বাঙালি কূটনীতিকরা পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন

বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রতিদিনই তীব্র হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে বাঙালি কূটনীতিকরা পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করছে।

একাত্তরের ২০ এপ্রিল ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের দু’জন বাঙালি কূটনীতিক শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল ইসলাম পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে পদত্যাগ করে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। তারা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

এদিন কলকাতার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নতুন দূতাবাস থেকে ৩০ জন পাকিস্তানি কূটনীতিক ও কর্মচারীকে বহিষ্কার করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।

এদিকে এদিন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ ও সাংবাদিক সম্পাদক আবিদুর রহমানকে ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।

ঢাকায় ২০ এপ্রিল নেজামে ইসলাম পার্টির মাওলানা আজিজুল হক, সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানি,

অ্যাডভোকেট সৈয়দ আনিসুর রহমান, হাজী আঁকিল সাহাব এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতের সহযোগিতায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের চর দেশদ্রোহীরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

ঢাকায় খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে এদিন শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে দেশের প্রতিটি এলাকায় শান্তি কমিটি গঠনের জন্য গোলাম আজম, আবুল কাশেম, এ জে খদ্দর, মাহমুদ আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

ঢাকায় এদিন শান্তি কমিটি ও নেজামে ইসলাম পার্টির উদ্যোগে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আজিজুল হক, সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানি, গোলাম আজম প্রমুখ। এই মিছিলে তারা বলেছিলেন, ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চল নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যম এবং ভারতীয় সরকার অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, দেশের প্রতিটি স্থান এখন শান্ত ও নিরাপদ। দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে দেশ। মিছিলের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘পাকিস্তান বাঁচাও ভারত হটাও’, ‘ভারতের দালাল হুঁশিয়ার’, ‘মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই পূর্ব ও পশ্চিম এক পাকিস্তান’।

ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব’ শিরোনামে এই দিন একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি সংক্রান্ত যুক্ত কমিটির সদস্য সিনেটর জন ও পেস্টর বাঙালিদের ওপর অমানবিক আচরণের বিরোধিতা করে একটি চিঠি লেখেন।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দেশের কোন এক মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন।’ বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সাংবিধানিক সরকারের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্বের গণতন্ত্রকামী ও মুক্তিকামী রাষ্ট্র ও মানুষের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

দিনাজপুরের হিলিতে মুক্তিবাহিনীর ওপর ব্যাপক হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তখন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার, নায়েক সুবেদার শহীদুল্লাহ, নায়েক সুবেদার করম আলীর নেতৃত্বে কোম্পানিগুলো ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায় হানাদারদের সঙ্গে। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মর্টার ও শেলিংয়ের হামলায় ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক শহীদ হন। হিলির অবস্থান টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বুঝে এদিন গভীর রাতে মুক্তিবাহিনীর ২৫০ মুক্তিযোদ্ধা হিলি থেকে ১৩ মাইল দূরে ভারতের কামালপাড়ায় কুরমাইল বেসিক ট্রেনিং ইন্সটিটিউশনে আশ্রয় নেয়।

২০ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী সিলেটের শেওলা ফেরিঘাটে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দলের ওপর হামলা চালায়। এ সময় হানাদারদের ৮ সেনা নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ফেরিঘাট ধ্বংস করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

এদিন পাকিস্তানি হানাদারদের দুই ব্যাটালিয়ন ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ভোর সাড়ে ৪টায় শুরু হওয়া এই যুদ্ধ শেষ হয় সন্ধ্যা ৭টায়। মুক্তিবাহিনীর প্রচ- ক্ষতি হয় এই যুদ্ধে। তারপর রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা মিরসরাই ত্যাগ করে মাস্তান নগরে অবস্থান নেয়। এ খবর জানতে পেরে হানাদারেরা ট্যাংক নিয়ে মাস্তান নগর আক্রমণ করে।

খাগড়াছড়ির মহালছড়ি ও রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার সীমান্তে কাপ্তাই লেক গুরুত্বপূর্ণ জলপথ ছিল। কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি, জালিয়াপাড়া হয়ে রামগড়ের যাওয়ার এটিই ছিল একমাত্র পথ। এই জলপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেজর মীর শওকত আলীর নির্দেশে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআরের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা এই জলপথ নিজেদের দখলে নেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে।

২০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল নিয়ে বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে ধ্বংস করতে ৭টি স্পিডবোট এবং দুটি লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের (এসএসজি) কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং লঞ্চ দুটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ করছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। তখন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পরিখায় অবস্থান নেন। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোলাগুলির তীব্রতায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে ৮ নম্বর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সিপাহি মুন্সী আবদুর রউফ বুঝতে পারেন, এভাবে চলতে থাকলে ঘাঁটির সবাইকেই হানাদার বাহিনীর হাতে মৃত্যু অথবা ধরা পড়তে হবে। সহযোদ্ধাদের পিছু হটার সুযোগ করে দিতে নিজে পরিখায় দাঁড়িয়ে অনবরত গুলি করতে থাকেন পাকিস্তানি স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে একা কৌশলে লড়ছিলেন তিনি। তিনি তাদের ৭টি স্পিডবোট একে একে ডুবিয়ে দিলে তারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। লঞ্চ দুটো পিছু হটে রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এরপর লঞ্চ থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। হঠাৎ একটি মর্টারের গোলা তার বাঙ্কারে এসে পড়ে এবং তিনি শহীদ হন। ততক্ষণে তার মৃত্যুর আগে সহযোগী যোদ্ধারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পেরেছিল। আবদুর রউফের আত্মত্যাগে তার কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পেয়েছিল।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ঘাটিনা রেলওয়ে ব্রিজের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ হয় এদিন। এই যুদ্ধে ২০ জনের বেশি পাকিস্তানি নিহত হয়েছিল।

আরও খবর
যানজট নিরসনে শ্রমিকদের ভাগ করে ছুটি দেয়ার নির্দেশনা গ্রহণের সিদ্ধান্ত
একনেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন
ঈদ সামনে রেখে রাজধানীতে বেড়েছে ছিনতাই, অজ্ঞান ও মলম পার্টির দৌরাত্ম্য
প্রস্তাবিত গণমাধ্যম আইন স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত করবে সম্পাদক পরিষদ
মাদারীপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সিন্ডিকেটের দখলে, ভোগান্তিতে নাগরিকরা
বিএনপি বরাবরই ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠে : ফখরুল
জবিতে ছয় পদে অবৈধ নিয়োগ, বেতন স্থগিত
পরীমণিকে মারধর, যৌন হয়রানি : নাসির অমির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন
বিয়ের চাপ দেয়ায় হোটেলে নিয়ে প্রেমিকাকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা
বিজেপিবিরোধী জোট গড়ার ডাক মমতার

বুধবার, ২০ এপ্রিল ২০২২ , ০৭ বৈশাখ ১৪২৮ ১৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

২০ এপ্রিল ১৯৭১

বাঙালি কূটনীতিকরা পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রতিদিনই তীব্র হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে বাঙালি কূটনীতিকরা পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করছে।

একাত্তরের ২০ এপ্রিল ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের দু’জন বাঙালি কূটনীতিক শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল ইসলাম পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে পদত্যাগ করে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। তারা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

এদিন কলকাতার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নতুন দূতাবাস থেকে ৩০ জন পাকিস্তানি কূটনীতিক ও কর্মচারীকে বহিষ্কার করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।

এদিকে এদিন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ ও সাংবাদিক সম্পাদক আবিদুর রহমানকে ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।

ঢাকায় ২০ এপ্রিল নেজামে ইসলাম পার্টির মাওলানা আজিজুল হক, সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানি,

অ্যাডভোকেট সৈয়দ আনিসুর রহমান, হাজী আঁকিল সাহাব এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতের সহযোগিতায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের চর দেশদ্রোহীরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

ঢাকায় খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে এদিন শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে দেশের প্রতিটি এলাকায় শান্তি কমিটি গঠনের জন্য গোলাম আজম, আবুল কাশেম, এ জে খদ্দর, মাহমুদ আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

ঢাকায় এদিন শান্তি কমিটি ও নেজামে ইসলাম পার্টির উদ্যোগে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আজিজুল হক, সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানি, গোলাম আজম প্রমুখ। এই মিছিলে তারা বলেছিলেন, ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চল নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যম এবং ভারতীয় সরকার অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, দেশের প্রতিটি স্থান এখন শান্ত ও নিরাপদ। দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে দেশ। মিছিলের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘পাকিস্তান বাঁচাও ভারত হটাও’, ‘ভারতের দালাল হুঁশিয়ার’, ‘মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই পূর্ব ও পশ্চিম এক পাকিস্তান’।

ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব’ শিরোনামে এই দিন একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি সংক্রান্ত যুক্ত কমিটির সদস্য সিনেটর জন ও পেস্টর বাঙালিদের ওপর অমানবিক আচরণের বিরোধিতা করে একটি চিঠি লেখেন।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দেশের কোন এক মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন।’ বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সাংবিধানিক সরকারের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্বের গণতন্ত্রকামী ও মুক্তিকামী রাষ্ট্র ও মানুষের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

দিনাজপুরের হিলিতে মুক্তিবাহিনীর ওপর ব্যাপক হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তখন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার, নায়েক সুবেদার শহীদুল্লাহ, নায়েক সুবেদার করম আলীর নেতৃত্বে কোম্পানিগুলো ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায় হানাদারদের সঙ্গে। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মর্টার ও শেলিংয়ের হামলায় ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক শহীদ হন। হিলির অবস্থান টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বুঝে এদিন গভীর রাতে মুক্তিবাহিনীর ২৫০ মুক্তিযোদ্ধা হিলি থেকে ১৩ মাইল দূরে ভারতের কামালপাড়ায় কুরমাইল বেসিক ট্রেনিং ইন্সটিটিউশনে আশ্রয় নেয়।

২০ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী সিলেটের শেওলা ফেরিঘাটে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দলের ওপর হামলা চালায়। এ সময় হানাদারদের ৮ সেনা নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ফেরিঘাট ধ্বংস করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

এদিন পাকিস্তানি হানাদারদের দুই ব্যাটালিয়ন ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ভোর সাড়ে ৪টায় শুরু হওয়া এই যুদ্ধ শেষ হয় সন্ধ্যা ৭টায়। মুক্তিবাহিনীর প্রচ- ক্ষতি হয় এই যুদ্ধে। তারপর রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা মিরসরাই ত্যাগ করে মাস্তান নগরে অবস্থান নেয়। এ খবর জানতে পেরে হানাদারেরা ট্যাংক নিয়ে মাস্তান নগর আক্রমণ করে।

খাগড়াছড়ির মহালছড়ি ও রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার সীমান্তে কাপ্তাই লেক গুরুত্বপূর্ণ জলপথ ছিল। কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি, জালিয়াপাড়া হয়ে রামগড়ের যাওয়ার এটিই ছিল একমাত্র পথ। এই জলপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেজর মীর শওকত আলীর নির্দেশে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআরের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা এই জলপথ নিজেদের দখলে নেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে।

২০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল নিয়ে বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে ধ্বংস করতে ৭টি স্পিডবোট এবং দুটি লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের (এসএসজি) কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং লঞ্চ দুটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ করছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। তখন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পরিখায় অবস্থান নেন। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোলাগুলির তীব্রতায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে ৮ নম্বর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সিপাহি মুন্সী আবদুর রউফ বুঝতে পারেন, এভাবে চলতে থাকলে ঘাঁটির সবাইকেই হানাদার বাহিনীর হাতে মৃত্যু অথবা ধরা পড়তে হবে। সহযোদ্ধাদের পিছু হটার সুযোগ করে দিতে নিজে পরিখায় দাঁড়িয়ে অনবরত গুলি করতে থাকেন পাকিস্তানি স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে একা কৌশলে লড়ছিলেন তিনি। তিনি তাদের ৭টি স্পিডবোট একে একে ডুবিয়ে দিলে তারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। লঞ্চ দুটো পিছু হটে রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এরপর লঞ্চ থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। হঠাৎ একটি মর্টারের গোলা তার বাঙ্কারে এসে পড়ে এবং তিনি শহীদ হন। ততক্ষণে তার মৃত্যুর আগে সহযোগী যোদ্ধারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পেরেছিল। আবদুর রউফের আত্মত্যাগে তার কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পেয়েছিল।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ঘাটিনা রেলওয়ে ব্রিজের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ হয় এদিন। এই যুদ্ধে ২০ জনের বেশি পাকিস্তানি নিহত হয়েছিল।