বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ

একাত্তরের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ মানুষকে হত্যাকা- চালিয়ে যায়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসের সঙ্গে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।

২১ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে গোয়ালন্দঘাটে হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের পর সকাল ৯টায় গোয়ালন্দঘাট দখল করে হানাদাররা। এরপর তারা ফরিদপুরে প্রবেশ করে। গোলেখামোত এলাকার মধ্যদিয়ে পাকিস্তানি শহরে প্রবেশ করে। এ সময় হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরে ছত্রীসেনা নামায় পাকিস্তানিরা। গোলেখারমত দিয়ে যাওয়ার সময় শ্রীঅঙ্গন মঠে কীর্তন হচ্ছিল। পাকিস্তানিরা সেখানে হামলা চালিয়ে গণহারে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি হানাদারদের আসার খবর শুনে কিছু সন্ন্যাসী মঠ থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু ৯ জন সন্ন্যাসী আশ্রম ছেড়ে যেতে রাজি হননি। সন্ন্যাসীরা সবাই কীর্তনে মগ্ন থাকার সময় পাকিস্তান হানাদাররা আশ্রম ঘেরাও করে। পাকিস্তানি হানাদাররা এরপর প্রার্থনা সভায় প্রবেশ করে সন্নাসীদের মন্দিরের সামনে চালতা গাছের নিচে টেনে নিয়ে যায়। সেখানে ৮ জন সন্ন্যাসীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। হত্যার পর পাকিস্তানি হানাদাররা ও বিহারিরা আশ্রমের সিন্দুক ভেঙে মূল্যবান জিনিসপত্র ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে সন্ন্যাসীদের লাশ ফরিদপুর পৌরসভার একটি ট্রাক নিয়ে যায়।

অন্যদিকে এদিন ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর একটি দল যশোরে পাকিস্তানি হানাদারদের নাভারন ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে ১০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহত হয় আরও ১০ জন।

এদিন মেজর ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য লাকসাম ত্যাগ করে কুমিল্লার মিয়ার বাজারে এসে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ২১ এপ্রিল দিনাজপুরের হিলিতে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী হিলি দখল করে নেয়।

এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের কিশোরগঞ্জ প্রতিরক্ষা ঘাঁটির ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে কিশোরগঞ্জের পতন হয়। একই দিন পাকিস্তানিরা দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড় শহর দখল করে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে, পুরো পঞ্চগড় বাজার পুড়িয়ে দেয়, বহু মানুষকে মহানন্দা নদীর পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি কেবল জাতিসংঘেই নন, বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

বাংলাদেশের প্রভাবশালী নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এদিনে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টদের কাছে গণহত্যা বন্ধের আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠান। বাংলাদেশের এক মুক্তাঞ্চল থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, গণচীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন লাই, সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ, চেয়ারম্যান কোসিগিন ও প্রধানমন্ত্রী পদগর্নি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিডো, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আরব লীগের মহাসচিব আবদেল খালেক হাসুনা ও আরব ঐক্য সংস্থার মহাসচিব দায়লো টেলির কাছে পাঠানো চিঠিতে অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগের আবেদন জানান।

তিনি বলেন, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর উচিত বাংলাদেশে যে সামরিক বাহিনীর বর্বরতা চালাচ্ছে তা স্বচক্ষে দেখার জন্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক পাঠানো। তাদের উচিত বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর যে ঘৃণ্য গণহত্যা চলছে তা অবলোকন করা।

ঢাকায় মুসলিম লীগ নেতা খান এ. সবুর সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতার জন্যে নিজ নিজ এলাকায় ভিজিলেন্স কমিটি গঠনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, শত্রুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উদ্দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সব ধরনের সাহায্য প্রদান বর্তমানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

২১ এপ্রিল ১৯৭১

বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একাত্তরের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ মানুষকে হত্যাকা- চালিয়ে যায়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসের সঙ্গে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।

২১ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে গোয়ালন্দঘাটে হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের পর সকাল ৯টায় গোয়ালন্দঘাট দখল করে হানাদাররা। এরপর তারা ফরিদপুরে প্রবেশ করে। গোলেখামোত এলাকার মধ্যদিয়ে পাকিস্তানি শহরে প্রবেশ করে। এ সময় হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরে ছত্রীসেনা নামায় পাকিস্তানিরা। গোলেখারমত দিয়ে যাওয়ার সময় শ্রীঅঙ্গন মঠে কীর্তন হচ্ছিল। পাকিস্তানিরা সেখানে হামলা চালিয়ে গণহারে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি হানাদারদের আসার খবর শুনে কিছু সন্ন্যাসী মঠ থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু ৯ জন সন্ন্যাসী আশ্রম ছেড়ে যেতে রাজি হননি। সন্ন্যাসীরা সবাই কীর্তনে মগ্ন থাকার সময় পাকিস্তান হানাদাররা আশ্রম ঘেরাও করে। পাকিস্তানি হানাদাররা এরপর প্রার্থনা সভায় প্রবেশ করে সন্নাসীদের মন্দিরের সামনে চালতা গাছের নিচে টেনে নিয়ে যায়। সেখানে ৮ জন সন্ন্যাসীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। হত্যার পর পাকিস্তানি হানাদাররা ও বিহারিরা আশ্রমের সিন্দুক ভেঙে মূল্যবান জিনিসপত্র ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে সন্ন্যাসীদের লাশ ফরিদপুর পৌরসভার একটি ট্রাক নিয়ে যায়।

অন্যদিকে এদিন ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর একটি দল যশোরে পাকিস্তানি হানাদারদের নাভারন ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে ১০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহত হয় আরও ১০ জন।

এদিন মেজর ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য লাকসাম ত্যাগ করে কুমিল্লার মিয়ার বাজারে এসে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ২১ এপ্রিল দিনাজপুরের হিলিতে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী হিলি দখল করে নেয়।

এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের কিশোরগঞ্জ প্রতিরক্ষা ঘাঁটির ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে কিশোরগঞ্জের পতন হয়। একই দিন পাকিস্তানিরা দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড় শহর দখল করে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে, পুরো পঞ্চগড় বাজার পুড়িয়ে দেয়, বহু মানুষকে মহানন্দা নদীর পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি কেবল জাতিসংঘেই নন, বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

বাংলাদেশের প্রভাবশালী নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এদিনে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টদের কাছে গণহত্যা বন্ধের আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠান। বাংলাদেশের এক মুক্তাঞ্চল থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, গণচীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন লাই, সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ, চেয়ারম্যান কোসিগিন ও প্রধানমন্ত্রী পদগর্নি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিডো, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আরব লীগের মহাসচিব আবদেল খালেক হাসুনা ও আরব ঐক্য সংস্থার মহাসচিব দায়লো টেলির কাছে পাঠানো চিঠিতে অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগের আবেদন জানান।

তিনি বলেন, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর উচিত বাংলাদেশে যে সামরিক বাহিনীর বর্বরতা চালাচ্ছে তা স্বচক্ষে দেখার জন্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক পাঠানো। তাদের উচিত বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর যে ঘৃণ্য গণহত্যা চলছে তা অবলোকন করা।

ঢাকায় মুসলিম লীগ নেতা খান এ. সবুর সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতার জন্যে নিজ নিজ এলাকায় ভিজিলেন্স কমিটি গঠনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, শত্রুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উদ্দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সব ধরনের সাহায্য প্রদান বর্তমানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।