দেশীয় চলচ্চিত্রের সংকট কাটবে কবে?

রেজাউল করিম খোকন

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশের প্রেক্ষাগৃহে ৯টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি প্রশংসিত হলেও সিনেমা হলে কোনটিই বড় আকারে ব্যবসায়িক সফলতা পায়নি। চলচ্চিত্রগুলো অনেক আশা নিয়ে মুক্তি পেলেও প্রেক্ষাগৃহ মালিকেরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রযোজকদেরও কেউ হতাশ, আবার কেউ করোনার সময়টাকেও প্রেক্ষাগৃহে দর্শকবিমুখতার কারণ মনে করছেন। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের কথা, বাণিজ্যিক বিবেচনায় এসব ছবি সময়োপযোগী গল্পের অভাব ও নির্মাণের দুর্বলতার কারণে ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

তিন মাসে মুক্তি পাওয়া বেশির ভাগ চলচ্চিত্র নিয়ে ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত তৈরির চেষ্টা করেছেন অনেকে। দর্শক টানতে তারকারাও বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছুটেছেন। কিন্তু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এসব কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফেসবুকে আওয়াজ তুলে হয়তো একবার সিনেমা হলে দর্শকদের নেয়া যাবে, কিন্তু দর্শকেরা ফিরে এসে যদি অন্যদের ছবিটি দেখতে না বলেন, তাহলে কোনো লাভ নেই। তাই মন দিয়ে সবাইকে ছবিটি বানাতে হবে। এখন আর গোঁজামিল দিয়ে কিছু করে দেয়ার সেই সময় কিন্তু নেই। মানসম্মত সিনেমা বানাতে পারলেই, দর্শক এমনিতেই প্রেক্ষাগৃহে ছুটবেন। দর্শকমন ছুঁতে পারে, তেমন সিনেমা বানানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। ঢাকার প্রাচীন প্রেক্ষাগৃহগুলোর মধ্যে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মধুমিতা। কিন্তু এই প্রেক্ষাগৃহের স্বত্বাধিকারী তাদের প্রেক্ষাগৃহের বর্তমান ব্যবসা নিয়ে আতঙ্কিত। যে কোন সময় মধুমিতা বন্ধ করে দিতে হয় কি না, সেটাও বুঝতে পারছেন না।

কেন এসব চলচ্চিত্র ফ্লপ করছে? সত্যি কথা বললে বলতে হয়, প্রযোজকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন ঠিকই পরিচালকেরা, কিন্তু সততা নিয়ে তারা সিনেমা বানাচ্ছেন না। এতে করে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেকে পরে আর প্রযোজনাই করতে চাইছেন না। প্রযোজকদেরও মানসম্মত পরিচালক খুঁজে বের করে চলচ্চিত্র বানাতে হবে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যে কয়টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, কোনোটিরই গল্প, নির্মাণ হলের দর্শকদের মুগ্ধ করার মতো ছিল না। মানুষ তো সারাসময় অফট্র্যাক জীবনের মধ্যে কাটায় না। মানুষ নানা ঝুটঝামেলা শেষে যখন একটি চলচ্চিত্র দেখতে যান, তখন সত্যিকার অর্থে বিনোদন পেতে চান। ফ্যান্টাসির জগতে থাকতে চান। স্বপ্ন দেখতে চান। দেখা যাচ্ছে, গল্প ভালো হচ্ছে, আবার অভিনয়ও হচ্ছে। কিন্তু কী যেন নেই।

চলচ্চিত্রের একটা আলাদা ভাষা আছে, এখনকার বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে তা পাওয়া যায় না। অনেকে আবার অফট্র্যাক চলচ্চিত্র বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। গতানুগতিক ধারার বাইরে ভিন্ন স্বাদের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের নানা পরীক্ষা চলছে আরও অনেক আগে থেকেই। তবে অতীতে ভিন্ন ধারার সিনেমা নির্মাণে এতটা সক্রিয় ছিলেন না নির্মাতারা। আজ যেভাবে নিত্যনতুন গল্পের প্লট নিয়ে ভিন্নতর উপস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করছেন বিভিন্ন নির্মাতা, তখন এটা আজকের মত এতটা ব্যাপকভাবে বিস্মৃত ছিল না। তখন কতিপয় সাহসী চলচ্চিত্রকার হয়তো নতুন ধাচের গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণে ব্রতী হতেন মনের তাগিদে, শিল্পের প্রতি বিশেষ অনুরাগ এবং সৃজনশীলতার প্রকাশে।

তবে ভিন্ন ধারার ছবিগুলো তখন পেরে উঠতো না গতানুগতিক ধারার সিনেমার সঙ্গে। কারণ, অনেক বড় বাজেটে তৈরি হতো গতানুগতিক অ্যাকশন, রোমান্টিক কিংবা পারিবারিক সেন্টিমেন্ট নির্ভর ছবিগুলো। ভিন্ন ধারার ছবিগুলো আর্ট ফিল্ম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকত সেই সময়ের দিনগুলোতে। কতিপয় শ্রেণীর দর্শকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো ভিন্ন ধারার ছবিগুলো। বিপুল শ্রেণীর দর্শকদের আনুকল্য পেত না ভিন্ন স্বাদের সিনেমাগুলো। সবাই বলতে গেলে গতানুগতিক ধারার অ্যাকশন, রোমান্টিক কিংবা পারিবারিক সামাজিক সেন্টিমেন্ট নির্ভর বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো তখন। নামিদামি জনপ্রিয় তারকা অভিনেতা অভিনেত্রীকে নিয়ে নির্মিত মাসালা ধাঁচের বাণিজ্যিক ছবিগুলোর আধিপত্য ছিল তখন।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক সময় সবকিছুই বদলে যায়। সময়ের পালাবদলে মানুষের রুচি, পছন্দ, মনমানসিকতায় অনেক পরিবর্তন আসে। নতুন চিন্তা-চেতনা ভাবনার বিকাশ ঘটে। শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্রেও তার প্রভাব পড়তে থাকে স্বাভাবিকভাবে। দর্শক তাদের আগের অবস্থান থেকে ক্রমেই সরে আসতে শুরু করে। ফর্মুলানির্ভর সিনেমাগুলো ধীরে ধীরে দর্শকদের কাছে একঘেয়ে, বিরক্তিকর চর্বিত চর্বণ বলে মনে হতে থাকে। নতুন কিছু সিনেমার পর্দায় দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে দর্শক। আগে যেমন নায়ক নায়িকার প্রেম- রোমান্স, তাদের মিলনের পথে বাধা হয়ে ওঠা ভিলেনের কুটচাল, ষড়যন্ত্র, ফলশ্রুতিতে সংঘাত এবং সবশেষে নায়ক-নায়িকার মধুর মিলন দৃশ্য দেখতে দেখতে দর্শক পরম তৃপ্তি নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরোতেন।

সময়ের পালাবদলে সেই অবস্থা বদলে যেতে থাকে। দর্শক গতানুগতিক প্রেম কাহিনী, মারদাঙ্গা অ্যাকশন কিংবা ম্যাড়মেড়ে সামাজিক পারিবারিক সেন্টিমেন্ট নির্ভর ছবিগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ভিন্ন স্বাদের সিনেমার প্রতি উৎসাহ দেখাতে শুরু করেন। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে অনেক। তবে উল্লেখযোগ্য একটি বড় কারণ, কয়েক দশক আগে এখানকার দর্শক নিজেদের দেশীয় সিনেমা দেখায় সীমাবদ্ধ রাখতেন। এখনকার মত সিনেমা হলে কিংবা বাড়িতে বসে টিভি পর্দায় হলিউড কিংবা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিচিত্র স্বাদে সিনেমা দেখার সুযোগ হতো না। এখন চাইলেই দর্শক ইউটিউব কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যখন তখন দেশি-বিদেশি সব ধরনের সিনেমা দেখতে পারছেন। ফলে তাদের রুচি পছন্দ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দর্শক রুচি-পছন্দ বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আজকাল নির্মাতারা তেমন ধাঁচের সিনেমা নির্মাণ করাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন। কারণ, এর মাধ্যমে সৃজনশীল ভাবনার শিল্পিত প্রকাশ যেমন সম্ভব হচ্ছে তেমনিভাবে বাণিজ্যিক সফলতাও অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।

অনলাইনের কল্যাণে তরুণ প্রজন্মের হাতের মুঠোয় সারা বিশ্বের সিনেমা। তারা তথাকথিত সস্তা প্রেম আর মারামারির সিনেমা সে অর্থে পছন্দ করছে না। এখন যে সিনেমাগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোর গল্প আর দর্শক টানবে বলে মনে হচ্ছে না। এগুলো সবই ফর্মুলাভিত্তিক গল্পের মধ্যে আটকে আছে। এই জায়গা থেকে বের হতে পারলে ঢালিউডের সংকট বাড়বে না। দর্শককে হলমুখী করতে হলে নির্মাণকৌশল, গল্প বলার ধরন, এক্সপেরিমেন্টাল কাজ বেশি করতে হবে। এগিয়ে চলা এসব দর্শকের চিন্তা ও মানসিক জগতের সঙ্গে নির্মাতারা এগিয়ে যেতে না পারলে, এই ধরনের নির্মাণ ও শিল্পীদের পারফরম্যান্স থাকলে আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব।

গত দুই বছরে করোনার মধ্যে মুক্তি পাওয়া কোন সিনেমা অর্ধেক বিনিয়োগও ওঠাতে পারেনি। এর মধ্যে তৈরি হচ্ছে না নতুন অভিনয়শিল্পী। কাজের চেয়ে বিভিন্ন সমিতির নির্বাচন বেশি আলোচনায়। এ কারণে সমালোচনার মুখে পড়ছে চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোও। আমাদের চলচ্চিত্র আগের সেই জায়গায় নেই। এখানে কথা হয় বেশি, কাজ কম। বর্তমানে তরুণ অভিনয়শিল্পীরা ভালো করছেন, নতুন নির্মাতা আসছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এগিয়ে যাচ্ছেন দেশের তরুণ নির্মাতারা। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে যেমন তাঁদের সিনেমা প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি সেগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করছে লগ্নি করতে। পাশাপাশি সেগুলো বিদেশের সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে, পুরস্কৃত হচ্ছে আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোয়। তবে এর পাশাপাশি আশার কথাও আছে। বিশ্বজুড়ে বাংলা সিনেমার আলাদা দর্শকও তৈরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়াজাগানো সিনেমা ঢালিউডে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে?

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল ২০২২ , ০৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৭ রমাদ্বান ১৪৪৩

দেশীয় চলচ্চিত্রের সংকট কাটবে কবে?

রেজাউল করিম খোকন

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশের প্রেক্ষাগৃহে ৯টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি প্রশংসিত হলেও সিনেমা হলে কোনটিই বড় আকারে ব্যবসায়িক সফলতা পায়নি। চলচ্চিত্রগুলো অনেক আশা নিয়ে মুক্তি পেলেও প্রেক্ষাগৃহ মালিকেরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রযোজকদেরও কেউ হতাশ, আবার কেউ করোনার সময়টাকেও প্রেক্ষাগৃহে দর্শকবিমুখতার কারণ মনে করছেন। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের কথা, বাণিজ্যিক বিবেচনায় এসব ছবি সময়োপযোগী গল্পের অভাব ও নির্মাণের দুর্বলতার কারণে ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

তিন মাসে মুক্তি পাওয়া বেশির ভাগ চলচ্চিত্র নিয়ে ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত তৈরির চেষ্টা করেছেন অনেকে। দর্শক টানতে তারকারাও বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছুটেছেন। কিন্তু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এসব কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফেসবুকে আওয়াজ তুলে হয়তো একবার সিনেমা হলে দর্শকদের নেয়া যাবে, কিন্তু দর্শকেরা ফিরে এসে যদি অন্যদের ছবিটি দেখতে না বলেন, তাহলে কোনো লাভ নেই। তাই মন দিয়ে সবাইকে ছবিটি বানাতে হবে। এখন আর গোঁজামিল দিয়ে কিছু করে দেয়ার সেই সময় কিন্তু নেই। মানসম্মত সিনেমা বানাতে পারলেই, দর্শক এমনিতেই প্রেক্ষাগৃহে ছুটবেন। দর্শকমন ছুঁতে পারে, তেমন সিনেমা বানানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। ঢাকার প্রাচীন প্রেক্ষাগৃহগুলোর মধ্যে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মধুমিতা। কিন্তু এই প্রেক্ষাগৃহের স্বত্বাধিকারী তাদের প্রেক্ষাগৃহের বর্তমান ব্যবসা নিয়ে আতঙ্কিত। যে কোন সময় মধুমিতা বন্ধ করে দিতে হয় কি না, সেটাও বুঝতে পারছেন না।

কেন এসব চলচ্চিত্র ফ্লপ করছে? সত্যি কথা বললে বলতে হয়, প্রযোজকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন ঠিকই পরিচালকেরা, কিন্তু সততা নিয়ে তারা সিনেমা বানাচ্ছেন না। এতে করে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেকে পরে আর প্রযোজনাই করতে চাইছেন না। প্রযোজকদেরও মানসম্মত পরিচালক খুঁজে বের করে চলচ্চিত্র বানাতে হবে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যে কয়টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, কোনোটিরই গল্প, নির্মাণ হলের দর্শকদের মুগ্ধ করার মতো ছিল না। মানুষ তো সারাসময় অফট্র্যাক জীবনের মধ্যে কাটায় না। মানুষ নানা ঝুটঝামেলা শেষে যখন একটি চলচ্চিত্র দেখতে যান, তখন সত্যিকার অর্থে বিনোদন পেতে চান। ফ্যান্টাসির জগতে থাকতে চান। স্বপ্ন দেখতে চান। দেখা যাচ্ছে, গল্প ভালো হচ্ছে, আবার অভিনয়ও হচ্ছে। কিন্তু কী যেন নেই।

চলচ্চিত্রের একটা আলাদা ভাষা আছে, এখনকার বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে তা পাওয়া যায় না। অনেকে আবার অফট্র্যাক চলচ্চিত্র বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। গতানুগতিক ধারার বাইরে ভিন্ন স্বাদের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের নানা পরীক্ষা চলছে আরও অনেক আগে থেকেই। তবে অতীতে ভিন্ন ধারার সিনেমা নির্মাণে এতটা সক্রিয় ছিলেন না নির্মাতারা। আজ যেভাবে নিত্যনতুন গল্পের প্লট নিয়ে ভিন্নতর উপস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করছেন বিভিন্ন নির্মাতা, তখন এটা আজকের মত এতটা ব্যাপকভাবে বিস্মৃত ছিল না। তখন কতিপয় সাহসী চলচ্চিত্রকার হয়তো নতুন ধাচের গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণে ব্রতী হতেন মনের তাগিদে, শিল্পের প্রতি বিশেষ অনুরাগ এবং সৃজনশীলতার প্রকাশে।

তবে ভিন্ন ধারার ছবিগুলো তখন পেরে উঠতো না গতানুগতিক ধারার সিনেমার সঙ্গে। কারণ, অনেক বড় বাজেটে তৈরি হতো গতানুগতিক অ্যাকশন, রোমান্টিক কিংবা পারিবারিক সেন্টিমেন্ট নির্ভর ছবিগুলো। ভিন্ন ধারার ছবিগুলো আর্ট ফিল্ম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকত সেই সময়ের দিনগুলোতে। কতিপয় শ্রেণীর দর্শকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো ভিন্ন ধারার ছবিগুলো। বিপুল শ্রেণীর দর্শকদের আনুকল্য পেত না ভিন্ন স্বাদের সিনেমাগুলো। সবাই বলতে গেলে গতানুগতিক ধারার অ্যাকশন, রোমান্টিক কিংবা পারিবারিক সামাজিক সেন্টিমেন্ট নির্ভর বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো তখন। নামিদামি জনপ্রিয় তারকা অভিনেতা অভিনেত্রীকে নিয়ে নির্মিত মাসালা ধাঁচের বাণিজ্যিক ছবিগুলোর আধিপত্য ছিল তখন।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক সময় সবকিছুই বদলে যায়। সময়ের পালাবদলে মানুষের রুচি, পছন্দ, মনমানসিকতায় অনেক পরিবর্তন আসে। নতুন চিন্তা-চেতনা ভাবনার বিকাশ ঘটে। শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্রেও তার প্রভাব পড়তে থাকে স্বাভাবিকভাবে। দর্শক তাদের আগের অবস্থান থেকে ক্রমেই সরে আসতে শুরু করে। ফর্মুলানির্ভর সিনেমাগুলো ধীরে ধীরে দর্শকদের কাছে একঘেয়ে, বিরক্তিকর চর্বিত চর্বণ বলে মনে হতে থাকে। নতুন কিছু সিনেমার পর্দায় দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে দর্শক। আগে যেমন নায়ক নায়িকার প্রেম- রোমান্স, তাদের মিলনের পথে বাধা হয়ে ওঠা ভিলেনের কুটচাল, ষড়যন্ত্র, ফলশ্রুতিতে সংঘাত এবং সবশেষে নায়ক-নায়িকার মধুর মিলন দৃশ্য দেখতে দেখতে দর্শক পরম তৃপ্তি নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরোতেন।

সময়ের পালাবদলে সেই অবস্থা বদলে যেতে থাকে। দর্শক গতানুগতিক প্রেম কাহিনী, মারদাঙ্গা অ্যাকশন কিংবা ম্যাড়মেড়ে সামাজিক পারিবারিক সেন্টিমেন্ট নির্ভর ছবিগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ভিন্ন স্বাদের সিনেমার প্রতি উৎসাহ দেখাতে শুরু করেন। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে অনেক। তবে উল্লেখযোগ্য একটি বড় কারণ, কয়েক দশক আগে এখানকার দর্শক নিজেদের দেশীয় সিনেমা দেখায় সীমাবদ্ধ রাখতেন। এখনকার মত সিনেমা হলে কিংবা বাড়িতে বসে টিভি পর্দায় হলিউড কিংবা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিচিত্র স্বাদে সিনেমা দেখার সুযোগ হতো না। এখন চাইলেই দর্শক ইউটিউব কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যখন তখন দেশি-বিদেশি সব ধরনের সিনেমা দেখতে পারছেন। ফলে তাদের রুচি পছন্দ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দর্শক রুচি-পছন্দ বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আজকাল নির্মাতারা তেমন ধাঁচের সিনেমা নির্মাণ করাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন। কারণ, এর মাধ্যমে সৃজনশীল ভাবনার শিল্পিত প্রকাশ যেমন সম্ভব হচ্ছে তেমনিভাবে বাণিজ্যিক সফলতাও অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।

অনলাইনের কল্যাণে তরুণ প্রজন্মের হাতের মুঠোয় সারা বিশ্বের সিনেমা। তারা তথাকথিত সস্তা প্রেম আর মারামারির সিনেমা সে অর্থে পছন্দ করছে না। এখন যে সিনেমাগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোর গল্প আর দর্শক টানবে বলে মনে হচ্ছে না। এগুলো সবই ফর্মুলাভিত্তিক গল্পের মধ্যে আটকে আছে। এই জায়গা থেকে বের হতে পারলে ঢালিউডের সংকট বাড়বে না। দর্শককে হলমুখী করতে হলে নির্মাণকৌশল, গল্প বলার ধরন, এক্সপেরিমেন্টাল কাজ বেশি করতে হবে। এগিয়ে চলা এসব দর্শকের চিন্তা ও মানসিক জগতের সঙ্গে নির্মাতারা এগিয়ে যেতে না পারলে, এই ধরনের নির্মাণ ও শিল্পীদের পারফরম্যান্স থাকলে আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব।

গত দুই বছরে করোনার মধ্যে মুক্তি পাওয়া কোন সিনেমা অর্ধেক বিনিয়োগও ওঠাতে পারেনি। এর মধ্যে তৈরি হচ্ছে না নতুন অভিনয়শিল্পী। কাজের চেয়ে বিভিন্ন সমিতির নির্বাচন বেশি আলোচনায়। এ কারণে সমালোচনার মুখে পড়ছে চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোও। আমাদের চলচ্চিত্র আগের সেই জায়গায় নেই। এখানে কথা হয় বেশি, কাজ কম। বর্তমানে তরুণ অভিনয়শিল্পীরা ভালো করছেন, নতুন নির্মাতা আসছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এগিয়ে যাচ্ছেন দেশের তরুণ নির্মাতারা। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে যেমন তাঁদের সিনেমা প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি সেগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করছে লগ্নি করতে। পাশাপাশি সেগুলো বিদেশের সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে, পুরস্কৃত হচ্ছে আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোয়। তবে এর পাশাপাশি আশার কথাও আছে। বিশ্বজুড়ে বাংলা সিনেমার আলাদা দর্শকও তৈরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়াজাগানো সিনেমা ঢালিউডে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে?

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]