কান ডায়েরি : ওহ্ বাংলাদেশ

ব্যক্তিক অনুভবের নির্মেদ শিল্পভাষ্য

আল মাকসুদ

পার্থ সন্জয় পেশাদার সাংবাদিক। সাংবাদিক না বলে গণমাধ্যমকর্মী বললে সম্ভবত সুখকর শোনায়। সাংবাদিকই বলি আর গণমাধ্যমকর্মীই বলি এদের ভেতরে থাকে এক ধরনের অবসেশন। এটি ব্যাধির মতো শরীরে মনে ছড়িয়ে পড়ে। সিনে সাংবাদিকরা হয়তো একটু বেশি এ-ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত। পার্থ সিনে সাংবাদিক কি? না মনে হয়। তবে সিনেমাকেন্দ্রিক যে বৈশ্বিক-আয়োজন সেখানে তার অবাধ গমনাগমন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র উৎসবের ব্রডকাস্ট তার মাধ্যমেই হয়েছে বাংলাদেশে। ‘ফেস্তিভাল দো কান’ মানেই বিশ্বব্যাপী কানখাড়া করার মতো ব্যাপার। ইউরোপের ঝাঁ-চকচকে এক উপকূলীয় নগর ‘কান’। ওখানেই অনুষ্ঠিত হয় ‘আঁ সেরতা রোগার্দ’ প্রতিযোগিতা। পৃথিবীর হইচই করা চলচ্চিত্র উৎসবের নাম- ‘পালে দে ফেস্তিভাল’। পার্থের এ ফেস্তিভালে গতায়ত ২০১৭ থেকে। ২০২১ সালের গ্লোবাল প্যান্ডামিক পরিস্থিতিতে এই ফেস্তিভালে যোগদানও একটি খবর। খবরটি নিঃসন্দেহে প্রেস্টিজিয়াস। ‘পম দর’ বা ‘গোল্ডেন পাম’- এই স্বর্ণের পাম পাতা কে পাচ্ছেন, কারা পাচ্ছেন সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রপ্রেমীদের দারুণ ঔৎসুক্যের প্রসঙ্গ এটি। পার্থ যায় ফ্রান্সে, রিপোর্ট করে- যোগসূত্র তৈরি হয় দেশি-বিদেশি অসংখ্য সিনে সাংবাদিক, সেলিব্রেটিদের সঙ্গে। বিষয়টি মজার। ২০২১ সালের যোগদানটি শুধু মজার মাঝে সীমিত থাকেনি। বিস্ময় তৈরি করেছে। কারণ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নির্মিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ মুভিটি ‘আঁ সেরতা রোগার্দ’ বিভাগের বিশটি ছবির মাঝে একটি। দেশে চলছে মুজিবশতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অপরদিকে মহামারি ক্লান্ত সমগ্র পৃথিবী- তার মাঝে সহসা এমন একটি রোমাঞ্চকর সংবাদ ‘কান ফেস্তিভালে যোগদান’! অতএব সব মিলিয়ে শুভযোগ। পার্থও সে সুযোগ হাতছাড়া করেনি। তার কথা:

অভূতপূর্ব রোমাঞ্চভরা এবারের স্বপ্নিল অভিযাত্রা। সুবর্ণ পঁচিশটি দিন। পাওয়ার অনাবিল আনন্দের পাশাপাশি অপূর্ণ প্রত্যাশার বেদনা। সবটাই ইতিহাস। মনে জেগে উঠল সবটুকু সবার জন্য মেলে ধরবার অসীম বাসনা, সবাইকে দেশের অনন্য অর্জনকে অংশী করার তোলবার আকাক্সক্ষা। সে তাড়না থেকেই আমার দিনলিপির পাতা ওল্টানো শুরু, শুরু এর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পুনর্বয়ান।

গ্রন্থটির নামে ব্যবহার করা হয়েছে ডায়েরি শব্দটি, এ-জন্য বোধ করি পার্থ এখানে সাংবাদিকতা করেনি। সর্বত্র তার স্বভাবসুলভ কাব্যভাষা। বৃহৎ বাক্যকে এড়িয়ে যাওয়া; বর্ণনায় নিজকথার আড়ালে দেশের কথা বলে যাওয়ার কৌশল বিশেষ স্বাতন্ত্র্য বইকি। আজমেরী হক বাঁধন অভিনীত মুভিটি নিয়ে দেশীয় চ্যানেলে শিরোনাম হয়েছিলো- ‘বিশ্ব চলচ্চিত্রে মর্যাদার আসন, কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে বাংলাদেশের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। এখান থেকেই উত্তেজনা আর উদ্বেগের সূত্রপাত। সেলুলয়েডের কাহিনি যদিচ, তবুও প্রেস জোনের পেশাদারিত্বের সবকছিু কাভার করেও পার্থ সন্জয়ের বর্ণনায় বাদ পড়ে না অতিথি যাপন, ঝক্কিঝামেলা, বিদেশবিভুঁইয়ে বৃষ্টির গন্ধে ইলিশের ঝোল, পিকাসোর গ্রাম, ফরাসি ওয়াইন, ফোয়া গ্রার স্বাদ, জীবনের প্রথম ফ্রগ খাওয়ার অভিজ্ঞতা, চলচ্চিত্র পিপাসু উদ্যমী বাংলাদেশি তরুণদের স্বপ্ন ইত্যাদি। প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে আইএফআইবি-এর প্রেসিডেন্ট সামিয়া জামান আপার কথা; তিনিও আছেন দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রের সঙ্গেই। কান ফেস্তিভালে তাঁর নিয়মিত ভ্রমণ; বরাবর তিনিই মূলত বাংলাদেশিদের অভিভাবক কানে। বইটি পড়তে পড়তে খুব নিরিবিলি ঘুরে আসা যায় সৈকত নগরী কান থেকে পিকাসোর স্মৃতিধন্য গ্রাম ‘মুজাঁ’, এবং পারফিউম জগতের ক্যাপিটালখ্যাত ‘গ্রাস’ নগরী-সহ, ভিনসেন্ট ভ্যান গগের সমাধিস্থল ‘ওভে সুর ওয়াজ’ শহর অব্দি। বাদ পড়ে না বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মডেল ও অভিনেত্রী মিস আয়ারল্যান্ড মাকসুদা আকতার প্রিয়তির প্লেন চালিয়ে কানে যোগদানের হটনিউজটিও। জানা যাবে এ-কথাও, প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার তেমনি ঘটনার নেতিবাচক ঐতিহ্যও আছে কানে। তা হলো চুরির ঘটনা। বৃটিশ কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেত্রী জোডি টার্নার স্মিথের দশ হাজার ইউরো মূল্যের অলঙ্কার চুরি হয়ে যায় উৎসবের নিণ্ডিদ্র নিরাপত্তাকে ডিঙিয়ে! সর্ষেতে ভূত থাকার গল্প কেবল বাঙাল মুল্লুকেই রয়েছে এমন নয়। তথাকথিত সভ্য দেশেও আছে চোরের উৎপাত। গ্রন্থজুড়ে আছে কিছু স্থিরচিত্র যেখানে ফেস্তিভালের ছবি যেমন, তেমনি আছে নজরকাড়া পোশাকে সজ্জিত রেহানা চরিত্রে অভিনীত বাঁধনের লাস্যময়ী ছবি আর রেডকার্পেটে মোড়ানো ঝলমলে কানের উৎসবচিত্র। এসব কারণে গ্রন্থটি চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাইরের অন্যদেরকেও সমান আকর্ষণ করবে বলে মনে করি।

বর্ণনার পরিমিতিবোধ লেখকের শিল্পনৈপুণ্যকে চিহ্নিত করেছে দারুণভাবে। বিষয়কে ছাপিয়ে অবিষয় এসে যুক্ত হয়নি। অকারণ সময়ক্ষেপণও নেই কোথাও। মনে হয়েছে মাপা কথা বের করে মেসেজটা দিতে পারলে বাঁচা যায়। এতে পাঠমোহ বেড়েছে। দ্রুত শেষ করা যায়। আগ্রহের রেশ থেকে যায় পাঠান্তে। আরেকটু বিস্তৃত হলে কী ক্ষতি ছিলো ভাবনাটা এমন। এ-ও বলে রাখা উচিত গণপাঠকের বিবেচনায় এ গ্রন্থ লেখা হয়নি। আবার অতি বুধমণ্ডলীর জন্যেও নয়। এ এক শ্রেণির পাঠকের জন্য- যাদের সংবেদনশীল হৃদয়বৃত্তি আছে। নিতে চায় নতুন আলোর আস্বাদন। গ্রন্থটি বিভক্ত হয়েছে চমৎকার কিছু শিরোনামে ছোট ছোট অধ্যায়ে। প্রতিটি অধ্যায়ের বর্ণনা নাতিদীর্ঘ কিন্তু আকর্ষণীয়। পড়া শেষ হলে মনে হয়, ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ...’। দৃষ্টান্ত :

সন্ধ্যা। ১৭ জুলাই। ‘গ্রঁ তেয়াথ লুমিয়্যার’, ফ্রান্সের বাইরে যা গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়ের নামে সুপরিচিত। বিচারক প্যানেলের নেতা স্পাইক লি। একের পর এক রায় আসছে। [...] প্রেস জোনে জাপানি এক সাংবাদিকের উচ্ছ্বাস। তখনও ‘পাম দর’-এর ঘোষণা বাকি। উৎসুক হয়েই আলাপ করলাম সেই সাংবাদিকের সাথে। জানতে চাইল কোন দেশ থেকে এসেছি, বললাম, ‘বাংলাদেশ’। উত্তরে সুরেলা টান সাংবাদিকের কণ্ঠে, ‘ওহ্, বাংলাদেশ... রেহানা!

উৎসব মানেই সবকিছুতেই গা ভাসিয়ে দেয়া নয়। ফরাসিরা উন্নত জাতি। ভাষা হিশেবেও ফ্রেঞ্চ একটি এলিট ভাষা। জাত্যাভিমান তো আছেই। তার ওপরে আছে পরিবেশ সচেতনতা। করোনা থেকে নিরাপদ থাকতেই প্রেস জোনে ছিলো না কোনো কম্পিউটার। প্রত্যেককে নিজস্ব ল্যাপটপে কাজ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়তি সচেতনতা- যা উৎসবকেন্দ্রিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জন্যে পরিবেশ রক্ষায় দৃষ্টান্ত হতে পারে। লেখকের বর্ণনা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরা যায় :

[...] এবার ব্যাগের ভেতর শুধু দুইখান লিফলেট। কারণ? এবার নাকি বৃক্ষনিধন হ্রাসে ছাপা কাগজের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে পরিবেশ-সচেতন উৎসব কমিটি। [...] আগের উৎসবে সব মিলিয়ে ২২ হাজারের বেশি প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা হয়েছিল। এবার তাও কমিয়ে ফেলার লক্ষ্য। দোতলা প্রেস রুম বা চার তলায় সাংবাদিকদের তেরাজ, কোনোখানেই প্লাস্টিকের ব্যবহার নেই। খাবার পানির গ্লাস-স্ট্র সবই কাগজের তৈরি। এমনকি দৈর্ঘ্যে অর্ধেক করা ফেলা হয়েছে লাল গালিচা, তৈরি করা হয়েছে পুনর্ব্যবহার্য উপাদান দিয়ে। [...] উৎসবে তারকাদের পরিবহণের গাড়িগুলো ৬০ শতাংশই বিদ্যুৎচালিত। সবমিলিয়ে, পরিবেশবান্ধব উৎসব করতে কর্তৃপক্ষ শরণ নিয়েছে পরিবেশবাদী সংস্থা ‘গ্রিন এভেনমঁর’।

কিছু কিছু প্যাশন থাকে যা কিছু ব্যক্তির জন্যই নির্দিষ্ট হয়তো। সেখানে গল্প থাকে। থাকে শ্রম ও মেধার কাহিনি। নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিকের গল্প। দেশের জন্য কিছু করতে পারলেই উদ্বেলিত হয় হৃদয়মন। ওড়ে যায় কষ্টকথা, যাপিত ব্যথা ও বেদনা। পার্থ সে-রকম একজন। বিদেশের আকাশে উড়ে বেড়াবার অভিপ্রায় থেকে নয়, দেশকে তুলে ধরবার প্রয়াসে তার কানযাত্রা। সেখান থেকে দেশের জন্য কোনো সুখবর দিতে পারার আনন্দ অপরিমেয়। পার্থ পুরো গ্রন্থে সেই বিষয়টিকেই ফোকাস করতে সচেষ্ট হয়েছেন নিবিড় যতেœ। যেমন:

৫০ বছর ধরে এমন এক দিনের অপেক্ষায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। উৎসব পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমোর কণ্ঠে ৩রা জুন উচ্চারিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ আর বাংলাদেশ শব্দগুলো এর মধ্যেই গড়ে দিয়েছে ইতিহাস। [...] উত্তেজনাটা শিরায় শিরায় উপলব্ধি করছি। ‘আঁ সেরতা রোগার্দ’ বিভাগে ঠাঁই করে নেওয়া প্রথম বাংলাদেশি ছবির প্রদর্শনী ‘তেয়াথ ক্লোওদ দেবুসিতে’। থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা অ্যাজ লাইভ করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলাম।

শেষেরও থাকে শেষ। বেলাশেষে ফিরতে হয় স্বনীড়ে পাখিদের মতো। সবাইকেই। এই ফেরায় আন্দপালক ঝলমলিয়ে উঠবে কি না তা নিয়ে তো থাকেই সংশয়। ব্যস্ততা। ব্রিফিং; ছবি পরিচালক সাদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। প্রতীক্ষা সুবর্ণ সময়ের। অপেক্ষা কখনোই স্বস্তিদায়ক হয় না। উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় সারাক্ষণ। কী হবে? কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ? ইত্যাদি ভাবনা মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে থাকে মনে-মগজে। চিন্তারা ছুটি পায় না। ছড়িয়েছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে করে আনাগোনা। হৃদয়ে মোচড় দিয়ে ওঠে। জয়-পরাজয়ের খেলায় এ-পৃথিবীতে কে চায় হারতে? জয়মাল্যের শোভন মুহূর্তকে আলিঙ্গনের আকাক্সক্ষা সবার। পর্বটা স্বল্প। অপেক্ষা দীর্ঘতর। শেষ হতে চায় না। তবুও শেষটা দেখতে চাই। র‌্যাফেল ড্র’র প্রথম ও শেষ পুরস্কারের নাম্বার নিশ্চয় আমারটাই হবে। এমনতর ভাবনা। যদিও এমন ভাবনার মাঝে অবাস্তবতা থাকে। কিন্তু ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ নিয়ে ইতোমধ্যে কানাঘুষা হয়েছে ভীষণ; সবারই হাস্যোজ্জ্বল মন্তব্য... ‘ইট ওয়াজ কমিউনিকেটিভ’। ‘ইট ওয়াজ এন অ্যামেইজিং মুভি উইথ স্ট্রং মেসেজ’। ‘এটা শুধু বাংলাদেশেরই গল্প না। এটা আমাদের গল্প, আমারও গল্প’। ‘ছবিটির স্ক্রিপ্ট অসাধারণ। আমার খুব ভালো লেগেছে। বিষয়বস্তু বৈশ্বিক আর চিরন্তন’। বিশ্বখ্যাত গুণী চলচ্চিত্র সমালোচকদের এমন অসংখ্য মন্তব্যে ঠাসা ছবিটি নিয়ে আশাজাগানিয়া উৎকণ্ঠা তৈরি হবে তাতে বিস্ময়ের কী আছে।

গ্রন্থটির প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনামে আছে নিজস্বতা। মুগ্ধতার বয়ান। পার্থের ব্যক্তিগত স্মার্টনেস লেখাকে আরো বেশি স্মার্ট করেছে। অহেতুক বর্ণনায় ভারী করে তোলার কোনো চাতুর্যের আশ্রয় কোথাও খুঁেজ পাওয়া যায় না। মেদহীন বর্ণনা। আত্মিক সম্পর্কায়নের কথা যেটুকু এসেছে তা-ও দেশকেই রিপ্রেজেন্ট করেছে। ৮৫ পৃষ্ঠার ২০ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বেলা শেষের গান’। কানের ৭৪তম আসরের শেষ কথা। অপেক্ষমাণ এ মুহূর্তের বর্ণনা লেখকের ভাষায় শোনা যাক :

[...] “প্রেসজোনে পা রাখতেই টের পাওয়া যাচ্ছে গনগনে উত্তেজনাটা। [...] তারপর একে একে আসতে থাকল ঘোষণা। জুরি প্রাইজ, সেরা পরিচালক, অভিনেতা। প্রত্যেকটা ঘোষণার আগে, এই বুঝি বলছে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর নাম। সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নিল রাশিয়ার নারী নির্মাতা কিরা কোভালেনকার ‘আনক্লেনচিং দ্য ফিস্টস’। [...] দর্শক অভিনন্দনে ¯œাত বিজয়ীরা। কোথাও নেই ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। বাংলাদেশে তখন রাত গড়িয়েছে। নিউজরুম জেনে গেছে, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর কিছুই না পাওয়ার খবর। [...] হতাশা লুকিয়ে ব্যস্ত হলাম পেশাগত নির্লিপ্ততায়।”

গ্রন্থটি গল্প কিংবা কবিতার নয়। একটি বিশেষ মুভিকে কেন্দ্র করে লেখকের কানযাত্রার ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে এখানে। কান উৎসব পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্র উৎসবের একটি। এখানে জমে থাকা শিশিরকণা যত সুন্দর আর ভিন্নতা নিয়েই দৃশ্যমান হোক না, তা কেবল চলচ্চিত্রের কথাই বলে। কিন্তু পার্থ চলচ্চিত্রের কথা বলতে বলতে বিচিত্র অনুষঙ্গকে একত্র করে নির্মাণ করেছে অভিজ্ঞতার এক অসাধারণ দিনলিপি- তাতে প্রাণের অভিব্যক্তি পেয়েছে ভিন্নতর ভাষা ও প্রতিবেশ। সময়ের যাপিত অধ্যায় জলজ আর্দ্রতায় পাঠককে ভ্রামণিক আনন্দের পাঠ দেবে যেমন, তেমনি ভাষা ও শব্দবুননে লেখকের কারুদক্ষতায় এই গ্রন্থটি নতুন কিছু দেবার পথ খোলা রেখেছে। পার্থ সন্জয়-এর লেখালেখির অভ্যাস ছাত্রজীবন থেকে থাকলেও গ্রন্থিত কোনো বইয়ের প্রথম দৃষ্টান্ত বোধ করি এটিই। হয়তো আরো ভালো হতো যদি এ্যালবাম অংশটাকে ভিন্ন একটি অধ্যায়ে উপস্থাপন করা যেত। অথবা প্রতিটি ছবির ক্যাপশনে উপস্থিত ব্যক্তিদের পরিচয় তুলে ধরা হলে সহজেই চেনা যেত অনেককেই। গ্রন্থের শেষাংশে পুনশ্চ-২কে এই খেরোখাতার প্রাসঙ্গিক-সৌন্দর্য মনে হয়েছে। এখানে এ-কথাও বলা আবশ্যক মনে করি এ গ্রন্থ পাঠান্তে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ মুভিটি দেখা, রেহানার নৈতিক লড়াই, কেন এটি সমালোচকের চোখে একটি ‘স্ট্রং মেসেজের মুভি’ মনে হয়েছে ইত্যাদি সম্পর্কে ঔৎসুক্য তৈরি হবে পাঠকের। ছবিটির কোথায় কী ঐশ্বর্য আছে তা জানতে ও তার রিভিউ পাঠে পাঠক আগ্রহী হবে এ-বিষয়েও আমি নিঃসন্দিগ্ধ। গ্রন্থটির মুদ্রণ, বানান ও প্রকরণ প্রশংসনীয়। মুদ্রণত্রুটি নেই বললেই চলে। গ্রন্থটি পাঠক মান্যতা পাবে তার স্বগুণেই এ বিশ্বাস রাখি।

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

কান ডায়েরি : ওহ্ বাংলাদেশ

ব্যক্তিক অনুভবের নির্মেদ শিল্পভাষ্য

আল মাকসুদ

image

পার্থ সন্জয় পেশাদার সাংবাদিক। সাংবাদিক না বলে গণমাধ্যমকর্মী বললে সম্ভবত সুখকর শোনায়। সাংবাদিকই বলি আর গণমাধ্যমকর্মীই বলি এদের ভেতরে থাকে এক ধরনের অবসেশন। এটি ব্যাধির মতো শরীরে মনে ছড়িয়ে পড়ে। সিনে সাংবাদিকরা হয়তো একটু বেশি এ-ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত। পার্থ সিনে সাংবাদিক কি? না মনে হয়। তবে সিনেমাকেন্দ্রিক যে বৈশ্বিক-আয়োজন সেখানে তার অবাধ গমনাগমন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র উৎসবের ব্রডকাস্ট তার মাধ্যমেই হয়েছে বাংলাদেশে। ‘ফেস্তিভাল দো কান’ মানেই বিশ্বব্যাপী কানখাড়া করার মতো ব্যাপার। ইউরোপের ঝাঁ-চকচকে এক উপকূলীয় নগর ‘কান’। ওখানেই অনুষ্ঠিত হয় ‘আঁ সেরতা রোগার্দ’ প্রতিযোগিতা। পৃথিবীর হইচই করা চলচ্চিত্র উৎসবের নাম- ‘পালে দে ফেস্তিভাল’। পার্থের এ ফেস্তিভালে গতায়ত ২০১৭ থেকে। ২০২১ সালের গ্লোবাল প্যান্ডামিক পরিস্থিতিতে এই ফেস্তিভালে যোগদানও একটি খবর। খবরটি নিঃসন্দেহে প্রেস্টিজিয়াস। ‘পম দর’ বা ‘গোল্ডেন পাম’- এই স্বর্ণের পাম পাতা কে পাচ্ছেন, কারা পাচ্ছেন সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রপ্রেমীদের দারুণ ঔৎসুক্যের প্রসঙ্গ এটি। পার্থ যায় ফ্রান্সে, রিপোর্ট করে- যোগসূত্র তৈরি হয় দেশি-বিদেশি অসংখ্য সিনে সাংবাদিক, সেলিব্রেটিদের সঙ্গে। বিষয়টি মজার। ২০২১ সালের যোগদানটি শুধু মজার মাঝে সীমিত থাকেনি। বিস্ময় তৈরি করেছে। কারণ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নির্মিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ মুভিটি ‘আঁ সেরতা রোগার্দ’ বিভাগের বিশটি ছবির মাঝে একটি। দেশে চলছে মুজিবশতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অপরদিকে মহামারি ক্লান্ত সমগ্র পৃথিবী- তার মাঝে সহসা এমন একটি রোমাঞ্চকর সংবাদ ‘কান ফেস্তিভালে যোগদান’! অতএব সব মিলিয়ে শুভযোগ। পার্থও সে সুযোগ হাতছাড়া করেনি। তার কথা:

অভূতপূর্ব রোমাঞ্চভরা এবারের স্বপ্নিল অভিযাত্রা। সুবর্ণ পঁচিশটি দিন। পাওয়ার অনাবিল আনন্দের পাশাপাশি অপূর্ণ প্রত্যাশার বেদনা। সবটাই ইতিহাস। মনে জেগে উঠল সবটুকু সবার জন্য মেলে ধরবার অসীম বাসনা, সবাইকে দেশের অনন্য অর্জনকে অংশী করার তোলবার আকাক্সক্ষা। সে তাড়না থেকেই আমার দিনলিপির পাতা ওল্টানো শুরু, শুরু এর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পুনর্বয়ান।

গ্রন্থটির নামে ব্যবহার করা হয়েছে ডায়েরি শব্দটি, এ-জন্য বোধ করি পার্থ এখানে সাংবাদিকতা করেনি। সর্বত্র তার স্বভাবসুলভ কাব্যভাষা। বৃহৎ বাক্যকে এড়িয়ে যাওয়া; বর্ণনায় নিজকথার আড়ালে দেশের কথা বলে যাওয়ার কৌশল বিশেষ স্বাতন্ত্র্য বইকি। আজমেরী হক বাঁধন অভিনীত মুভিটি নিয়ে দেশীয় চ্যানেলে শিরোনাম হয়েছিলো- ‘বিশ্ব চলচ্চিত্রে মর্যাদার আসন, কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে বাংলাদেশের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। এখান থেকেই উত্তেজনা আর উদ্বেগের সূত্রপাত। সেলুলয়েডের কাহিনি যদিচ, তবুও প্রেস জোনের পেশাদারিত্বের সবকছিু কাভার করেও পার্থ সন্জয়ের বর্ণনায় বাদ পড়ে না অতিথি যাপন, ঝক্কিঝামেলা, বিদেশবিভুঁইয়ে বৃষ্টির গন্ধে ইলিশের ঝোল, পিকাসোর গ্রাম, ফরাসি ওয়াইন, ফোয়া গ্রার স্বাদ, জীবনের প্রথম ফ্রগ খাওয়ার অভিজ্ঞতা, চলচ্চিত্র পিপাসু উদ্যমী বাংলাদেশি তরুণদের স্বপ্ন ইত্যাদি। প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে আইএফআইবি-এর প্রেসিডেন্ট সামিয়া জামান আপার কথা; তিনিও আছেন দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রের সঙ্গেই। কান ফেস্তিভালে তাঁর নিয়মিত ভ্রমণ; বরাবর তিনিই মূলত বাংলাদেশিদের অভিভাবক কানে। বইটি পড়তে পড়তে খুব নিরিবিলি ঘুরে আসা যায় সৈকত নগরী কান থেকে পিকাসোর স্মৃতিধন্য গ্রাম ‘মুজাঁ’, এবং পারফিউম জগতের ক্যাপিটালখ্যাত ‘গ্রাস’ নগরী-সহ, ভিনসেন্ট ভ্যান গগের সমাধিস্থল ‘ওভে সুর ওয়াজ’ শহর অব্দি। বাদ পড়ে না বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মডেল ও অভিনেত্রী মিস আয়ারল্যান্ড মাকসুদা আকতার প্রিয়তির প্লেন চালিয়ে কানে যোগদানের হটনিউজটিও। জানা যাবে এ-কথাও, প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার তেমনি ঘটনার নেতিবাচক ঐতিহ্যও আছে কানে। তা হলো চুরির ঘটনা। বৃটিশ কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেত্রী জোডি টার্নার স্মিথের দশ হাজার ইউরো মূল্যের অলঙ্কার চুরি হয়ে যায় উৎসবের নিণ্ডিদ্র নিরাপত্তাকে ডিঙিয়ে! সর্ষেতে ভূত থাকার গল্প কেবল বাঙাল মুল্লুকেই রয়েছে এমন নয়। তথাকথিত সভ্য দেশেও আছে চোরের উৎপাত। গ্রন্থজুড়ে আছে কিছু স্থিরচিত্র যেখানে ফেস্তিভালের ছবি যেমন, তেমনি আছে নজরকাড়া পোশাকে সজ্জিত রেহানা চরিত্রে অভিনীত বাঁধনের লাস্যময়ী ছবি আর রেডকার্পেটে মোড়ানো ঝলমলে কানের উৎসবচিত্র। এসব কারণে গ্রন্থটি চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাইরের অন্যদেরকেও সমান আকর্ষণ করবে বলে মনে করি।

বর্ণনার পরিমিতিবোধ লেখকের শিল্পনৈপুণ্যকে চিহ্নিত করেছে দারুণভাবে। বিষয়কে ছাপিয়ে অবিষয় এসে যুক্ত হয়নি। অকারণ সময়ক্ষেপণও নেই কোথাও। মনে হয়েছে মাপা কথা বের করে মেসেজটা দিতে পারলে বাঁচা যায়। এতে পাঠমোহ বেড়েছে। দ্রুত শেষ করা যায়। আগ্রহের রেশ থেকে যায় পাঠান্তে। আরেকটু বিস্তৃত হলে কী ক্ষতি ছিলো ভাবনাটা এমন। এ-ও বলে রাখা উচিত গণপাঠকের বিবেচনায় এ গ্রন্থ লেখা হয়নি। আবার অতি বুধমণ্ডলীর জন্যেও নয়। এ এক শ্রেণির পাঠকের জন্য- যাদের সংবেদনশীল হৃদয়বৃত্তি আছে। নিতে চায় নতুন আলোর আস্বাদন। গ্রন্থটি বিভক্ত হয়েছে চমৎকার কিছু শিরোনামে ছোট ছোট অধ্যায়ে। প্রতিটি অধ্যায়ের বর্ণনা নাতিদীর্ঘ কিন্তু আকর্ষণীয়। পড়া শেষ হলে মনে হয়, ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ...’। দৃষ্টান্ত :

সন্ধ্যা। ১৭ জুলাই। ‘গ্রঁ তেয়াথ লুমিয়্যার’, ফ্রান্সের বাইরে যা গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়ের নামে সুপরিচিত। বিচারক প্যানেলের নেতা স্পাইক লি। একের পর এক রায় আসছে। [...] প্রেস জোনে জাপানি এক সাংবাদিকের উচ্ছ্বাস। তখনও ‘পাম দর’-এর ঘোষণা বাকি। উৎসুক হয়েই আলাপ করলাম সেই সাংবাদিকের সাথে। জানতে চাইল কোন দেশ থেকে এসেছি, বললাম, ‘বাংলাদেশ’। উত্তরে সুরেলা টান সাংবাদিকের কণ্ঠে, ‘ওহ্, বাংলাদেশ... রেহানা!

উৎসব মানেই সবকিছুতেই গা ভাসিয়ে দেয়া নয়। ফরাসিরা উন্নত জাতি। ভাষা হিশেবেও ফ্রেঞ্চ একটি এলিট ভাষা। জাত্যাভিমান তো আছেই। তার ওপরে আছে পরিবেশ সচেতনতা। করোনা থেকে নিরাপদ থাকতেই প্রেস জোনে ছিলো না কোনো কম্পিউটার। প্রত্যেককে নিজস্ব ল্যাপটপে কাজ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়তি সচেতনতা- যা উৎসবকেন্দ্রিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জন্যে পরিবেশ রক্ষায় দৃষ্টান্ত হতে পারে। লেখকের বর্ণনা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরা যায় :

[...] এবার ব্যাগের ভেতর শুধু দুইখান লিফলেট। কারণ? এবার নাকি বৃক্ষনিধন হ্রাসে ছাপা কাগজের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে পরিবেশ-সচেতন উৎসব কমিটি। [...] আগের উৎসবে সব মিলিয়ে ২২ হাজারের বেশি প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা হয়েছিল। এবার তাও কমিয়ে ফেলার লক্ষ্য। দোতলা প্রেস রুম বা চার তলায় সাংবাদিকদের তেরাজ, কোনোখানেই প্লাস্টিকের ব্যবহার নেই। খাবার পানির গ্লাস-স্ট্র সবই কাগজের তৈরি। এমনকি দৈর্ঘ্যে অর্ধেক করা ফেলা হয়েছে লাল গালিচা, তৈরি করা হয়েছে পুনর্ব্যবহার্য উপাদান দিয়ে। [...] উৎসবে তারকাদের পরিবহণের গাড়িগুলো ৬০ শতাংশই বিদ্যুৎচালিত। সবমিলিয়ে, পরিবেশবান্ধব উৎসব করতে কর্তৃপক্ষ শরণ নিয়েছে পরিবেশবাদী সংস্থা ‘গ্রিন এভেনমঁর’।

কিছু কিছু প্যাশন থাকে যা কিছু ব্যক্তির জন্যই নির্দিষ্ট হয়তো। সেখানে গল্প থাকে। থাকে শ্রম ও মেধার কাহিনি। নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিকের গল্প। দেশের জন্য কিছু করতে পারলেই উদ্বেলিত হয় হৃদয়মন। ওড়ে যায় কষ্টকথা, যাপিত ব্যথা ও বেদনা। পার্থ সে-রকম একজন। বিদেশের আকাশে উড়ে বেড়াবার অভিপ্রায় থেকে নয়, দেশকে তুলে ধরবার প্রয়াসে তার কানযাত্রা। সেখান থেকে দেশের জন্য কোনো সুখবর দিতে পারার আনন্দ অপরিমেয়। পার্থ পুরো গ্রন্থে সেই বিষয়টিকেই ফোকাস করতে সচেষ্ট হয়েছেন নিবিড় যতেœ। যেমন:

৫০ বছর ধরে এমন এক দিনের অপেক্ষায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। উৎসব পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমোর কণ্ঠে ৩রা জুন উচ্চারিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ আর বাংলাদেশ শব্দগুলো এর মধ্যেই গড়ে দিয়েছে ইতিহাস। [...] উত্তেজনাটা শিরায় শিরায় উপলব্ধি করছি। ‘আঁ সেরতা রোগার্দ’ বিভাগে ঠাঁই করে নেওয়া প্রথম বাংলাদেশি ছবির প্রদর্শনী ‘তেয়াথ ক্লোওদ দেবুসিতে’। থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা অ্যাজ লাইভ করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলাম।

শেষেরও থাকে শেষ। বেলাশেষে ফিরতে হয় স্বনীড়ে পাখিদের মতো। সবাইকেই। এই ফেরায় আন্দপালক ঝলমলিয়ে উঠবে কি না তা নিয়ে তো থাকেই সংশয়। ব্যস্ততা। ব্রিফিং; ছবি পরিচালক সাদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। প্রতীক্ষা সুবর্ণ সময়ের। অপেক্ষা কখনোই স্বস্তিদায়ক হয় না। উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় সারাক্ষণ। কী হবে? কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ? ইত্যাদি ভাবনা মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে থাকে মনে-মগজে। চিন্তারা ছুটি পায় না। ছড়িয়েছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে করে আনাগোনা। হৃদয়ে মোচড় দিয়ে ওঠে। জয়-পরাজয়ের খেলায় এ-পৃথিবীতে কে চায় হারতে? জয়মাল্যের শোভন মুহূর্তকে আলিঙ্গনের আকাক্সক্ষা সবার। পর্বটা স্বল্প। অপেক্ষা দীর্ঘতর। শেষ হতে চায় না। তবুও শেষটা দেখতে চাই। র‌্যাফেল ড্র’র প্রথম ও শেষ পুরস্কারের নাম্বার নিশ্চয় আমারটাই হবে। এমনতর ভাবনা। যদিও এমন ভাবনার মাঝে অবাস্তবতা থাকে। কিন্তু ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ নিয়ে ইতোমধ্যে কানাঘুষা হয়েছে ভীষণ; সবারই হাস্যোজ্জ্বল মন্তব্য... ‘ইট ওয়াজ কমিউনিকেটিভ’। ‘ইট ওয়াজ এন অ্যামেইজিং মুভি উইথ স্ট্রং মেসেজ’। ‘এটা শুধু বাংলাদেশেরই গল্প না। এটা আমাদের গল্প, আমারও গল্প’। ‘ছবিটির স্ক্রিপ্ট অসাধারণ। আমার খুব ভালো লেগেছে। বিষয়বস্তু বৈশ্বিক আর চিরন্তন’। বিশ্বখ্যাত গুণী চলচ্চিত্র সমালোচকদের এমন অসংখ্য মন্তব্যে ঠাসা ছবিটি নিয়ে আশাজাগানিয়া উৎকণ্ঠা তৈরি হবে তাতে বিস্ময়ের কী আছে।

গ্রন্থটির প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনামে আছে নিজস্বতা। মুগ্ধতার বয়ান। পার্থের ব্যক্তিগত স্মার্টনেস লেখাকে আরো বেশি স্মার্ট করেছে। অহেতুক বর্ণনায় ভারী করে তোলার কোনো চাতুর্যের আশ্রয় কোথাও খুঁেজ পাওয়া যায় না। মেদহীন বর্ণনা। আত্মিক সম্পর্কায়নের কথা যেটুকু এসেছে তা-ও দেশকেই রিপ্রেজেন্ট করেছে। ৮৫ পৃষ্ঠার ২০ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বেলা শেষের গান’। কানের ৭৪তম আসরের শেষ কথা। অপেক্ষমাণ এ মুহূর্তের বর্ণনা লেখকের ভাষায় শোনা যাক :

[...] “প্রেসজোনে পা রাখতেই টের পাওয়া যাচ্ছে গনগনে উত্তেজনাটা। [...] তারপর একে একে আসতে থাকল ঘোষণা। জুরি প্রাইজ, সেরা পরিচালক, অভিনেতা। প্রত্যেকটা ঘোষণার আগে, এই বুঝি বলছে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর নাম। সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নিল রাশিয়ার নারী নির্মাতা কিরা কোভালেনকার ‘আনক্লেনচিং দ্য ফিস্টস’। [...] দর্শক অভিনন্দনে ¯œাত বিজয়ীরা। কোথাও নেই ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। বাংলাদেশে তখন রাত গড়িয়েছে। নিউজরুম জেনে গেছে, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর কিছুই না পাওয়ার খবর। [...] হতাশা লুকিয়ে ব্যস্ত হলাম পেশাগত নির্লিপ্ততায়।”

গ্রন্থটি গল্প কিংবা কবিতার নয়। একটি বিশেষ মুভিকে কেন্দ্র করে লেখকের কানযাত্রার ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে এখানে। কান উৎসব পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্র উৎসবের একটি। এখানে জমে থাকা শিশিরকণা যত সুন্দর আর ভিন্নতা নিয়েই দৃশ্যমান হোক না, তা কেবল চলচ্চিত্রের কথাই বলে। কিন্তু পার্থ চলচ্চিত্রের কথা বলতে বলতে বিচিত্র অনুষঙ্গকে একত্র করে নির্মাণ করেছে অভিজ্ঞতার এক অসাধারণ দিনলিপি- তাতে প্রাণের অভিব্যক্তি পেয়েছে ভিন্নতর ভাষা ও প্রতিবেশ। সময়ের যাপিত অধ্যায় জলজ আর্দ্রতায় পাঠককে ভ্রামণিক আনন্দের পাঠ দেবে যেমন, তেমনি ভাষা ও শব্দবুননে লেখকের কারুদক্ষতায় এই গ্রন্থটি নতুন কিছু দেবার পথ খোলা রেখেছে। পার্থ সন্জয়-এর লেখালেখির অভ্যাস ছাত্রজীবন থেকে থাকলেও গ্রন্থিত কোনো বইয়ের প্রথম দৃষ্টান্ত বোধ করি এটিই। হয়তো আরো ভালো হতো যদি এ্যালবাম অংশটাকে ভিন্ন একটি অধ্যায়ে উপস্থাপন করা যেত। অথবা প্রতিটি ছবির ক্যাপশনে উপস্থিত ব্যক্তিদের পরিচয় তুলে ধরা হলে সহজেই চেনা যেত অনেককেই। গ্রন্থের শেষাংশে পুনশ্চ-২কে এই খেরোখাতার প্রাসঙ্গিক-সৌন্দর্য মনে হয়েছে। এখানে এ-কথাও বলা আবশ্যক মনে করি এ গ্রন্থ পাঠান্তে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ মুভিটি দেখা, রেহানার নৈতিক লড়াই, কেন এটি সমালোচকের চোখে একটি ‘স্ট্রং মেসেজের মুভি’ মনে হয়েছে ইত্যাদি সম্পর্কে ঔৎসুক্য তৈরি হবে পাঠকের। ছবিটির কোথায় কী ঐশ্বর্য আছে তা জানতে ও তার রিভিউ পাঠে পাঠক আগ্রহী হবে এ-বিষয়েও আমি নিঃসন্দিগ্ধ। গ্রন্থটির মুদ্রণ, বানান ও প্রকরণ প্রশংসনীয়। মুদ্রণত্রুটি নেই বললেই চলে। গ্রন্থটি পাঠক মান্যতা পাবে তার স্বগুণেই এ বিশ্বাস রাখি।