‘এক সময় ভিক্ষা দিছি, আইজ ভিক্ষা নেই’

‘এক সময় এই হাত দিয়া ভিক্ষা দিছি, আইজ এই হাত দিয়া ভিক্ষা নেই। জীবন হইলো নদীর মতো গো মা, যখন ভাঙা শুরু হয় কিছু দিয়া থামান যায় না,’ বলছিলেন জেসমিন আক্তার।

ফার্মগেট এলাকায় ভিক্ষা করে জীবন চালান। ঘর ছিল, সংসার ছিল। সন্তানদের আবদার ছিল। প্রতিবেশীদের নিয়ে ছিল হাসি-ঠাট্টা-আনন্দ। এখন এই ভিক্ষার ওপরই তার অসুস্থ স্বামী- সন্তানের ভরন-পোষণ। তার কথায়, ‘আমি একা হইলে খাই না খাই পইরা থাকতাম কোনখানে।’

ছোট-খাটো গড়ন, এখনো লাজুক ভাব চোখে মুখে। পরনের কাপড়টা পুরনো হলেও বেশ পরিষ্কার। তার সঙ্গের কয়েকজন ভিক্ষুক কাউকে দেখলেই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন কিংবা গাড়ির কাছে ছুটে যাচ্ছেন। তা করছেন না মধ্য বয়সী এই নারী। কার কাছে হাত বাড়াবে ভাবতে দেখা যায়। ভিক্ষাটা এখনো ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারেননি বোঝা যায়।

তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হাতে ধরা প্লাস্টিকের বাটিটা এগিয়ে দেন। আস্তে করে বলেন, ‘কিছু দিবেন।’

জিজ্ঞেস করি, ‘কেন ভিক্ষা করছেন?’ এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘খাওয়াইবো কেডা। স্বামী পঙ্গু হয়া বিছানায়। তার ওষুধ কেডা কিনবো?’

এরপর একটু উদাস হয়ে যান। গ্রীষ্মের প্রচ- তাপে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে বলেন, ‘ভিক্ষা করতে কি ভালো লাগে। কিন্তু কী করবাম, ভিক্ষা ছাড়া উপায় ছিল না গো মা।’

জেসমিন বলেন, চার বছর আগে একদিন কাজ শেষে তার স্বামী জ্বর নিয়ে বাসায় আসে। সেই যে বিছানায় পড়ে, আজও সেই অবস্থা। তার শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। কারও সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না।

তার চিকিৎসায় জেসমিনের জমানো যে ক’টা টাকা ছিল তা শেষ হয়ে যায়। হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে ঘরে যা কিছু ছিল একে একে সব বেচে দেন। সবশেষ বাপের ভিটে বেচে দিয়ে এখন নিঃস্ব। জেসমিন বলেন, ‘ভাবছিলাম সে সুস্থ হইলে আমাগোর সমস্যা থাকবো না। কিন্তু কিছুই হইলো না। আমগোর এহন মাথা গোঁজারও জায়গা নাই।’

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার প্রত্যন্ত একটা গ্রাম। সেই গ্রামে ১৪ বছর বয়সে জেসমিন বউ হয়ে আসেন, গাড়ি চালক শাহাদাৎ ইসলামের সংসারে। শাহাদাৎ ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে গাড়ির চালক ছিলেন। ৩৩ বছরের সংসার জীবনে সব সুখোস্মৃতি গত ৪ বছরেই যেন শেষ হয়ে গেছে।

বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ নিয়ে ভরা সংসারে জেসমিনের দায়িত্বের শেষ ছিল না। বাড়ির বড় বউ বলে কথা। সংসারে সবাই থাকলেও তার ছিল বাড়তি দায়িত্ব। সেই ছোট্ট বয়সেই জেসমিন বেশ বুঝে নিয়েছিল তার ঘর-সংসার।

মাসে দুই চার দিন ভিক্ষুক বাড়িতে এলে ফেরাতেন না, তাদের যতœ করে খাওয়াতেন। অনেকদিন নিজের জন্য রাখা তরকারি তাদের খেতে দিয়ে নিজে মরিচ লবন দিয়ে ভাত খেয়েছেন।

শ্বশুর বাড়ির কাছে বড় আম গাছের নিচে একটা টং পাতা ছিল। সেই টংটা বিকেলে মেয়েদের

দখলে থাকতো। দুপুরের সব কাজ শেষে বিকেল গড়াতে না গড়াতে না আশপাশের মেয়ে-বউরা ওই টংয়ে এসে জড়ো হত। চলতো হাসি ঠাট্টা। বিশেষ করে গরমে এটা ছিল রোজকার রুটিন।

জেসমিন বলেন, ‘কখনো এমন দিন ছিল আমি ভুইলাই গেছি। এখন তো একটাই চিন্তা, পেটের চিন্তা।’

জেসমিন শুনেছেন ঢাকায় ভিক্ষুকদের ভালো আয় হয়। আর ময়মনসিংহে এই কাজ করতে চাননি। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে লজ্জা পেতে হবে বলে।

জেসমিন বলেন, ‘গেরামে কাম কাজ নাই। কম দুঃখে এই কামে বাইর হইছি না।’

স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর অনেকেই ছেড়ে চলে গেছে। এখন সে ভিক্ষুক হওয়ায় সবাই তাদের ছেড়ে চলে গেছে জানিয়ে জেসমিন বলেন ‘কেউ নাই আমার। দেবর, ননদ, আত্মীয়-স্বজন কেউ এখন আর খোঁজ নেয় না। অথচ আমার স্বামীর টেয়া দিয়াই ওই সংসার চলতো।’

‘বাড়িতে সবাই অপেক্ষা কইরা থাকতো কুনদিন হেয় (শাহাদাৎ) আইবো। কারও কিছু লাগলে তার কাছেই কইতো’ দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে বসে পড়েন জেসমিন। এবার গলা ধরে আসে তার। স্মৃতি কথায় যেন পেয়ে বসে তাকে।

‘সবার সব আবদার পূরণ করতো আমার স্বামী। তহন টেয়া (টাকা) আছিল, ইচ্ছামতো খরচ করছে, আইজ আমি ভিক্ষা করি।’

শ্বশুর-শাশুড়ি অনেক আগেই মারা গেছেন। দেবর, ননদ আলাদা হয়ে গেছেন। তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। দুই মেয়ের একজনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু অসুস্থ বাবার দেখা-শোনা করার জন্য তার বিয়ে দিতে দেরি করছেন।

ভিক্ষুক জীবনের শুরুতে প্রতিদিন যাওয়া আসা করতেন ঢাকা-ময়মনসিংহ-নান্দাইল। সে সময় খুব কষ্ট হত। ট্রেনের ঠিক না থাকেলে আরও বিপাকে পড়তেন। এখন কয়েকদিন পর পর বাড়ি যান। মেয়ের জন্য সমস্যা হয়ে গেছে। অসুস্থ স্বামী, কৈশোর পার করা মেয়েকে নিয়ে খুবই চিন্তায় থাকেন তিনি।

বলেন, ‘একটা গরু যদি কিনতে পারতাম। মুদি দোকান দিতে পারলে মেয়েটারে বিয়া দিয়া জামাইরে বসাইতাম দোকানে-’ এ কথার সঙ্গে দূরে দৃষ্টি চলে যায় জেসমিনের। ‘ভালো থাইকেন।’ বলেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত চলে যায়।

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

‘এক সময় ভিক্ষা দিছি, আইজ ভিক্ষা নেই’

জাহিদা পারভেজ

image

‘এক সময় এই হাত দিয়া ভিক্ষা দিছি, আইজ এই হাত দিয়া ভিক্ষা নেই। জীবন হইলো নদীর মতো গো মা, যখন ভাঙা শুরু হয় কিছু দিয়া থামান যায় না,’ বলছিলেন জেসমিন আক্তার।

ফার্মগেট এলাকায় ভিক্ষা করে জীবন চালান। ঘর ছিল, সংসার ছিল। সন্তানদের আবদার ছিল। প্রতিবেশীদের নিয়ে ছিল হাসি-ঠাট্টা-আনন্দ। এখন এই ভিক্ষার ওপরই তার অসুস্থ স্বামী- সন্তানের ভরন-পোষণ। তার কথায়, ‘আমি একা হইলে খাই না খাই পইরা থাকতাম কোনখানে।’

ছোট-খাটো গড়ন, এখনো লাজুক ভাব চোখে মুখে। পরনের কাপড়টা পুরনো হলেও বেশ পরিষ্কার। তার সঙ্গের কয়েকজন ভিক্ষুক কাউকে দেখলেই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন কিংবা গাড়ির কাছে ছুটে যাচ্ছেন। তা করছেন না মধ্য বয়সী এই নারী। কার কাছে হাত বাড়াবে ভাবতে দেখা যায়। ভিক্ষাটা এখনো ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারেননি বোঝা যায়।

তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হাতে ধরা প্লাস্টিকের বাটিটা এগিয়ে দেন। আস্তে করে বলেন, ‘কিছু দিবেন।’

জিজ্ঞেস করি, ‘কেন ভিক্ষা করছেন?’ এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘খাওয়াইবো কেডা। স্বামী পঙ্গু হয়া বিছানায়। তার ওষুধ কেডা কিনবো?’

এরপর একটু উদাস হয়ে যান। গ্রীষ্মের প্রচ- তাপে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে বলেন, ‘ভিক্ষা করতে কি ভালো লাগে। কিন্তু কী করবাম, ভিক্ষা ছাড়া উপায় ছিল না গো মা।’

জেসমিন বলেন, চার বছর আগে একদিন কাজ শেষে তার স্বামী জ্বর নিয়ে বাসায় আসে। সেই যে বিছানায় পড়ে, আজও সেই অবস্থা। তার শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। কারও সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না।

তার চিকিৎসায় জেসমিনের জমানো যে ক’টা টাকা ছিল তা শেষ হয়ে যায়। হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে ঘরে যা কিছু ছিল একে একে সব বেচে দেন। সবশেষ বাপের ভিটে বেচে দিয়ে এখন নিঃস্ব। জেসমিন বলেন, ‘ভাবছিলাম সে সুস্থ হইলে আমাগোর সমস্যা থাকবো না। কিন্তু কিছুই হইলো না। আমগোর এহন মাথা গোঁজারও জায়গা নাই।’

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার প্রত্যন্ত একটা গ্রাম। সেই গ্রামে ১৪ বছর বয়সে জেসমিন বউ হয়ে আসেন, গাড়ি চালক শাহাদাৎ ইসলামের সংসারে। শাহাদাৎ ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে গাড়ির চালক ছিলেন। ৩৩ বছরের সংসার জীবনে সব সুখোস্মৃতি গত ৪ বছরেই যেন শেষ হয়ে গেছে।

বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ নিয়ে ভরা সংসারে জেসমিনের দায়িত্বের শেষ ছিল না। বাড়ির বড় বউ বলে কথা। সংসারে সবাই থাকলেও তার ছিল বাড়তি দায়িত্ব। সেই ছোট্ট বয়সেই জেসমিন বেশ বুঝে নিয়েছিল তার ঘর-সংসার।

মাসে দুই চার দিন ভিক্ষুক বাড়িতে এলে ফেরাতেন না, তাদের যতœ করে খাওয়াতেন। অনেকদিন নিজের জন্য রাখা তরকারি তাদের খেতে দিয়ে নিজে মরিচ লবন দিয়ে ভাত খেয়েছেন।

শ্বশুর বাড়ির কাছে বড় আম গাছের নিচে একটা টং পাতা ছিল। সেই টংটা বিকেলে মেয়েদের

দখলে থাকতো। দুপুরের সব কাজ শেষে বিকেল গড়াতে না গড়াতে না আশপাশের মেয়ে-বউরা ওই টংয়ে এসে জড়ো হত। চলতো হাসি ঠাট্টা। বিশেষ করে গরমে এটা ছিল রোজকার রুটিন।

জেসমিন বলেন, ‘কখনো এমন দিন ছিল আমি ভুইলাই গেছি। এখন তো একটাই চিন্তা, পেটের চিন্তা।’

জেসমিন শুনেছেন ঢাকায় ভিক্ষুকদের ভালো আয় হয়। আর ময়মনসিংহে এই কাজ করতে চাননি। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে লজ্জা পেতে হবে বলে।

জেসমিন বলেন, ‘গেরামে কাম কাজ নাই। কম দুঃখে এই কামে বাইর হইছি না।’

স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর অনেকেই ছেড়ে চলে গেছে। এখন সে ভিক্ষুক হওয়ায় সবাই তাদের ছেড়ে চলে গেছে জানিয়ে জেসমিন বলেন ‘কেউ নাই আমার। দেবর, ননদ, আত্মীয়-স্বজন কেউ এখন আর খোঁজ নেয় না। অথচ আমার স্বামীর টেয়া দিয়াই ওই সংসার চলতো।’

‘বাড়িতে সবাই অপেক্ষা কইরা থাকতো কুনদিন হেয় (শাহাদাৎ) আইবো। কারও কিছু লাগলে তার কাছেই কইতো’ দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে বসে পড়েন জেসমিন। এবার গলা ধরে আসে তার। স্মৃতি কথায় যেন পেয়ে বসে তাকে।

‘সবার সব আবদার পূরণ করতো আমার স্বামী। তহন টেয়া (টাকা) আছিল, ইচ্ছামতো খরচ করছে, আইজ আমি ভিক্ষা করি।’

শ্বশুর-শাশুড়ি অনেক আগেই মারা গেছেন। দেবর, ননদ আলাদা হয়ে গেছেন। তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। দুই মেয়ের একজনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু অসুস্থ বাবার দেখা-শোনা করার জন্য তার বিয়ে দিতে দেরি করছেন।

ভিক্ষুক জীবনের শুরুতে প্রতিদিন যাওয়া আসা করতেন ঢাকা-ময়মনসিংহ-নান্দাইল। সে সময় খুব কষ্ট হত। ট্রেনের ঠিক না থাকেলে আরও বিপাকে পড়তেন। এখন কয়েকদিন পর পর বাড়ি যান। মেয়ের জন্য সমস্যা হয়ে গেছে। অসুস্থ স্বামী, কৈশোর পার করা মেয়েকে নিয়ে খুবই চিন্তায় থাকেন তিনি।

বলেন, ‘একটা গরু যদি কিনতে পারতাম। মুদি দোকান দিতে পারলে মেয়েটারে বিয়া দিয়া জামাইরে বসাইতাম দোকানে-’ এ কথার সঙ্গে দূরে দৃষ্টি চলে যায় জেসমিনের। ‘ভালো থাইকেন।’ বলেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত চলে যায়।