রুখতে শেয়ার দর কমায় ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার দেয় বিএসইসি।

পরবর্তীতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে বিএসইসি। তখন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো রোজায় ৩০০ কোটি টাকা আর প্রতিটি স্টক ডিলার অ্যাকাউন্ট থেকে ১ কোটি করে আড়াই শ কোটি টাকা লেনদেনের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করে। কিন্তু ঘোষণার পর নতুন বিনিয়োগ না আসায় দ্বিতীয় রোজ থেকেই দর পতন শুরু হয় পুঁজিবাজারে। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ১১ কার্যদিবসে ডিএসই’র সার্বিক মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ২৮৯.৫৩ পয়েন্ট। গত ৩ এপ্রিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক ছিল ৬ হাজার ৭৭১ পয়েন্টে। এদিকে, ১৮ এপ্রিল দিনশেষে ডিএসই’র সার্বিক মূল্যসূচক ৬ হাজার ৪৮২ পয়েন্টে স্থিতি পেয়েছে।

মার্কেটের এমন দর পতনের কারণ জানতে চাইলে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম সংবাদকে বলেন, এমন দর পতনের কারণ আমরাও বুঝতে পারিছি না। কিন্তু মার্কেটে কিভাবে লিকুইডিটি (তারল্য) বাড়ানো যায় ও ফোর্স সেল যাতে না আসে আমার তার জন্য কাজ করছি।

তিনি বলেন, মার্কেটকে প্যানিক করার চেষ্ঠা করেছে এমন ১৫টি অর্থরাইজডকে আমার সাসপেন্ড করেছি। যাতে কেউ মার্কেটকে প্যানিক না করে সেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

রেজাউল করিম বলেন, এমন মার্কেট পরিস্থিতিতে দেখা যায় যারা শেয়ার কিনবে তারা আরও একটু দাম কমার অপেক্ষা করে। কিন্তু যারা বিক্রি করার মানুষিকতা সেট করে তারা অতিদ্রুত বিক্রির চেষ্ঠা করে। তাই দর পতন ত্বরান্বিত হয়।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, টানা দর পতনে আস্থা সংকট সৃষ্টি হয়েছে পুঁজিবাজারে। পাশাপাশি দর কমায় ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার দেয়ায় শেয়ার দর কমায় বেশি সময় নিচ্ছে। ফলে, যারা অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ করবে তারাও ওয়েট অ্যান্ড সি পলিসিতে রয়েছে। তিনি বলেন, বাজারকে স্বাভাবিক ভাবে চলতে দেয়া উচিত। এতে করে নিদিষ্ট সময় পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।

মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল ২০২২ , ০৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৭ রমাদ্বান ১৪৪৩

বিএসইসির টনিকেও নিস্তেজ পুঁজিবাজার

জাহিদুল ইসলাম সুজন

অব্যাহত বিক্রয় চাপে ক্রমেই তারল্য শূন্য হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজার। টানা দর পতনে বিগত ১১ কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক কমেছে প্রায় ২৯০ পয়েন্ট। এদিকে, গতকাল সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে ডিএসইর ৩৪৭টি কোম্পানি ও ফান্ডের দর কমেছে। পাশাপাশি হাজার কোটি টাকার দৈনিক লেনদেন নেমে এসেছে ৪’শ কোটি টাকার নিচে। যা গত ২০২১ সালের এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন।

করোনা মহামারীতে দেশের পুঁজিবাজারে নতুন নতুন রেকর্ড গড়লেও গত ৫ মাস যাতব দর পতনে চলছে। তবে, ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলার পর পুঁজিবাজারের দর পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। যদিও দর পতন বন্ধে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে তারল্য সরবরাহ বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তা কাজে আসেনি। নতুন বিনিয়োগ না আসায় নিস্তেজ হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজার।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগানে পরিমান অনেক বেশি। নতুন নতুন প্রডাক্টের মাধ্যমে বাজার থেকে তারল্য অন্য খাতে হস্থান্তর করা হলেও নতুন বিনিয়োগ না আসায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও টানা দর পতনে লোকসানে থাকা বিনিয়োগকারীরা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ পলিসি অনুসরণ করায় বাজারে দর পতন দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ইস্যু ম্যানেজার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাজারে আনুমানিক তারল্যের পরিমাণ ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সুকুক বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে আড়াই থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে, বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রত্যেক ঈদে বিনিয়োগকারীরা প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মত নিজেদের প্রয়োজনে উত্তোলন করে। দর পতন দীর্ঘায়িত হওয়ায় যা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর থেকে পুঁজিবাজার ধস দেখা দেয়ায় বাজারে তারল্য বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি নানা চেষ্টা করেছে। এই লক্ষ্যে প্রথমে ব্যাংক, পরে মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি, এরপর মার্চেন্ট ব্যাংক, স্টক ডিলারসহ বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠক হয়। গত ৯, ১০ ও ৩০ মার্চের এই বৈঠক শেষে সব পক্ষই বাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করে।

৩৩টি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলা হয়, যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে, তারা কয়েক দিনের মধ্যে ২ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াবে। এতে শেয়ারবাজারে তারল্যপ্রবাহ বাড়বে। ব্যাংকগুলোর জন্য ঘোষিত ২০০ কোটি টাকার ফান্ড এখনও যেসব ব্যাংক গঠন করেনি, তারা তা করবেন বলে সভা শেষে জানানো হয়। এরপর সক্ষমতা অনুযায়ী তারা বিনিয়োগ করবেন বলে নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া যারা ফান্ড গঠন করে এখনও বিনিয়োগ করেননি, তারা বিনিয়োগ করবেন বলে বলা হয়। পরদিন মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে বৈঠক শেষেও বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করা হয়। পাশাপাশি দর পতন রুখতে শেয়ার দর কমায় ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার দেয় বিএসইসি।

পরবর্তীতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে বিএসইসি। তখন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো রোজায় ৩০০ কোটি টাকা আর প্রতিটি স্টক ডিলার অ্যাকাউন্ট থেকে ১ কোটি করে আড়াই শ কোটি টাকা লেনদেনের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করে। কিন্তু ঘোষণার পর নতুন বিনিয়োগ না আসায় দ্বিতীয় রোজ থেকেই দর পতন শুরু হয় পুঁজিবাজারে। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ১১ কার্যদিবসে ডিএসই’র সার্বিক মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ২৮৯.৫৩ পয়েন্ট। গত ৩ এপ্রিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক ছিল ৬ হাজার ৭৭১ পয়েন্টে। এদিকে, ১৮ এপ্রিল দিনশেষে ডিএসই’র সার্বিক মূল্যসূচক ৬ হাজার ৪৮২ পয়েন্টে স্থিতি পেয়েছে।

মার্কেটের এমন দর পতনের কারণ জানতে চাইলে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম সংবাদকে বলেন, এমন দর পতনের কারণ আমরাও বুঝতে পারিছি না। কিন্তু মার্কেটে কিভাবে লিকুইডিটি (তারল্য) বাড়ানো যায় ও ফোর্স সেল যাতে না আসে আমার তার জন্য কাজ করছি।

তিনি বলেন, মার্কেটকে প্যানিক করার চেষ্ঠা করেছে এমন ১৫টি অর্থরাইজডকে আমার সাসপেন্ড করেছি। যাতে কেউ মার্কেটকে প্যানিক না করে সেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

রেজাউল করিম বলেন, এমন মার্কেট পরিস্থিতিতে দেখা যায় যারা শেয়ার কিনবে তারা আরও একটু দাম কমার অপেক্ষা করে। কিন্তু যারা বিক্রি করার মানুষিকতা সেট করে তারা অতিদ্রুত বিক্রির চেষ্ঠা করে। তাই দর পতন ত্বরান্বিত হয়।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, টানা দর পতনে আস্থা সংকট সৃষ্টি হয়েছে পুঁজিবাজারে। পাশাপাশি দর কমায় ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার দেয়ায় শেয়ার দর কমায় বেশি সময় নিচ্ছে। ফলে, যারা অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ করবে তারাও ওয়েট অ্যান্ড সি পলিসিতে রয়েছে। তিনি বলেন, বাজারকে স্বাভাবিক ভাবে চলতে দেয়া উচিত। এতে করে নিদিষ্ট সময় পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।