বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশমাতৃকার কবি কাজী রোজী

মার্জিয়া লিপি

আমাদের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন অগণিত গণযোদ্ধা। ১৯৭১-এ মাতৃভূমি এবং সূর্যসন্তান-মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস নানা আঙ্গিকে লেখা প্রয়োজন ইতিহাসের প্রয়োজনে। অনুসন্ধান প্রয়োজন মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধদিনের সংগ্রাম, স্মৃতিকথা, আত্মত্যাগের ইতিহাস।

একাত্তরের রণাঙ্গনের কণ্ঠসৈনিক কাজী রোজী ছিলেন ‘আমৃত্যু যোদ্ধা’। আমৃত্যুই যুদ্ধ করতে হয়েছে যাপিত জীবনে কিংবা দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে। ২১ বছর বয়সে মিরপুর ৬নং সেক্টরের নিজের বাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রওনা করেন। বন্ধু উলফাৎ এবং কবি সিকান্দর আবু জাফরসহ আরো অনেকেই ছিলেন সে যাত্রায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাড়ি ছাড়ার সময় মা-বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি; তবে মায়ের সে উপদেশ সর্বদায় স্মরণে ছিল, “যা কিছু করো নিজের বিবেকের তাড়নায় করো। বিবেকের তাড়নায় তিনি দেশ মাতৃকার বিপদে নিজের যেটুকু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।”

বেঁচে থাকতে গুরুগম্ভীর সাহিত্যসভা তাঁর উপস্থিতিতে ছিল উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত এবং উচ্চকণ্ঠের। মানুষের ভিড়ে উচ্চৈঃস্বরে কথায় ও কবিতার ছন্দে চমকে দিতেন। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত জীবনবাদী কবি ছিলেন প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক কাজী রোজীর প্রায় ২০ বছর আগে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। লেখালেখিসহ প্রতিদিনের সংগ্রাম ও কর্মব্যস্ততায় চাপা পড়ে যায় কাজী রোজীর ভয় ও যন্ত্রণা। তিনি ছিলেন ক্যান্সার আক্রান্ত অনেকের অনুপ্রেরণা। তাঁকে দেখে অন্য রোগীরাও মনে সাহস সঞ্চয় করেন। কবিতা লিখেছেন ক্যানসার নিয়ে। ক্যানসারের সঙ্গে বসবাসের ১৫ বছর পূর্তিতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ‘নারী শক্তি সম্মাননা’ পাওয়ার বিষয়টি তিনি সর্বদা গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ‘ক্যান্সার রোগীদের এভাবে সাহস জোগালে তাঁদের পক্ষে লড়ে যাওয়াটা সহজ হয়।’

কবি কাজী রোজীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বিনিময় হয় নানা প্রসঙ্গে। কখনও সাহিত্যবিষয়ক কখনও সংগঠন নিয়ে। বিশেষ একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি রয়েছে তাঁকে ঘিরে। ২০১০ সালে আমার প্রথম বই এর মোড়ক উন্মোচনে তিনি উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে। প্রকাশিত বই ‘আমার মেয়ে: আত্মজার সাথে কথোপকথন’ একটি পর্যালোচনা লিখেছিলেন ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’। ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনে কাজের সূত্রেও অনেকবার কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বিভিন্ন সভায় ও অনুষ্ঠানে। নিয়মিত যোগাযোগে বিচ্ছিন্নতা শুরু হয় ২০২০-এর পর কোভিডের সঙ্গ নিরোধের দিনগুলোতে। ১১ অক্টোবর, ২০১৬তে ১০৫, প্রিয়প্রাঙ্গণ, ধানমণ্ডির বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা, কবি কাজী রোজীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। প্রশ্নপত্রের কিছু প্রশ্ন ছিল- ব্যক্তিগত সাধারণ তথ্য সম্পর্কিত। তবে অধিকাংশ প্রশ্নই ছিল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত।

কলেজে পড়ার সময় থেকেই কাজী রোজী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৫ সাল থেকে রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংগঠনে সম্পৃক্ত ছিলেন। একই সময়ে অবাঙালিদের অপতৎপরতার হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্যে ‘একশন কমিটি’ তৈরি করেন। পাক-হানাদার, রাজাকার ও বিহারীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে নিজ বাড়ির ছাদে উড়িয়েছিলেন লাল-সবুজের পতাকা। অবাঙালী ও বিহারীদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত মিরপুরের বাঙালিদের রক্ষার জন্য যিনি প্রিয় বান্ধবী কবি মেহেরুন্নেসাকে সাথে নিয়ে গঠন করেছিলেন- “অ্যাকশন কমিটি”। তিনি সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন।

সহসংগঠক ও কবি মেহেরুন্নেসা সেসময়ে লিখেছিলেন “সাত কোটি জয় বাংলার বীর! ভয় করি নাকো কোন/ বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে- চির বিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে/ আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু। তুমি/ চির বিজয়ের অটল শপথ/ জয় এ বাংলায় তুমি...” এই কবিতাটি জানান দেয় বিপ্লবের কথা। জাতির বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যাওয়া দুঃসাহসী কবি ছিলেন মেহেরুন্নেসা। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর প্রতি ছুঁড়ে দেয়া তার চ্যালেঞ্জে ক্ষমতার ভিত কেঁপে ওঠে। ১৯৭১-এর ২৫ শে মার্চের ভয়াল কালরাতে “অপারেশন সার্চলাইট”-এর নামে পাকবাহিনী বাঙালিদের ওপর চালায় নির্মম গণহত্যা। এর ঠিক দুইদিন পর, ২৭ মার্চে নির্মমভাবে জবাই করে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয় কবি মেহেরুন্নেসা, তাঁর মা ও দুই ভাইকে। মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার নেতৃত্বে, তার দোসরদের সাথে পরিচালিত এই হত্যাকাণ্ড ছিল মানবতার ইতিহাসে অন্যতম এক কালো অধ্যায়। শিল্পসাহিত্যের জগতের প্রতিবাদী স্বর-কাজী রোজী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

কাজী রোজীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৬ই আগস্ট। সাতক্ষীরা জেলায়। খুব ছোটবেলা থেকেই ছড়া-কবিতা লিখতেন। মা উৎসাহ দিতেন। বাবা কবিতা পাঠ শুনাতেন। বাবা কাজী শহীদুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য থেকে পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। মা ছিলেন খুবই সাধারণ একজন মানুষ, তবে সুগৃহিণী। তিনি সবসময় ব্যস্ত ছিলেন ছয় সন্তানকে মানুষ করার জন্যে। মা-বাবার প্রথম সন্তান কাজী রোজী। মা সবসময় চাইতেন, “তাঁর এই মেয়েটি যেনো জীবনের প্রতিটি সংগ্রামে জয়ী হয়- শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংসারে সকল ক্ষেত্রে যুদ্ধে যেন জয়ী হয়।” মা কাজী বারিরা মনে করতেন, “যুদ্ধ কেবল ঘর থেকে বের হয়েই করতে হয় না, সংসারে থেকেও করতে হয়।”

দুঃখ, অভাববোধ, যন্ত্রণা- সংসারের সঙ্গী ছিল নিত্যদিনের। খুব ছোট থেকেই কাজী রোজী যদি কবিতা-ছড়া কিংবা অনুষ্ঠান করে কোনো সম্মানী পেতেন, তা মাকে এনে দিতেন। মা কাজী বারিরা শহীদ ছিলেন তার প্রেরণা। মাকে মনে হতো দেবী- দূর্গা। দশ হাতে তিনি সন্তান, সংসারের ভালো-মন্দ সামলিয়ে, সবাইকে যত্ন করে, সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করে, সকলের মাঝে নিজেকে জড়িয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করতেন। মা সম্পর্কে কাজী রোজী বলেন, মাকে চিনেই চারপাশের সবকিছুকে চিনতে পেরেছেন। মা-ই দেশকে ভালোবাসার প্রেরণা। সর্বংসহা মা-এর মতো এদেশ মাতৃকা, সবুজের পটভূমিতে রক্তরাঙা পতাকা।

কবিতার লাইন দিয়ে মা, দেশ ও দেশের পতাকা সম্পর্কে বলেছেন-

“এ পতাকা আমার মায়ের মুখের মতো কারুকার্যময়

এ পতাকা আমার বাবার চোখের মতো দূরদৃষ্টিময়

এ পতাকা আমার স্বাধীনতা শব্দের মতো ঐশ্বর্যময়’’

একাত্তরে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল স্বাধীনতা অর্জনের দিনটি। সেদিনের অনুভূতি ব্যক্ত করেন, “আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’’ মনে পড়ছিলো- “ঝর্ণা যেমন পাহাড় থেকে নেমে ভূমিকে প্লাবিত করে, তেমনি স্বাধীনতা ও সমস্ত অনুভূতিকে প্লাবিত করেছে।”

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মাটিতে পা রাখার অনুভূতিটি আজন্ম অনুভব করেছেন। অনুভব করেছেন দেশে ফিরে আসার পর মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আলিঙ্গনের উষ্ণতা। মায়ের চোখে ছিল সন্তানকে বুকে পাওয়ার আনন্দ। মা কাজী বারিরা শহীদ বলতেন, “মুক্তিযোদ্ধারা ছিল তাই তো স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের জেলে, তাঁতি, কৃষক সকলেই জানতো কীভাবে পাকিস্তানিদের মারতে হবে। এক-একটা ছেলে দেশের জন্য এক একটা অস্ত্র। সোনার ছেলেরা দেশের স্বাধীনতা এনেছে।’’ মা বুঝতেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে, মাথা গোঁজার একখণ্ড জমি পেয়েছেন। সন্তানরা যুদ্ধ করেছে বলে দেশের এই পরিবর্তন! যুদ্ধের সময় তাঁর স্বপ্ন ছিল- ‘বঙ্গব›দ্ধুর সোনার বাংলাকে নিয়ে। স্বপ্ন ছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নিজেকে গড়ে তোলার।” তিনি দেশমাতৃকার প্রতি ঋণ শোধের জন্যেই ছিলেন সোচ্চার। যদিও তাঁর জীবনে যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ চলতেই থাকে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যদিও তিনি সামাজিক সম্মান-স্বীকৃতি পেয়েছেন।

২০১৪ সালে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। নিজের বিবেকের তাড়নায় ৪২ বছর পর আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২০১২ সালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং ২০১৩ সালে গণআন্দোলনের ফলে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের রায় কার্যকর হয়। অনেকদিন ধরে নিজের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভের কিছুটা প্রশমন হয়েছে- “একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকর দেখে যেতে পারছি জীবদ্দশায়। দেশের উন্নয়ন হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলার মানুষ সুখী সমৃদ্ধ জীবন যাপন করবে”- এই প্রত্যাশার বাস্তবায়নের পথ পরিক্রমা দেখতে পাওয়াই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।

পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন কবি ও “সমকাল”-সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের সহধর্মিণী এবং কবি সুমী সিকান্দারের মা। পেশা জীবনে ছিলেন তথ্য অধিদপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ১৯৬০-এর দশকে কবিতা লেখা শুরু করেন। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০২১ সালের বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক পান।

কাজী রোজীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো: পথঘাট মানুষের নাম (কাব্যগ্রন্থ), নষ্ট জোয়ার (কাব্যগ্রন্থ), আমার পিরানের কোনো মাপ নেই (কাব্যগ্রন্থ), লড়াই (কাব্যগ্রন্থ), শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা (জীবনী গ্রন্থ), রবীন্দ্রনাথ: রসিকতার কবিতা (গবেষণা গ্রন্থ)।

মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কোভিড পজিটিভ হওয়ায় ছিলেন নিবিড় চিকিৎসা কেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে। পরবর্তীতে তার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি। কিডনিসহ মাল্টি অর্গান সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। স্ট্রোক করার কারণে তার মস্তিষ্ক কোনো কাজ করছিল না। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এ ৭৩ বছর বয়সে একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও রাজনীতিবিদ কাজী রোজীর মৃত্যু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক হিসেবে এই কবিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পতাকায় মুড়ে গার্ড অব অনার ও বিউগলের করুণ সুর বাজিয়ে সমাহিত করা হয় মুক্তিযোদ্ধা, কবি কাজী রোজীকে। মুক্তিযোদ্ধা কবি মিশে আছেন এদেশের মাটির সঙ্গে, মিশে আছেন দেশের মানচিত্রের সঙ্গে। শস্য শ্যামলা পতাকার সবুজ পটভূমিতে মিশে আছেন তিনি রক্তলাল সূর্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে।

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশমাতৃকার কবি কাজী রোজী

মার্জিয়া লিপি

image

[কাজী রোজী / জন্ম : ১৬ আগস্ট, ১৯৪৯; মৃত্যু: ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২]

আমাদের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন অগণিত গণযোদ্ধা। ১৯৭১-এ মাতৃভূমি এবং সূর্যসন্তান-মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস নানা আঙ্গিকে লেখা প্রয়োজন ইতিহাসের প্রয়োজনে। অনুসন্ধান প্রয়োজন মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধদিনের সংগ্রাম, স্মৃতিকথা, আত্মত্যাগের ইতিহাস।

একাত্তরের রণাঙ্গনের কণ্ঠসৈনিক কাজী রোজী ছিলেন ‘আমৃত্যু যোদ্ধা’। আমৃত্যুই যুদ্ধ করতে হয়েছে যাপিত জীবনে কিংবা দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে। ২১ বছর বয়সে মিরপুর ৬নং সেক্টরের নিজের বাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রওনা করেন। বন্ধু উলফাৎ এবং কবি সিকান্দর আবু জাফরসহ আরো অনেকেই ছিলেন সে যাত্রায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাড়ি ছাড়ার সময় মা-বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি; তবে মায়ের সে উপদেশ সর্বদায় স্মরণে ছিল, “যা কিছু করো নিজের বিবেকের তাড়নায় করো। বিবেকের তাড়নায় তিনি দেশ মাতৃকার বিপদে নিজের যেটুকু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।”

বেঁচে থাকতে গুরুগম্ভীর সাহিত্যসভা তাঁর উপস্থিতিতে ছিল উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত এবং উচ্চকণ্ঠের। মানুষের ভিড়ে উচ্চৈঃস্বরে কথায় ও কবিতার ছন্দে চমকে দিতেন। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত জীবনবাদী কবি ছিলেন প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক কাজী রোজীর প্রায় ২০ বছর আগে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। লেখালেখিসহ প্রতিদিনের সংগ্রাম ও কর্মব্যস্ততায় চাপা পড়ে যায় কাজী রোজীর ভয় ও যন্ত্রণা। তিনি ছিলেন ক্যান্সার আক্রান্ত অনেকের অনুপ্রেরণা। তাঁকে দেখে অন্য রোগীরাও মনে সাহস সঞ্চয় করেন। কবিতা লিখেছেন ক্যানসার নিয়ে। ক্যানসারের সঙ্গে বসবাসের ১৫ বছর পূর্তিতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ‘নারী শক্তি সম্মাননা’ পাওয়ার বিষয়টি তিনি সর্বদা গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ‘ক্যান্সার রোগীদের এভাবে সাহস জোগালে তাঁদের পক্ষে লড়ে যাওয়াটা সহজ হয়।’

কবি কাজী রোজীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বিনিময় হয় নানা প্রসঙ্গে। কখনও সাহিত্যবিষয়ক কখনও সংগঠন নিয়ে। বিশেষ একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি রয়েছে তাঁকে ঘিরে। ২০১০ সালে আমার প্রথম বই এর মোড়ক উন্মোচনে তিনি উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে। প্রকাশিত বই ‘আমার মেয়ে: আত্মজার সাথে কথোপকথন’ একটি পর্যালোচনা লিখেছিলেন ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’। ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনে কাজের সূত্রেও অনেকবার কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বিভিন্ন সভায় ও অনুষ্ঠানে। নিয়মিত যোগাযোগে বিচ্ছিন্নতা শুরু হয় ২০২০-এর পর কোভিডের সঙ্গ নিরোধের দিনগুলোতে। ১১ অক্টোবর, ২০১৬তে ১০৫, প্রিয়প্রাঙ্গণ, ধানমণ্ডির বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা, কবি কাজী রোজীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। প্রশ্নপত্রের কিছু প্রশ্ন ছিল- ব্যক্তিগত সাধারণ তথ্য সম্পর্কিত। তবে অধিকাংশ প্রশ্নই ছিল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত।

কলেজে পড়ার সময় থেকেই কাজী রোজী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৫ সাল থেকে রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংগঠনে সম্পৃক্ত ছিলেন। একই সময়ে অবাঙালিদের অপতৎপরতার হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্যে ‘একশন কমিটি’ তৈরি করেন। পাক-হানাদার, রাজাকার ও বিহারীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে নিজ বাড়ির ছাদে উড়িয়েছিলেন লাল-সবুজের পতাকা। অবাঙালী ও বিহারীদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত মিরপুরের বাঙালিদের রক্ষার জন্য যিনি প্রিয় বান্ধবী কবি মেহেরুন্নেসাকে সাথে নিয়ে গঠন করেছিলেন- “অ্যাকশন কমিটি”। তিনি সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন।

সহসংগঠক ও কবি মেহেরুন্নেসা সেসময়ে লিখেছিলেন “সাত কোটি জয় বাংলার বীর! ভয় করি নাকো কোন/ বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে- চির বিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে/ আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু। তুমি/ চির বিজয়ের অটল শপথ/ জয় এ বাংলায় তুমি...” এই কবিতাটি জানান দেয় বিপ্লবের কথা। জাতির বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যাওয়া দুঃসাহসী কবি ছিলেন মেহেরুন্নেসা। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর প্রতি ছুঁড়ে দেয়া তার চ্যালেঞ্জে ক্ষমতার ভিত কেঁপে ওঠে। ১৯৭১-এর ২৫ শে মার্চের ভয়াল কালরাতে “অপারেশন সার্চলাইট”-এর নামে পাকবাহিনী বাঙালিদের ওপর চালায় নির্মম গণহত্যা। এর ঠিক দুইদিন পর, ২৭ মার্চে নির্মমভাবে জবাই করে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয় কবি মেহেরুন্নেসা, তাঁর মা ও দুই ভাইকে। মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার নেতৃত্বে, তার দোসরদের সাথে পরিচালিত এই হত্যাকাণ্ড ছিল মানবতার ইতিহাসে অন্যতম এক কালো অধ্যায়। শিল্পসাহিত্যের জগতের প্রতিবাদী স্বর-কাজী রোজী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

কাজী রোজীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৬ই আগস্ট। সাতক্ষীরা জেলায়। খুব ছোটবেলা থেকেই ছড়া-কবিতা লিখতেন। মা উৎসাহ দিতেন। বাবা কবিতা পাঠ শুনাতেন। বাবা কাজী শহীদুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য থেকে পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। মা ছিলেন খুবই সাধারণ একজন মানুষ, তবে সুগৃহিণী। তিনি সবসময় ব্যস্ত ছিলেন ছয় সন্তানকে মানুষ করার জন্যে। মা-বাবার প্রথম সন্তান কাজী রোজী। মা সবসময় চাইতেন, “তাঁর এই মেয়েটি যেনো জীবনের প্রতিটি সংগ্রামে জয়ী হয়- শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংসারে সকল ক্ষেত্রে যুদ্ধে যেন জয়ী হয়।” মা কাজী বারিরা মনে করতেন, “যুদ্ধ কেবল ঘর থেকে বের হয়েই করতে হয় না, সংসারে থেকেও করতে হয়।”

দুঃখ, অভাববোধ, যন্ত্রণা- সংসারের সঙ্গী ছিল নিত্যদিনের। খুব ছোট থেকেই কাজী রোজী যদি কবিতা-ছড়া কিংবা অনুষ্ঠান করে কোনো সম্মানী পেতেন, তা মাকে এনে দিতেন। মা কাজী বারিরা শহীদ ছিলেন তার প্রেরণা। মাকে মনে হতো দেবী- দূর্গা। দশ হাতে তিনি সন্তান, সংসারের ভালো-মন্দ সামলিয়ে, সবাইকে যত্ন করে, সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করে, সকলের মাঝে নিজেকে জড়িয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করতেন। মা সম্পর্কে কাজী রোজী বলেন, মাকে চিনেই চারপাশের সবকিছুকে চিনতে পেরেছেন। মা-ই দেশকে ভালোবাসার প্রেরণা। সর্বংসহা মা-এর মতো এদেশ মাতৃকা, সবুজের পটভূমিতে রক্তরাঙা পতাকা।

কবিতার লাইন দিয়ে মা, দেশ ও দেশের পতাকা সম্পর্কে বলেছেন-

“এ পতাকা আমার মায়ের মুখের মতো কারুকার্যময়

এ পতাকা আমার বাবার চোখের মতো দূরদৃষ্টিময়

এ পতাকা আমার স্বাধীনতা শব্দের মতো ঐশ্বর্যময়’’

একাত্তরে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল স্বাধীনতা অর্জনের দিনটি। সেদিনের অনুভূতি ব্যক্ত করেন, “আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’’ মনে পড়ছিলো- “ঝর্ণা যেমন পাহাড় থেকে নেমে ভূমিকে প্লাবিত করে, তেমনি স্বাধীনতা ও সমস্ত অনুভূতিকে প্লাবিত করেছে।”

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মাটিতে পা রাখার অনুভূতিটি আজন্ম অনুভব করেছেন। অনুভব করেছেন দেশে ফিরে আসার পর মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আলিঙ্গনের উষ্ণতা। মায়ের চোখে ছিল সন্তানকে বুকে পাওয়ার আনন্দ। মা কাজী বারিরা শহীদ বলতেন, “মুক্তিযোদ্ধারা ছিল তাই তো স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের জেলে, তাঁতি, কৃষক সকলেই জানতো কীভাবে পাকিস্তানিদের মারতে হবে। এক-একটা ছেলে দেশের জন্য এক একটা অস্ত্র। সোনার ছেলেরা দেশের স্বাধীনতা এনেছে।’’ মা বুঝতেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে, মাথা গোঁজার একখণ্ড জমি পেয়েছেন। সন্তানরা যুদ্ধ করেছে বলে দেশের এই পরিবর্তন! যুদ্ধের সময় তাঁর স্বপ্ন ছিল- ‘বঙ্গব›দ্ধুর সোনার বাংলাকে নিয়ে। স্বপ্ন ছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নিজেকে গড়ে তোলার।” তিনি দেশমাতৃকার প্রতি ঋণ শোধের জন্যেই ছিলেন সোচ্চার। যদিও তাঁর জীবনে যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ চলতেই থাকে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যদিও তিনি সামাজিক সম্মান-স্বীকৃতি পেয়েছেন।

২০১৪ সালে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। নিজের বিবেকের তাড়নায় ৪২ বছর পর আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২০১২ সালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং ২০১৩ সালে গণআন্দোলনের ফলে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের রায় কার্যকর হয়। অনেকদিন ধরে নিজের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভের কিছুটা প্রশমন হয়েছে- “একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকর দেখে যেতে পারছি জীবদ্দশায়। দেশের উন্নয়ন হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলার মানুষ সুখী সমৃদ্ধ জীবন যাপন করবে”- এই প্রত্যাশার বাস্তবায়নের পথ পরিক্রমা দেখতে পাওয়াই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।

পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন কবি ও “সমকাল”-সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের সহধর্মিণী এবং কবি সুমী সিকান্দারের মা। পেশা জীবনে ছিলেন তথ্য অধিদপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ১৯৬০-এর দশকে কবিতা লেখা শুরু করেন। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০২১ সালের বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক পান।

কাজী রোজীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো: পথঘাট মানুষের নাম (কাব্যগ্রন্থ), নষ্ট জোয়ার (কাব্যগ্রন্থ), আমার পিরানের কোনো মাপ নেই (কাব্যগ্রন্থ), লড়াই (কাব্যগ্রন্থ), শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা (জীবনী গ্রন্থ), রবীন্দ্রনাথ: রসিকতার কবিতা (গবেষণা গ্রন্থ)।

মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কোভিড পজিটিভ হওয়ায় ছিলেন নিবিড় চিকিৎসা কেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে। পরবর্তীতে তার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি। কিডনিসহ মাল্টি অর্গান সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। স্ট্রোক করার কারণে তার মস্তিষ্ক কোনো কাজ করছিল না। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এ ৭৩ বছর বয়সে একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও রাজনীতিবিদ কাজী রোজীর মৃত্যু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক হিসেবে এই কবিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পতাকায় মুড়ে গার্ড অব অনার ও বিউগলের করুণ সুর বাজিয়ে সমাহিত করা হয় মুক্তিযোদ্ধা, কবি কাজী রোজীকে। মুক্তিযোদ্ধা কবি মিশে আছেন এদেশের মাটির সঙ্গে, মিশে আছেন দেশের মানচিত্রের সঙ্গে। শস্য শ্যামলা পতাকার সবুজ পটভূমিতে মিশে আছেন তিনি রক্তলাল সূর্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে।