বাঙালির অপ্রতিরোধ্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য

সেলিনা হোসেন

বাংলাদেশের নববর্ষ এখন আমরা যেভাবে পালন করছি, যে বাধামুক্ত পরিবেশে নিজেদের মতো করে, এই উৎসব পালনের পরিবেশটি অর্জন করেছি, তার জন্য আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ভিতর দিয়ে আসতে হয়েছে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীন পাকিস্তানের বাঙালিরা শুরু থেকেই নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে বৈরিতার মুখোমুখি হয়েছিলো। সক্রিয় হয়েছিল বাঙালির বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের দল। পাকিস্তান হওয়ার আগেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পাকিস্তান হওয়ার আগেই এই চক্রান্তকারীরা কলকাতায় বসেই ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম নিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করেছিলো। অথচ তখন পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের নাম ছিলো পূর্ব বাংলা। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর সরকারিভাবে এই ভূখণ্ডের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের বাঙালির দোসররা এই সত্যকেও মানতে চায়নি। অপরদিকে পাকিস্তান শুরুর পর থেকেই যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার সূচনা হয়, তার একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালি, বিশেষ করে নবগঠিত মুসলমান মধ্যবিত্ত বাঙালি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহরে বাংলা নববর্ষ উৎসব উদযাপন শুরু করে। এটি কোনোই বচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না। বাঙালি তার স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলো। ইতিহাসে তার নজির আছে। সূচনা পর্বে বাঙালিদের এই নতুন ভিন্নমুখী উদ্যোগ পাকিস্তান সরকার ও তার এদেশীয় দোসররা ভালো চোখে দেখেনি। তারা বাঙালি সংস্কৃতির এই নতুন বিন্যাস ও বিকাশ প্রক্রিয়াকে হিন্দুয়ানি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলে যে, বাংলা নববর্ষ উদযাপন পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আদর্শের পরিপন্থী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অনেক আগেই স্থানীয় একটি পত্রিকায় পাকিস্তানের বাঙালি বন্ধুদের কেউ নববর্ষ উদযাপনের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখলেন, ‘পাকিস্তানি হুঁশিয়ার’ শিরোনাম। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসর পর বাংলা নববর্ষ উদযাপন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু সামরিক শাসন দিয়ে কি একটি জাতির মূল উপড়ে ফেলা যায়?

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ভিতর দিয়ে এদেশের মানুষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই শুরু আর থামেনি। এর পরবর্তী ঘটনা ‘ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয়’-এর প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিষ্ঠানটি ষাটের দশকে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা জাগিয়ে তোলায় ব্যাপক সহযোগিতা করে। এদের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষকে স্বীয় দেশজ বৈশিষ্ট্যে জীবনঘনিষ্ঠ করে তোলা। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’। ১৯৬৪ সালে ঢাকা শহরে বাংলা নববর্ষ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে উদযাপিত হয়। ছায়ানটের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল রমনার বটমূলে ভোর ছয়টায় নববর্ষের অনুষ্ঠানের সূচনা করা। প্রাদেশিক সরকার এই দিনটিকে ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে। এ অনুষ্ঠানে যে বিপুল জনসমাগম হয় তা দেখে সে সময়ের কোনো কোনো পত্রিকা বিস্ময় প্রকাশ করে। এ বছরের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ছোট-বড় অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, সংস্থা নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।

বাঙালির এই উপচেপড়া আবেগ ক্রুদ্ধ করে পাকিস্তান সরকারকে। তারা রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করার পাঁয়তারা করে। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বাজেট অধিবেশন বসে রাওয়ালপিন্ডিতে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি ও সে সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নিয়ে পরিষদের ভিতরে সরকার দলীয় ও বিরোধী দলের প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা হয়। সে সময় সরকারি দলের নেতা ছিলেন বাঙালি আবদুস সবুর খান। তিনি বিষোদগার করে বলেন যে, পহেলা বৈশাখ ও রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপনের নামে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এভাবে চলতে থাকলে পাকিস্তানের ইসলামি জীবনাদর্শের পরিপন্থী কার্যকলাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। এই পরিষদে বাঙালি নেতারা তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকলে সবুর খান উত্তেজিত হয়ে তাদেরকে howling idiot বলে উল্লেখ করেন। তখনকার তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করার পক্ষে বিবৃতি দেন।

ততোদিনে বাঙালির বুকের ভিতরে বড়ো ধরনের রূপান্তর ঘটে গেছে- মরে গেছে পাকিস্তান, জেগে উঠেছে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। শুরু হয়ে যায় রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। বুদ্ধিজীবীরা এ ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ বর্ণনা করে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষèতা দান করেছে তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের কাছে সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।’ বাঙালির এই প্রবল প্রতিরোধের মুখে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তা প্রত্যাহার করে নেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ এ সন শুধু আমাদের জীবনে একটি উৎসব নয়, আমাদের জাতিসত্তা বিকাশের প্রবল শক্তিও বটে। কেননা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ভিতর দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রতিবাদী ধারার সঙ্গে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের চেতনার ঐক্যবদ্ধ সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক সংগ্রামে এসেছে তীব্রতা, এসেছে তীক্ষèতা। এসেছে সব মানুষের একই সমান্তরাল অবস্থানের দৃঢ়তা। এভাবেই সংস্কৃতির এই শুদ্ধতা ছোট-বড় ভেদ মুছে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বড়ো অর্জনের সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এখন এ উৎসব পালিত হয় শহরে, গ্রামে। নানা ধরনের উৎসব অনুষ্ঠানে, খেলাধুলা, মেলা ইত্যাদি আয়োজনের ভিতর দিয়ে। শহরের অসংখ্য ছোট-বড় জায়গায় আয়োজিত হয় অসংখ্য মেলা দেশীয় পণ্য সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়ে। এটি নববর্ষ উদযাপনের একটি বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশিভাবে লোকসঙ্গীত, সারি জারি, ভাটিয়ালী, কবিগান, গম্ভীরা, লালন, হাছন রাজার গান ইত্যাদি আয়োজন বাংলার নিজস্ব স্বকীয়তা। গত কয়েক বছর ধরে চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় আল্পনা করে। নানা ধরনের হাতি, ঘোড়া, বাঘ, বক, পেঁচা, বানর ইত্যাদি তৈরি করে। অসংখ্য মুখোশ বানায় এবং এই সবকিছু নিয়ে এক বর্ণাঢ্য মিছিল শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। সঙ্গে ঢোল বাজে, মাদল বাজে এবং একতারা দোতরা ইত্যাদি নিয়ে ছেলেমেয়রা বাউলের ডঙ্গে নেচে বেড়ায়। এই আনন্দঘন পরিবেশের আড়ালে শুধু উৎসবই থাকে না, থাকে সংস্কৃতির প্রতিবাদী চেতনার ফাল্গুধারা- যা বিভিন্ন আকারের পশু ও পাখির ভিতর দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র যার জাতীয় সন বাংলা। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ বাঙালির একটি বড় ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন উৎসব। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকল মানুষের মহামিলন ক্ষেত্র এই দিন। তাই এই দিন শুধু উৎসব নয়, আত্মিক শক্তিও। বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপন এখনো বাঙালির জাতিসত্তা রক্ষার প্রধান নিয়ামক। যতই মৌলবাদের উত্থান ঘটুক না কেন, মানুষের অন্তর্নিহিত চেতনায় তার ভিতটি বড় মজবুত। সেটা থেকে তাকে কেউ দূরে সরিয়ে নিতে পারবে না। মৌলবাদের ছোবল হয়তো আসবে; কিন্তু এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তাকে প্রতিহতও করবে। শেকড় প্রথিত আছে বাংলা নববর্ষে।

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

বাঙালির অপ্রতিরোধ্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য

সেলিনা হোসেন

image

মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত শিল্পকর্ম

বাংলাদেশের নববর্ষ এখন আমরা যেভাবে পালন করছি, যে বাধামুক্ত পরিবেশে নিজেদের মতো করে, এই উৎসব পালনের পরিবেশটি অর্জন করেছি, তার জন্য আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ভিতর দিয়ে আসতে হয়েছে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীন পাকিস্তানের বাঙালিরা শুরু থেকেই নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে বৈরিতার মুখোমুখি হয়েছিলো। সক্রিয় হয়েছিল বাঙালির বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের দল। পাকিস্তান হওয়ার আগেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পাকিস্তান হওয়ার আগেই এই চক্রান্তকারীরা কলকাতায় বসেই ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম নিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করেছিলো। অথচ তখন পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের নাম ছিলো পূর্ব বাংলা। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর সরকারিভাবে এই ভূখণ্ডের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের বাঙালির দোসররা এই সত্যকেও মানতে চায়নি। অপরদিকে পাকিস্তান শুরুর পর থেকেই যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার সূচনা হয়, তার একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালি, বিশেষ করে নবগঠিত মুসলমান মধ্যবিত্ত বাঙালি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহরে বাংলা নববর্ষ উৎসব উদযাপন শুরু করে। এটি কোনোই বচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না। বাঙালি তার স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলো। ইতিহাসে তার নজির আছে। সূচনা পর্বে বাঙালিদের এই নতুন ভিন্নমুখী উদ্যোগ পাকিস্তান সরকার ও তার এদেশীয় দোসররা ভালো চোখে দেখেনি। তারা বাঙালি সংস্কৃতির এই নতুন বিন্যাস ও বিকাশ প্রক্রিয়াকে হিন্দুয়ানি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলে যে, বাংলা নববর্ষ উদযাপন পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আদর্শের পরিপন্থী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অনেক আগেই স্থানীয় একটি পত্রিকায় পাকিস্তানের বাঙালি বন্ধুদের কেউ নববর্ষ উদযাপনের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখলেন, ‘পাকিস্তানি হুঁশিয়ার’ শিরোনাম। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসর পর বাংলা নববর্ষ উদযাপন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু সামরিক শাসন দিয়ে কি একটি জাতির মূল উপড়ে ফেলা যায়?

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ভিতর দিয়ে এদেশের মানুষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই শুরু আর থামেনি। এর পরবর্তী ঘটনা ‘ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয়’-এর প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিষ্ঠানটি ষাটের দশকে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা জাগিয়ে তোলায় ব্যাপক সহযোগিতা করে। এদের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষকে স্বীয় দেশজ বৈশিষ্ট্যে জীবনঘনিষ্ঠ করে তোলা। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’। ১৯৬৪ সালে ঢাকা শহরে বাংলা নববর্ষ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে উদযাপিত হয়। ছায়ানটের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল রমনার বটমূলে ভোর ছয়টায় নববর্ষের অনুষ্ঠানের সূচনা করা। প্রাদেশিক সরকার এই দিনটিকে ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে। এ অনুষ্ঠানে যে বিপুল জনসমাগম হয় তা দেখে সে সময়ের কোনো কোনো পত্রিকা বিস্ময় প্রকাশ করে। এ বছরের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ছোট-বড় অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, সংস্থা নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।

বাঙালির এই উপচেপড়া আবেগ ক্রুদ্ধ করে পাকিস্তান সরকারকে। তারা রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করার পাঁয়তারা করে। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বাজেট অধিবেশন বসে রাওয়ালপিন্ডিতে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি ও সে সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নিয়ে পরিষদের ভিতরে সরকার দলীয় ও বিরোধী দলের প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা হয়। সে সময় সরকারি দলের নেতা ছিলেন বাঙালি আবদুস সবুর খান। তিনি বিষোদগার করে বলেন যে, পহেলা বৈশাখ ও রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপনের নামে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এভাবে চলতে থাকলে পাকিস্তানের ইসলামি জীবনাদর্শের পরিপন্থী কার্যকলাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। এই পরিষদে বাঙালি নেতারা তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকলে সবুর খান উত্তেজিত হয়ে তাদেরকে howling idiot বলে উল্লেখ করেন। তখনকার তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করার পক্ষে বিবৃতি দেন।

ততোদিনে বাঙালির বুকের ভিতরে বড়ো ধরনের রূপান্তর ঘটে গেছে- মরে গেছে পাকিস্তান, জেগে উঠেছে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। শুরু হয়ে যায় রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। বুদ্ধিজীবীরা এ ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ বর্ণনা করে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষèতা দান করেছে তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের কাছে সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।’ বাঙালির এই প্রবল প্রতিরোধের মুখে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তা প্রত্যাহার করে নেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ এ সন শুধু আমাদের জীবনে একটি উৎসব নয়, আমাদের জাতিসত্তা বিকাশের প্রবল শক্তিও বটে। কেননা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ভিতর দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রতিবাদী ধারার সঙ্গে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের চেতনার ঐক্যবদ্ধ সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক সংগ্রামে এসেছে তীব্রতা, এসেছে তীক্ষèতা। এসেছে সব মানুষের একই সমান্তরাল অবস্থানের দৃঢ়তা। এভাবেই সংস্কৃতির এই শুদ্ধতা ছোট-বড় ভেদ মুছে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বড়ো অর্জনের সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এখন এ উৎসব পালিত হয় শহরে, গ্রামে। নানা ধরনের উৎসব অনুষ্ঠানে, খেলাধুলা, মেলা ইত্যাদি আয়োজনের ভিতর দিয়ে। শহরের অসংখ্য ছোট-বড় জায়গায় আয়োজিত হয় অসংখ্য মেলা দেশীয় পণ্য সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়ে। এটি নববর্ষ উদযাপনের একটি বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশিভাবে লোকসঙ্গীত, সারি জারি, ভাটিয়ালী, কবিগান, গম্ভীরা, লালন, হাছন রাজার গান ইত্যাদি আয়োজন বাংলার নিজস্ব স্বকীয়তা। গত কয়েক বছর ধরে চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় আল্পনা করে। নানা ধরনের হাতি, ঘোড়া, বাঘ, বক, পেঁচা, বানর ইত্যাদি তৈরি করে। অসংখ্য মুখোশ বানায় এবং এই সবকিছু নিয়ে এক বর্ণাঢ্য মিছিল শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। সঙ্গে ঢোল বাজে, মাদল বাজে এবং একতারা দোতরা ইত্যাদি নিয়ে ছেলেমেয়রা বাউলের ডঙ্গে নেচে বেড়ায়। এই আনন্দঘন পরিবেশের আড়ালে শুধু উৎসবই থাকে না, থাকে সংস্কৃতির প্রতিবাদী চেতনার ফাল্গুধারা- যা বিভিন্ন আকারের পশু ও পাখির ভিতর দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র যার জাতীয় সন বাংলা। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ বাঙালির একটি বড় ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন উৎসব। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকল মানুষের মহামিলন ক্ষেত্র এই দিন। তাই এই দিন শুধু উৎসব নয়, আত্মিক শক্তিও। বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপন এখনো বাঙালির জাতিসত্তা রক্ষার প্রধান নিয়ামক। যতই মৌলবাদের উত্থান ঘটুক না কেন, মানুষের অন্তর্নিহিত চেতনায় তার ভিতটি বড় মজবুত। সেটা থেকে তাকে কেউ দূরে সরিয়ে নিতে পারবে না। মৌলবাদের ছোবল হয়তো আসবে; কিন্তু এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তাকে প্রতিহতও করবে। শেকড় প্রথিত আছে বাংলা নববর্ষে।