নয়া-উদারতাবাদ ও ডুবন্ত হাওর

পাভেল পার্থ

একে একে ডুবছে হাওর। পেটবোঝাই পুষ্ট, অপুষ্ট দানা নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ধানের জমি। এসব জমি বেশ প্রাচীন, বলা চলে জীবন্ত প্রতœতাত্ত্বিক কৃষিজমি। দেখার হাওর, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, সজনার হাইর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, ঘুইঙ্গাজুড়ি হাওর, জালিয়ার হাওর, বাওরবাগ, খরচার হাওর, পাথরচাউলি, গুরমার হাওর বা চেপটির হাওরের মতো আদি বৈশিষ্ট্যের সব জমিন আজ পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। গত ৩০ বছর ধরে এভাবেই জমিনবোঝাই ফসল নিয়ে প্রশ্নহীনভাবে তলিয়ে যাচ্ছে হাওর।

বাংলাদেশকে যদি ছয় ভাগ করা হয়, তার এক ভাগ হলো হাওরভাটি। হাওরে ধান মওসুম মূলত একটাই, বোরো মওসুম। আর এই মওসুম ঘিরেই হাওরবাসী পুরো বছরের টিকে থাকার প্রস্তুতি নেয়। এমনিতেই চৈত্র মাসে হাওরে চলে চৈত্রের নিদান। শস্যের আকাল। এর ভেতর একমাত্র ফসল তলিয়ে গেলে সেই নিদানের রূপ কেমন হয় তা শুধু হাওরবাসীই জানে। কেউ এই নিদানকালে হাওর আগলে দাঁড়ায় না। লাগাতার রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অন্যায় আর অনাচারের ভেতরেই জেগে থাকে হাওর। দেশকে জোগায় ধান আর মাছ, দুনিয়াকে উপহার দেয় গান ও বৈচিত্র্যের বিন্যাস। চৈত্র-বৈশাখে অবিরত বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওরের তলিয়ে যাওয়া নতুন কোন ঘটনা নয়। এটি ঐতিহাসিক এবং সুরাহাহীনভাবেই ঘটে চলেছে। হাওরের বিশেষ বাস্তুসংস্থানই হাওরবাসীকে এ অঞ্চলে টিকে থাকবার সংগ্রামে প্রতিদিন নতুনভাবে প্রস্তুত করে তুলে। রাষ্ট্র এই প্রস্তুতির দিকে ফিরেও তাকায় না। সবকিছু ডুবে তলিয়ে গেলে সরকার কিছু উফশী ধানের বস্তা জোগান দেয়। কখনোবা ঘর তোলার জন্য কয়েক বান্ডিল ঢেউ টিন।

হাওরের উন্নয়ন বলতে মূলধারা এখনো বুঝে ডুবন্ত রাস্তা, ফসল রক্ষা বাঁধ আর বাণিজ্যিক মাছ চাষর জন্য বিল জলাভূমির ইজারাকে। আর এ নিয়েই বছরভর লেগে থাকে ভাগ-বাটোয়ারার দরবার, কোন্দল আর দুর্নীতি। হাওরের উজান-ভাটির শর্তকে কেউই মান্য করে না। প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখে পাহাড়ি ঢলে ধান জমিন তলিয়ে গেলে এ নিয়ে কিছু দিন কথা হয়। গণমাধ্যমে কিছু লেখালেখি ও প্রচার চলে। তারপর আবারো সব নিশ্চুপ। আবার পরের বছরের চৈত্র মাসের তলিয়ে যাওয়া দিয়ে শুরু হয়। শুধু তর্ক চলে ফসল রক্ষা বাঁধ বানাতে কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, কে কত ভাগ পেল, কী পায়নি, কোন চেয়ারম্যান কত টাকা মেরেছে, কোন ঠিকাদার কাজ না করে চলে গেছে। কেউ কোন দায়িত্ব নেয় না। দায় নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। হাওরের সুরক্ষাপ্রশ্ন কোনোভাবেই বাঁধ, ইজারা আর অবকাঠামোর সঙ্গে জড়িত নয়। হাওরের সঙ্গে সম্পর্কহীন বা হাওরের উজান-ভাটির বিজ্ঞান বুঝতে না পারা উন্নয়নবিদদের চাপিয়ে দেয়া উন্নয়নচিন্তাই হাওরকে প্রতি বছর তলিয়ে দেয়। বাঁধ দিয়ে কী কোনভাবেই হাওরের সুরক্ষা সম্ভব? শনির হাওরের জন্য বাঁধ দিলে মাটিয়ান হাওর ডুবে মরে। হাকালুকির উত্তরে বান দিলে দক্ষিণে নিদান শুরু হয়। হাওরের সুরক্ষাকে রং-বেরঙের উন্নয়নের রোদচশমা চোখে দিয়ে নয়, দেখতে হবে হাওরের চোখেই। হাওরবাসীর উজান-ভাটির অঙ্ক থেকেই।

২.

তো, হাওরের এই উজান-ভাটির অঙ্কটি কী? হাওরাঞ্চলগুলো ভাটিতে অবস্থিত। এ কারণেই হাওরাঞ্চল হলো দেশের ভাটি-বাংলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ ছাড়া দেশের প্রায় হাওরগুলোই উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের কাছাকাছি। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি উজানে জন্ম নিয়েছে শতসহস্র পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়া। এই পাহাড়ি জলধারাই বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর উৎসস্থল। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি দুনিয়ার সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল অঞ্চল। পানির ধর্ম উজান থেকে ভাটিতে গড়িয়ে পড়া। মেঘালয় পাহাড়ের উজানের পানি ভাটির হাওরে নামবেই। বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলও বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল। চৈত্র-বৈশাখের বর্ষণের ঢল উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় থেকে বাংলাদেশের ভাটির হাওরের নেমে আসে বলেই এই ঢল ‘পাহাইড়্যা পানি বা পাহাড়ি ঢল’ নামে পরিচিত। আর এই পাহাড়ি ঢলেই আজ তলিয়ে যাচ্ছে ভাটির হাওর।

পাহাড়ি ঢলের ফলে তৈরি প্লাবিত এই অসনীয় অবস্থাকে হাওরের অভিধানে বলে ‘আফাল’। কালবৈশাখী ঝড় আর বাতাসের গতি আটকে পড়া পাহাড়ি ঢলের পানিতে ‘আফরমারা’ তীব্র ঢেউ তৈরি করে। পাহাড়ি ঢল থেকে হাওরের সুরক্ষায় আফাল ও আফরমারাকে বোঝা জরুরি। কেবল ইট-সিমেন্টের বাঁধ ঘিরে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মাপে হাওরকে বোঝা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় আর ভাটির বাংলাদেশের হাওরের এ সম্পর্ক কত দিনের? সম্পর্কটি যদি ঐতিহাসিক হয়, তবে আজ কেন ভাটিতে এ যন্ত্রণা? হাওরের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ের সম্পর্কটি ঐতিহাসিক।

ময়মনসিংহ গীতিকা ও সিলেটি বারোমাসীর মতো হাওরের প্রাচীন দলিলগুলোতে এর সত্যতা মেলে। উজানের পাহাড় থেকে জল গড়িয়ে নামতো ভাটির হাওরে। এ যেন নাইওরী আসা, জলের নাইওরী। পুরো বর্ষাকাল এই জল নাইওরী কাটিয়ে নানান নদীর প্রবাহে চলে যেত সমুদ্রে। জংগল পাহাড় থেকে ঝিরিছড়া হয়ে নদী ও হাওর এবং তারপর সমুদ্র, জলপ্রবাহের এই দীর্ঘ পরিভ্রমণে হাওরাঞ্চল পেত বৈশাখী জলের এক বিশেষ স্পর্শ। এ স্পর্শে কোন আঘাত, যন্ত্রণা বা তলিয়ে যাওয়ার ছল ছিল না। বরং ওই জলে জীবনের টান ছিল। রাধারমণ থেকে শাহ আবদুল করিম কেউই এই জলের টান অস্বীকার করতে পারেননি। আর তাই এখনো সেই টান জাগিয়ে রাখেন ভাটির নারীরা ধামাইল গানের নাচে, ...জলে গিয়াছিলাম সই, কালা কাজলের পাখি দেইখ্যা আইলাম অই। কিন্তু এখন আর কালা কাজলের পাখি দেখে ঘরে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। এখন পাহাড়ি ঢলের গতিপ্রকৃতি বোঝা যায় না, দুম করেই পাহাড়ি ঢলের তলায় সব হারিয়ে যায়। তো হাওরের এমন অবস্থাটি কেমন করে হলো?

৩.

স্কটল্যান্ড থেকে ভাগ্য বদলানোর জন্য রবার্ট লিন্ডসে শাসনের নামে সম্পদ লুটপাট করতে সিলেট এসেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশকালে। ব্রিটিশ রানীকে ঘুষ দিয়ে বারো বছর সিলেট শাসন করেছেন। লিন্ডসে তার লেখায় তখনকার ভাটির সিলেট ও উত্তরপূর্ব ভারতের যে বিবরণ দিয়েছেন সেখানেও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়ার এমন মর্মান্তিক কোন হদিশ নেই। বরং পাহাড় ও হাওরের পুরো অঞ্চলজুড়ে গভীর বনভূমির কথা আছে। এমনকি সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো পাহাড় সীমান্তসংলগ্ন গভীর জলাবন। হাওর অভিধানে তাই ‘করচের বাগ’, ‘হিজলের বাগ, ‘নল-নটার বন, ‘ইকর-আটিয়ার বন’ এগুলো খুবই প্রচলিত শব্দ। মেঘালয় পাহাড়জুড়ে যেমন মিশ্র বর্ষারণ্য, হাওরজুড়ে জলাবন। চৈত্র-বৈশাখের কালবৈশাখী থেকে শুরু করে অবিরাম বর্ষণ উজানের বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে ভাটিতে গড়িয়ে পড়ত। এসব পাহাড়ি বনে বুনো লতা, ঘাস, গুল্ম এবং বৃক্ষের আচ্ছাদন বৃষ্টির পানির ধারাকে দুম করে গড়িয়ে পড়তে বাধা দিত।

পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ‘ছাঁকনি বা চুইয়ে পড়া নীতিতে’ উজান থেকে ভাটির হাওরে নামত। ১৯৬০ সনের দিকে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও পাহাড়ি ঢলের এই নামতা হাওরবাসীর মুখস্থ ছিল। টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢল নামলে মাটিয়ান বা খরচার হাওর পর্যন্ত আসতে কত সময় লাগবে সেই হিসেব মানুষের ছিল। আকাশের নানা কোণে কী রঙের কী ধাঁচের মেঘ জমল তাই দেখে হাওরের বুড়িগুলো আগে আফালের হিসাব কষতে জানত। এখন এসব বুড়িগুলোও নেই আর প্রবীণ জংগলও নেই। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রাকৃতিক বনভূমি বিনাশ করে বহুজাতিক খনি প্রকল্প তৈরি হয়েছে। মেঘালয় পাহাড় আজ কয়লা আর চুনাপাথর তুলতে তুলতে ফাঁপা হয়ে গেছে। অল্পবিস্তর বৃষ্টিতেই আজ মেঘালয় পাহাড় ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশের হাওরে। এখন উজানের পাহাড় থেকে শুধু ঢল নয়, নামে পাহাড়ি বালি ও পাথর-কাঁকরের স্তূপ। উজানের পাহাড়ি বালিতে হাওর ভাটির প্রায় নিম্নভূমি, জলাঞ্চল, বিল ও নদীগুলো আজ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে যাওয়া হাওরভূমিতে এখন বৃষ্টির পানি ধরে রাখবার মতো বৈশিষ্ট্য নেই। তাই অল্প বৃষ্টি, এমনকি চৈত্রের প্রথম বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় হাওর। প্লাবিত হয়, মূলত বৃষ্টির জল কোথাও প্রবাহিত হতে না পেরে হাওর ভূমির কৃষি জমিতেই ছড়িয়ে পড়ে, প্লাবিত হয়। তাই মূলত ডুবে যায় হাওরের ধান জমিনগুলো। অথচ মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়েই আছে বালফাকরাম সংরক্ষিত বনভূমি। বন থাকার কারণে বালফাকরামের ভাটিতে কিন্তু পাহাড়ি ঢলে এখনো তলিয়ে যায়না সেখানকার নিম্নাঞ্চল।

৪.

এ তো গেল উজানের কথা, ভাটিতে কী তাহলে জলপ্রবাহের অঙ্ক ঠিক আছে? না ভাটিতেও উজানের মতোই প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহকে গলাটিপে ধরা হয়েছে। প্রভাবশালীদের ইজারার মাধ্যমে হাওর আজ বাণিজ্যিক মৎস্য খামার। পাহাড়ি বালি পাথর বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে একদল মুনাফাখোর। এই জল ও বালিমহাল ইজারাদাররাই আজ হাওর নিয়ন্ত্রণ করছে। এই মনস্তত্ত্ব চায় মেঘালয় পাহাড় ভেঙে হাওর ভরাট হয়ে যাক এবং বছর বছর তলিয়ে যাক। উজানের খনি ব্যবসায়ী ও ভাটির ইজারাদারেরা মূলত একই নয়াউদারবাদী করপোরেট মনস্তত্ত্ব ধারণ করে। হাওরের নদী ও প্রবাহগুলোকে আটকে দেয়া হয়েছে। উজান থেকে ভাটিতে বৃষ্টির ঢল গড়িয়ে যাওয়ার পথ বারবার বন্ধ করে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই হাওরের সুরক্ষা দিতে পারেনি। হাওরের এ উজান-ভাটির অঙ্কটি সচল রাখার দাবি কোনভাবেই আজকের নতুন নয়, ভাসান পানির আন্দোলনের থেকেই হাওরবাসী এই দাবি করে আসছেন। নিদারুণভাবে আজ নয়াউদারবাদী মুনাফার ময়দানে জিম্মি হয়ে আছে হাওর। পাহাড়ি ঢলে হাওরের এ তলিয়ে যাওয়া বিষয়টি পুরোপুরো একটি আন্তঃরাষ্ট্রিক সংকট।

বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই এক বহুপক্ষীয় জলাভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণের ভেতর দিয়েই শুধু এর সুরাহা সম্ভব। হাওরের অভীন্ন নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন কখনোই কোন ন্যায়বিচার করেনি। তাহলে কীভাবে হবে? চৈত্র-বৈশাখে হাওর তলিয়েই যাবে। উজান কিংবা ভাটিতে যে উন্নয়ন বাহাদুরি বহাল আছে তাতে বছর বছর ডুববে হাওর। আর হাওরবাসী দিন দিন হাওর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হবে। পেছনে পড়ে থাকবে করিমের বান্ধা কী রাধারমণের ধামাইলের বিদীর্ণ আহাজারি।

[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ]

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

নয়া-উদারতাবাদ ও ডুবন্ত হাওর

পাভেল পার্থ

একে একে ডুবছে হাওর। পেটবোঝাই পুষ্ট, অপুষ্ট দানা নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ধানের জমি। এসব জমি বেশ প্রাচীন, বলা চলে জীবন্ত প্রতœতাত্ত্বিক কৃষিজমি। দেখার হাওর, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, সজনার হাইর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, ঘুইঙ্গাজুড়ি হাওর, জালিয়ার হাওর, বাওরবাগ, খরচার হাওর, পাথরচাউলি, গুরমার হাওর বা চেপটির হাওরের মতো আদি বৈশিষ্ট্যের সব জমিন আজ পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। গত ৩০ বছর ধরে এভাবেই জমিনবোঝাই ফসল নিয়ে প্রশ্নহীনভাবে তলিয়ে যাচ্ছে হাওর।

বাংলাদেশকে যদি ছয় ভাগ করা হয়, তার এক ভাগ হলো হাওরভাটি। হাওরে ধান মওসুম মূলত একটাই, বোরো মওসুম। আর এই মওসুম ঘিরেই হাওরবাসী পুরো বছরের টিকে থাকার প্রস্তুতি নেয়। এমনিতেই চৈত্র মাসে হাওরে চলে চৈত্রের নিদান। শস্যের আকাল। এর ভেতর একমাত্র ফসল তলিয়ে গেলে সেই নিদানের রূপ কেমন হয় তা শুধু হাওরবাসীই জানে। কেউ এই নিদানকালে হাওর আগলে দাঁড়ায় না। লাগাতার রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অন্যায় আর অনাচারের ভেতরেই জেগে থাকে হাওর। দেশকে জোগায় ধান আর মাছ, দুনিয়াকে উপহার দেয় গান ও বৈচিত্র্যের বিন্যাস। চৈত্র-বৈশাখে অবিরত বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওরের তলিয়ে যাওয়া নতুন কোন ঘটনা নয়। এটি ঐতিহাসিক এবং সুরাহাহীনভাবেই ঘটে চলেছে। হাওরের বিশেষ বাস্তুসংস্থানই হাওরবাসীকে এ অঞ্চলে টিকে থাকবার সংগ্রামে প্রতিদিন নতুনভাবে প্রস্তুত করে তুলে। রাষ্ট্র এই প্রস্তুতির দিকে ফিরেও তাকায় না। সবকিছু ডুবে তলিয়ে গেলে সরকার কিছু উফশী ধানের বস্তা জোগান দেয়। কখনোবা ঘর তোলার জন্য কয়েক বান্ডিল ঢেউ টিন।

হাওরের উন্নয়ন বলতে মূলধারা এখনো বুঝে ডুবন্ত রাস্তা, ফসল রক্ষা বাঁধ আর বাণিজ্যিক মাছ চাষর জন্য বিল জলাভূমির ইজারাকে। আর এ নিয়েই বছরভর লেগে থাকে ভাগ-বাটোয়ারার দরবার, কোন্দল আর দুর্নীতি। হাওরের উজান-ভাটির শর্তকে কেউই মান্য করে না। প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখে পাহাড়ি ঢলে ধান জমিন তলিয়ে গেলে এ নিয়ে কিছু দিন কথা হয়। গণমাধ্যমে কিছু লেখালেখি ও প্রচার চলে। তারপর আবারো সব নিশ্চুপ। আবার পরের বছরের চৈত্র মাসের তলিয়ে যাওয়া দিয়ে শুরু হয়। শুধু তর্ক চলে ফসল রক্ষা বাঁধ বানাতে কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, কে কত ভাগ পেল, কী পায়নি, কোন চেয়ারম্যান কত টাকা মেরেছে, কোন ঠিকাদার কাজ না করে চলে গেছে। কেউ কোন দায়িত্ব নেয় না। দায় নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। হাওরের সুরক্ষাপ্রশ্ন কোনোভাবেই বাঁধ, ইজারা আর অবকাঠামোর সঙ্গে জড়িত নয়। হাওরের সঙ্গে সম্পর্কহীন বা হাওরের উজান-ভাটির বিজ্ঞান বুঝতে না পারা উন্নয়নবিদদের চাপিয়ে দেয়া উন্নয়নচিন্তাই হাওরকে প্রতি বছর তলিয়ে দেয়। বাঁধ দিয়ে কী কোনভাবেই হাওরের সুরক্ষা সম্ভব? শনির হাওরের জন্য বাঁধ দিলে মাটিয়ান হাওর ডুবে মরে। হাকালুকির উত্তরে বান দিলে দক্ষিণে নিদান শুরু হয়। হাওরের সুরক্ষাকে রং-বেরঙের উন্নয়নের রোদচশমা চোখে দিয়ে নয়, দেখতে হবে হাওরের চোখেই। হাওরবাসীর উজান-ভাটির অঙ্ক থেকেই।

২.

তো, হাওরের এই উজান-ভাটির অঙ্কটি কী? হাওরাঞ্চলগুলো ভাটিতে অবস্থিত। এ কারণেই হাওরাঞ্চল হলো দেশের ভাটি-বাংলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ ছাড়া দেশের প্রায় হাওরগুলোই উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের কাছাকাছি। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি উজানে জন্ম নিয়েছে শতসহস্র পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়া। এই পাহাড়ি জলধারাই বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর উৎসস্থল। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি দুনিয়ার সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল অঞ্চল। পানির ধর্ম উজান থেকে ভাটিতে গড়িয়ে পড়া। মেঘালয় পাহাড়ের উজানের পানি ভাটির হাওরে নামবেই। বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলও বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল। চৈত্র-বৈশাখের বর্ষণের ঢল উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় থেকে বাংলাদেশের ভাটির হাওরের নেমে আসে বলেই এই ঢল ‘পাহাইড়্যা পানি বা পাহাড়ি ঢল’ নামে পরিচিত। আর এই পাহাড়ি ঢলেই আজ তলিয়ে যাচ্ছে ভাটির হাওর।

পাহাড়ি ঢলের ফলে তৈরি প্লাবিত এই অসনীয় অবস্থাকে হাওরের অভিধানে বলে ‘আফাল’। কালবৈশাখী ঝড় আর বাতাসের গতি আটকে পড়া পাহাড়ি ঢলের পানিতে ‘আফরমারা’ তীব্র ঢেউ তৈরি করে। পাহাড়ি ঢল থেকে হাওরের সুরক্ষায় আফাল ও আফরমারাকে বোঝা জরুরি। কেবল ইট-সিমেন্টের বাঁধ ঘিরে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মাপে হাওরকে বোঝা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় আর ভাটির বাংলাদেশের হাওরের এ সম্পর্ক কত দিনের? সম্পর্কটি যদি ঐতিহাসিক হয়, তবে আজ কেন ভাটিতে এ যন্ত্রণা? হাওরের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ের সম্পর্কটি ঐতিহাসিক।

ময়মনসিংহ গীতিকা ও সিলেটি বারোমাসীর মতো হাওরের প্রাচীন দলিলগুলোতে এর সত্যতা মেলে। উজানের পাহাড় থেকে জল গড়িয়ে নামতো ভাটির হাওরে। এ যেন নাইওরী আসা, জলের নাইওরী। পুরো বর্ষাকাল এই জল নাইওরী কাটিয়ে নানান নদীর প্রবাহে চলে যেত সমুদ্রে। জংগল পাহাড় থেকে ঝিরিছড়া হয়ে নদী ও হাওর এবং তারপর সমুদ্র, জলপ্রবাহের এই দীর্ঘ পরিভ্রমণে হাওরাঞ্চল পেত বৈশাখী জলের এক বিশেষ স্পর্শ। এ স্পর্শে কোন আঘাত, যন্ত্রণা বা তলিয়ে যাওয়ার ছল ছিল না। বরং ওই জলে জীবনের টান ছিল। রাধারমণ থেকে শাহ আবদুল করিম কেউই এই জলের টান অস্বীকার করতে পারেননি। আর তাই এখনো সেই টান জাগিয়ে রাখেন ভাটির নারীরা ধামাইল গানের নাচে, ...জলে গিয়াছিলাম সই, কালা কাজলের পাখি দেইখ্যা আইলাম অই। কিন্তু এখন আর কালা কাজলের পাখি দেখে ঘরে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। এখন পাহাড়ি ঢলের গতিপ্রকৃতি বোঝা যায় না, দুম করেই পাহাড়ি ঢলের তলায় সব হারিয়ে যায়। তো হাওরের এমন অবস্থাটি কেমন করে হলো?

৩.

স্কটল্যান্ড থেকে ভাগ্য বদলানোর জন্য রবার্ট লিন্ডসে শাসনের নামে সম্পদ লুটপাট করতে সিলেট এসেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশকালে। ব্রিটিশ রানীকে ঘুষ দিয়ে বারো বছর সিলেট শাসন করেছেন। লিন্ডসে তার লেখায় তখনকার ভাটির সিলেট ও উত্তরপূর্ব ভারতের যে বিবরণ দিয়েছেন সেখানেও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়ার এমন মর্মান্তিক কোন হদিশ নেই। বরং পাহাড় ও হাওরের পুরো অঞ্চলজুড়ে গভীর বনভূমির কথা আছে। এমনকি সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো পাহাড় সীমান্তসংলগ্ন গভীর জলাবন। হাওর অভিধানে তাই ‘করচের বাগ’, ‘হিজলের বাগ, ‘নল-নটার বন, ‘ইকর-আটিয়ার বন’ এগুলো খুবই প্রচলিত শব্দ। মেঘালয় পাহাড়জুড়ে যেমন মিশ্র বর্ষারণ্য, হাওরজুড়ে জলাবন। চৈত্র-বৈশাখের কালবৈশাখী থেকে শুরু করে অবিরাম বর্ষণ উজানের বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে ভাটিতে গড়িয়ে পড়ত। এসব পাহাড়ি বনে বুনো লতা, ঘাস, গুল্ম এবং বৃক্ষের আচ্ছাদন বৃষ্টির পানির ধারাকে দুম করে গড়িয়ে পড়তে বাধা দিত।

পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ‘ছাঁকনি বা চুইয়ে পড়া নীতিতে’ উজান থেকে ভাটির হাওরে নামত। ১৯৬০ সনের দিকে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও পাহাড়ি ঢলের এই নামতা হাওরবাসীর মুখস্থ ছিল। টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢল নামলে মাটিয়ান বা খরচার হাওর পর্যন্ত আসতে কত সময় লাগবে সেই হিসেব মানুষের ছিল। আকাশের নানা কোণে কী রঙের কী ধাঁচের মেঘ জমল তাই দেখে হাওরের বুড়িগুলো আগে আফালের হিসাব কষতে জানত। এখন এসব বুড়িগুলোও নেই আর প্রবীণ জংগলও নেই। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রাকৃতিক বনভূমি বিনাশ করে বহুজাতিক খনি প্রকল্প তৈরি হয়েছে। মেঘালয় পাহাড় আজ কয়লা আর চুনাপাথর তুলতে তুলতে ফাঁপা হয়ে গেছে। অল্পবিস্তর বৃষ্টিতেই আজ মেঘালয় পাহাড় ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশের হাওরে। এখন উজানের পাহাড় থেকে শুধু ঢল নয়, নামে পাহাড়ি বালি ও পাথর-কাঁকরের স্তূপ। উজানের পাহাড়ি বালিতে হাওর ভাটির প্রায় নিম্নভূমি, জলাঞ্চল, বিল ও নদীগুলো আজ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে যাওয়া হাওরভূমিতে এখন বৃষ্টির পানি ধরে রাখবার মতো বৈশিষ্ট্য নেই। তাই অল্প বৃষ্টি, এমনকি চৈত্রের প্রথম বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় হাওর। প্লাবিত হয়, মূলত বৃষ্টির জল কোথাও প্রবাহিত হতে না পেরে হাওর ভূমির কৃষি জমিতেই ছড়িয়ে পড়ে, প্লাবিত হয়। তাই মূলত ডুবে যায় হাওরের ধান জমিনগুলো। অথচ মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়েই আছে বালফাকরাম সংরক্ষিত বনভূমি। বন থাকার কারণে বালফাকরামের ভাটিতে কিন্তু পাহাড়ি ঢলে এখনো তলিয়ে যায়না সেখানকার নিম্নাঞ্চল।

৪.

এ তো গেল উজানের কথা, ভাটিতে কী তাহলে জলপ্রবাহের অঙ্ক ঠিক আছে? না ভাটিতেও উজানের মতোই প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহকে গলাটিপে ধরা হয়েছে। প্রভাবশালীদের ইজারার মাধ্যমে হাওর আজ বাণিজ্যিক মৎস্য খামার। পাহাড়ি বালি পাথর বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে একদল মুনাফাখোর। এই জল ও বালিমহাল ইজারাদাররাই আজ হাওর নিয়ন্ত্রণ করছে। এই মনস্তত্ত্ব চায় মেঘালয় পাহাড় ভেঙে হাওর ভরাট হয়ে যাক এবং বছর বছর তলিয়ে যাক। উজানের খনি ব্যবসায়ী ও ভাটির ইজারাদারেরা মূলত একই নয়াউদারবাদী করপোরেট মনস্তত্ত্ব ধারণ করে। হাওরের নদী ও প্রবাহগুলোকে আটকে দেয়া হয়েছে। উজান থেকে ভাটিতে বৃষ্টির ঢল গড়িয়ে যাওয়ার পথ বারবার বন্ধ করে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই হাওরের সুরক্ষা দিতে পারেনি। হাওরের এ উজান-ভাটির অঙ্কটি সচল রাখার দাবি কোনভাবেই আজকের নতুন নয়, ভাসান পানির আন্দোলনের থেকেই হাওরবাসী এই দাবি করে আসছেন। নিদারুণভাবে আজ নয়াউদারবাদী মুনাফার ময়দানে জিম্মি হয়ে আছে হাওর। পাহাড়ি ঢলে হাওরের এ তলিয়ে যাওয়া বিষয়টি পুরোপুরো একটি আন্তঃরাষ্ট্রিক সংকট।

বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই এক বহুপক্ষীয় জলাভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণের ভেতর দিয়েই শুধু এর সুরাহা সম্ভব। হাওরের অভীন্ন নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন কখনোই কোন ন্যায়বিচার করেনি। তাহলে কীভাবে হবে? চৈত্র-বৈশাখে হাওর তলিয়েই যাবে। উজান কিংবা ভাটিতে যে উন্নয়ন বাহাদুরি বহাল আছে তাতে বছর বছর ডুববে হাওর। আর হাওরবাসী দিন দিন হাওর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হবে। পেছনে পড়ে থাকবে করিমের বান্ধা কী রাধারমণের ধামাইলের বিদীর্ণ আহাজারি।

[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ]