অচেনাবৃত্তের চেনা সন্ধ্যা

গৌতম রায়

সঙ্গীত জগতের বিস্ময় গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ‘কিন্নরকণ্ঠী’ বলে ডাকতেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তারাশঙ্করের লেখা গান, ‘মধুর মধুর বংশী বাজে কথা কোন কদমতলীতে’ সন্ধ্যার কণ্ঠের অনবদ্য নিবেদনে সংগীতের দুনিয়ার এক চিরন্তন সম্পদ হয়ে আছে। গান গাইবার ক্ষেত্রে, গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী প্রত্যেকের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতেন বলেই হয়তো তাঁর প্রতিটি গান বছরের পর বছর ধরে শ্রোতার হৃদয়ে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ধীরে ধীরে সংগীতজগতে নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন, সেই সময় কাল থেকে, তাঁর জীবনের শেষ পর্ব পর্যন্ত, নিজের চরিত্রে এতটা সাধারণ আটপৌরে বজায় রাখতে পেরেছিলেন যে, ভাবলে সত্যিই বিস্ময় জাগে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। খাওয়া-পরার অভাব ছিল না তাঁর বাপের বাড়িতে। তাই বলে অতিরিক্ত আতিশয্য কিছু ছিল না। এই যে শৈশব-কৈশোরের ভারসাম্যযুক্ত জীবনযাপন, সেটা কিন্তু তিনি শেষ দিন পর্যন্ত, অত্যন্ত শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে বজায় রেখে গিয়েছেন। কোন দিন যাপনচিত্র, সাজপোশাক, আচার-আচরণ- তাঁর এই সবকিছুর ভেতরে, আমরা কখনো এতটুকু বাহুল্য দেখতে পাইনি। যখন তিনি বিশ্ববন্দিতা সুচিত্রা সেনের লিপে গান গেয়ে খ্যাতির শীর্ষে, পরিমিত আকারে হলেও বিভিন্ন জলসায় অংশগ্রহণ করছেন। তখনো তাঁর সাজ পোশাকের মধ্যে এই আটপৌরেয়ানাটা ছিল একটা বিশেষ রকমের ট্রেডমার্ক।

তিনি বলতেন; আমাদের ছোটবেলায় অত স্নো পাউডার মাখা, এ সব কিছুতে অভ্যস্ত ছিলাম না। আর স্নো পাউডার মাখার অত টাকা পয়সাও তখন ছিল না। তাই কোনো ফাংশনের যাওয়ার আগে অ্যালোভেরা পাতা ভেঙে নিয়ে, সেই অ্যালোভেরার জেল মুখে মেখে বেশ কিছুক্ষণ পরে মুখ ধুয়ে ফেলতাম। মুক একদম চক চক চক চক করতো। সাজসজ্জার ঘরোয়া টোটকা, এই জিনিসটার প্রতি কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চিরদিন একটা বিশেষ রকমের পক্ষপাতিত্ব ছিল। অসুখ-বিসুখ ঘরোয়া টোটকাতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। কথায় কথায় নামিদামি ডাক্তারের কাছে যাওয়া, নামিদামি ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী দুর্মূল্য ওষুধপত্র খাওয়া, এই সবকিছু থেকে তিনি একটা দূরত্ব বজায় রাখতেন। তাই শরীর ঠিক রাখার জন্য পরিমিত আহার, ঠিক সময়মতো ঘুম- এই দুটো বিষয়ের উপরে তাঁর ছিল তীক্ষè নজর।

এইটা যে কেবল তিনি তাঁর নিজের জন্য করতেন তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই নজরটা স্বামী গীতিকার শ্যামল গুপ্তর প্রতিও তাঁর চিরদিন বজায় ছিল। খেতে ভালো লাগছে বলেই কোনো খাবার অতিরিক্ত খেয়ে ফেললাম, বা অতিরিক্ত তেলমশলা, ভাজা খাবার খেলাম, এই সমস্ত কিন্তু তাঁর চরিত্রবিরুদ্ধ ছিল। বাড়িতে অতিথি এলে, তাঁদের জন্য নিজে হাতে খাবার তৈরি করে তাঁদের পেট ভরে খাওয়াতে কখনো কার্পণ্য বা ক্লান্তি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছিল না।

আসলে তাঁকে ঘরোয়া পরিবেশে দেখার সুযোগ পেয়েছি বলেই বুঝতে পেরেছি, কী অসামান্য অধ্যবসায়ের ভেতর দিয়ে তিনি সংগীতশিল্পী হিসেবে কেবল বাংলা নয়, কেবল ভারত নয়, গোটা বিশ্বের সঙ্গীত দুনিয়ায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। যখন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের কোনো কনফারেন্সে গাইবার জন্য স্বীকৃত হতেন, তখন দীর্ঘদিন কোনো লঘুসঙ্গীত গাইতেন না, অর্থাৎ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সঙ্গে লঘুসঙ্গীতের একটা সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়ে তাঁর মন-মেজাজের ওপরে প্রভাব ফেলুক, এটা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বরদাস্ত করতে পারতেন না। তাই লঘুসংগীত যখন গাইতেন, তখন আবার উচ্চাঙ্গসংগীতের পরিবেশ থেকে নিজেকে খানিকটা দূরেই রাখতে পছন্দ করতেন।

কালজয়ী বেসিক রেকর্ড, ফিল্মি গান, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের লেখা দেশাত্মবোধক গান, নানা ধরনের হিন্দি গীত, ভজন- এইসব গাওয়া সত্ত্বেও, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি ছিল কিন্তু তাঁর একটা বিশেষ ধরনের পক্ষপাতিত্ব। তাই তাঁর যখন প্রথম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের লং প্লেয়িং রেকর্ডটি প্রকাশিত হয় সাতের দশকের গোড়ার দিকে, সেটির দীর্ঘ আলোচনা দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই আলোচনার কথা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় খুব আনন্দের সঙ্গে মান্না দে-কে জানিয়েছিলেন। মানব বাবুর কাছ থেকে দেশ পত্রিকার সেই ইতিবাচক সমালোচনা শুনে মান্নাবাবুর মন্তব্য করেছিলেন; সন্ধ্যা আবার আজকাল ‘ক্লাসিক্যাল’ গাইছে নাকি?

ঘটনাটি হয়তো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে কিছুটা আহত করেই থাকবে, তাই অনেক সময় নানা আলাপচারিতায় ওই ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করতেন। আসলে কোনো ঘটনাকে বিবৃত করবার ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ পরিম-লে, ঘুরিয়ে কথা বলার মতো চাতুর্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছিল না। তাই সুরকার নচিকেতা ঘোষকে ঘিরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে হয়তো একটা চাপা দুঃখের আভাস তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিম-লে দিতে দ্বিধা করেননি।

হেমন্তবাবু তখন খ্যাতির শীর্ষে। সুরকার হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে তখনকার বোম্বে, আজকের মুম্বাইতে তাঁকে নিয়ে যান হেমন্তবাবু। কিন্তু সেই এক বছরে একটি গানেও তিনি নচিবাবুকে দিয়ে সুর করাননি। কার্যত অকর্মণ্য করে, মাইনে নিয়ে নচিবাবুর পক্ষে এই বসে থাকাটা খুব অস্বস্তিকর হচ্ছিল। এই সময় শারদ উৎসবের কিছুটা আগে কলকাতায় এসেছিলেন নচিবাবু। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেইবারের পুজোর গানটির সুর করবার।

গানটি লিখলেন প্রখ্যাত গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’ মোহাম্মদ রফির স্বল্প পরিচিত গান, ‘স্বপ্না লেকে আয়ে রে চান্দা’- এই গানটার একট বাংলা অনুবাদ শিবদাস বাবু করলেন। জীবনসায়হ্নে শিবদাসবাবুকে খুব গর্বের সঙ্গেই কথা বলতে শুনেছি যে, চলে যাওয়ার আগে এই আত্মতৃপ্তি আমার মধ্যে আছে, মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রার রিমেক হবে না।

এই গানটি বিভিন্ন মাহফিলে অসাধারণ ভঙ্গিমায় বিভিন্ন শব্দকে নানা আঙ্গিকে উচ্চারণ করে গাইতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গানটি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাথে অনেক আসরে তবলায় সঙ্গত করতেন রাধাকান্ত নন্দী। সেই দুর্লভ দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছে, তাঁরাই মনে করতে পারেন, রাধাকান্ত বাবু সম্বন্ধে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই উক্তি; রাধাকান্তপুর তবলা বাজাতেন না, তিনি তবলায় গান বাজাতেন, সেটির যথার্থতা।

শিবদাস বাবুর জীবনের একদম শেষ প্রান্তে তাঁকে কিছু আর্থিক সাহায্য করার জন্য আমাকে তিনি বললেন। সামান্য কিছু অর্থ শিবদাস বাবুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর হাতে তুলে দিলাম। পরবর্তীতে শিবদাস বাবু, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে, তাঁকে মনে রেখে, তাঁর আর্থিক দুরবস্থার কথা চিন্তা করে, এই যে অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো, তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছিলেন।

পরিচিত বৃত্তের ভিতরে টাকা ধার করার একটা বদভ্যাস ছিল নচিকেতা ঘোষের। মৃত্যুর পর যখন বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেই নিজের গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন মান্না দে, তখন কোনো কোনো পরিচিত মানুষ মান্না বাবুর কাছে বলেছিলেন, আপনি তো নচিবাবুর সুরে বহু গান গেয়েছেন। তাহলে আজকে কেন এত দূরে দূরে চলেছেন? মান্না বাবু তখন উত্তর দিয়েছিলেন; ডেড বডি যদি হাত পাতে। অর্থাৎ; যদি আবার টাকা ধার চায়।

যখন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের কোনো কনফারেন্সে গাইবার জন্য স্বীকৃত হতেন, তখন দীর্ঘদিন কোনো লঘুসঙ্গীত গাইতেন না, অর্থাৎ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সঙ্গে লঘুসঙ্গীতের একটা সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়ে তাঁর মন-মেজাজের ওপরে প্রভাব ফেলুক, এটা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বরদাস্ত করতে পারতেন না

অসাধারণ এই কথাটি উল্লেখ করতেন শ্যামল গুপ্ত। যখন এই কথাগুলো তিনি বলতেন, তখন কিন্তু কোনো রকম ইন্টারফেয়ার করতেন না সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মিটিমিটি হাসতেন। অর্থাৎ শ্যামল বাবুর কথায় যে তাঁর পূর্ণ সমর্থন আছে, সেটা বুঝিয়ে দিতেন কিন্তু তাই বলে কোনো সংযোজন-বিয়োজন, বিরোধিতা এইসব ওঁদের সম্পর্কের ভেতরে কখনো দেখতে পাওয়া যায়নি।

একবার শিলিগুড়িতে একটি জলসায় গাইতে চলেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। রাধাকান্ত বাবু ও আছেন। এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ে পতœী বেলা মুখোপাধ্যায়। তিনি আবদার ধরে বসলেন তাঁর স্বামী হেমন্তের কাছে, শিলিগুড়ি থেকে কিছু একটা নিয়ে এসো।

এই ঘটনাক্রম যখন বলা হচ্ছে তখন শিলিগুড়িতে হংকং মার্কেট তৈরি হয়নি। নানা রকম বিদেশী জিনিসপত্র পাওয়ার সুযোগ সুবিধে পরবর্তী সময়ের মতো ছিল না। তাই একটু আশ্চর্য হলেন হেমন্তবাবু। তিনি বললেন; শিলিগুড়ি থেকে কি জিনিস আনব? রাধাকান্ত বাবু কানে কানে বললেন বেলা দেবীর, শিলিগুড়ির গামছা কিন্তু খুব বিখ্যাত।

রাধাকান্তপুর মজাটা ধরতে পারলেন না বেলা মুখোপাধ্যায়। ব্যাপারটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে, তিনি স্বামী হেমন্তকে বললেন; তাহলে শিলিগুড়ি থেকে গেমছাই নিয়ে এসো।

এই সম্পর্কের নানা স্মৃতি রোমান্থনে কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শেষ জীবনে মাঝে মাঝে বিভোর হয়ে যেতেন। তখন যেন মনে হতো, তাঁর একদম শেষ দিকের গাওয়া সেই গানটার কথা; “আমার স্মৃতিতে অনুপম আর রবীন চট্টোপাধ্যায়, গানে গানে দিন, ছিল কি রঙিন, জাগে স্মৃতি এই রাতটায়।” সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলতেন: আমরা সংগীতজীবনের মানুষেরা হেমন্তদাকে যতটা চিনি জানি, তার থেকে অনেক বেশি হেমন্তদাকে চেনেন, জানেন সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে হিমালয় সদৃশ ব্যক্তিত্ব, তাকে সন্ধ্যা চিরদিন অত্যন্ত সম্মান আর মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন।

‘ছোটিসি মুলাকাত’ ফিল্ম করবার পর বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় অংশের মানুষদের অসহযোগিতায় ভয়ঙ্কর রকমের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন উত্তম কুমার। এই সময় তিনি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা সাম্মানিক নিয়ে, বিভিন্ন জলসায় অংশগ্রহণ করতেন। এই সময়ে বসুশ্রী সিনেমা হলের এক জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখনও এসে পৌঁছননি। উত্তম বাবু অনুরোধ করলেন তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে সেই বিখ্যাত গানটি “সপ্তপদী” ফিল্মের ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো’ গাইতে। অবলীলাক্রমে মঞ্চে গাইতে থাকেন সেই গানটা উত্তম কুমারের সাথে সন্ধ্যা।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে একটা আড়াল রাখতেই হয়েছিল, তা না হলে তাঁর মতো শিল্পীর সঙ্গীত সাধনা ব্যাহত হতো। সেই আড়ালটাকে তিনি হয়তো খানিকটা নিজের ইচ্ছেতেই ভেঙে দিয়েছিলেন শ্যামল গুপ্তর মৃত্যুর পর। শ্যামল গুপ্ত যতদিন বেঁচে ছিলেন, কখনো কোনো রকম রাজনীতির তাপ উত্তাপের ভিতরে পতœী সন্ধ্যাকে এতটুকু আসতে দেননি তিনি। নীলকণ্ঠের মতো সমস্ত রাজনীতি, সংগীতজগতের চাপানউতোর- এই সমস্ত কিছুতে নিজেকে সামলাতেন শ্যামল গুপ্ত।

শ্যামলবাবুর অসুস্থতার সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মহম্মদ সেলিম, শ্যামলী গুপ্তের মতো প্রথম সারির বামপন্থী নেতারা যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই সহযোগিতাকে আপন করে নিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এতটুকু দেরি লাগেনি। শ্যামল গুপ্তর মৃত্যুর খবর পেয়ে আধঘণ্টার মধ্যে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিমান বসুর মতো প্রথম সারির বামপন্থী নেতা মহঃ সেলিমকে সাথে নিয়ে।

সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ঘিরে এতটুকু বাড়তিত উচ্ছ্বাস সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিন্তু সেদিন দেখাননি। তার পরবর্তী যাপনচিত্র দেখে মনে হয়, হয়তো সেদিন তিনি বামপন্থী নেতাদের নিজের বাড়িতে দেখে খুব একটা খুশি হন নি। যদিও শ্যামল গুপ্তর মৃত্যুর সেই তাৎক্ষণিক মুহূর্ত বা তার পরবর্তী একটা দীর্ঘ সময়, যতদিন পর্যন্ত বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন ছিল, সেই সময় কালে, তাঁর চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যে ব্যবস্থাপনা, সেই ব্যবস্থাপনা গ্রহণে তিনি কখনো তাঁর অপারগতার কথা জানাননি। অপছন্দের বিষয়টিকেও প্রয়োজনের তাগিদে আপন করে নিতে পারার অসামান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছিল, তেমন বৈশিষ্ট্য খুব কম শিল্পীর মধ্যেই আমরা দেখতে পেয়েছি।

সন্ধ্যা মুখার্জী চিরদিন অন্তরালে থেকে, নিজের সংগীত সাধনা ঘিরেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করতেন। তাই যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, তখনকার শাসক শিবিরের পক্ষ থেকে নানা সময়ে, তাঁকে নানা ধরনের অনুরোধ-উপরোধ জানানো হতো। কিন্তু সেইসব অনুরোধগুলির ভেতরে যদি দেশ রক্ষার তাগিদ, দেশের সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ- এইসব বিষয়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকত, তাহলে সেগুলির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে দিতে কখনো দেরি করেননি।

তিনি যখন বেসিক রেকর্ড আর ফিল্মি গানের দৌলতে খ্যাতির শীর্ষে, সেই সময়কালের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে রাজভবনে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে সেবামূলক কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান হতো। সেইসব অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক ছিলেন কিন্তু উৎপলা সেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও বন্ধু উৎপলার আমন্ত্রণ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতেন। এইসব অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শ্রোতাদের মন মাতিয়ে দিতেন।

এই কর্মকা-ের ধারা আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গান গেয়ে শ্রোতাদের জয় করে, তার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ভাবনাকে তিনি মেলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সচেতন নাগরিক হিসেবে কখনো রাজপথ জনপথে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি মনে করতেন সচেতনতা ঘটাতে গেলে কেবলমাত্র সভা-সমিতিতে যেতে হবে, তার কোনো সঠিক অর্থ নেই। নিজের মতো করে, নিজের জীবনযাপনের ভেতর দিয়েও যে মানুষের কাজের প্রতি সমস্ত রকমের সম্মান, সহযোগিতা, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রাখা যায়, এটাই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর গোটা জীবন ধরে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন।

অবশ্য সেই ভাবধারার একবারই আমরা ব্যতিক্রম দেখেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি সমর্থনে রবীন্দ্রসদন চত্বরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ধর্ণায় বসেছিলেন। একেবারই তৃণমূল কংগ্রেস দলটির দলীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁর এই রাজনৈতিক অবস্থান। তাঁর গোটা জীবনের যাপনচিত্রের বৈশিষ্ট্য, এটি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। অনেকেই এটা বিশ্বাস করেন যে, শ্যামল গুপ্ত যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের সভা কার্যত যেটি হয়ে উঠেছিল, সেখানে ওই রকম রাজনৈতিক ভঙ্গিমায়, বুকে রাজনৈতিক স্লোগানের প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্রদের সঙ্গে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ধর্ণায় বসতেন না।

এই ব্যতিক্রমী কাজটি আরেকটি ক্ষেত্রে তাঁকে করতে দেখা গিয়েছিল, সেটি হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের পর, বামফ্রন্ট সরকারের নিয়োজিত রাজ্য সংগীত একাডেমির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত, প্রখ্যাত সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিবর্তে, তাঁকে নতুন সরকারি পদে নিযুক্ত করে নতুন সরকার। তিনি সেই পদটি গ্রহণ করেছিলেন।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে অপসারিত করে, সেই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান থেকে গিয়েছিল।

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

অচেনাবৃত্তের চেনা সন্ধ্যা

গৌতম রায়

image

সঙ্গীত জগতের বিস্ময় গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ‘কিন্নরকণ্ঠী’ বলে ডাকতেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তারাশঙ্করের লেখা গান, ‘মধুর মধুর বংশী বাজে কথা কোন কদমতলীতে’ সন্ধ্যার কণ্ঠের অনবদ্য নিবেদনে সংগীতের দুনিয়ার এক চিরন্তন সম্পদ হয়ে আছে। গান গাইবার ক্ষেত্রে, গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী প্রত্যেকের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতেন বলেই হয়তো তাঁর প্রতিটি গান বছরের পর বছর ধরে শ্রোতার হৃদয়ে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ধীরে ধীরে সংগীতজগতে নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন, সেই সময় কাল থেকে, তাঁর জীবনের শেষ পর্ব পর্যন্ত, নিজের চরিত্রে এতটা সাধারণ আটপৌরে বজায় রাখতে পেরেছিলেন যে, ভাবলে সত্যিই বিস্ময় জাগে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। খাওয়া-পরার অভাব ছিল না তাঁর বাপের বাড়িতে। তাই বলে অতিরিক্ত আতিশয্য কিছু ছিল না। এই যে শৈশব-কৈশোরের ভারসাম্যযুক্ত জীবনযাপন, সেটা কিন্তু তিনি শেষ দিন পর্যন্ত, অত্যন্ত শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে বজায় রেখে গিয়েছেন। কোন দিন যাপনচিত্র, সাজপোশাক, আচার-আচরণ- তাঁর এই সবকিছুর ভেতরে, আমরা কখনো এতটুকু বাহুল্য দেখতে পাইনি। যখন তিনি বিশ্ববন্দিতা সুচিত্রা সেনের লিপে গান গেয়ে খ্যাতির শীর্ষে, পরিমিত আকারে হলেও বিভিন্ন জলসায় অংশগ্রহণ করছেন। তখনো তাঁর সাজ পোশাকের মধ্যে এই আটপৌরেয়ানাটা ছিল একটা বিশেষ রকমের ট্রেডমার্ক।

তিনি বলতেন; আমাদের ছোটবেলায় অত স্নো পাউডার মাখা, এ সব কিছুতে অভ্যস্ত ছিলাম না। আর স্নো পাউডার মাখার অত টাকা পয়সাও তখন ছিল না। তাই কোনো ফাংশনের যাওয়ার আগে অ্যালোভেরা পাতা ভেঙে নিয়ে, সেই অ্যালোভেরার জেল মুখে মেখে বেশ কিছুক্ষণ পরে মুখ ধুয়ে ফেলতাম। মুক একদম চক চক চক চক করতো। সাজসজ্জার ঘরোয়া টোটকা, এই জিনিসটার প্রতি কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চিরদিন একটা বিশেষ রকমের পক্ষপাতিত্ব ছিল। অসুখ-বিসুখ ঘরোয়া টোটকাতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। কথায় কথায় নামিদামি ডাক্তারের কাছে যাওয়া, নামিদামি ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী দুর্মূল্য ওষুধপত্র খাওয়া, এই সবকিছু থেকে তিনি একটা দূরত্ব বজায় রাখতেন। তাই শরীর ঠিক রাখার জন্য পরিমিত আহার, ঠিক সময়মতো ঘুম- এই দুটো বিষয়ের উপরে তাঁর ছিল তীক্ষè নজর।

এইটা যে কেবল তিনি তাঁর নিজের জন্য করতেন তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই নজরটা স্বামী গীতিকার শ্যামল গুপ্তর প্রতিও তাঁর চিরদিন বজায় ছিল। খেতে ভালো লাগছে বলেই কোনো খাবার অতিরিক্ত খেয়ে ফেললাম, বা অতিরিক্ত তেলমশলা, ভাজা খাবার খেলাম, এই সমস্ত কিন্তু তাঁর চরিত্রবিরুদ্ধ ছিল। বাড়িতে অতিথি এলে, তাঁদের জন্য নিজে হাতে খাবার তৈরি করে তাঁদের পেট ভরে খাওয়াতে কখনো কার্পণ্য বা ক্লান্তি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছিল না।

আসলে তাঁকে ঘরোয়া পরিবেশে দেখার সুযোগ পেয়েছি বলেই বুঝতে পেরেছি, কী অসামান্য অধ্যবসায়ের ভেতর দিয়ে তিনি সংগীতশিল্পী হিসেবে কেবল বাংলা নয়, কেবল ভারত নয়, গোটা বিশ্বের সঙ্গীত দুনিয়ায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। যখন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের কোনো কনফারেন্সে গাইবার জন্য স্বীকৃত হতেন, তখন দীর্ঘদিন কোনো লঘুসঙ্গীত গাইতেন না, অর্থাৎ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সঙ্গে লঘুসঙ্গীতের একটা সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়ে তাঁর মন-মেজাজের ওপরে প্রভাব ফেলুক, এটা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বরদাস্ত করতে পারতেন না। তাই লঘুসংগীত যখন গাইতেন, তখন আবার উচ্চাঙ্গসংগীতের পরিবেশ থেকে নিজেকে খানিকটা দূরেই রাখতে পছন্দ করতেন।

কালজয়ী বেসিক রেকর্ড, ফিল্মি গান, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের লেখা দেশাত্মবোধক গান, নানা ধরনের হিন্দি গীত, ভজন- এইসব গাওয়া সত্ত্বেও, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি ছিল কিন্তু তাঁর একটা বিশেষ ধরনের পক্ষপাতিত্ব। তাই তাঁর যখন প্রথম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের লং প্লেয়িং রেকর্ডটি প্রকাশিত হয় সাতের দশকের গোড়ার দিকে, সেটির দীর্ঘ আলোচনা দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই আলোচনার কথা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় খুব আনন্দের সঙ্গে মান্না দে-কে জানিয়েছিলেন। মানব বাবুর কাছ থেকে দেশ পত্রিকার সেই ইতিবাচক সমালোচনা শুনে মান্নাবাবুর মন্তব্য করেছিলেন; সন্ধ্যা আবার আজকাল ‘ক্লাসিক্যাল’ গাইছে নাকি?

ঘটনাটি হয়তো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে কিছুটা আহত করেই থাকবে, তাই অনেক সময় নানা আলাপচারিতায় ওই ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করতেন। আসলে কোনো ঘটনাকে বিবৃত করবার ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ পরিম-লে, ঘুরিয়ে কথা বলার মতো চাতুর্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছিল না। তাই সুরকার নচিকেতা ঘোষকে ঘিরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে হয়তো একটা চাপা দুঃখের আভাস তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিম-লে দিতে দ্বিধা করেননি।

হেমন্তবাবু তখন খ্যাতির শীর্ষে। সুরকার হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে তখনকার বোম্বে, আজকের মুম্বাইতে তাঁকে নিয়ে যান হেমন্তবাবু। কিন্তু সেই এক বছরে একটি গানেও তিনি নচিবাবুকে দিয়ে সুর করাননি। কার্যত অকর্মণ্য করে, মাইনে নিয়ে নচিবাবুর পক্ষে এই বসে থাকাটা খুব অস্বস্তিকর হচ্ছিল। এই সময় শারদ উৎসবের কিছুটা আগে কলকাতায় এসেছিলেন নচিবাবু। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেইবারের পুজোর গানটির সুর করবার।

গানটি লিখলেন প্রখ্যাত গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’ মোহাম্মদ রফির স্বল্প পরিচিত গান, ‘স্বপ্না লেকে আয়ে রে চান্দা’- এই গানটার একট বাংলা অনুবাদ শিবদাস বাবু করলেন। জীবনসায়হ্নে শিবদাসবাবুকে খুব গর্বের সঙ্গেই কথা বলতে শুনেছি যে, চলে যাওয়ার আগে এই আত্মতৃপ্তি আমার মধ্যে আছে, মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রার রিমেক হবে না।

এই গানটি বিভিন্ন মাহফিলে অসাধারণ ভঙ্গিমায় বিভিন্ন শব্দকে নানা আঙ্গিকে উচ্চারণ করে গাইতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গানটি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাথে অনেক আসরে তবলায় সঙ্গত করতেন রাধাকান্ত নন্দী। সেই দুর্লভ দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছে, তাঁরাই মনে করতে পারেন, রাধাকান্ত বাবু সম্বন্ধে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই উক্তি; রাধাকান্তপুর তবলা বাজাতেন না, তিনি তবলায় গান বাজাতেন, সেটির যথার্থতা।

শিবদাস বাবুর জীবনের একদম শেষ প্রান্তে তাঁকে কিছু আর্থিক সাহায্য করার জন্য আমাকে তিনি বললেন। সামান্য কিছু অর্থ শিবদাস বাবুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর হাতে তুলে দিলাম। পরবর্তীতে শিবদাস বাবু, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে, তাঁকে মনে রেখে, তাঁর আর্থিক দুরবস্থার কথা চিন্তা করে, এই যে অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো, তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছিলেন।

পরিচিত বৃত্তের ভিতরে টাকা ধার করার একটা বদভ্যাস ছিল নচিকেতা ঘোষের। মৃত্যুর পর যখন বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেই নিজের গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন মান্না দে, তখন কোনো কোনো পরিচিত মানুষ মান্না বাবুর কাছে বলেছিলেন, আপনি তো নচিবাবুর সুরে বহু গান গেয়েছেন। তাহলে আজকে কেন এত দূরে দূরে চলেছেন? মান্না বাবু তখন উত্তর দিয়েছিলেন; ডেড বডি যদি হাত পাতে। অর্থাৎ; যদি আবার টাকা ধার চায়।

যখন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের কোনো কনফারেন্সে গাইবার জন্য স্বীকৃত হতেন, তখন দীর্ঘদিন কোনো লঘুসঙ্গীত গাইতেন না, অর্থাৎ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সঙ্গে লঘুসঙ্গীতের একটা সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়ে তাঁর মন-মেজাজের ওপরে প্রভাব ফেলুক, এটা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বরদাস্ত করতে পারতেন না

অসাধারণ এই কথাটি উল্লেখ করতেন শ্যামল গুপ্ত। যখন এই কথাগুলো তিনি বলতেন, তখন কিন্তু কোনো রকম ইন্টারফেয়ার করতেন না সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মিটিমিটি হাসতেন। অর্থাৎ শ্যামল বাবুর কথায় যে তাঁর পূর্ণ সমর্থন আছে, সেটা বুঝিয়ে দিতেন কিন্তু তাই বলে কোনো সংযোজন-বিয়োজন, বিরোধিতা এইসব ওঁদের সম্পর্কের ভেতরে কখনো দেখতে পাওয়া যায়নি।

একবার শিলিগুড়িতে একটি জলসায় গাইতে চলেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। রাধাকান্ত বাবু ও আছেন। এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ে পতœী বেলা মুখোপাধ্যায়। তিনি আবদার ধরে বসলেন তাঁর স্বামী হেমন্তের কাছে, শিলিগুড়ি থেকে কিছু একটা নিয়ে এসো।

এই ঘটনাক্রম যখন বলা হচ্ছে তখন শিলিগুড়িতে হংকং মার্কেট তৈরি হয়নি। নানা রকম বিদেশী জিনিসপত্র পাওয়ার সুযোগ সুবিধে পরবর্তী সময়ের মতো ছিল না। তাই একটু আশ্চর্য হলেন হেমন্তবাবু। তিনি বললেন; শিলিগুড়ি থেকে কি জিনিস আনব? রাধাকান্ত বাবু কানে কানে বললেন বেলা দেবীর, শিলিগুড়ির গামছা কিন্তু খুব বিখ্যাত।

রাধাকান্তপুর মজাটা ধরতে পারলেন না বেলা মুখোপাধ্যায়। ব্যাপারটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে, তিনি স্বামী হেমন্তকে বললেন; তাহলে শিলিগুড়ি থেকে গেমছাই নিয়ে এসো।

এই সম্পর্কের নানা স্মৃতি রোমান্থনে কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শেষ জীবনে মাঝে মাঝে বিভোর হয়ে যেতেন। তখন যেন মনে হতো, তাঁর একদম শেষ দিকের গাওয়া সেই গানটার কথা; “আমার স্মৃতিতে অনুপম আর রবীন চট্টোপাধ্যায়, গানে গানে দিন, ছিল কি রঙিন, জাগে স্মৃতি এই রাতটায়।” সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলতেন: আমরা সংগীতজীবনের মানুষেরা হেমন্তদাকে যতটা চিনি জানি, তার থেকে অনেক বেশি হেমন্তদাকে চেনেন, জানেন সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে হিমালয় সদৃশ ব্যক্তিত্ব, তাকে সন্ধ্যা চিরদিন অত্যন্ত সম্মান আর মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন।

‘ছোটিসি মুলাকাত’ ফিল্ম করবার পর বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় অংশের মানুষদের অসহযোগিতায় ভয়ঙ্কর রকমের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন উত্তম কুমার। এই সময় তিনি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা সাম্মানিক নিয়ে, বিভিন্ন জলসায় অংশগ্রহণ করতেন। এই সময়ে বসুশ্রী সিনেমা হলের এক জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখনও এসে পৌঁছননি। উত্তম বাবু অনুরোধ করলেন তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে সেই বিখ্যাত গানটি “সপ্তপদী” ফিল্মের ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো’ গাইতে। অবলীলাক্রমে মঞ্চে গাইতে থাকেন সেই গানটা উত্তম কুমারের সাথে সন্ধ্যা।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে একটা আড়াল রাখতেই হয়েছিল, তা না হলে তাঁর মতো শিল্পীর সঙ্গীত সাধনা ব্যাহত হতো। সেই আড়ালটাকে তিনি হয়তো খানিকটা নিজের ইচ্ছেতেই ভেঙে দিয়েছিলেন শ্যামল গুপ্তর মৃত্যুর পর। শ্যামল গুপ্ত যতদিন বেঁচে ছিলেন, কখনো কোনো রকম রাজনীতির তাপ উত্তাপের ভিতরে পতœী সন্ধ্যাকে এতটুকু আসতে দেননি তিনি। নীলকণ্ঠের মতো সমস্ত রাজনীতি, সংগীতজগতের চাপানউতোর- এই সমস্ত কিছুতে নিজেকে সামলাতেন শ্যামল গুপ্ত।

শ্যামলবাবুর অসুস্থতার সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মহম্মদ সেলিম, শ্যামলী গুপ্তের মতো প্রথম সারির বামপন্থী নেতারা যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই সহযোগিতাকে আপন করে নিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এতটুকু দেরি লাগেনি। শ্যামল গুপ্তর মৃত্যুর খবর পেয়ে আধঘণ্টার মধ্যে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিমান বসুর মতো প্রথম সারির বামপন্থী নেতা মহঃ সেলিমকে সাথে নিয়ে।

সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ঘিরে এতটুকু বাড়তিত উচ্ছ্বাস সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিন্তু সেদিন দেখাননি। তার পরবর্তী যাপনচিত্র দেখে মনে হয়, হয়তো সেদিন তিনি বামপন্থী নেতাদের নিজের বাড়িতে দেখে খুব একটা খুশি হন নি। যদিও শ্যামল গুপ্তর মৃত্যুর সেই তাৎক্ষণিক মুহূর্ত বা তার পরবর্তী একটা দীর্ঘ সময়, যতদিন পর্যন্ত বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন ছিল, সেই সময় কালে, তাঁর চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যে ব্যবস্থাপনা, সেই ব্যবস্থাপনা গ্রহণে তিনি কখনো তাঁর অপারগতার কথা জানাননি। অপছন্দের বিষয়টিকেও প্রয়োজনের তাগিদে আপন করে নিতে পারার অসামান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছিল, তেমন বৈশিষ্ট্য খুব কম শিল্পীর মধ্যেই আমরা দেখতে পেয়েছি।

সন্ধ্যা মুখার্জী চিরদিন অন্তরালে থেকে, নিজের সংগীত সাধনা ঘিরেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করতেন। তাই যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, তখনকার শাসক শিবিরের পক্ষ থেকে নানা সময়ে, তাঁকে নানা ধরনের অনুরোধ-উপরোধ জানানো হতো। কিন্তু সেইসব অনুরোধগুলির ভেতরে যদি দেশ রক্ষার তাগিদ, দেশের সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ- এইসব বিষয়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকত, তাহলে সেগুলির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে দিতে কখনো দেরি করেননি।

তিনি যখন বেসিক রেকর্ড আর ফিল্মি গানের দৌলতে খ্যাতির শীর্ষে, সেই সময়কালের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে রাজভবনে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে সেবামূলক কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান হতো। সেইসব অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক ছিলেন কিন্তু উৎপলা সেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও বন্ধু উৎপলার আমন্ত্রণ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতেন। এইসব অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শ্রোতাদের মন মাতিয়ে দিতেন।

এই কর্মকা-ের ধারা আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গান গেয়ে শ্রোতাদের জয় করে, তার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ভাবনাকে তিনি মেলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সচেতন নাগরিক হিসেবে কখনো রাজপথ জনপথে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি মনে করতেন সচেতনতা ঘটাতে গেলে কেবলমাত্র সভা-সমিতিতে যেতে হবে, তার কোনো সঠিক অর্থ নেই। নিজের মতো করে, নিজের জীবনযাপনের ভেতর দিয়েও যে মানুষের কাজের প্রতি সমস্ত রকমের সম্মান, সহযোগিতা, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রাখা যায়, এটাই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর গোটা জীবন ধরে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন।

অবশ্য সেই ভাবধারার একবারই আমরা ব্যতিক্রম দেখেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি সমর্থনে রবীন্দ্রসদন চত্বরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ধর্ণায় বসেছিলেন। একেবারই তৃণমূল কংগ্রেস দলটির দলীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁর এই রাজনৈতিক অবস্থান। তাঁর গোটা জীবনের যাপনচিত্রের বৈশিষ্ট্য, এটি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। অনেকেই এটা বিশ্বাস করেন যে, শ্যামল গুপ্ত যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের সভা কার্যত যেটি হয়ে উঠেছিল, সেখানে ওই রকম রাজনৈতিক ভঙ্গিমায়, বুকে রাজনৈতিক স্লোগানের প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্রদের সঙ্গে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ধর্ণায় বসতেন না।

এই ব্যতিক্রমী কাজটি আরেকটি ক্ষেত্রে তাঁকে করতে দেখা গিয়েছিল, সেটি হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের পর, বামফ্রন্ট সরকারের নিয়োজিত রাজ্য সংগীত একাডেমির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত, প্রখ্যাত সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিবর্তে, তাঁকে নতুন সরকারি পদে নিযুক্ত করে নতুন সরকার। তিনি সেই পদটি গ্রহণ করেছিলেন।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে অপসারিত করে, সেই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান থেকে গিয়েছিল।