যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন, বিচারকের বিরুদ্ধে মামলা

রংপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এর বিচারক দেবাংশু কুমার সরকারের বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করেছেন তার স্ত্রী। মামলায় দেবাংশু কুমার সরকারের বাবা সুধাংশু কুমার সরকার, তাদের আত্মীয় নিলয় দে সরকার ও রঞ্জন সরকারকে আসামি করা হয়েছে।

৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবিতে মারধরের অভিযোগে গতকাল রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক মো. রোকনুজ্জামানের আদালতে মামলাটি করেছেন তার স্ত্রী ডা. রিদিতা সরকার। আগামী ২১ এপ্রিল মামলার শুনানির দিন ধার্য করেছেন বিচারক।

মামলার পর ভুক্তভোগীর জবানবন্দি গ্রহণের জন্য বিচারক মো. রোকনুজ্জামানের কাছে আবেদন জানান বাদীপক্ষের আইনজীবী সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) খন্দকার রফিক হাসনাইন। জবাবে বিচারক বলেন, এর আগে এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী। তারা কোন ব্যবস্থা নিয়েছে কি-না, তা না জানার কারণে আজ বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এর জবাবে পিপি আদালতকে বলেন, ফৌজদারি অপরাধ কার্যবিধি অনুযায়ী ওই অভিযোগের সঙ্গে বাদীর জবানবন্দি

গ্রহণে আইনগত বাধা নেই। আমরা মামলা করেছি, আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আদেশ দেবেন, সেটাই কামনা করছি। তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বিচারক বলেন, পুরো বিষয়টি জানার পর ২১ এপ্রিল জবানবন্দি গ্রহণসহ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মামলার বাদী বলেন, ‘রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসা পেশায় যোগ দিই। ২০১৫ সালের ১১ মে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দেবাংশু কুমার সরকারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেক বিচারক ও আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের দিনই ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন দেবাংশু।

মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে ৫০ ভরি সোনার অলঙ্কারসহ ২৫ লাখ টাকার উপহার দেন আমার বাবা।’

তিনি বলেন, ‘বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই একটি নতুন গাড়ি কিনে দেয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন দেবাংশু। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এরই মধ্যে রংপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বদলি হয়ে আসেন তিনি। স্বামী-স্ত্রী রংপুর নগরীতে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে শুরু করি। এখানে আসার কিছুদিন পর দেবাংশুর মাদকাসক্তির বিষয়টি আমার নজরে আসে।’

ভুক্তভোগী এই নারী আরও বলেন, ‘নগরীর বাসিন্দা অমিত বণিকের সঙ্গে মিশে মাদকাসক্ত হন দেবাংশু। গত বছরের ২৮ মে পুনরায় ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন দেবাংশু। সেই সঙ্গে ওই টাকা দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আমাকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন জজশিপের স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দা বিচারক বেদী রানি, মিনহাজুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন আমাকে রক্ষা করেন। দীর্ঘদিন ধরে এসব নির্যাতন সহ্য করে আসছি। এসবের মধ্যে আমাদের এক পুত্রসন্তান হয়। আবারও ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। পরে জানতে পারি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন দেবাংশু।

বাধ্য হয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং আইন সচিবের কাছে অভিযোগ দিয়ে বিচার দাবি করি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। এরপর একাধিক দিন রংপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে দেবাংশুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। সবশেষ লোক মারফত দেবাংশু জানান, ৩০ লাখ টাকা না দিলে আমার সঙ্গে সংসার করবেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে স্বজনদের নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেবাংশুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তার দেখা না পেয়ে আদালতের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলে অপেক্ষা করছিলাম। ওই সময় হঠাৎ এসে আমার চুলের মুঠি ধরে এলোপাতাড়ি মারধর করেন দেবাংশু। এতে আমার নাক-মুখ দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এ সময় গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেন দেবাংশু। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়লে পালিয়ে যান দেবাংশু। পরে আমাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। ২১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সুস্থ হয়ে রোববার রংপুর মেট্রোপলিটন কোতয়ালি থানায় মামলা করতে গেলে নেয়নি পুলিশ। এজন্য আদালতে মামলা করেছি।’

পিপি খন্দকার রফিক হাসনাইন বলেন, ‘যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ায় বিচারক দেবাংশু কুমার সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তার স্ত্রী। আগামী ২১ এপ্রিল বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ ও শুনানির দিন ধার্য করেছেন বিচারক।’

বুধবার, ২০ এপ্রিল ২০২২ , ০৭ বৈশাখ ১৪২৮ ১৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন, বিচারকের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, রংপুর

রংপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এর বিচারক দেবাংশু কুমার সরকারের বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করেছেন তার স্ত্রী। মামলায় দেবাংশু কুমার সরকারের বাবা সুধাংশু কুমার সরকার, তাদের আত্মীয় নিলয় দে সরকার ও রঞ্জন সরকারকে আসামি করা হয়েছে।

৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবিতে মারধরের অভিযোগে গতকাল রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক মো. রোকনুজ্জামানের আদালতে মামলাটি করেছেন তার স্ত্রী ডা. রিদিতা সরকার। আগামী ২১ এপ্রিল মামলার শুনানির দিন ধার্য করেছেন বিচারক।

মামলার পর ভুক্তভোগীর জবানবন্দি গ্রহণের জন্য বিচারক মো. রোকনুজ্জামানের কাছে আবেদন জানান বাদীপক্ষের আইনজীবী সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) খন্দকার রফিক হাসনাইন। জবাবে বিচারক বলেন, এর আগে এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী। তারা কোন ব্যবস্থা নিয়েছে কি-না, তা না জানার কারণে আজ বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এর জবাবে পিপি আদালতকে বলেন, ফৌজদারি অপরাধ কার্যবিধি অনুযায়ী ওই অভিযোগের সঙ্গে বাদীর জবানবন্দি

গ্রহণে আইনগত বাধা নেই। আমরা মামলা করেছি, আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আদেশ দেবেন, সেটাই কামনা করছি। তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বিচারক বলেন, পুরো বিষয়টি জানার পর ২১ এপ্রিল জবানবন্দি গ্রহণসহ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মামলার বাদী বলেন, ‘রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসা পেশায় যোগ দিই। ২০১৫ সালের ১১ মে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দেবাংশু কুমার সরকারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেক বিচারক ও আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের দিনই ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন দেবাংশু।

মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে ৫০ ভরি সোনার অলঙ্কারসহ ২৫ লাখ টাকার উপহার দেন আমার বাবা।’

তিনি বলেন, ‘বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই একটি নতুন গাড়ি কিনে দেয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন দেবাংশু। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এরই মধ্যে রংপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বদলি হয়ে আসেন তিনি। স্বামী-স্ত্রী রংপুর নগরীতে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে শুরু করি। এখানে আসার কিছুদিন পর দেবাংশুর মাদকাসক্তির বিষয়টি আমার নজরে আসে।’

ভুক্তভোগী এই নারী আরও বলেন, ‘নগরীর বাসিন্দা অমিত বণিকের সঙ্গে মিশে মাদকাসক্ত হন দেবাংশু। গত বছরের ২৮ মে পুনরায় ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন দেবাংশু। সেই সঙ্গে ওই টাকা দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আমাকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন জজশিপের স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দা বিচারক বেদী রানি, মিনহাজুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন আমাকে রক্ষা করেন। দীর্ঘদিন ধরে এসব নির্যাতন সহ্য করে আসছি। এসবের মধ্যে আমাদের এক পুত্রসন্তান হয়। আবারও ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। পরে জানতে পারি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন দেবাংশু।

বাধ্য হয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং আইন সচিবের কাছে অভিযোগ দিয়ে বিচার দাবি করি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। এরপর একাধিক দিন রংপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে দেবাংশুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। সবশেষ লোক মারফত দেবাংশু জানান, ৩০ লাখ টাকা না দিলে আমার সঙ্গে সংসার করবেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে স্বজনদের নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেবাংশুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তার দেখা না পেয়ে আদালতের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলে অপেক্ষা করছিলাম। ওই সময় হঠাৎ এসে আমার চুলের মুঠি ধরে এলোপাতাড়ি মারধর করেন দেবাংশু। এতে আমার নাক-মুখ দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এ সময় গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেন দেবাংশু। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়লে পালিয়ে যান দেবাংশু। পরে আমাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। ২১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সুস্থ হয়ে রোববার রংপুর মেট্রোপলিটন কোতয়ালি থানায় মামলা করতে গেলে নেয়নি পুলিশ। এজন্য আদালতে মামলা করেছি।’

পিপি খন্দকার রফিক হাসনাইন বলেন, ‘যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ায় বিচারক দেবাংশু কুমার সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তার স্ত্রী। আগামী ২১ এপ্রিল বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ ও শুনানির দিন ধার্য করেছেন বিচারক।’