ধারাবাহিক উপন্যাস : চল্লিশ

শিকিবু

আবুল কাসেম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঊনআশি.

সম্রাট ইচিজোর দরবারে বিশাল এক সভা বসেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা আছেন, দরবারি অন্যসব অমাত্যরা আছেন, আছেন রাজকীয় সাহিত্য আকাদেমির কর্মকর্তা এবং সমকালীন খ্যাতিমান কবি-লেখকেরা।

সভায় প্রধান আলোচ্য বিষয় রাজকীয় কবিতা সংকলন। বেশ বড় এক কার্যপত্র নিয়ে বসে আছেন সভা কবি ফুজিওয়ারা-নো-কিন্তু। কবিদের সারিতে অন্যান্যের সঙ্গে আছেন ইমন, সেই শোনাগন, মুরাসাকি এবং ইঝোমি।

সম্রাট এলেন, দরবার শুরু হলো। কিন্তু অনুমতি নিয়ে তার বক্তব্য পেশ করছেন। তিনি বললেন, একটা প্রাথমিক নির্বাচনী সভা হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়। ঐ সভায় তার নির্দেশনায় কবিদের একটি খসড়া তালিকা এবং কবিতার সম্ভাব্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।

তাকে থামিয়ে প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা বললেন, তুমি থামো। আমি বলছি। সম্রাটের আদেশ পেয়ে কিন্তু ছুটে আসে আমার কাছে। আমি রাজকীয় সাহিত্য আকাদেমির লোকজন, সাহিত্যানুরাগী এবং বিশেষ কবিদের নিয়ে বসি। সেখানে ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়। সবাই মিলে কবি এবং কবিতার একটি তালিকা খসড়া আকারে চূড়ান্ত নির্বাচনের জন্য সম্রাটের দরবারে পেশ করতে বলি। সম্রাট কাঝানের সময়ে একটি সংকলন হয়েছে। তা সম্পূর্ণ নয় এবং তা কীভাবে করা হয়েছে অনেকেই জানেন। সভাকবি তখনও ছিল। আমি বলেছি, সে সময়কার কবিকে বাদ দেয়া যাবে না, তাদের নতুন বা অন্য কবিতা নির্বাচন করতে হবে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে দুটি সংকলনে একই কবিতা স্থান পেলে এখনকার সংকলন প্রকাশের গুরুত্ব থাকে না।

সম্রাট বললেন, মাননীয় মহামন্ত্রীর কথায় যুক্তি আছে। ঐ সভায় আলোচনা সম্পর্কে সেই শোনাগন আমাকে বলেছে।

একথা শুনে সবাই শোনাগনের দিকে তাকালেন। প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেই অবাক হলেন। ব্যাপারটা হলো এই যে, শোনাগন সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন এসব কথা বলেন। সম্রাট আবার বললেন, কিন্তু নাকি যাদের গুরুত্বহীন মনে করেছে তাদেরও কবি তালিকায় আনা হয়েছে। শোনাগনের তাতে আপত্তি আছে।

মহামান্য সম্রাটের কথা শেষ হলে আবার আমাকে কথা বলতে হবে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে হবে। বললেন মিচিনাগা।

সম্রাট কথা শেষ না করে বললেন, আপনি বলুন। আমরা শুনতে চাই।

সভায় মোটামুটি কবিদের সবাই উপস্থিত ছিল। উপস্থিত ছিল না তাকাকু। কিন্তু কি কারণ জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘তিনি তো মনোগাতারি লেখেন, কবি না।’ আমি তার কাছে জানতে চাইলাম ‘গেঞ্জি’ মনোগাতারিতে কতগুলো কবিতা আছে। আমি তাকে সংকলনে তাকাকুর কবিতা অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছি।

সম্রাট বললেন, তাকাকুকে আমি ভালোভাবে চিনি। তার কবিতা তার মুখে শুনেছি- আমার বেশ মনে আছে। একটা মিথ্যে অনুযোগের ভিত্তিতে ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’ বিষয়ে কথা বলতে তাকে দরবারে ডেকে পাঠানো হয়। সে অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ের কবি এবং লেখিকা। মাননীয় মন্ত্রীর নির্বাচন ঠিক আছে। বরং সভাকবি ভুল করেছিল।

কিন্তু এবারে কবিতা সংকলনটির কাঠামো এবং বিন্যায় নিয়ে কথা বললেন।

মিচিনাগা বললেন, প্রায় তিন হাজার কবিতার সংকলন এটি। তার আঙ্গিক, বিন্যাস এবং লিপিকরণ দীর্ঘ, কিন্তু নান্দনিক হওয়া দরকার। পাশাপাশি চিত্রাংকন ও অলংকরণের ব্যাপারটিও এসে যায়। যারা লিপিকরণে সিদ্ধ এবং অলংকরণ বা ছবি আঁকাতে পারদর্শী সমকালীন সেসব কবিদের কবিতা অন্য লিপিকরদের দিয়ে লিপিকরণের প্রয়োজন নেই।

সম্রাট বললেন, ঠিক বলেছেন। তাদের হাতের লেখা সংকলনটির গৌরব বৃদ্ধি করবে।

শোনাগন দেখলেন, এখানেও মুরাসাকিই গুরুত্ব পাচ্ছেন। কারণ তিনি ক্যালিগ্রাফি, চিত্রাংকন এবং অলংকরণে সিদ্ধ। বললেন, সবটা সংকলন একই রকম হওয়া ভালো নয়?

কিন্তু যোগ করলেন, এরকমটি আগে কখনো হয়নি। সম্রাট বললেন, আমি বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী। যা বলেছি তাই করো।

তামেতোকি ইচিগো প্রদেশ থেকে এসেছেন। তিনি রাজকীয় সাহিত্য আকাদেমির সম্মানিত সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি আঙ্গিক সম্পর্কে কিছু বলতে চান। সম্রাট বললেন বলুন আপনি।

তামেতোকি বললেন, সংকলনটি রাজকীয়। হেইয়ান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সাহিত্যানুরাগী সম্রাট তা প্রকাশ করছেন, তাই তা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্চনীয়। এর বাহ্যিক সৌকর্য নিয়ে নিশ্চয়ই প্রচ্ছদ শিল্প ভাববেন। ভেতরকার সাজসজ্জাও এরকম শিল্পীরাই করবেন। কাঠামোগতভাবে কয়েকটি বিষয় বিন্যাসের কথা আমরা বলতে পারি। কবিতাগুলোকে বিষয়ভিত্তিক সাজাবার পরামর্শ আমার। ঋতুভেদে রচিত হয়েছে নানা কবিতা, যেমন: বসন্তের কবিতা, গ্রীষ্মের কবিতা, শরতের কবিতা ইত্যাদি। আবার রয়েছে ভ্রমণের কবিতা, অভিনন্দনের কবিতা, প্রেমের কবিতা, ইতিহাস ঐতিহ্যভিত্তিক কবিতা, ধাঁধাঁ জাতীয়, শোকের কবিতা, বিবিধ কবিতা প্রভৃতি। প্রতিটি কবিতার ওপর কবির পরিচিতি থাকতে পারে। সংক্ষিপ্তভাবে দু’তিন বাক্যে।

সভাকবি কিন্তু বললেন, এসব ঝামেলা না করেই দুই খ- বা ভাগে ছেপে দেয়াই ভালো প্রাচীন ও বর্তমানকালে কবিতা।

মিচিনাগা বললেন, অনেকগুণের অধিকারী গভর্নর তামেতোকি। কবি, চীনা সাহিত্য প-িত, আকাদেমির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি যা বলেছেন, তা-ই যথাযথ।

সম্রাট বললেন আমারও এই মত।

পা-ুলিপি তৈরিতে প্রচুর সময় লাগবে।

লাগুক, আমরা তো প্রতিদিন সংকলন করবো না।

মিচিনাগা বললেন, মহামান্য সম্রাট ঠিকই বলেছেন।

সাহিত্য আকাদেমিকে একাজের সঙ্গে যুক্ত করা হলো।

কিন্তু বললেন, নাম, নাম কী হবে?

সম্রাট বললেন, আগে পা-ুলিপির রূপরেখা তেরি কর। এই

সময় আমি কিছুটা ভেবে নিই।

সভা শেষে শোনাগন সভাকবি কিন্তুর দপ্তরে গেলেন। তাঁদের ইচ্ছার বাইরে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গেছে। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার কোনো সুযোগ সম্রাটের দরবারে নেই। তাই এরা নিজেদের মধ্যেই চাপা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটালেন। কিন্তু বললেন, তুমি সম্রাটকে কীভাবে বলেছ যে, সম্রাট তা বলে দিলেন সবার সামনে।

আমি বড় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। ভাবতেও পারিনি সম্রাট হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবেন। সংকলনে অহংকারী মেয়ে তাকাকু থাকছেই।

প্রধানমন্ত্রীর অনুগ্রহ রয়েছে তার প্রতি।

আপনার সঙ্গেও তো ভালো ব্যবহার করেনি।

আমি বলেছিলাম, তোমার ‘গেঞ্জি’তে দরবারের কে কে আছে? সে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, কেউ না।

আমি কী প্রমাণ করে দেব, কে কে আছে? বিরাট কৃতিত্বের দাবিদার তিনি। সম্রাট সাহিত্যের কী বোঝেন?

এখন কী করতে চান?

ভাবতে দাও। রাজকীয় কাব্য সংকলন! হিমাগারে পাঠাব আমি একে।

তাই ভালো হবে। সানজু ক্ষমতায় এলে আমরা তা আমাদের মতো করে প্রকাশ করবো। শুধু কবিতা না, তখন আমার গদ্য লেখাও স্থান করে দিতে হবে।

তুমি আবার এসব সম্রাটকে বলে দিও না।

আরে না। মানুষ বোকামি একবার করে, বারবার না।

এদিকে মিচিনাগা তার দপ্তরে ইমন, মুরাসাকি এবং ইঝোমিকে নিয়ে বসলেন। বললেন, ওর কা-টা দেখেছ? আমরা সভায় কী বলেছি, সে গিয়ে সম্রাটকে তা বলে এসেছে। এখানেও বাগড়া দিচ্ছে। তার মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমি তাকে কোনো ছাড় দেব না। সম্রাজ্ঞী শোশি ঠিকই তাকে চিনতে পেরেছে। সে নাকি শোনাগন নয়, তেইশির প্রেতাত্মা। ইমন বললেন, সবাই যা বলে তাকে তার উল্টোটা বলতেই হবে। তার অহংকার এখনো চূর্ণ হয়নি।

ইঝোমি বললেন, সে অনুদার। তাকাকু ডায়েরিতে যা লিখেছে সবই ঠিক। যাক, বিরুদ্ধ মতের মানুষ থাকা ভালো, তাতে আমরা সচেতন থাকতে পারি।

মুরাসাকি কিছুই বললেন না, শুধু শুনলেন।

কেন বললেন না মিচিনাগা তা জানেন।

আশি.

মুরাসাকি ‘গেঞ্জি’ উপন্যাসের শেষ অধ্যায়, অর্থাৎ চুয়ান্নতম অধ্যায় লিখতে যাচ্ছেন। পরিকল্পনা মতোই এগোচ্ছেন। কিন্তু চল্লিশের আগের অধ্যায়গুলোর অবস্থা এখানে নেই। নিজেও তা অনুভব করেন। তাই তুলির গোড়াটা কামড়াচ্ছেন। কোথায় যেন ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। পরে ভাবলেন, তা তো কয়েক অধ্যায় ধরেই চলছে। আগে শেষ করি পরে দেখা যাবে।

এ সময়ই সেনশির দরবার থেকে সংবাদ এলো।

সম্রাটের মাতা তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। লেখা বন্ধ করে যেতে হলো তাকে।

সেনশি সম্রাটের দরবারে গিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই সেখানে যান, সম্রাটের নানা কাজে প্রভাব বিস্তার করেন। এসব ক্ষেত্রে সম্রাটের কাম্পাকু (উপদেষ্টা) মিচিনাগারও করার কিছু থাকে না। মুরাসাকি এরকম একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তির ছায়াতলে আছেন। তাকে দেখে সেনশি বললেন, সম্রাটের ওখানে গেছিলাম। তার মুখে তোমার সুনাম শুনে ভালো লাগলো। ভাবলাম ডেকে তোমাকে এ কথা বলি। তুমি যদি সাম্রাজ্যে ভালো কোনো পদ চাও ব্যবস্থা করে দিতে পারি। অবস্থাটা তোমার অনুকূলে।

আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। ডেকে স্নেহ করেন, এটি আমার বড় পাওয়া। আমি আসলে নির্জনতার মধ্যে থেকে লেখাটা পছন্দ করি।

বেশ তাই করো, যা করে আনন্দ পাও, তাই করা উচিত। শেষ অধ্যায়টা কবে পাব?

এটা নিয়েই ভাবছিলাম।

কী সিন্ধান্তে এলে?

মানুষের জীবনটা বিচিত্র। এতে আছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ভোগ-লালসা, ক্ষমতার দাপট ও তার পরিণাম। রোমাঞ্চ এবং সম্ভোগের কিছু মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার আছে। তার ব্যাখ্যা নানাভাবে হতে পারে। আমাদের সামনে থাকা বৌদ্ধ ধর্মের যে ব্যাখ্যা এবং নির্দেশনা তাকে উপেক্ষা করা চলে না।

তবে তোমার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যেন ধর্মীয় অনুশাসনকেও ছাড়িয়ে গেছে। তা হয়ত তোমার অগোচরে হয়েছে।

না, ব্যাপারটা তেমন না। প্রতিটা বিষয়েই আমি ভেবে নিই, তারপর কলম ধরি। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকটটা মূলত তৈরি হয় মনের গভীর থেকে, কোনো ধর্মীয় বোধ থেকে নয়, হয়ত ধর্মীয় অনুশাসনে মেনে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়। সেই উত্তরণের ধর্মীয় নির্দেশনায় আমার চরিত্রগুলো হাঁটেনি। চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে আমি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণগুলো একই সঙ্গে নৈতিক, নিয়তিনির্ভর এবং বৈজ্ঞানিক করে তুলতে চেয়েছি। নৈতিকতার দিকটি হয়ত ধর্ম সমর্থিত, কর্মফল, নিয়তি এবং বিজ্ঞান ধর্মীয় চিন্তার বাইরে, এগুলো মানুষের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রার গভীরতর পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত। একান্ত মানবিক। তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দেখুন, গেঞ্জির কৃতকর্মের অনুশোচনা কিংবা প্রায়শ্চিত্তবোধ কোনো ধর্মীয় অনুশোচনা থেকে আসেনি। এসেছে তার নিজের মনের গভীর থেকে। ধর্মীয় অনুশাসন থেকে এলে সে ক্ষমতা পেয়ে যেতো। কর্মফল এবং নিয়তি তাকে ক্ষমা করেনি। বেঁচে থাকতেই তাকে দেখে যেতে হয়েছে তার কৃতকর্মের ফল। ফলাফলটাও মনস্তাত্ত্বিক শাস্তি, আদালতের দ- বা ধর্মীয় শাস্তি নয়। আর তা ঘটলো তখনই, যখন সম্রাটপুত্রের কল্যাণে তার সুদিনের বাতাস বইতে শুরু করেছিল। তার যারা উত্তরসূরী তাদের জীবনেও সে দুঃখ-দুর্দশা এবং বিরহ অশান্তি লোক-পরম্পরায় চলতে থাকবে।

তাই কি শেষটাও হচ্ছে বিয়োগান্তক? বললেন সেনশি।

ওটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ বাসনা এবং ভোগ উষ্ণতা, সেখানে পরিণতি সুখকর হতে পারে।

লোকজন বলে যে, মুরাসাকির মধ্যে তুমি আছো।

স্রষ্টা ঈশ্বরের সঙ্গে লেখকের একটা মিল আছে।

কারণ তিনিও স্রষ্টা?

তা তো বটেই। তবে তিনি তার সৃষ্টির জন্য কাঁদতে পারেন, আত্মতুষ্টিলাভ করতে পারে, একাত্ম হতে পারেন না, আত্মপ্রক্ষেপণ শূন্যতা, নির্লিপ্ততা অবশ্যই থাকতে হবে। মনোগাতারিতেও লেখক কোনো চরিত্রে নিজের জীবনের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন তবে স্রষ্টা হিসেবে তাকে ঈশ্বরই থাকতে হবে, এর কোনো চরিত্র হতে যাবেন না। তা হলে স্রষ্টার দায়িত্বে অবহেলা হবে। লেখাটির শিল্পগুণ ব্যাহত হবে। কবিতায় তা চলতে পারে, মনোগাতারিতে না, কোনো গল্পে না।

আশায় রইলাম। শেষ করো।

সেনশির কথার জবাবে মুরাসাকি শুধু হাসলেন।

সেনশি আবার বললেন, একটা কথা, সেই শোনাগনের কী অবস্থা?

জানেন বোধহয়, তিনি ফিরে এসেছেন।

তা তো জানি, শুনলাম, মিচিনাগা ওর ওপর খুব ক্ষেপেছে। ‘তা তো তুমি বলতে পারবে। সে দিন নাকি কবিতা সংকলনের সভায় সমস্যা করেছে। তুমি তো সভায় ছিলে, আসলে কী হয়েছিল?’

আমি সভায় ছিলাম তা ঠিক, সাংঘাতিক কিছু তো তিনি (শোনাগন) বলেননি। মহামান্য সম্রাটকে নাকি সভার আগে বলেছেন, সভাকবি যাদের গুরুত্বহীন কবি বলে বাদ দিয়েছিলেন, মহামন্ত্রী তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তাতে শোনাগনের আপত্তি আছে। তারা মূলতঃ আমার বিরুদ্ধেই বলেছিলেন, আমার কবিতা সংকলনে স্থান দেয়াতেই তার আপত্তি। আমি কিছু মনে করিনি, কিছু বলিওনি। তবে সম্রাট বলেছেন।

সম্রাট আমাকেও একথাই বলেছে। আর যা বলেছে তা তো তোমাকে বললামই। আমি এক সময় ওর বাবার কারণে সম্রাজ্ঞী তেইশিকে খুব অপছন্দ করতাম। সঙ্গে শোনাগনকেও। যার জন্য মিচিনাগার কন্যাকে আমরা সম্রাজ্ঞী করেছি। তেইশির বাবাসহ আমার অন্যান্য ভাইদের মৃত্যুতে আমি তেইশিকে ক্ষমা করে দিয়েছি। সঙ্গে শোনাগনকেও। মিচিনাগা এদের কাউকে ক্ষমা করেনি। অবশ্য এরা কেউ ক্ষমা পাবার মতো কাজ করেনি, শোশির বিরুদ্ধে সমস্যা করেই যাচ্ছিল। এদিকে শোশির সঙ্গে মিচিনাগার দাপটও বেড়ে যায়। আমি ভেবেছিলাম অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সকলের মধ্যেই পরিবর্তন আসবে। না, তা হলো না। শোনাগন কাজটা ঠিক করেনি। আরো খারাপ কাজ করেছে কাঝানের পুত্র ক্রাউন প্রিন্স সানজুর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে। তা যে ভালো উদ্দেশ্যে করেনি তা পরিষ্কার। তাই মিচিনাগা ক্ষুব্ধ হয়েছে। শোনাগনের তাতে ক্ষতি হতে পারে।

মুরাসাকি অনুনয় করে বললেন, আপনি কী অনুগ্রহ করে আমার একটি কথা রাখবেন?

বলো কী কথা?

আপনি শোনাগনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করুন।

কী বলছ তুমি? সে তোমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।

তিনি ভুল করছেন, আমরা কেন ভুল করবো?

তার তো জানা উচিত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সে আছে। তুমি মহৎ বলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারলে।

মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, আমি মহৎ না, তার সম্পর্কে আমি ভালো কিছু লিখিনি। আমার মনে হয়েছে তাকে সভাকবি কিন্তু ব্যবহার করেছেন। এছাড়া একজন খ্যাতিমান কবি তিনি, সামান্য ভুলের জন্য তাকে গুরুদ- দেয়া ঠিক হবে না।

তার অপরাধ সামান্য নয়, একের পর এক তা করেই যাচ্ছে।

আপনি দয়া করলে হয়ত তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে।

তুমি যখন বলছ, দেখি কী করা যায়।

মুরাসাকি চলে এলে সেনশি শোনাগনকে রক্ষা করার মধ্যে তার নিজের জন্য একটি ভালো দিক দেখলেন। মিচিনাগা এবং সম্রাজ্ঞী শোশি আগের মতো তার কাছে নমনীয় নয়। তেইশির মৃত্যুর পর থেকে তাদের মধ্যে একটি দাপুটে ও অনমনীয় মনোভাব তৈরি হয়েছে। এক সময় হয়ত তা বিদ্রোহের রূপ নেবে। তাই সময় থাকতে সাবধান। তিনি সেই শোনাগনকে রক্ষা করে হাতে রাখবেন, প্রয়োজনে ব্যবহার করবেন।

একথা ভাবতে ভাবতে তিনি পুত্র সম্রাট ইচিজোর দরবারের দিকে গেলেন। ক্রমশ...

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

ধারাবাহিক উপন্যাস : চল্লিশ

শিকিবু

আবুল কাসেম

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঊনআশি.

সম্রাট ইচিজোর দরবারে বিশাল এক সভা বসেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা আছেন, দরবারি অন্যসব অমাত্যরা আছেন, আছেন রাজকীয় সাহিত্য আকাদেমির কর্মকর্তা এবং সমকালীন খ্যাতিমান কবি-লেখকেরা।

সভায় প্রধান আলোচ্য বিষয় রাজকীয় কবিতা সংকলন। বেশ বড় এক কার্যপত্র নিয়ে বসে আছেন সভা কবি ফুজিওয়ারা-নো-কিন্তু। কবিদের সারিতে অন্যান্যের সঙ্গে আছেন ইমন, সেই শোনাগন, মুরাসাকি এবং ইঝোমি।

সম্রাট এলেন, দরবার শুরু হলো। কিন্তু অনুমতি নিয়ে তার বক্তব্য পেশ করছেন। তিনি বললেন, একটা প্রাথমিক নির্বাচনী সভা হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়। ঐ সভায় তার নির্দেশনায় কবিদের একটি খসড়া তালিকা এবং কবিতার সম্ভাব্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।

তাকে থামিয়ে প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা বললেন, তুমি থামো। আমি বলছি। সম্রাটের আদেশ পেয়ে কিন্তু ছুটে আসে আমার কাছে। আমি রাজকীয় সাহিত্য আকাদেমির লোকজন, সাহিত্যানুরাগী এবং বিশেষ কবিদের নিয়ে বসি। সেখানে ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়। সবাই মিলে কবি এবং কবিতার একটি তালিকা খসড়া আকারে চূড়ান্ত নির্বাচনের জন্য সম্রাটের দরবারে পেশ করতে বলি। সম্রাট কাঝানের সময়ে একটি সংকলন হয়েছে। তা সম্পূর্ণ নয় এবং তা কীভাবে করা হয়েছে অনেকেই জানেন। সভাকবি তখনও ছিল। আমি বলেছি, সে সময়কার কবিকে বাদ দেয়া যাবে না, তাদের নতুন বা অন্য কবিতা নির্বাচন করতে হবে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে দুটি সংকলনে একই কবিতা স্থান পেলে এখনকার সংকলন প্রকাশের গুরুত্ব থাকে না।

সম্রাট বললেন, মাননীয় মহামন্ত্রীর কথায় যুক্তি আছে। ঐ সভায় আলোচনা সম্পর্কে সেই শোনাগন আমাকে বলেছে।

একথা শুনে সবাই শোনাগনের দিকে তাকালেন। প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেই অবাক হলেন। ব্যাপারটা হলো এই যে, শোনাগন সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন এসব কথা বলেন। সম্রাট আবার বললেন, কিন্তু নাকি যাদের গুরুত্বহীন মনে করেছে তাদেরও কবি তালিকায় আনা হয়েছে। শোনাগনের তাতে আপত্তি আছে।

মহামান্য সম্রাটের কথা শেষ হলে আবার আমাকে কথা বলতে হবে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে হবে। বললেন মিচিনাগা।

সম্রাট কথা শেষ না করে বললেন, আপনি বলুন। আমরা শুনতে চাই।

সভায় মোটামুটি কবিদের সবাই উপস্থিত ছিল। উপস্থিত ছিল না তাকাকু। কিন্তু কি কারণ জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘তিনি তো মনোগাতারি লেখেন, কবি না।’ আমি তার কাছে জানতে চাইলাম ‘গেঞ্জি’ মনোগাতারিতে কতগুলো কবিতা আছে। আমি তাকে সংকলনে তাকাকুর কবিতা অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছি।

সম্রাট বললেন, তাকাকুকে আমি ভালোভাবে চিনি। তার কবিতা তার মুখে শুনেছি- আমার বেশ মনে আছে। একটা মিথ্যে অনুযোগের ভিত্তিতে ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’ বিষয়ে কথা বলতে তাকে দরবারে ডেকে পাঠানো হয়। সে অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ের কবি এবং লেখিকা। মাননীয় মন্ত্রীর নির্বাচন ঠিক আছে। বরং সভাকবি ভুল করেছিল।

কিন্তু এবারে কবিতা সংকলনটির কাঠামো এবং বিন্যায় নিয়ে কথা বললেন।

মিচিনাগা বললেন, প্রায় তিন হাজার কবিতার সংকলন এটি। তার আঙ্গিক, বিন্যাস এবং লিপিকরণ দীর্ঘ, কিন্তু নান্দনিক হওয়া দরকার। পাশাপাশি চিত্রাংকন ও অলংকরণের ব্যাপারটিও এসে যায়। যারা লিপিকরণে সিদ্ধ এবং অলংকরণ বা ছবি আঁকাতে পারদর্শী সমকালীন সেসব কবিদের কবিতা অন্য লিপিকরদের দিয়ে লিপিকরণের প্রয়োজন নেই।

সম্রাট বললেন, ঠিক বলেছেন। তাদের হাতের লেখা সংকলনটির গৌরব বৃদ্ধি করবে।

শোনাগন দেখলেন, এখানেও মুরাসাকিই গুরুত্ব পাচ্ছেন। কারণ তিনি ক্যালিগ্রাফি, চিত্রাংকন এবং অলংকরণে সিদ্ধ। বললেন, সবটা সংকলন একই রকম হওয়া ভালো নয়?

কিন্তু যোগ করলেন, এরকমটি আগে কখনো হয়নি। সম্রাট বললেন, আমি বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী। যা বলেছি তাই করো।

তামেতোকি ইচিগো প্রদেশ থেকে এসেছেন। তিনি রাজকীয় সাহিত্য আকাদেমির সম্মানিত সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি আঙ্গিক সম্পর্কে কিছু বলতে চান। সম্রাট বললেন বলুন আপনি।

তামেতোকি বললেন, সংকলনটি রাজকীয়। হেইয়ান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সাহিত্যানুরাগী সম্রাট তা প্রকাশ করছেন, তাই তা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্চনীয়। এর বাহ্যিক সৌকর্য নিয়ে নিশ্চয়ই প্রচ্ছদ শিল্প ভাববেন। ভেতরকার সাজসজ্জাও এরকম শিল্পীরাই করবেন। কাঠামোগতভাবে কয়েকটি বিষয় বিন্যাসের কথা আমরা বলতে পারি। কবিতাগুলোকে বিষয়ভিত্তিক সাজাবার পরামর্শ আমার। ঋতুভেদে রচিত হয়েছে নানা কবিতা, যেমন: বসন্তের কবিতা, গ্রীষ্মের কবিতা, শরতের কবিতা ইত্যাদি। আবার রয়েছে ভ্রমণের কবিতা, অভিনন্দনের কবিতা, প্রেমের কবিতা, ইতিহাস ঐতিহ্যভিত্তিক কবিতা, ধাঁধাঁ জাতীয়, শোকের কবিতা, বিবিধ কবিতা প্রভৃতি। প্রতিটি কবিতার ওপর কবির পরিচিতি থাকতে পারে। সংক্ষিপ্তভাবে দু’তিন বাক্যে।

সভাকবি কিন্তু বললেন, এসব ঝামেলা না করেই দুই খ- বা ভাগে ছেপে দেয়াই ভালো প্রাচীন ও বর্তমানকালে কবিতা।

মিচিনাগা বললেন, অনেকগুণের অধিকারী গভর্নর তামেতোকি। কবি, চীনা সাহিত্য প-িত, আকাদেমির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি যা বলেছেন, তা-ই যথাযথ।

সম্রাট বললেন আমারও এই মত।

পা-ুলিপি তৈরিতে প্রচুর সময় লাগবে।

লাগুক, আমরা তো প্রতিদিন সংকলন করবো না।

মিচিনাগা বললেন, মহামান্য সম্রাট ঠিকই বলেছেন।

সাহিত্য আকাদেমিকে একাজের সঙ্গে যুক্ত করা হলো।

কিন্তু বললেন, নাম, নাম কী হবে?

সম্রাট বললেন, আগে পা-ুলিপির রূপরেখা তেরি কর। এই

সময় আমি কিছুটা ভেবে নিই।

সভা শেষে শোনাগন সভাকবি কিন্তুর দপ্তরে গেলেন। তাঁদের ইচ্ছার বাইরে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গেছে। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার কোনো সুযোগ সম্রাটের দরবারে নেই। তাই এরা নিজেদের মধ্যেই চাপা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটালেন। কিন্তু বললেন, তুমি সম্রাটকে কীভাবে বলেছ যে, সম্রাট তা বলে দিলেন সবার সামনে।

আমি বড় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। ভাবতেও পারিনি সম্রাট হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবেন। সংকলনে অহংকারী মেয়ে তাকাকু থাকছেই।

প্রধানমন্ত্রীর অনুগ্রহ রয়েছে তার প্রতি।

আপনার সঙ্গেও তো ভালো ব্যবহার করেনি।

আমি বলেছিলাম, তোমার ‘গেঞ্জি’তে দরবারের কে কে আছে? সে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, কেউ না।

আমি কী প্রমাণ করে দেব, কে কে আছে? বিরাট কৃতিত্বের দাবিদার তিনি। সম্রাট সাহিত্যের কী বোঝেন?

এখন কী করতে চান?

ভাবতে দাও। রাজকীয় কাব্য সংকলন! হিমাগারে পাঠাব আমি একে।

তাই ভালো হবে। সানজু ক্ষমতায় এলে আমরা তা আমাদের মতো করে প্রকাশ করবো। শুধু কবিতা না, তখন আমার গদ্য লেখাও স্থান করে দিতে হবে।

তুমি আবার এসব সম্রাটকে বলে দিও না।

আরে না। মানুষ বোকামি একবার করে, বারবার না।

এদিকে মিচিনাগা তার দপ্তরে ইমন, মুরাসাকি এবং ইঝোমিকে নিয়ে বসলেন। বললেন, ওর কা-টা দেখেছ? আমরা সভায় কী বলেছি, সে গিয়ে সম্রাটকে তা বলে এসেছে। এখানেও বাগড়া দিচ্ছে। তার মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমি তাকে কোনো ছাড় দেব না। সম্রাজ্ঞী শোশি ঠিকই তাকে চিনতে পেরেছে। সে নাকি শোনাগন নয়, তেইশির প্রেতাত্মা। ইমন বললেন, সবাই যা বলে তাকে তার উল্টোটা বলতেই হবে। তার অহংকার এখনো চূর্ণ হয়নি।

ইঝোমি বললেন, সে অনুদার। তাকাকু ডায়েরিতে যা লিখেছে সবই ঠিক। যাক, বিরুদ্ধ মতের মানুষ থাকা ভালো, তাতে আমরা সচেতন থাকতে পারি।

মুরাসাকি কিছুই বললেন না, শুধু শুনলেন।

কেন বললেন না মিচিনাগা তা জানেন।

আশি.

মুরাসাকি ‘গেঞ্জি’ উপন্যাসের শেষ অধ্যায়, অর্থাৎ চুয়ান্নতম অধ্যায় লিখতে যাচ্ছেন। পরিকল্পনা মতোই এগোচ্ছেন। কিন্তু চল্লিশের আগের অধ্যায়গুলোর অবস্থা এখানে নেই। নিজেও তা অনুভব করেন। তাই তুলির গোড়াটা কামড়াচ্ছেন। কোথায় যেন ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। পরে ভাবলেন, তা তো কয়েক অধ্যায় ধরেই চলছে। আগে শেষ করি পরে দেখা যাবে।

এ সময়ই সেনশির দরবার থেকে সংবাদ এলো।

সম্রাটের মাতা তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। লেখা বন্ধ করে যেতে হলো তাকে।

সেনশি সম্রাটের দরবারে গিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই সেখানে যান, সম্রাটের নানা কাজে প্রভাব বিস্তার করেন। এসব ক্ষেত্রে সম্রাটের কাম্পাকু (উপদেষ্টা) মিচিনাগারও করার কিছু থাকে না। মুরাসাকি এরকম একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তির ছায়াতলে আছেন। তাকে দেখে সেনশি বললেন, সম্রাটের ওখানে গেছিলাম। তার মুখে তোমার সুনাম শুনে ভালো লাগলো। ভাবলাম ডেকে তোমাকে এ কথা বলি। তুমি যদি সাম্রাজ্যে ভালো কোনো পদ চাও ব্যবস্থা করে দিতে পারি। অবস্থাটা তোমার অনুকূলে।

আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। ডেকে স্নেহ করেন, এটি আমার বড় পাওয়া। আমি আসলে নির্জনতার মধ্যে থেকে লেখাটা পছন্দ করি।

বেশ তাই করো, যা করে আনন্দ পাও, তাই করা উচিত। শেষ অধ্যায়টা কবে পাব?

এটা নিয়েই ভাবছিলাম।

কী সিন্ধান্তে এলে?

মানুষের জীবনটা বিচিত্র। এতে আছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ভোগ-লালসা, ক্ষমতার দাপট ও তার পরিণাম। রোমাঞ্চ এবং সম্ভোগের কিছু মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার আছে। তার ব্যাখ্যা নানাভাবে হতে পারে। আমাদের সামনে থাকা বৌদ্ধ ধর্মের যে ব্যাখ্যা এবং নির্দেশনা তাকে উপেক্ষা করা চলে না।

তবে তোমার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যেন ধর্মীয় অনুশাসনকেও ছাড়িয়ে গেছে। তা হয়ত তোমার অগোচরে হয়েছে।

না, ব্যাপারটা তেমন না। প্রতিটা বিষয়েই আমি ভেবে নিই, তারপর কলম ধরি। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকটটা মূলত তৈরি হয় মনের গভীর থেকে, কোনো ধর্মীয় বোধ থেকে নয়, হয়ত ধর্মীয় অনুশাসনে মেনে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়। সেই উত্তরণের ধর্মীয় নির্দেশনায় আমার চরিত্রগুলো হাঁটেনি। চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে আমি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণগুলো একই সঙ্গে নৈতিক, নিয়তিনির্ভর এবং বৈজ্ঞানিক করে তুলতে চেয়েছি। নৈতিকতার দিকটি হয়ত ধর্ম সমর্থিত, কর্মফল, নিয়তি এবং বিজ্ঞান ধর্মীয় চিন্তার বাইরে, এগুলো মানুষের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রার গভীরতর পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত। একান্ত মানবিক। তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দেখুন, গেঞ্জির কৃতকর্মের অনুশোচনা কিংবা প্রায়শ্চিত্তবোধ কোনো ধর্মীয় অনুশোচনা থেকে আসেনি। এসেছে তার নিজের মনের গভীর থেকে। ধর্মীয় অনুশাসন থেকে এলে সে ক্ষমতা পেয়ে যেতো। কর্মফল এবং নিয়তি তাকে ক্ষমা করেনি। বেঁচে থাকতেই তাকে দেখে যেতে হয়েছে তার কৃতকর্মের ফল। ফলাফলটাও মনস্তাত্ত্বিক শাস্তি, আদালতের দ- বা ধর্মীয় শাস্তি নয়। আর তা ঘটলো তখনই, যখন সম্রাটপুত্রের কল্যাণে তার সুদিনের বাতাস বইতে শুরু করেছিল। তার যারা উত্তরসূরী তাদের জীবনেও সে দুঃখ-দুর্দশা এবং বিরহ অশান্তি লোক-পরম্পরায় চলতে থাকবে।

তাই কি শেষটাও হচ্ছে বিয়োগান্তক? বললেন সেনশি।

ওটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ বাসনা এবং ভোগ উষ্ণতা, সেখানে পরিণতি সুখকর হতে পারে।

লোকজন বলে যে, মুরাসাকির মধ্যে তুমি আছো।

স্রষ্টা ঈশ্বরের সঙ্গে লেখকের একটা মিল আছে।

কারণ তিনিও স্রষ্টা?

তা তো বটেই। তবে তিনি তার সৃষ্টির জন্য কাঁদতে পারেন, আত্মতুষ্টিলাভ করতে পারে, একাত্ম হতে পারেন না, আত্মপ্রক্ষেপণ শূন্যতা, নির্লিপ্ততা অবশ্যই থাকতে হবে। মনোগাতারিতেও লেখক কোনো চরিত্রে নিজের জীবনের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন তবে স্রষ্টা হিসেবে তাকে ঈশ্বরই থাকতে হবে, এর কোনো চরিত্র হতে যাবেন না। তা হলে স্রষ্টার দায়িত্বে অবহেলা হবে। লেখাটির শিল্পগুণ ব্যাহত হবে। কবিতায় তা চলতে পারে, মনোগাতারিতে না, কোনো গল্পে না।

আশায় রইলাম। শেষ করো।

সেনশির কথার জবাবে মুরাসাকি শুধু হাসলেন।

সেনশি আবার বললেন, একটা কথা, সেই শোনাগনের কী অবস্থা?

জানেন বোধহয়, তিনি ফিরে এসেছেন।

তা তো জানি, শুনলাম, মিচিনাগা ওর ওপর খুব ক্ষেপেছে। ‘তা তো তুমি বলতে পারবে। সে দিন নাকি কবিতা সংকলনের সভায় সমস্যা করেছে। তুমি তো সভায় ছিলে, আসলে কী হয়েছিল?’

আমি সভায় ছিলাম তা ঠিক, সাংঘাতিক কিছু তো তিনি (শোনাগন) বলেননি। মহামান্য সম্রাটকে নাকি সভার আগে বলেছেন, সভাকবি যাদের গুরুত্বহীন কবি বলে বাদ দিয়েছিলেন, মহামন্ত্রী তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তাতে শোনাগনের আপত্তি আছে। তারা মূলতঃ আমার বিরুদ্ধেই বলেছিলেন, আমার কবিতা সংকলনে স্থান দেয়াতেই তার আপত্তি। আমি কিছু মনে করিনি, কিছু বলিওনি। তবে সম্রাট বলেছেন।

সম্রাট আমাকেও একথাই বলেছে। আর যা বলেছে তা তো তোমাকে বললামই। আমি এক সময় ওর বাবার কারণে সম্রাজ্ঞী তেইশিকে খুব অপছন্দ করতাম। সঙ্গে শোনাগনকেও। যার জন্য মিচিনাগার কন্যাকে আমরা সম্রাজ্ঞী করেছি। তেইশির বাবাসহ আমার অন্যান্য ভাইদের মৃত্যুতে আমি তেইশিকে ক্ষমা করে দিয়েছি। সঙ্গে শোনাগনকেও। মিচিনাগা এদের কাউকে ক্ষমা করেনি। অবশ্য এরা কেউ ক্ষমা পাবার মতো কাজ করেনি, শোশির বিরুদ্ধে সমস্যা করেই যাচ্ছিল। এদিকে শোশির সঙ্গে মিচিনাগার দাপটও বেড়ে যায়। আমি ভেবেছিলাম অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সকলের মধ্যেই পরিবর্তন আসবে। না, তা হলো না। শোনাগন কাজটা ঠিক করেনি। আরো খারাপ কাজ করেছে কাঝানের পুত্র ক্রাউন প্রিন্স সানজুর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে। তা যে ভালো উদ্দেশ্যে করেনি তা পরিষ্কার। তাই মিচিনাগা ক্ষুব্ধ হয়েছে। শোনাগনের তাতে ক্ষতি হতে পারে।

মুরাসাকি অনুনয় করে বললেন, আপনি কী অনুগ্রহ করে আমার একটি কথা রাখবেন?

বলো কী কথা?

আপনি শোনাগনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করুন।

কী বলছ তুমি? সে তোমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।

তিনি ভুল করছেন, আমরা কেন ভুল করবো?

তার তো জানা উচিত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সে আছে। তুমি মহৎ বলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারলে।

মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, আমি মহৎ না, তার সম্পর্কে আমি ভালো কিছু লিখিনি। আমার মনে হয়েছে তাকে সভাকবি কিন্তু ব্যবহার করেছেন। এছাড়া একজন খ্যাতিমান কবি তিনি, সামান্য ভুলের জন্য তাকে গুরুদ- দেয়া ঠিক হবে না।

তার অপরাধ সামান্য নয়, একের পর এক তা করেই যাচ্ছে।

আপনি দয়া করলে হয়ত তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে।

তুমি যখন বলছ, দেখি কী করা যায়।

মুরাসাকি চলে এলে সেনশি শোনাগনকে রক্ষা করার মধ্যে তার নিজের জন্য একটি ভালো দিক দেখলেন। মিচিনাগা এবং সম্রাজ্ঞী শোশি আগের মতো তার কাছে নমনীয় নয়। তেইশির মৃত্যুর পর থেকে তাদের মধ্যে একটি দাপুটে ও অনমনীয় মনোভাব তৈরি হয়েছে। এক সময় হয়ত তা বিদ্রোহের রূপ নেবে। তাই সময় থাকতে সাবধান। তিনি সেই শোনাগনকে রক্ষা করে হাতে রাখবেন, প্রয়োজনে ব্যবহার করবেন।

একথা ভাবতে ভাবতে তিনি পুত্র সম্রাট ইচিজোর দরবারের দিকে গেলেন। ক্রমশ...