প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ শুরু, প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং মন্ত্রী সভার শপথগ্রহণের মধ্যদিয়ে পুরো বাংলাদেশে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুরো বিশ্ব জেনে যায় যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে একটি সরকারের অধীনে। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন দেশের মন্ত্রীরা শপথ নেয়ার পর প্রবাসী সরকার একের পর এক সরকার পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করে।

১৯ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ১৮টি নির্দেশনা জারি করে। এ নির্দেশনায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আদেশ মেনে চলার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। অন্যদিকে এদিন থেকেই কলকাতার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের হাইকমিশনে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে ও বাঙালিদের তরফ থেকে শরণার্থীদের জন্য প্রচুর ত্রাণসামগ্রী ও অর্থ সাহায্য আসতে থাকে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিখ্যাত সব সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে উঠে আসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের চিত্র।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা : ১. কোন বাঙালি কর্মচারী শত্রুপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না। প্রতিটি কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অনুসারে কাজ করবেন। শত্রু কবলিত এলাকায়

অবস্থা বিশেষে বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন। ২. সরকারি আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিফৌজকে সাহায্য করবেন। ৩. সব কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেবেন। শত্রুর সঙ্গে সহযোগিতা করবেন না। ৪. বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারও বাংলাদেশ থেকে কর, খাজনা ও শুল্ক আদায়ের অধিকার নেই। ৫. যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে নৌ চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোন অবস্থায় শত্রুকে সাহায্য করবেন না। ৬. নিজ নিজ এলাকায় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদার ওপর লক্ষ্য রাখবেন। ৭. চুরি, ডাকাতি, কালোবাজারি, মজুতদারির ওপর কঠোর নজর রাখবেন। ৮. ধর্মের দোহাই দিয়ে ও অখ-তার বুলি আউড়ে এক শ্রেণীর দেশদ্রোহী মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এদের চিহ্নিত করে রাখুন। এদের সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করুন। তাদের মুক্তিফৌজদের হাতে অর্পণ করুন। ৯. গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলুন এবং রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের মুক্তিবাহিনীর নিকটতম ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। ১০. শত্রুপক্ষের গতিবিধির খবর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে জানাবেন। ১১. মুক্তিবাহিনীর চলাচলের জন্য চাহিবামাত্র সরকারি যানবাহন হস্তান্তর করতে হবে। ১২. বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিবাহিনী ছাড়া জ্বালানি বিক্রি করা চলবে না। ১৩. কেউ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অথবা তাদের এজেন্টদের সাহায্য করবে না। যে করবে তাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ১৪. গুজবে কান দেবেন না। চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। ১৫. সব সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিকটতম মুক্তিবাহিনী শিবিরে রিপোর্ট করতে হবে। ১৬. শত্রুবাহিনীর ধরা পড়া কিংবা আত্মসমর্পণকারী সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সপর্দ করতে হবে। ১৭. পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সব প্রকার যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে। ১৮. তথাকথিত পাকিস্তান বেতারের মিথ্যা প্রচারণা আদৌ বিশ্বাস করবেন না।

১৯. এপ্রিল কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মালিক মোহাম্মদ কাশেম গভর্নর ও প্রধান সামরিক প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে তারা বলেন, কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা পাকিস্তানি হানাদারদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।

এদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি বাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা ও আহ্বায়কদের নাম ঘোষণা করা হয়। অ্যাডভোকেট নুরুল হক মজুমদারকে শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় অফিসের সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

১৯ এপ্রিল পাবনার সাঁথিয়ার পাইকরহাটি গ্রামের ডাববাগান এলাকায় নগরবাড়ি- বগুড়া মহাসড়কের পাশে অবস্থান নিয়ে গোটা উত্তরবঙ্গের চলাচলের রাস্তা রুখে দেয় মুক্তিবাহিনী। এদিকে ইপিআরের সুবেদার গাজী আলী আকবরের নেতৃত্বে ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার, পুলিশ ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলে পাকিস্তানি হানাদারদের বিপক্ষে। প্রচ- যুদ্ধে ৫০ জনের বেশি পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদারেরা নগরবাড়িতে পুনরায় ফিরে যায়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বেশ ক’জন শহীদ হয়েছিলেন।

পাকিস্তানি হানাদারেরা পিছু হটে নগরবাড়ি গিয়েই ক্ষান্ত দেয়নি। তারা আবার সেদিন রাতে অস্ত্র গোলাবারুদ ও বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ফিরে আসে। এ সময় পাকিস্তানি বহরের সামনে যুদ্ধে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটে। এমন সময় হানাদারেরা প্রতিহিংসায় উন্মুত্ত হয়ে ডাববাগান সংলগ্ন বড়গ্রাম, কোড়িয়াল, রামভদ্রবাটি ও সাটিয়াকোলা গ্রামে ঢুকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিরীহ মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হয়েছিল শতাধিক মানুষ।

১৯ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সিলেটের বিমানঘাঁটির দখল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। প্রথমে মুখোমুখি যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি হানাদারেরা মুক্তিবাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালায়। তখন বাধ্য হয়ে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে।

১৯ এপ্রিল রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শহর দখল করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদারেরা।

এইদিনে ইস্পাহানি জুটমিল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধদের ধরে এনে পৈশাচিক কায়দায় গণহত্যা চালানো হয়। এরআগে ইস্পাহানি জুট মিলসের বহু অফিসার ও শ্রমিক নিখোঁজ হন। তাদের লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইস্পাহানি জুট মিলস ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চালানো গণহত্যায় প্রায় এক হাজার মানুষ হতাহত হয়েছিলেন।

এদিন চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির বরকলের কাপ্তাই লেকের আকাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর বোমা হামলা চালায় হানাদাররা। অন্যদিকে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠে হানাদাররা। তারা এরমধ্যে ছত্রীসেনা নামায়।

কুষ্টিয়ার দর্শনার বিখ্যাত যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ১৯ এপ্রিল সংখ্যায় প্রচ্ছদ সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক ড্যান কগিন ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ শিরোনামে এই প্রচ্ছদকাহিনী রচনা করেছিলেন। এর আগে ২৫ মার্চের গণহত্যার পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ভারত সীমান্ত দিয়ে কুষ্টিয়ায় আসেন টাইম সাময়িকীর সাংবাদিক ড্যান কগিনস। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজনদের সাক্ষাৎকার নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ও সাধারণ মানুষের বাড়িতে গিয়ে খবর নেন কিভাবে কুষ্টিয়াতে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলা হয়েছিল। যা প্রকাশিত হয়েছিল টাইম ম্যাগাজিনের ১৯ এপ্রিল সংখ্যায়।

মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল ২০২২ , ০৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৭ রমাদ্বান ১৪৪৩

১৯ এপ্রিল ১৯৭১

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ শুরু, প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং মন্ত্রী সভার শপথগ্রহণের মধ্যদিয়ে পুরো বাংলাদেশে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুরো বিশ্ব জেনে যায় যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে একটি সরকারের অধীনে। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন দেশের মন্ত্রীরা শপথ নেয়ার পর প্রবাসী সরকার একের পর এক সরকার পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করে।

১৯ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ১৮টি নির্দেশনা জারি করে। এ নির্দেশনায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আদেশ মেনে চলার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। অন্যদিকে এদিন থেকেই কলকাতার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের হাইকমিশনে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে ও বাঙালিদের তরফ থেকে শরণার্থীদের জন্য প্রচুর ত্রাণসামগ্রী ও অর্থ সাহায্য আসতে থাকে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিখ্যাত সব সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে উঠে আসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের চিত্র।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা : ১. কোন বাঙালি কর্মচারী শত্রুপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না। প্রতিটি কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অনুসারে কাজ করবেন। শত্রু কবলিত এলাকায়

অবস্থা বিশেষে বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন। ২. সরকারি আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিফৌজকে সাহায্য করবেন। ৩. সব কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেবেন। শত্রুর সঙ্গে সহযোগিতা করবেন না। ৪. বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারও বাংলাদেশ থেকে কর, খাজনা ও শুল্ক আদায়ের অধিকার নেই। ৫. যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে নৌ চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোন অবস্থায় শত্রুকে সাহায্য করবেন না। ৬. নিজ নিজ এলাকায় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদার ওপর লক্ষ্য রাখবেন। ৭. চুরি, ডাকাতি, কালোবাজারি, মজুতদারির ওপর কঠোর নজর রাখবেন। ৮. ধর্মের দোহাই দিয়ে ও অখ-তার বুলি আউড়ে এক শ্রেণীর দেশদ্রোহী মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এদের চিহ্নিত করে রাখুন। এদের সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করুন। তাদের মুক্তিফৌজদের হাতে অর্পণ করুন। ৯. গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলুন এবং রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের মুক্তিবাহিনীর নিকটতম ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। ১০. শত্রুপক্ষের গতিবিধির খবর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে জানাবেন। ১১. মুক্তিবাহিনীর চলাচলের জন্য চাহিবামাত্র সরকারি যানবাহন হস্তান্তর করতে হবে। ১২. বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিবাহিনী ছাড়া জ্বালানি বিক্রি করা চলবে না। ১৩. কেউ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অথবা তাদের এজেন্টদের সাহায্য করবে না। যে করবে তাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ১৪. গুজবে কান দেবেন না। চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। ১৫. সব সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিকটতম মুক্তিবাহিনী শিবিরে রিপোর্ট করতে হবে। ১৬. শত্রুবাহিনীর ধরা পড়া কিংবা আত্মসমর্পণকারী সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সপর্দ করতে হবে। ১৭. পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সব প্রকার যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে। ১৮. তথাকথিত পাকিস্তান বেতারের মিথ্যা প্রচারণা আদৌ বিশ্বাস করবেন না।

১৯. এপ্রিল কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মালিক মোহাম্মদ কাশেম গভর্নর ও প্রধান সামরিক প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে তারা বলেন, কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা পাকিস্তানি হানাদারদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।

এদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি বাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা ও আহ্বায়কদের নাম ঘোষণা করা হয়। অ্যাডভোকেট নুরুল হক মজুমদারকে শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় অফিসের সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

১৯ এপ্রিল পাবনার সাঁথিয়ার পাইকরহাটি গ্রামের ডাববাগান এলাকায় নগরবাড়ি- বগুড়া মহাসড়কের পাশে অবস্থান নিয়ে গোটা উত্তরবঙ্গের চলাচলের রাস্তা রুখে দেয় মুক্তিবাহিনী। এদিকে ইপিআরের সুবেদার গাজী আলী আকবরের নেতৃত্বে ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার, পুলিশ ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলে পাকিস্তানি হানাদারদের বিপক্ষে। প্রচ- যুদ্ধে ৫০ জনের বেশি পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদারেরা নগরবাড়িতে পুনরায় ফিরে যায়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বেশ ক’জন শহীদ হয়েছিলেন।

পাকিস্তানি হানাদারেরা পিছু হটে নগরবাড়ি গিয়েই ক্ষান্ত দেয়নি। তারা আবার সেদিন রাতে অস্ত্র গোলাবারুদ ও বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ফিরে আসে। এ সময় পাকিস্তানি বহরের সামনে যুদ্ধে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটে। এমন সময় হানাদারেরা প্রতিহিংসায় উন্মুত্ত হয়ে ডাববাগান সংলগ্ন বড়গ্রাম, কোড়িয়াল, রামভদ্রবাটি ও সাটিয়াকোলা গ্রামে ঢুকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিরীহ মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হয়েছিল শতাধিক মানুষ।

১৯ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সিলেটের বিমানঘাঁটির দখল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। প্রথমে মুখোমুখি যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি হানাদারেরা মুক্তিবাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালায়। তখন বাধ্য হয়ে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে।

১৯ এপ্রিল রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শহর দখল করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদারেরা।

এইদিনে ইস্পাহানি জুটমিল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধদের ধরে এনে পৈশাচিক কায়দায় গণহত্যা চালানো হয়। এরআগে ইস্পাহানি জুট মিলসের বহু অফিসার ও শ্রমিক নিখোঁজ হন। তাদের লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইস্পাহানি জুট মিলস ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চালানো গণহত্যায় প্রায় এক হাজার মানুষ হতাহত হয়েছিলেন।

এদিন চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির বরকলের কাপ্তাই লেকের আকাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর বোমা হামলা চালায় হানাদাররা। অন্যদিকে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠে হানাদাররা। তারা এরমধ্যে ছত্রীসেনা নামায়।

কুষ্টিয়ার দর্শনার বিখ্যাত যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ১৯ এপ্রিল সংখ্যায় প্রচ্ছদ সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক ড্যান কগিন ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ শিরোনামে এই প্রচ্ছদকাহিনী রচনা করেছিলেন। এর আগে ২৫ মার্চের গণহত্যার পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ভারত সীমান্ত দিয়ে কুষ্টিয়ায় আসেন টাইম সাময়িকীর সাংবাদিক ড্যান কগিনস। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজনদের সাক্ষাৎকার নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ও সাধারণ মানুষের বাড়িতে গিয়ে খবর নেন কিভাবে কুষ্টিয়াতে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলা হয়েছিল। যা প্রকাশিত হয়েছিল টাইম ম্যাগাজিনের ১৯ এপ্রিল সংখ্যায়।