চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি শিক্ষায় রাষ্ট্রের ব্যয় বেশি, কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রশাসন ক্যাডারে সুবিধা বেশি বলে অনেকের বিশেষায়িত শিক্ষা আর কাজে লাগে না
বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে সদস্য প্রায় ২২ হাজার। এই ক্যাডারের শীর্ষ পদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। পদটি গ্রেড-১ এর হলেও বর্তমানে এই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গ্রেড-৩ এর সুবিধা ভোগ করছেন। এর আগের মহাপরিচালকও গ্রেড-২-এ থেকেই অবসরে যান বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রকৌশলীদের সংস্থা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) প্রধান প্রকৌশলীর পদটি গ্রেড-২ এর সমমর্যাদার। অথচ এই সংস্থার বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী গ্রেড-৩ এর সুবিধা ভোগ করছেন। বারবার চেষ্টা করেও পদোন্নতির আশা দেখছেন না প্রধান প্রকৌশলী।
প্রায় ১৬ হাজার সদস্য নিয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার। এই ক্যাডারের অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) শীর্ষ পদ গ্রেড-১ এর। অথচ মাউশির টানা তিনজন মহাপরিচালক অবসরে গেছেন তৃতীয় গ্রেড নিয়ে। বর্তমান মহাপরিচালক চতুর্থ গ্রেডে নিয়োগ পেয়েছেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল, স্বাস্থ্য প্রকৌশলসহ অন্য বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর শীর্ষপদেও দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের বৈষম্য। আর এই পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিতরা অর্থাৎ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষি বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনকারীরা প্রশাসনিক বা অন্য ক্যাডারের চাকরির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের ‘বৈষম্যের’ কারণে বিশেষায়িত ক্যাডার ও পেশার প্রতি চাকরি প্রত্যাশীরা আকর্ষণ হারাচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পেশার প্রতিনিধি ও শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বিসিএস পরীক্ষায় নিয়োগের চিত্র :
প্রশাসনিক ক্ষমতা, সম্মান, আর্থিক ও আবাসন এবং ব্যক্তিগত গাড়ি সুবিধা, বিদেশ ভ্রমণসহ প্রায় সব ধরনের সুবিধায় শীর্ষে রয়েছে প্রশাসন ক্যাডার। পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারেও যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে। অন্য ক্যাডারে এই ধরনের সুবিধা তুলনামূলক কম। এ কারণে ‘বিশেষায়িত’ বিশেষ করে চিকিৎসা ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীরাও এখন সাধারণ প্রশাসনের চাকরির দিকে ঝুঁকছে।
গত ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। এতে দেখা গেছে প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশ এই তিন ক্যাডারেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
তাদের মধ্যে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জান্নাতুল ফেরদৌস প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কাজি ফাইজুল করিম পুলিশ ক্যাডারে প্রথম এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এই তিনজনই তাদের পছন্দের ক্যাডার পেয়েছেন।
৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলেও প্রকৌশল ও চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের আধিক্য ছিল। তখন ২৪টি ক্যাডারে দুই হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল পিএসসি। এর মধ্যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫ জন প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল যাদের সাতজনই ছিলেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী। ১৩ জন ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থী, যাদের ১০ জনই বুয়েটের। অন্যদের মধ্যে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একজন, কুয়েটের একজন এবং আরেকজন অন্য একটি প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা।
কৃষিবিদরাও পেশা বদল করছেন। ৩৮তম বিসিএসে শুধু শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করা তিনজন প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। ওই বিসিএসে মেডিকেল, প্রকৌশলসহ বিশেষায়িত শিক্ষায় উচ্চ ডিগ্রি নেয়া ১২০ জন শিক্ষার্থী প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন।
এর আগে ৩৬তম বিসিএসে
শতাধিক চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কৃষিবিদ নিজ পেশায় না গিয়ে প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। ৩৭তম বিসিএসে বিশেষায়িত শিক্ষায় ডিগ্রি পাওয়া ৮০ জন অন্য ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন বলে ক্যাডার ভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে শুধু চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়।
সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক সংবাদকে বলেছেন, পিএসসির প্রচলিত যে বিধি-বিধান আছে তার আওতায় চাকরি প্রার্থীরা পেশা বদল করছেন এবং এটা সবার মৌলিক অধিকার। তবে আর্থিক, গাড়ি ও আবাসন সুবিধাসহ অন্য কারণে চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা পেশা ত্যাগ করছেন বলে মনে করেন না সাবেক এই সচিব।
ড. সাদিক বলেন, ‘জেলা সিভিল সার্জন, কৃষি বা খাদ্য কর্মকর্তা, প্রকৌশলীদেরও গাড়ি ও আবাসনের ব্যবস্থা আছে। এখানে জেলা প্রশাসকের মূল কাজ সবকিছু সমন্বয় করা। কোথাও রাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য কর্মকর্তারা ছুটে যান না। সেখানে যেতে হয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জনদের। তাদের তো গাড়ির প্রয়োজন আছেই।’
শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেশি চিকিৎসা শিক্ষায়, তারপর কৃষি :
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীপ্রতি রাষ্ট্রের ১৫ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়। আর দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাঁচ বছরের এমবিবিএস ডিগ্রি পেতে শিক্ষার্থীপ্রতি ১৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়।
ইিউজিসি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, যেকোন সাধারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে পাঁচ বছরের কোর্স।
ইউজিসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি বছরে ব্যয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যয় এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো। তবে বুয়েটে বছরে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দুই লাখ ৩০ হাজার এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে এই ব্যয় পৌনে চার লাখ টাকার মতো।
প্রকৌশল, চিকিৎসক ও কৃষিতে উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের সাধারণ প্রশাসনে চাকরিতে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৃচি (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) বিসিএস ২৫ ক্যাডার সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া সংবাদকে বলেন ‘এটা ইতিবাচক’। তার মতে প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও কৃষিবিদদের মতো শিক্ষার্থীরা গেলে প্রশাসনের উপকারই হবে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেখাপড়া শেষে চাকরি খোঁজেন দাবি করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘তাদের প্রতি দশজনের একজন সরকারি চাকরি পান। বাকিদের বেসরকারি চাকরি খুঁজতে হয়। কাজেই সরকারি চাকরি না পেলে তারা বিদেশে ছুটবে।’
‘স্পেশালাইজড’ শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন নেই-দাবি করে প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রায় সব সুযোগ-সুবিধাই প্রশাসন ক্যাডারকেন্দ্রিক। প্রশাসন ক্যাডারে পদ শূন্য না থাকলেও নিয়মিত পদোন্নতি হয়, অন্যান্য ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতিই হয় না। বরং নানা অজুহাতে পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়।’
পরিস্থিতির জন্য দায়ী আন্তঃক্যাডার বৈষম্য :
ক্যাডারভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের নেতা জানিয়েছেন, প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির মূল্য, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের চেয়ে অনেক বেশি। তারা কর্মক্ষেত্রেও নানাভাবে অবহেলিত। তাদের সুযোগ-সুবিধা ও পদোন্নতি নির্ভর করে প্রশাসন ক্যাডারের ওপর। এ কারণেই প্রকৌশলী ও চিকিৎসকরা প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেতে আগ্রহী হচ্ছেন।
পেশাজীবী নেতারা জানান, প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি শুরু হয় সহকারী কমিশনার হিসেবে, পদায়ন হয় মাঠ পর্যায়ে। সেখানে তারা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পান। চাকরি নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের পদোন্নতি হয় জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হিসেবে। এই পদে থেকেই অনেকে দায়িত্ব পান ‘সিনিয়র সহকারী সচিব’ বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে।
আর প্রশাসন ক্যাডারে যারা সচিবালয়ে পদায়ন পান, তাদের প্রথম পদ সহকারী সচিব এবং পরে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হন। মাঠ পর্যায় বা সচিবালয়ের পরবর্তী পদোন্নতি হয় উপসচিব হিসেবে। এরপর নিয়মিত পদোন্নতি হতে থাকে। চাকরির শুরু থেকে তাদের গাড়ি, আবাসনসহ নানা ধরনের সুবিধা থাকে। উপসচিব হলে সরকার থেকে নামমাত্র সুদে ঋণ নিয়ে গাড়ি কেনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকাও পান।
চিকিৎসা ক্যাডারে ডাক্তাররা প্রথম যোগ দেন সহকারী সার্জন বা জুনিয়র কনসালট্যান্ট এবং মাঠ পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে। এর পরের পদে পদোন্নতি হয় শর্তযুক্ত। যারা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করতে পারেন তারা সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হন। মাঠ পর্যায়ে চাকরির পাশাপাশি স্নাতকোত্তর কোর্স করতে অনেকের আট-দশ বছর সময় লেগে যায়। এ কারণে যারা স্নাতকোত্তর করতে পারেন না তাদের চাকরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল বা সিভিল সার্জন অফিসেই শেষ হয়ে যায়।
মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল ২০২২ , ০৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৭ রমাদ্বান ১৪৪৩
চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি শিক্ষায় রাষ্ট্রের ব্যয় বেশি, কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রশাসন ক্যাডারে সুবিধা বেশি বলে অনেকের বিশেষায়িত শিক্ষা আর কাজে লাগে না
রাকিব উদ্দিন
বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে সদস্য প্রায় ২২ হাজার। এই ক্যাডারের শীর্ষ পদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। পদটি গ্রেড-১ এর হলেও বর্তমানে এই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গ্রেড-৩ এর সুবিধা ভোগ করছেন। এর আগের মহাপরিচালকও গ্রেড-২-এ থেকেই অবসরে যান বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রকৌশলীদের সংস্থা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) প্রধান প্রকৌশলীর পদটি গ্রেড-২ এর সমমর্যাদার। অথচ এই সংস্থার বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী গ্রেড-৩ এর সুবিধা ভোগ করছেন। বারবার চেষ্টা করেও পদোন্নতির আশা দেখছেন না প্রধান প্রকৌশলী।
প্রায় ১৬ হাজার সদস্য নিয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার। এই ক্যাডারের অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) শীর্ষ পদ গ্রেড-১ এর। অথচ মাউশির টানা তিনজন মহাপরিচালক অবসরে গেছেন তৃতীয় গ্রেড নিয়ে। বর্তমান মহাপরিচালক চতুর্থ গ্রেডে নিয়োগ পেয়েছেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল, স্বাস্থ্য প্রকৌশলসহ অন্য বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর শীর্ষপদেও দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের বৈষম্য। আর এই পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিতরা অর্থাৎ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষি বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনকারীরা প্রশাসনিক বা অন্য ক্যাডারের চাকরির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের ‘বৈষম্যের’ কারণে বিশেষায়িত ক্যাডার ও পেশার প্রতি চাকরি প্রত্যাশীরা আকর্ষণ হারাচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পেশার প্রতিনিধি ও শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বিসিএস পরীক্ষায় নিয়োগের চিত্র :
প্রশাসনিক ক্ষমতা, সম্মান, আর্থিক ও আবাসন এবং ব্যক্তিগত গাড়ি সুবিধা, বিদেশ ভ্রমণসহ প্রায় সব ধরনের সুবিধায় শীর্ষে রয়েছে প্রশাসন ক্যাডার। পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারেও যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে। অন্য ক্যাডারে এই ধরনের সুবিধা তুলনামূলক কম। এ কারণে ‘বিশেষায়িত’ বিশেষ করে চিকিৎসা ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীরাও এখন সাধারণ প্রশাসনের চাকরির দিকে ঝুঁকছে।
গত ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। এতে দেখা গেছে প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশ এই তিন ক্যাডারেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
তাদের মধ্যে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জান্নাতুল ফেরদৌস প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কাজি ফাইজুল করিম পুলিশ ক্যাডারে প্রথম এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এই তিনজনই তাদের পছন্দের ক্যাডার পেয়েছেন।
৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলেও প্রকৌশল ও চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের আধিক্য ছিল। তখন ২৪টি ক্যাডারে দুই হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল পিএসসি। এর মধ্যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫ জন প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল যাদের সাতজনই ছিলেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী। ১৩ জন ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থী, যাদের ১০ জনই বুয়েটের। অন্যদের মধ্যে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একজন, কুয়েটের একজন এবং আরেকজন অন্য একটি প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা।
কৃষিবিদরাও পেশা বদল করছেন। ৩৮তম বিসিএসে শুধু শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করা তিনজন প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। ওই বিসিএসে মেডিকেল, প্রকৌশলসহ বিশেষায়িত শিক্ষায় উচ্চ ডিগ্রি নেয়া ১২০ জন শিক্ষার্থী প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন।
এর আগে ৩৬তম বিসিএসে
শতাধিক চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কৃষিবিদ নিজ পেশায় না গিয়ে প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। ৩৭তম বিসিএসে বিশেষায়িত শিক্ষায় ডিগ্রি পাওয়া ৮০ জন অন্য ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন বলে ক্যাডার ভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে শুধু চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়।
সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক সংবাদকে বলেছেন, পিএসসির প্রচলিত যে বিধি-বিধান আছে তার আওতায় চাকরি প্রার্থীরা পেশা বদল করছেন এবং এটা সবার মৌলিক অধিকার। তবে আর্থিক, গাড়ি ও আবাসন সুবিধাসহ অন্য কারণে চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা পেশা ত্যাগ করছেন বলে মনে করেন না সাবেক এই সচিব।
ড. সাদিক বলেন, ‘জেলা সিভিল সার্জন, কৃষি বা খাদ্য কর্মকর্তা, প্রকৌশলীদেরও গাড়ি ও আবাসনের ব্যবস্থা আছে। এখানে জেলা প্রশাসকের মূল কাজ সবকিছু সমন্বয় করা। কোথাও রাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য কর্মকর্তারা ছুটে যান না। সেখানে যেতে হয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জনদের। তাদের তো গাড়ির প্রয়োজন আছেই।’
শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেশি চিকিৎসা শিক্ষায়, তারপর কৃষি :
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীপ্রতি রাষ্ট্রের ১৫ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়। আর দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাঁচ বছরের এমবিবিএস ডিগ্রি পেতে শিক্ষার্থীপ্রতি ১৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়।
ইিউজিসি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, যেকোন সাধারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে পাঁচ বছরের কোর্স।
ইউজিসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি বছরে ব্যয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যয় এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো। তবে বুয়েটে বছরে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দুই লাখ ৩০ হাজার এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে এই ব্যয় পৌনে চার লাখ টাকার মতো।
প্রকৌশল, চিকিৎসক ও কৃষিতে উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের সাধারণ প্রশাসনে চাকরিতে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৃচি (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) বিসিএস ২৫ ক্যাডার সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া সংবাদকে বলেন ‘এটা ইতিবাচক’। তার মতে প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও কৃষিবিদদের মতো শিক্ষার্থীরা গেলে প্রশাসনের উপকারই হবে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেখাপড়া শেষে চাকরি খোঁজেন দাবি করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘তাদের প্রতি দশজনের একজন সরকারি চাকরি পান। বাকিদের বেসরকারি চাকরি খুঁজতে হয়। কাজেই সরকারি চাকরি না পেলে তারা বিদেশে ছুটবে।’
‘স্পেশালাইজড’ শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন নেই-দাবি করে প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রায় সব সুযোগ-সুবিধাই প্রশাসন ক্যাডারকেন্দ্রিক। প্রশাসন ক্যাডারে পদ শূন্য না থাকলেও নিয়মিত পদোন্নতি হয়, অন্যান্য ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতিই হয় না। বরং নানা অজুহাতে পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়।’
পরিস্থিতির জন্য দায়ী আন্তঃক্যাডার বৈষম্য :
ক্যাডারভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের নেতা জানিয়েছেন, প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির মূল্য, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের চেয়ে অনেক বেশি। তারা কর্মক্ষেত্রেও নানাভাবে অবহেলিত। তাদের সুযোগ-সুবিধা ও পদোন্নতি নির্ভর করে প্রশাসন ক্যাডারের ওপর। এ কারণেই প্রকৌশলী ও চিকিৎসকরা প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেতে আগ্রহী হচ্ছেন।
পেশাজীবী নেতারা জানান, প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি শুরু হয় সহকারী কমিশনার হিসেবে, পদায়ন হয় মাঠ পর্যায়ে। সেখানে তারা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পান। চাকরি নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের পদোন্নতি হয় জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হিসেবে। এই পদে থেকেই অনেকে দায়িত্ব পান ‘সিনিয়র সহকারী সচিব’ বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে।
আর প্রশাসন ক্যাডারে যারা সচিবালয়ে পদায়ন পান, তাদের প্রথম পদ সহকারী সচিব এবং পরে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হন। মাঠ পর্যায় বা সচিবালয়ের পরবর্তী পদোন্নতি হয় উপসচিব হিসেবে। এরপর নিয়মিত পদোন্নতি হতে থাকে। চাকরির শুরু থেকে তাদের গাড়ি, আবাসনসহ নানা ধরনের সুবিধা থাকে। উপসচিব হলে সরকার থেকে নামমাত্র সুদে ঋণ নিয়ে গাড়ি কেনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকাও পান।
চিকিৎসা ক্যাডারে ডাক্তাররা প্রথম যোগ দেন সহকারী সার্জন বা জুনিয়র কনসালট্যান্ট এবং মাঠ পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে। এর পরের পদে পদোন্নতি হয় শর্তযুক্ত। যারা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করতে পারেন তারা সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হন। মাঠ পর্যায়ে চাকরির পাশাপাশি স্নাতকোত্তর কোর্স করতে অনেকের আট-দশ বছর সময় লেগে যায়। এ কারণে যারা স্নাতকোত্তর করতে পারেন না তাদের চাকরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল বা সিভিল সার্জন অফিসেই শেষ হয়ে যায়।