ইয়েটসের সার্ধশতজন্মবার্ষিকীতে নরডিক সাহিত্য উৎসবে

মুহাম্মদ সামাদ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

মালমো পর্ব

সকালের স্নানাহার সেরে নয়টার দিকে ক্রিস্টিয়ান গাড়ি হাঁকালো তার নিজের শহর মালমো অভিমুখে। আগেই বলেছি- ট্রনস থেকে মালমো পাঁচ-ছয় ঘণ্টার পথ। পথের বাঁকে বাঁকে ছিলো গাড়ির জ্বালানি নেয়া, গাড়ি থামিয়ে ক্রিস্টিয়ানের সিগারেট ফোঁকা, দুপুরের খাবার, আর বিকেল আড়াইটায় মালমো থেকে নব্বই কিলোমিটার আগে ছোট শহর ভেইবস্ট্রান্ডে হৃদরোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে দুঃস্থ রোগীদের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান। শ্রোতা ছিলেন আট-দশজন শুশ্রুষা গ্রহণরত বয়ষ্ক মানুষ, আয়োজক লেইফ দেলিন আর হাস্যোজ্জ্বল শাদা সেবিকারা। কবিতাপাঠের পরে শ্রোতাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিলো। একজন আমার ‘কাক’ কবিতাটি তার ভালো লেগেছে জানিয়ে প্রশ্ন করলেন- আমি শুধু কাক নিয়ে কবিতা লিখেছি কেন? আমি বললাম- ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজেসের কাক নিয়ে রচিত কবিতাগুলোর দুর্বোধ্যতা আর আমাদের সমাজে কাকদের হেয় দৃষ্টিতে দেখার বিপরীতে তাদেরকে আমি আমার মা-বোন, সমাজের নীতিনির্ধারক ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের আসনে বসিয়ে সম্মানিত করার মানসে কাক নিয়ে কবিতাটি লিখেছি। ভদ্রলোক আমার উত্তরে একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- কেন? আমি সব পাখি ভালোবাসি। সব পাখিই সমান। কাককে ছোট করে দেখার কী আছে? আমি মনে মনে বলি- তোমাদের মতো উন্নত আর কম মানুষের দেশের কাকেরা ভালো থাকলেও বাংলাদেশের কাকদের থাকা-খাওয়ার কত যে কষ্ট তা দেখলে তুমিও আমার মতো কাকদের পক্ষ নিয়ে লিখতে বা কথা বলতে। কথা হচ্ছিল ক্রিস্টিয়ানের দোভাষীতায়। সে আমার ইংরেজি কথা ভদ্রলোককে সুইডিশে আর তার সুইডিশ কথা আমাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে কথোপকথনে সহায়তা করছিলো। হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে তাঁর ইংরেজি জানা সেবিকাকে জিগ্যেস করলাম- তাঁর কবিতানুরাগী সত্তরোর্ধ ভদ্রলোক সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন কি-না? তরুণীটি হাসিমুখে জানালো- তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ট্রাক ড্রাইভার!

বলা বাহুল্য, ২০১৩ সালে গোথেনবার্গ বইমেলার মূল থিম ‘রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষপূর্তি ও বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর’ শীর্ষক অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিতে গিয়ে সড়কপথে নরওয়ের রাজধানী অসলো হয়ে গোথেনবার্গ, উপসালা, স্টকহোম এবং ফিরতি পথে একইভাবে স্টকহোম থেকে অসলো এসেছিলাম। পথিমধ্যে ধানকাঁটা শেষে বাংলাদেশের নাড়াভরা লালচে-হলুদ বিরান প্রান্তরের মতো কৃষিজমি পেরিয়ে যাওয়ার সময় বন্ধু জন জোন্সকে নরওয়ে-সুইডেনের কৃষকদের বাড়িঘর দেখানোর আর্জি জানিয়েছিলাম। সে জবাব দিয়েছিলো- পরের বার দেখাব। এবার চলতি পথে বাংলাদেশের কচি সর্ষেক্ষেত বা মিনেসোটার কচি সয়াবিন ক্ষেতের মতো অবারিত সবুজের সমারোহ দেখে কবিবন্ধু ক্রিস্টিয়ান কার্লসনকে জন জোন্সের জবাব স্মরণ করিয়ে দিলাম। ক্রিস্টিয়ান কোনো উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ঘুরিয়ে এক সুইডিশ কৃষকের বাড়িতে নিয়ে গেলো। বাড়িতে নীল জিন্সের হাফপ্যান্ট, লাল গেঞ্জি আর শাদা ক্যাপ পরিহিত এক জবরদস্ত ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো। বিশাল আয়তনের বাড়ির একপাশে বিমানের হ্যাঙারের মতো উঁচু টিনশেড ঘরে বিরাট ট্র্যাক্টর আর ছোট ছোট ঘরে অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি। ভদ্রলোক জানালেন- চতুর্দিকে প্রান্তরভরা সবুজ কচিগাছগুলো ভোজ্যতেলের। এক বছর সময় নিয়ে এসব গাছের মূল পোক্ত হয়। তারপর সেই মূল থেকে উৎপাদিত হয় হাজার হাজার লিটার ভোজ্যতেল। ক্রিস্টিয়ান জানালো- এখন এরাই কৃষক। আগে এসব গ্রামে অনেক কৃষি পরিবার ছিলো। আগের দিনে তারা প্রধানত ঘোড়া দিয়ে চাষাবাদ করতো আর গবাদি পশুপালন করে যোগান দিতো দুধ-দই, পনির ও প্রোটিনের। এখন অনেকটা জমিদারী প্রথার মতো শহরের ধনিকশ্রেণি বিশাল বিশাল এলাকাজুড়ে জমি কিনে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দেশের কৃষিকে নিয়ন্ত্রণ করছে; আর আগের কৃষক পরিবারগুলো ছেটোখাটো কাজ করে শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

সন্ধ্যার একটু আগে আমরা মালমোতে পৌঁছলাম। কবি ক্রিস্টিয়ান কার্লসনের জন্মশহর মালমো স্কেনিয়া প্রদেশের রাজধানী এবং সুইডেনের অন্যতম বড়ো নগরী। মালমো পৌঁছেই ক্রিস্টিয়ান কাঁচা বাজারে ঢুকলো এবং ঝটপট কিছু কেনাকাটা সেরে আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেলো। ওর স্ত্রী ক্রিস্টিনা এ্যান্ডারসন আর ওদের চার/পাঁচ বছরের ছেলে অরল্যান্ডো অ্যান্ডারসনের সঙ্গে পরিচয় হলো। ক্রিস্টিনার হাতে ঢাকা থেকে নেয়া একটি ছোটো বাঁধানো নকশিকাঁথা আর অরল্যান্ডোর হাতে ক্রিস্টিয়ানের পরামর্শে কেনা ওর পছন্দের চকলেট দিলাম। ক্রিস্টিনার মতো এমন নম্র-নমিত বিদেশিনী বধূ আমি আর দেখিনি। আমেরিকা, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে আমার বন্ধুপতœীদের থেকে ক্রিস্টিনা সত্যিই আলাদা এক মেয়ে। আমাদের গ্রাম বাংলার সাদাসিধে, সরল, অতিথিপরায়না আর সহানভূতিশীল নারীর মতোন এই সুইডিশ রমণী ক্রিস্টিনা। আমার মনে হচ্ছিল যেনো অনেক দিন পর নিজের বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। ক্রিস্টিনা আর আমি গল্প করতে করতে রাতের খাবার তৈরি করে ফেললো ক্রিস্টিয়ান। ভাত, সবজি, ডাল আর মুরগি। চমৎকার সুস্বাদু সব খাবার। মনে পড়লো কলেজ জীবনে পড়া ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত যাযাবরের উপন্যাস দৃষ্টিপাত-এর কয়েকটি কথা- ‘ভোজনপর্বে... শুক্তো, ভাঁজা, ডাল, তরকারি, মাছ, টক ও একটু দই। সাধারণ ভদ্র বাঙালি পরিবারে যা প্রাত্যহিক আহার- অতিথির জন্যও সেই ব্যবস্থা। অপরাহ্ণে নারিকেল কুচি সহযোগে চিড়ে ভাজা বা বাড়িতে তৈরি খানকয়েক লুচি। চায়ের সঙ্গে পান্তুয়া রসগোল্লার সমারোহ এবং ভাতের সঙ্গে চপ-কাটলেটেরে বাহুল্য দ্বারা প্রত্যহই অতিথিকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা নেই যে, এ গৃহে সে একজন বহিরাগত আগন্তুক মাত্র। সহজ হওয়ার মধ্যেই আছে কালচারের পরিচয়, আড়ম্বরের মধ্যে আছে দম্ভের। সে দম্ভ কখনও অর্থের, কখনও বিদ্যার, কখনও বা প্রতিপত্তির।’

সুইডেনে মাইলের হিসেব ভিন্নতর। এক মাইল সমান দশ কিলোমিটার। ক্রিস্টিয়ানের ছোট্ট ছিমছাম সুন্দর ভাড়া বাড়ি থেকে মালমো শহরের কেন্দ্রে আমার হোটেলটি এক মাইল অর্থাৎ দশ কিলোমিটার দূরে। শহরের পুরনো এলাকায় অবস্থিত হোটেলটির নাম মরতেনসেন। সারাদিনের ভ্রমণ আর পরদিন সকালে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানের কথা ভেবে আমাদের আড্ডা শেষ করতে হলো। অবশ্য পরের রাতে দীর্ঘদিন পর আমি দুটি কবিতা লিখেছি এই হোটেলে।

পরদিন ৪ঠা নভেম্বর সকাল দশটার কিছু আগে মালমো কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হলাম আমরা। কবিতাপাঠের আয়োজকদের পক্ষ থেকে আমাদের অভ্যর্থনা করলো গ্রন্থাগারের কর্মকর্তা অ্যান্ডারস জোহান্সন স্টিল্ৎজে ও কবি মেরিমা দিজদারেভিক। সব কিছু এখানে ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে। গ্রন্থাগারের নিচতলায় সাজানো-গোছানো মঞ্চ। দর্শক-শ্রোতার সংখ্যাও বেশ। এদের মধ্যে কবি-আবৃত্তিকার ও গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠকরা এসেছেন। অনুষ্ঠানের খবর প্রচার করা হয়েছে মালমো শহরজুড়ে। শুনে খুব অবাক লাগলো যে, কবি মেরিমা দিজদারেভিক নিজে সাইকেলে করে রেলস্টেশন, শপিংমল, বড় রাস্তাগুলোয় হ্যান্ড-মাইক দিয়ে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানের কথা প্রচার করেছেন, প্রচারপত্র বিলি করেছেন। সব শুনে আশ্চর্য আনন্দাশ্রুতে চোখ ছলছল করে উঠলো। আমি কোথাকার কোন পাড়াগাঁর ছেলে! কয়েক পঙ্ক্তি কবিতা লিখে এতো ভালোবাসা পেয়ে অভিভূত হওয়া ছাড়া আমার আর কী করার আছে!

সকাল দশটায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলো মিষ্টি মেয়ে মেরিমা দিজদারেভিক। আমাদের দেশের মতো আয়োজকদের স্বাগত ভাষণ, পুষ্পার্ঘ্য আর ক্রেস্ট দেয়ার নাম করে জনে-জনে মঞ্চে ওঠার সুযোগ নেয়ার মতো বিরক্তির কিছু ছিলো না। শুরুতেই ক্রিস্টিয়ান আর আমাকে মঞ্চে ডেকে নিলো মেরিমা। এখানে আমি বাংলায় ‘ধর্ম’ ও ‘কাক’সহ পাঁচটি কবিতা পড়লাম এবং ক্রিস্টিয়ান সেগুলোর সুইডিশ অনুবাদ শোনালো। আমার কবিতা যে শ্রোতারা অপছন্দ করেননি বরং একাগ্রতার সঙ্গে উপভোগ করেছেন তা বুঝলাম প্রশ্নোত্তর পর্বে। স্বভাবসুলভ ইউরোপিয়ান ভদ্রতায় আমাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে বেশ কয়েকজন প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পঠিত কবিতাগুলোর প্রেক্ষাপট, নির্মাণশৈলী ও বার্তা জেনে নিলো। ক্রিস্টিয়ানের সুইডিশ অনুবাদে চলছিলো আমাদের কথোপকথন। ২০০৫ সালে প্রথম এরকম প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় উইনোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি আয়োজিত একটি একক এবং পঞ্চাশ মাইল দূরে বিশ্ববিদ্যালয়টির অত্যাধুনিক ক্যাম্পাসে উইনোনা, রচেস্টার, টুইনসিটিখ্যাত মিনিয়াপলিস-সেইন্টপল আর পাশের উইসকনসিন রাজ্যের লাক্রস শহরে বসবাসকারী ১০ ভাষার কবিদের মধ্যে ‘ফিচার্ড পোয়েট’ হিসেবে কবিতা পড়ার সময়। আমার অধ্যাপক-বন্ধু ক্যাথির পরামর্শে এবং আনিসের সহায়তায় বাংলা কবিতার ইতিকথা আর ধারাবাহিকতা নিয়ে ইংরেজিতে বিশ/বাইশ পাতার একটি নোট নিয়ে যাওয়ায় সে যাত্রায় খুব কাজে দিয়েছিলো বলেই এখন অনেকটা অভ্যস্থ হয়ে গেছি বলা যায়। যাই হোক, আমরা শেষ করে কফি হাতে দর্শক সারিতে বসলাম। ওরল্যান্ডোকে স্কুলে দিয়ে ক্রিস্টিনাও এসেছে। আমাদের পরে কবিতা পড়লেন মেরিমা দিজদারেভিক, নাকে ইউরোপীয় নোলকপরা তরুণী কবি রাইয়ানন বেনমেক্কি, মালমোর একজন প্রবীণ অভিনেত্রী ক্রিস্টিনা ক্যাম্নার্তসহ কয়েকজন। সম্মানী হিসেবে ক্রিস্টিয়ান আমাকে আড়াই হাজার সুইডিশ ক্রোনার দিয়েছিলো ট্রনসেই। এবার মেরিমা সুন্দর একরঙা

র‌্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটি ইংরেজি বই উপহার দিলো। আচারে-শিষ্টাচারে বিদেশেও নিজের সংস্কৃতির প্রতি অবিচল থেকে পথ চলতে আমার ভালো লাগে। অভিনেত্রী-কবি ক্রিস্টিয়ানা ক্যাম্নার্ত, মেরিমা আর রাইয়ানদের সঙ্গে করমর্দন করে আর অ্যান্ডারস জোহান্সন স্টিল্ৎজেকে বুকে জড়িয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

অতঃপর ক্রিস্টিয়ানের সঙ্গে মালমো দেখার পালা। সব সময়ই দেশ ভ্রমণে আমার আগ্রহের তালিকায় প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে ঐতিহাসিক বা প্রাচীন প্রাসাদ-অট্টালিকা-উপাসনালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়। যেমন ভারতের লালকেল্লা, আগ্রা ফোর্ট, তাজমহল, বুদ্ধগয়া, কামাক্ষা মন্দির, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়; ইন্দোনেশিয়ার জগজাকার্তায় সুলতানের প্রাসাদ ও বোরোবুদুর মন্দির, বার্মার শে^ডাগন প্যাগোডা, প্রাচীন রাজাদের ভগ্ন-প্রাসাদ, রূপোর শীতল পাটি; চীনের প্রাচীর, ফরবিডেন সিটি, সামার প্যালেস, মমিকৃত মাও সে তুঙ; জাপান সম্রাটদের প্রাচীন প্রাসাদ, হিরোসিমায় আনবিক বোমায় বিধ্বস্ত সিটি হল, টোকিওর ন্যাশনাল মিউজিয়ামে নানার আকৃতির বুদ্ধমূর্তি, ব্রোঞ্জের টাকার গাছ, কবিতার লম্বা পাণ্ডুলিপি; মালয়েশিয়ার সাপের মন্দির, ভিয়েতনামের বিদ্যার্থীদের পূজনীয় বিরাট বিরাট পাথরের কাছিম, দক্ষিণ কোরিয়ার সারি সারি পুরনো রাজপ্রাসাদ, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীর্ণ দালান-কোঠা; ওয়াশিংটনের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকার পাথরের দালান-কোঠা ও উঁচু গির্জা, সুইডেন-নরওয়ের রাজার প্রাসাদ, ডেনমার্কের রানীর প্রাচীন দুর্গ ইত্যাদি দেখে মানুষের মেধা, সভ্যতা, শিল্পশৈলীর দক্ষতা ও শক্তিমত্তায় বিস্মিত ও বিমোহিত হয়েছি। উল্লেখ্য, দুইশো বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত উত্তর ইউরোপের দুটি প্রাচীনতম ও প্রথম শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় হলো উপসালা (১৪৪৭) ও লুন্দ (১৬৬৬)। ২০১৩ সালে ‘এশিয়ার জীবনধারা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেয়ার সূত্রে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের কিছুটা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। তাই, ক্রিস্টিয়ানকে বললাম- মালমোতে আমি প্রথমে তোমাদের লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখতে চাই।

মালমো শহরের কেন্দ্র থেকে লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয় তিরিশ মিনিটের পথ। ট্রেনে যেতে আরও কম সময় লাগে। আমরা দুপুর বারোটার মধ্যে লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছলাম। সুইডেনের অন্য শহরের তুলনায় মালমোতে শীত কম এবং শুরুও হয় একটু পরে। তবু গাড়ির বাইরে বেরোলেই বেশ ঠাণ্ডা লাগছিলো। আজ রোববারের ছুটির দিনে দুই-চারজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে দেখা গেলেও আর সবকিছুরই দ্বার রুদ্ধ। ক্রিস্টিয়ান এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভাষা-সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে। অনুষদ, বিভাগ, গবেষণাগার, লাইব্রেরিসহ সবকিছু ওর নখদর্পণে। অনেক কথার মধ্যে তিনটি বিষয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ক্রিস্টিয়ান।

এক. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আজকে যেটি লুন্দ ক্যাথিড্র্যাল এই অঙ্গনে একটি গির্জা নির্মিত হয়েছিলো ১০৮৫ সালের আগে আর এখানেই ১০৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো ডেনমার্কের প্রথম বিদ্যালয়। বর্তমানে লুন্দ ক্যাথিড্র্যাল সুইডেনের প্রধান উপাসনালয় এবং প্রথামাফিক এখানেই আর্চবিশপের আসন;

দুই. এখানকার গ্রন্থাগারটি খুব সমৃদ্ধ এবং ছোটো-বড় সকল লভ্য প্রকাশনার একটি কপি এখানে সংরক্ষণ করা হয় (গ্রন্থাগারের ভেতরটা ঘুরে দেখতে না-পারায় খুব কষ্ট হচ্ছিল); এবং

তিন. লুন্দ বিশবিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের নির্মিয়মাণ অত্যাধুনিক ভবন দেখিয়ে বললো- এখানে একটি এক্স-রে মেশিন বসানোর কাজ চলছে, যেটি সম্পন্ন হলে একজন মানুষের রোগ নির্ণয়ের জন্যে যে এক্স-রে করা হবে সেটির দৈর্ঘ্য এক থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। অতঃপর লুন্ড থেকে ফিরে মালমো বিশ্ববিদ্যালয়, মালমো অপেরা হাউস, আর ধনী দেশের উল্টোচিত্র পলিথিনের তাঁবুর সামনে ভিক্ষাপাত্র হাতে রুমানিয়ার ফর্সা কোমল নারী-শিশুসহ ভাগ্যান্বাষীদের করুণ ম্রিয়মান মুখ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো।

উপসালা পর্ব

৫ই অক্টোবর ২০১৫ সাল সোমবার সারাদিন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন ঘুরে সন্ধ্যার ট্রেনে রওনা হয়ে উপসালা এলাম। আনিস আমাকে নিয়ে ওঠালো উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ছিমছাম একাডেমি হোটেলে। ২০১৩ সালেও এখানে ছিলাম। অনেক রাত অবধি আমরা কথা বললাম নিজেদের ব্যক্তিগত, বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ট্রনস, মালমো আর কোপেনহেগেন ভ্রমণ নিয়ে। পরদিন উপসালার সাহিত্য একাডেমির গৎসুন্দা সংস্কৃতি কেন্দ্রে কবি বেঙত্ বিয়র্কলুন্দের একক কবিতাপাঠের আসরে যোগ দিতে গিয়ে আমাকেও কিছু বলতে ও একটি কবিতাপাঠ করতে হলো। খুব মজার মানুষ কবি বেঙত্ বিয়র্কলুন্দ। ছোটবেলা থেকেই বাউন্ডুলে। কম বয়সেই মাদকের মামলায় তুরস্কের কারাগারে কাটাতে হয়েছে অনেক দিন। কারাগারেই পরিচয় ও প্রণয়সূত্রে প্রথম বিয়ে করেন এক জাপানি রমণীকে। এভাবে জাপানি, ব্রিটিশ আর সুইডিশ মিলিয়ে পাঁচ নারীকে বিয়ে করে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এখনকার স্ত্রী একজন স্কুল শিক্ষিকা। এই প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা খুব মিশুক এবং বেঙত্কে নিয়ে বেশ গর্বিত। বেঙত্ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাউন্ডুলে জীবন শুরু করলেও কবি হওয়ার সুবাদে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে দুই বছর ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলো। পঞ্চম স্ত্রী নিয়ে এখন স্টকহোমবাসী। সুন্দর ছবি আঁকতে আর ভালো বাঁশি বাজাতে পারেন কবি বেঙত্্ বিয়র্কলুন্দ।

পরদিন সাতই অক্টোবর মঙ্গলবার উপসালার ব্ল্যাংকা থিয়েটারে সুইডেনের বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা দাগেনস নিহেতারের সাবেক প্রধান সম্পাদক-কবি অরনে রুথের সভাপতিত্বে বাংলা-নরডিক সাহিত্য সন্ধ্যায় কবিতাপাঠ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিই। এবার উপসালায় আমার মূল অনুষ্ঠান ছিলো এটি। অনুষ্ঠানে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার কবিদের মধ্যে নরওয়ের অসলো থেকে জন ওয়াই জোন্স, সুইডিশ কবি লার্স হেইগার, ম্যাগনাস দালেরুস এবং উপসালা প্রবাসী কবি আনিসুর রহমান ও শ্যামলী চক্রবর্তী অংশ নেন। সাহিত্যালোচনা পর্বটি খুব জমজমাট হয়েছিলো। বাঙালি কবিদের পাশাপশি বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার কবিদের অনুবাদ নিয়ে বলতে হয়েছিলো আমাকে। আমি সফোক্লিসের নাটক থেকে হোমার, শেক্সপিয়োর, কিটস্, ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট, দান্তে, ব্রেখট, দু ফু, লু শ্যুন, বোঁদলেয়ার, লুঁই আঁরাগো, র্যাঁবো, নাজিম হিকমাত, পাবলো নেরুদা, লোরকা, কাহলিল জিবরান, আলেক্সান্দর পুশকিন, মায়াকোভস্কি এবং ইবসেন, ট্রান্সট্রয়মার, মাহমুদ দারবিশ থেকে সমসাময়িক অসংখ্য অন্য ভাষার কবিদের বাংলা অনুবাদের কথা উল্লেখ করায় উপস্থিত সবাই বিস্মিত হলেন। আমার নরওয়ের লেখক-বন্ধু জন জোন্স বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা উৎসবে দেশ-বিদেশের কবিদের অংশগ্রহণের ছবিসহ তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করলে শ্রোতা-দর্শকরা চমকিত হলো। উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুপর্ণা স্যান্যাল ও বিপ্লব স্যান্যালের নেতৃত্বে তাঁদের সংগীতদলের গান পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে উপসালার ব্লাংকা থিয়েটারের মিলনমেলা শেষ করে আনিস, জন জোন্স ও আমি একাডেমি হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম। তখন ঠাণ্ডা মাইনাসে নামতে শুরু করেছে।

বিদায়বেলায়

পরদিন ৮ই অক্টোবর সকালে স্টকহোমের অরল্যান্ডো বিমানবন্দর থেকে অশ্রুসজল আনিসুর রহমান আমাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে তুলে দিলো। বিদায়বেলায় আনিসের পাশাপাশি আমার ভেজা চোখে ভেসে উঠলো কবিবন্ধু ক্রিস্টিয়ান কার্লসনের মুখ। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন বিমানবন্দর থেকে সুইডেনের ট্রনস; ট্রনস থেকে মালমো ও কোপেনহেগেন ভ্রমণে ক্রিস্টিয়ানের অক্লান্ত গাড়ি হাঁকানো, অন্তহীন আন্তরিকতা আর উদারহস্ত সহৃদয়তার মূল্য দেয়ার সামর্থ্য আমার কোনোদিন হবে কি! (সমাপ্ত)

রচনাকাল : ২০১৬, ঢাকা বিশ^দ্যিালয়

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

ইয়েটসের সার্ধশতজন্মবার্ষিকীতে নরডিক সাহিত্য উৎসবে

মুহাম্মদ সামাদ

image

উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস

(পূর্ব প্রকাশের পর)

মালমো পর্ব

সকালের স্নানাহার সেরে নয়টার দিকে ক্রিস্টিয়ান গাড়ি হাঁকালো তার নিজের শহর মালমো অভিমুখে। আগেই বলেছি- ট্রনস থেকে মালমো পাঁচ-ছয় ঘণ্টার পথ। পথের বাঁকে বাঁকে ছিলো গাড়ির জ্বালানি নেয়া, গাড়ি থামিয়ে ক্রিস্টিয়ানের সিগারেট ফোঁকা, দুপুরের খাবার, আর বিকেল আড়াইটায় মালমো থেকে নব্বই কিলোমিটার আগে ছোট শহর ভেইবস্ট্রান্ডে হৃদরোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে দুঃস্থ রোগীদের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান। শ্রোতা ছিলেন আট-দশজন শুশ্রুষা গ্রহণরত বয়ষ্ক মানুষ, আয়োজক লেইফ দেলিন আর হাস্যোজ্জ্বল শাদা সেবিকারা। কবিতাপাঠের পরে শ্রোতাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিলো। একজন আমার ‘কাক’ কবিতাটি তার ভালো লেগেছে জানিয়ে প্রশ্ন করলেন- আমি শুধু কাক নিয়ে কবিতা লিখেছি কেন? আমি বললাম- ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজেসের কাক নিয়ে রচিত কবিতাগুলোর দুর্বোধ্যতা আর আমাদের সমাজে কাকদের হেয় দৃষ্টিতে দেখার বিপরীতে তাদেরকে আমি আমার মা-বোন, সমাজের নীতিনির্ধারক ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের আসনে বসিয়ে সম্মানিত করার মানসে কাক নিয়ে কবিতাটি লিখেছি। ভদ্রলোক আমার উত্তরে একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- কেন? আমি সব পাখি ভালোবাসি। সব পাখিই সমান। কাককে ছোট করে দেখার কী আছে? আমি মনে মনে বলি- তোমাদের মতো উন্নত আর কম মানুষের দেশের কাকেরা ভালো থাকলেও বাংলাদেশের কাকদের থাকা-খাওয়ার কত যে কষ্ট তা দেখলে তুমিও আমার মতো কাকদের পক্ষ নিয়ে লিখতে বা কথা বলতে। কথা হচ্ছিল ক্রিস্টিয়ানের দোভাষীতায়। সে আমার ইংরেজি কথা ভদ্রলোককে সুইডিশে আর তার সুইডিশ কথা আমাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে কথোপকথনে সহায়তা করছিলো। হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে তাঁর ইংরেজি জানা সেবিকাকে জিগ্যেস করলাম- তাঁর কবিতানুরাগী সত্তরোর্ধ ভদ্রলোক সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন কি-না? তরুণীটি হাসিমুখে জানালো- তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ট্রাক ড্রাইভার!

বলা বাহুল্য, ২০১৩ সালে গোথেনবার্গ বইমেলার মূল থিম ‘রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষপূর্তি ও বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর’ শীর্ষক অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিতে গিয়ে সড়কপথে নরওয়ের রাজধানী অসলো হয়ে গোথেনবার্গ, উপসালা, স্টকহোম এবং ফিরতি পথে একইভাবে স্টকহোম থেকে অসলো এসেছিলাম। পথিমধ্যে ধানকাঁটা শেষে বাংলাদেশের নাড়াভরা লালচে-হলুদ বিরান প্রান্তরের মতো কৃষিজমি পেরিয়ে যাওয়ার সময় বন্ধু জন জোন্সকে নরওয়ে-সুইডেনের কৃষকদের বাড়িঘর দেখানোর আর্জি জানিয়েছিলাম। সে জবাব দিয়েছিলো- পরের বার দেখাব। এবার চলতি পথে বাংলাদেশের কচি সর্ষেক্ষেত বা মিনেসোটার কচি সয়াবিন ক্ষেতের মতো অবারিত সবুজের সমারোহ দেখে কবিবন্ধু ক্রিস্টিয়ান কার্লসনকে জন জোন্সের জবাব স্মরণ করিয়ে দিলাম। ক্রিস্টিয়ান কোনো উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ঘুরিয়ে এক সুইডিশ কৃষকের বাড়িতে নিয়ে গেলো। বাড়িতে নীল জিন্সের হাফপ্যান্ট, লাল গেঞ্জি আর শাদা ক্যাপ পরিহিত এক জবরদস্ত ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো। বিশাল আয়তনের বাড়ির একপাশে বিমানের হ্যাঙারের মতো উঁচু টিনশেড ঘরে বিরাট ট্র্যাক্টর আর ছোট ছোট ঘরে অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি। ভদ্রলোক জানালেন- চতুর্দিকে প্রান্তরভরা সবুজ কচিগাছগুলো ভোজ্যতেলের। এক বছর সময় নিয়ে এসব গাছের মূল পোক্ত হয়। তারপর সেই মূল থেকে উৎপাদিত হয় হাজার হাজার লিটার ভোজ্যতেল। ক্রিস্টিয়ান জানালো- এখন এরাই কৃষক। আগে এসব গ্রামে অনেক কৃষি পরিবার ছিলো। আগের দিনে তারা প্রধানত ঘোড়া দিয়ে চাষাবাদ করতো আর গবাদি পশুপালন করে যোগান দিতো দুধ-দই, পনির ও প্রোটিনের। এখন অনেকটা জমিদারী প্রথার মতো শহরের ধনিকশ্রেণি বিশাল বিশাল এলাকাজুড়ে জমি কিনে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দেশের কৃষিকে নিয়ন্ত্রণ করছে; আর আগের কৃষক পরিবারগুলো ছেটোখাটো কাজ করে শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

সন্ধ্যার একটু আগে আমরা মালমোতে পৌঁছলাম। কবি ক্রিস্টিয়ান কার্লসনের জন্মশহর মালমো স্কেনিয়া প্রদেশের রাজধানী এবং সুইডেনের অন্যতম বড়ো নগরী। মালমো পৌঁছেই ক্রিস্টিয়ান কাঁচা বাজারে ঢুকলো এবং ঝটপট কিছু কেনাকাটা সেরে আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেলো। ওর স্ত্রী ক্রিস্টিনা এ্যান্ডারসন আর ওদের চার/পাঁচ বছরের ছেলে অরল্যান্ডো অ্যান্ডারসনের সঙ্গে পরিচয় হলো। ক্রিস্টিনার হাতে ঢাকা থেকে নেয়া একটি ছোটো বাঁধানো নকশিকাঁথা আর অরল্যান্ডোর হাতে ক্রিস্টিয়ানের পরামর্শে কেনা ওর পছন্দের চকলেট দিলাম। ক্রিস্টিনার মতো এমন নম্র-নমিত বিদেশিনী বধূ আমি আর দেখিনি। আমেরিকা, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে আমার বন্ধুপতœীদের থেকে ক্রিস্টিনা সত্যিই আলাদা এক মেয়ে। আমাদের গ্রাম বাংলার সাদাসিধে, সরল, অতিথিপরায়না আর সহানভূতিশীল নারীর মতোন এই সুইডিশ রমণী ক্রিস্টিনা। আমার মনে হচ্ছিল যেনো অনেক দিন পর নিজের বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। ক্রিস্টিনা আর আমি গল্প করতে করতে রাতের খাবার তৈরি করে ফেললো ক্রিস্টিয়ান। ভাত, সবজি, ডাল আর মুরগি। চমৎকার সুস্বাদু সব খাবার। মনে পড়লো কলেজ জীবনে পড়া ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত যাযাবরের উপন্যাস দৃষ্টিপাত-এর কয়েকটি কথা- ‘ভোজনপর্বে... শুক্তো, ভাঁজা, ডাল, তরকারি, মাছ, টক ও একটু দই। সাধারণ ভদ্র বাঙালি পরিবারে যা প্রাত্যহিক আহার- অতিথির জন্যও সেই ব্যবস্থা। অপরাহ্ণে নারিকেল কুচি সহযোগে চিড়ে ভাজা বা বাড়িতে তৈরি খানকয়েক লুচি। চায়ের সঙ্গে পান্তুয়া রসগোল্লার সমারোহ এবং ভাতের সঙ্গে চপ-কাটলেটেরে বাহুল্য দ্বারা প্রত্যহই অতিথিকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা নেই যে, এ গৃহে সে একজন বহিরাগত আগন্তুক মাত্র। সহজ হওয়ার মধ্যেই আছে কালচারের পরিচয়, আড়ম্বরের মধ্যে আছে দম্ভের। সে দম্ভ কখনও অর্থের, কখনও বিদ্যার, কখনও বা প্রতিপত্তির।’

সুইডেনে মাইলের হিসেব ভিন্নতর। এক মাইল সমান দশ কিলোমিটার। ক্রিস্টিয়ানের ছোট্ট ছিমছাম সুন্দর ভাড়া বাড়ি থেকে মালমো শহরের কেন্দ্রে আমার হোটেলটি এক মাইল অর্থাৎ দশ কিলোমিটার দূরে। শহরের পুরনো এলাকায় অবস্থিত হোটেলটির নাম মরতেনসেন। সারাদিনের ভ্রমণ আর পরদিন সকালে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানের কথা ভেবে আমাদের আড্ডা শেষ করতে হলো। অবশ্য পরের রাতে দীর্ঘদিন পর আমি দুটি কবিতা লিখেছি এই হোটেলে।

পরদিন ৪ঠা নভেম্বর সকাল দশটার কিছু আগে মালমো কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হলাম আমরা। কবিতাপাঠের আয়োজকদের পক্ষ থেকে আমাদের অভ্যর্থনা করলো গ্রন্থাগারের কর্মকর্তা অ্যান্ডারস জোহান্সন স্টিল্ৎজে ও কবি মেরিমা দিজদারেভিক। সব কিছু এখানে ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে। গ্রন্থাগারের নিচতলায় সাজানো-গোছানো মঞ্চ। দর্শক-শ্রোতার সংখ্যাও বেশ। এদের মধ্যে কবি-আবৃত্তিকার ও গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠকরা এসেছেন। অনুষ্ঠানের খবর প্রচার করা হয়েছে মালমো শহরজুড়ে। শুনে খুব অবাক লাগলো যে, কবি মেরিমা দিজদারেভিক নিজে সাইকেলে করে রেলস্টেশন, শপিংমল, বড় রাস্তাগুলোয় হ্যান্ড-মাইক দিয়ে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানের কথা প্রচার করেছেন, প্রচারপত্র বিলি করেছেন। সব শুনে আশ্চর্য আনন্দাশ্রুতে চোখ ছলছল করে উঠলো। আমি কোথাকার কোন পাড়াগাঁর ছেলে! কয়েক পঙ্ক্তি কবিতা লিখে এতো ভালোবাসা পেয়ে অভিভূত হওয়া ছাড়া আমার আর কী করার আছে!

সকাল দশটায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলো মিষ্টি মেয়ে মেরিমা দিজদারেভিক। আমাদের দেশের মতো আয়োজকদের স্বাগত ভাষণ, পুষ্পার্ঘ্য আর ক্রেস্ট দেয়ার নাম করে জনে-জনে মঞ্চে ওঠার সুযোগ নেয়ার মতো বিরক্তির কিছু ছিলো না। শুরুতেই ক্রিস্টিয়ান আর আমাকে মঞ্চে ডেকে নিলো মেরিমা। এখানে আমি বাংলায় ‘ধর্ম’ ও ‘কাক’সহ পাঁচটি কবিতা পড়লাম এবং ক্রিস্টিয়ান সেগুলোর সুইডিশ অনুবাদ শোনালো। আমার কবিতা যে শ্রোতারা অপছন্দ করেননি বরং একাগ্রতার সঙ্গে উপভোগ করেছেন তা বুঝলাম প্রশ্নোত্তর পর্বে। স্বভাবসুলভ ইউরোপিয়ান ভদ্রতায় আমাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে বেশ কয়েকজন প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পঠিত কবিতাগুলোর প্রেক্ষাপট, নির্মাণশৈলী ও বার্তা জেনে নিলো। ক্রিস্টিয়ানের সুইডিশ অনুবাদে চলছিলো আমাদের কথোপকথন। ২০০৫ সালে প্রথম এরকম প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় উইনোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি আয়োজিত একটি একক এবং পঞ্চাশ মাইল দূরে বিশ্ববিদ্যালয়টির অত্যাধুনিক ক্যাম্পাসে উইনোনা, রচেস্টার, টুইনসিটিখ্যাত মিনিয়াপলিস-সেইন্টপল আর পাশের উইসকনসিন রাজ্যের লাক্রস শহরে বসবাসকারী ১০ ভাষার কবিদের মধ্যে ‘ফিচার্ড পোয়েট’ হিসেবে কবিতা পড়ার সময়। আমার অধ্যাপক-বন্ধু ক্যাথির পরামর্শে এবং আনিসের সহায়তায় বাংলা কবিতার ইতিকথা আর ধারাবাহিকতা নিয়ে ইংরেজিতে বিশ/বাইশ পাতার একটি নোট নিয়ে যাওয়ায় সে যাত্রায় খুব কাজে দিয়েছিলো বলেই এখন অনেকটা অভ্যস্থ হয়ে গেছি বলা যায়। যাই হোক, আমরা শেষ করে কফি হাতে দর্শক সারিতে বসলাম। ওরল্যান্ডোকে স্কুলে দিয়ে ক্রিস্টিনাও এসেছে। আমাদের পরে কবিতা পড়লেন মেরিমা দিজদারেভিক, নাকে ইউরোপীয় নোলকপরা তরুণী কবি রাইয়ানন বেনমেক্কি, মালমোর একজন প্রবীণ অভিনেত্রী ক্রিস্টিনা ক্যাম্নার্তসহ কয়েকজন। সম্মানী হিসেবে ক্রিস্টিয়ান আমাকে আড়াই হাজার সুইডিশ ক্রোনার দিয়েছিলো ট্রনসেই। এবার মেরিমা সুন্দর একরঙা

র‌্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটি ইংরেজি বই উপহার দিলো। আচারে-শিষ্টাচারে বিদেশেও নিজের সংস্কৃতির প্রতি অবিচল থেকে পথ চলতে আমার ভালো লাগে। অভিনেত্রী-কবি ক্রিস্টিয়ানা ক্যাম্নার্ত, মেরিমা আর রাইয়ানদের সঙ্গে করমর্দন করে আর অ্যান্ডারস জোহান্সন স্টিল্ৎজেকে বুকে জড়িয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

অতঃপর ক্রিস্টিয়ানের সঙ্গে মালমো দেখার পালা। সব সময়ই দেশ ভ্রমণে আমার আগ্রহের তালিকায় প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে ঐতিহাসিক বা প্রাচীন প্রাসাদ-অট্টালিকা-উপাসনালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়। যেমন ভারতের লালকেল্লা, আগ্রা ফোর্ট, তাজমহল, বুদ্ধগয়া, কামাক্ষা মন্দির, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়; ইন্দোনেশিয়ার জগজাকার্তায় সুলতানের প্রাসাদ ও বোরোবুদুর মন্দির, বার্মার শে^ডাগন প্যাগোডা, প্রাচীন রাজাদের ভগ্ন-প্রাসাদ, রূপোর শীতল পাটি; চীনের প্রাচীর, ফরবিডেন সিটি, সামার প্যালেস, মমিকৃত মাও সে তুঙ; জাপান সম্রাটদের প্রাচীন প্রাসাদ, হিরোসিমায় আনবিক বোমায় বিধ্বস্ত সিটি হল, টোকিওর ন্যাশনাল মিউজিয়ামে নানার আকৃতির বুদ্ধমূর্তি, ব্রোঞ্জের টাকার গাছ, কবিতার লম্বা পাণ্ডুলিপি; মালয়েশিয়ার সাপের মন্দির, ভিয়েতনামের বিদ্যার্থীদের পূজনীয় বিরাট বিরাট পাথরের কাছিম, দক্ষিণ কোরিয়ার সারি সারি পুরনো রাজপ্রাসাদ, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীর্ণ দালান-কোঠা; ওয়াশিংটনের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকার পাথরের দালান-কোঠা ও উঁচু গির্জা, সুইডেন-নরওয়ের রাজার প্রাসাদ, ডেনমার্কের রানীর প্রাচীন দুর্গ ইত্যাদি দেখে মানুষের মেধা, সভ্যতা, শিল্পশৈলীর দক্ষতা ও শক্তিমত্তায় বিস্মিত ও বিমোহিত হয়েছি। উল্লেখ্য, দুইশো বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত উত্তর ইউরোপের দুটি প্রাচীনতম ও প্রথম শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় হলো উপসালা (১৪৪৭) ও লুন্দ (১৬৬৬)। ২০১৩ সালে ‘এশিয়ার জীবনধারা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেয়ার সূত্রে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের কিছুটা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। তাই, ক্রিস্টিয়ানকে বললাম- মালমোতে আমি প্রথমে তোমাদের লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখতে চাই।

মালমো শহরের কেন্দ্র থেকে লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয় তিরিশ মিনিটের পথ। ট্রেনে যেতে আরও কম সময় লাগে। আমরা দুপুর বারোটার মধ্যে লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছলাম। সুইডেনের অন্য শহরের তুলনায় মালমোতে শীত কম এবং শুরুও হয় একটু পরে। তবু গাড়ির বাইরে বেরোলেই বেশ ঠাণ্ডা লাগছিলো। আজ রোববারের ছুটির দিনে দুই-চারজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে দেখা গেলেও আর সবকিছুরই দ্বার রুদ্ধ। ক্রিস্টিয়ান এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভাষা-সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে। অনুষদ, বিভাগ, গবেষণাগার, লাইব্রেরিসহ সবকিছু ওর নখদর্পণে। অনেক কথার মধ্যে তিনটি বিষয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ক্রিস্টিয়ান।

এক. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আজকে যেটি লুন্দ ক্যাথিড্র্যাল এই অঙ্গনে একটি গির্জা নির্মিত হয়েছিলো ১০৮৫ সালের আগে আর এখানেই ১০৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো ডেনমার্কের প্রথম বিদ্যালয়। বর্তমানে লুন্দ ক্যাথিড্র্যাল সুইডেনের প্রধান উপাসনালয় এবং প্রথামাফিক এখানেই আর্চবিশপের আসন;

দুই. এখানকার গ্রন্থাগারটি খুব সমৃদ্ধ এবং ছোটো-বড় সকল লভ্য প্রকাশনার একটি কপি এখানে সংরক্ষণ করা হয় (গ্রন্থাগারের ভেতরটা ঘুরে দেখতে না-পারায় খুব কষ্ট হচ্ছিল); এবং

তিন. লুন্দ বিশবিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের নির্মিয়মাণ অত্যাধুনিক ভবন দেখিয়ে বললো- এখানে একটি এক্স-রে মেশিন বসানোর কাজ চলছে, যেটি সম্পন্ন হলে একজন মানুষের রোগ নির্ণয়ের জন্যে যে এক্স-রে করা হবে সেটির দৈর্ঘ্য এক থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। অতঃপর লুন্ড থেকে ফিরে মালমো বিশ্ববিদ্যালয়, মালমো অপেরা হাউস, আর ধনী দেশের উল্টোচিত্র পলিথিনের তাঁবুর সামনে ভিক্ষাপাত্র হাতে রুমানিয়ার ফর্সা কোমল নারী-শিশুসহ ভাগ্যান্বাষীদের করুণ ম্রিয়মান মুখ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো।

উপসালা পর্ব

৫ই অক্টোবর ২০১৫ সাল সোমবার সারাদিন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন ঘুরে সন্ধ্যার ট্রেনে রওনা হয়ে উপসালা এলাম। আনিস আমাকে নিয়ে ওঠালো উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ছিমছাম একাডেমি হোটেলে। ২০১৩ সালেও এখানে ছিলাম। অনেক রাত অবধি আমরা কথা বললাম নিজেদের ব্যক্তিগত, বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ট্রনস, মালমো আর কোপেনহেগেন ভ্রমণ নিয়ে। পরদিন উপসালার সাহিত্য একাডেমির গৎসুন্দা সংস্কৃতি কেন্দ্রে কবি বেঙত্ বিয়র্কলুন্দের একক কবিতাপাঠের আসরে যোগ দিতে গিয়ে আমাকেও কিছু বলতে ও একটি কবিতাপাঠ করতে হলো। খুব মজার মানুষ কবি বেঙত্ বিয়র্কলুন্দ। ছোটবেলা থেকেই বাউন্ডুলে। কম বয়সেই মাদকের মামলায় তুরস্কের কারাগারে কাটাতে হয়েছে অনেক দিন। কারাগারেই পরিচয় ও প্রণয়সূত্রে প্রথম বিয়ে করেন এক জাপানি রমণীকে। এভাবে জাপানি, ব্রিটিশ আর সুইডিশ মিলিয়ে পাঁচ নারীকে বিয়ে করে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এখনকার স্ত্রী একজন স্কুল শিক্ষিকা। এই প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা খুব মিশুক এবং বেঙত্কে নিয়ে বেশ গর্বিত। বেঙত্ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাউন্ডুলে জীবন শুরু করলেও কবি হওয়ার সুবাদে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে দুই বছর ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলো। পঞ্চম স্ত্রী নিয়ে এখন স্টকহোমবাসী। সুন্দর ছবি আঁকতে আর ভালো বাঁশি বাজাতে পারেন কবি বেঙত্্ বিয়র্কলুন্দ।

পরদিন সাতই অক্টোবর মঙ্গলবার উপসালার ব্ল্যাংকা থিয়েটারে সুইডেনের বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা দাগেনস নিহেতারের সাবেক প্রধান সম্পাদক-কবি অরনে রুথের সভাপতিত্বে বাংলা-নরডিক সাহিত্য সন্ধ্যায় কবিতাপাঠ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিই। এবার উপসালায় আমার মূল অনুষ্ঠান ছিলো এটি। অনুষ্ঠানে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার কবিদের মধ্যে নরওয়ের অসলো থেকে জন ওয়াই জোন্স, সুইডিশ কবি লার্স হেইগার, ম্যাগনাস দালেরুস এবং উপসালা প্রবাসী কবি আনিসুর রহমান ও শ্যামলী চক্রবর্তী অংশ নেন। সাহিত্যালোচনা পর্বটি খুব জমজমাট হয়েছিলো। বাঙালি কবিদের পাশাপশি বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার কবিদের অনুবাদ নিয়ে বলতে হয়েছিলো আমাকে। আমি সফোক্লিসের নাটক থেকে হোমার, শেক্সপিয়োর, কিটস্, ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট, দান্তে, ব্রেখট, দু ফু, লু শ্যুন, বোঁদলেয়ার, লুঁই আঁরাগো, র্যাঁবো, নাজিম হিকমাত, পাবলো নেরুদা, লোরকা, কাহলিল জিবরান, আলেক্সান্দর পুশকিন, মায়াকোভস্কি এবং ইবসেন, ট্রান্সট্রয়মার, মাহমুদ দারবিশ থেকে সমসাময়িক অসংখ্য অন্য ভাষার কবিদের বাংলা অনুবাদের কথা উল্লেখ করায় উপস্থিত সবাই বিস্মিত হলেন। আমার নরওয়ের লেখক-বন্ধু জন জোন্স বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা উৎসবে দেশ-বিদেশের কবিদের অংশগ্রহণের ছবিসহ তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করলে শ্রোতা-দর্শকরা চমকিত হলো। উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুপর্ণা স্যান্যাল ও বিপ্লব স্যান্যালের নেতৃত্বে তাঁদের সংগীতদলের গান পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে উপসালার ব্লাংকা থিয়েটারের মিলনমেলা শেষ করে আনিস, জন জোন্স ও আমি একাডেমি হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম। তখন ঠাণ্ডা মাইনাসে নামতে শুরু করেছে।

বিদায়বেলায়

পরদিন ৮ই অক্টোবর সকালে স্টকহোমের অরল্যান্ডো বিমানবন্দর থেকে অশ্রুসজল আনিসুর রহমান আমাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে তুলে দিলো। বিদায়বেলায় আনিসের পাশাপাশি আমার ভেজা চোখে ভেসে উঠলো কবিবন্ধু ক্রিস্টিয়ান কার্লসনের মুখ। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন বিমানবন্দর থেকে সুইডেনের ট্রনস; ট্রনস থেকে মালমো ও কোপেনহেগেন ভ্রমণে ক্রিস্টিয়ানের অক্লান্ত গাড়ি হাঁকানো, অন্তহীন আন্তরিকতা আর উদারহস্ত সহৃদয়তার মূল্য দেয়ার সামর্থ্য আমার কোনোদিন হবে কি! (সমাপ্ত)

রচনাকাল : ২০১৬, ঢাকা বিশ^দ্যিালয়