শিক্ষার্থীর পাশে ইউনিয়ন পরিষদ

অমিত রায় চৌধুরী

একটি ব্যতিক্রমী সময়ের সেদিন সাক্ষী হয়েছিলাম। বেতাগা উচ্চশিক্ষা সহায়তা প্রকল্পের দশকপূর্তি অনুষ্ঠান। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদ। এখনো বলা যায় এটিই দেশের সবচেয়ে কার্যকর ও জনসম্পৃক্ত এলজি ইউনিট। দেশকে এগিয়ে নিতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অফুরন্ত সম্ভাবনা। সঠিকভাবে এ উৎসগুলো কাজে লাগাতে পারলে সমষ্টিগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। সমাজের সুষম বিকাশ সম্ভব হয়। সুযোগের অসমতা দূর করা বা জীবনমানের গুণগত উন্নয়নের মতো কাজ সহজ হয়ে ওঠে। দেশের অনেক স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বেতাগা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম অনুসরণ করছেন। তাদের অনেকের মত-ওয়ার্ড সভার মাধ্যমে অগ্রাধিকার নির্ণয় করে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো যেভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। পরিষদের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলোÑসিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ, ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও অংশীজনের আস্থা, যা উন্নয়নকে টেকসই করার ইঙ্গিত দেয়। অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নে কন্যাবর্তিকা ও উচ্চশিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি সর্বত্রই যথেষ্ট উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। জনগণের নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তোলা শিক্ষা প্রকল্পটি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নজর কেড়েছে। খোদ বিশ্বব্যাংকও দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই উদ্যোগটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে।

কোভিড-উত্তর অর্থনীতি, ইউরোপীয় যুদ্ধ এমনকি আঞ্চলিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিত দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের বহুমাত্রিক গুরুত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কোন বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় দরকার রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা। আর তা এক দিনে গড়ে ওঠে না। সে জন্য সবার আগে চাই দেশপ্রেম, সংকল্প ও মানসম্পন্ন শিক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রের পক্ষে সুস্থ সমাজ গঠনের শর্ত পূরণ অসম্ভবও ছিল না। কারণ যাই হোক, বাস্তবতা হলো, তা হয়নি। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় স্বনির্ভরতার ধারণাও বদলে গেছে। কার্যত পরস্পর সহযোগিতার মধ্য দিয়েই সভ্যতার নতুন কাঠামো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের লক্ষ্যই হলো দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়। উন্নততর জীবনের সন্ধান। বিশ্বজনীন জ্ঞান অর্জনই এখন সর্বোত্তম উন্নয়ন কৌশল, কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের হাতিয়ার। আমাদের মতো দেশের বড় ঐশ্বর্য তারুণ্য। এই বিপুল জনবল দক্ষ হলে তা হয় সম্পদ, না হলে বোঝা। নির্ণায়ক এই সত্যটি উপলব্ধি না করলে বিপদ। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে আমাদের সমাজে বিভক্তির ক্ষতটা গভীর। সমৃদ্ধি যত বেড়েছে, বৈষম্য ততই বেড়েছে। সে কারণে টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক শর্ত হয়েছে অন্তর্ভুক্তি। সমকালীন চাহিদাই আমাদের গন্তব্য ঠিক করে দিচ্ছে। শিক্ষাই আজ শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। গুণগত শিক্ষার পরিধি হতে হবে বিস্তৃত। সময়ের এই দাবিকে আমলে নিয়েই আমজনতার অংশীদারত্বে শিক্ষা সহায়তার ভাবনা দেশের প্রত্যন্ত এ জনপদে। মেধাবী যেন টাকার অভাবে ঝরে না যায় তা নিশ্চিত করছে স্থানীয় সরকার, বৃহত্তর অর্থে সমাজ। সরকার নয়, অর্থ জোগাচ্ছে দিনমজুর হতে শিল্পপতি।

যুক্তির জগৎটাকে মজবুত মনে হয়েছে। উদ্দেশ্যে মহত্ত্বও আছে। দেশে বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামোর সিংহভাগই ছড়িয়ে রয়েছে মফস্বলে। তবে দুর্নাম আছেÑগ্রামীণ শিক্ষা পরিকাঠামো ভীষণ দুর্বল। দালান-কোঠা, ল্যাব বা লাইব্রেরির যেমন ঘাটতি, যোগ্য শিক্ষকেরও অভাব তীব্র। গ্রামীণ শিক্ষায় অবকাঠোমো বা শিক্ষকের সংকট বৃহত্তর অবহেলার অংশমাত্র। বঞ্চনার ঐতিহ্য দীর্ঘ। অনেক প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শাখা নেই। আবার শাখা থাকলেই যে বিজ্ঞান পড়া যাবে, তা নয়। কারণ তার সঙ্গে প্রাইভেট পড়ার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং শিক্ষক থাকলেই হবে না। মেধা বা আকাক্সক্ষা থাকলেও না; দরকার স্রেফ আর্থিক সঙ্গতি। সামর্থ্য থাকলে শিক্ষাবাজার থেকে মূল্য দিয়ে ভবিষ্যৎ কিনে নেয়া যায়-কৌশলের এ ছকটা এখন শিক্ষার্থী বা অভিভাবক-অনেকেরই মগজে গেঁড়ে বসেছে। আবার দক্ষতার বাজারে আরেক বিপত্তি হানা দিচ্ছে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ কাজের বাজারে গ্রেডভিত্তিক ভালো শিক্ষার্থীর বড় অংশই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। কারণ, এরা পরীক্ষাকে টার্গেট করে তৈরি হয়েছে। অধ্যায় বেছে প্রস্তুতি। আর মডেল পরীক্ষা। হাতে-কলমে জ্ঞানের দুনিয়ায় বেশ অসহায়। স্কুল-কলেজে প্র্যাকট্যিাল ক্লাস অনেক আগেই পাটে উঠেছে। সুতরাং কার্যকর মনিটরিং প্রয়োজন। এখানেও সমাজের প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা জরুরি। এ বিষয়টিও ইউনিয়নের শিক্ষাবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির নজর এড়ায়নি।

ইউনিয়ন পরিষদটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠোমো উন্নয়নে হাত দিয়েছে। একাডেমিক ভবন, সীমানা প্রাচীর এমনকি বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের চেইঞ্জ রুম নির্মাণ স্থানীয় উন্নয়ন এজেন্ডায় অগ্রাধিকার পেয়েছে। এসব কাজ হচ্ছে পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে বা অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ সংকোচনের মাধ্যমে। মনিটরিং কাঠামোকে ফলপ্রসূ করেছে প্রযুক্তির সংযোগ। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধি-সবাই এখন তদারকি প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত। বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময় দুর্বলতার নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলিকে চিনিয়ে দিচ্ছে। অভিজ্ঞতা ও তথ্য বিনিময়ের সুফল ভোগ করছে প্রতিষ্ঠানগুলি; যা কার্যত জবাবদিহি, সহযোগিতা ও সমষ্টি চেতনার মঞ্চকে উর্বর করছে। প্রায়োগিক ভাষা শিক্ষা ও বিতর্ক অনুশীলন চলছে জোরেশোরে। এ উদ্যোগগুলো অপ্রচলিত; কিন্তু সুস্থ ও বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজ গঠনে সহশিক্ষা কার্যক্রমের প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করে না। আর অবশ্যই তা বাস্তব জীবন ও কর্মক্ষেত্রের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

ফকিরহাট উপজেলা বিশেষকরে এ জনপদে মানুষের জীবিকা প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ধান, মাছ, সবজি, দুধ-এ জাতীয় কৃষিপণ্য উৎপাদন করে স্থানীয় চাষি-খামারিরা। দুই দশক আগেও দারিদ্র্য এদের পায়ে পায়ে হেঁটেছে। শিক্ষার কুলীন সমাজে এরা ব্রাত্যই থেকেছে। জীবনমানে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা এদের তীব্র। হয়তো এ লক্ষ্যই তাদের একাত্ত করেছে। নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি তাদের প্রাণিত করেছে, সংগঠিত করেছে। উৎপাদনের প্রচলিত বৃত্ত ভাঙার সংকল্পে এরা মুষ্টিবদ্ধ। শুধু কায়িক নয়, মগজনির্ভর অভিজাত বৃত্তিতেও অংশীদারত্ব চায় নতুন এ প্রজন্ম। এ লক্ষ্যে তারা অবিচল, স্থির। একে অপরকে সাহায্য করতে উদগ্রীব, সমষ্টিগত লক্ষ্যভেদে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভ্যানচালক, মুদি দোকানদার, প্রান্তিক কৃষক, শিক্ষক, ব্যাঙ্কার, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিল্পপতি, জনপ্রতিনিধি-সবার নিয়মিত ও স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তায় চলে এ শিক্ষা তহবিল। একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকারকে শুনলাম-উচ্চশিক্ষায় ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের তাৎক্ষণিক আবাসনের জন্য ঢাকায় নিজের বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। সদিচ্ছা ও সহযোগিতার দুর্লভ দৃষ্টান্তটি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত শক্তিকে আরেকবার চিনিয়ে দিল।

ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অতুলনীয় বলে মনে হলো। ভালো ছেলেমেয়েরা যাতে অসচ্ছলতার কারণে উচ্চশিক্ষা হতে বঞ্চিত না হয়Ñতা নিশ্চিত করাই এ প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ। কার্যক্রমটি কীভাবে আরও ভালো করা যায়Ñতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নিয়েছে অংশীজনেরা। একের পর এক প্রস্তাব বা সুপারিশ এসেছে। কর্মসূচির পরিধি সম্প্রসারণ বা উদ্যোগকে টেকসই করার আগ্রহই অংশীজনের একাত্ততা প্রমাণ করে। এক কোটির বেশি টাকা নিয়ে এই শিক্ষা সহায়তা তহবিল, যা জনগণের অর্থে গঠিত ও পরিচালিত। তার অনুপূঙ্খ হিসাব সব অংশীজনের কাছে। সেটা উপস্থাপন হচ্ছে নিয়মিত সাধারণ সভায়। এককালীন ৩ লক্ষ টাকার ৭ জন নতুন ডোনার এই বৃত্তি তহবিলে এই দিনেই নাম লেখালেন। এমন ডোনারের সংখ্যা ১৬; যাদের নামে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বৃত্তি দেয়া হয়। শেখ হেলালউদ্দীন ফাউন্ডেশনও এখানে ডোনার; যার সহায়তা ক্ষেত্র উপজেলাব্যাপী চিকিৎসা-প্রকৌশল শিক্ষা।

ইউনিয়নের কাঠামোগত আকর্ষণ হলো-স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো একদম কেতাবি ছকে গড়ে তোলা। সদস্যরা জানেন তাদের কাজ কী, গন্তব্য কোথায়। বড় কথা-উদ্যোগের লভ্যাংশ সমাজ এ প্রজন্মেই ভোগ করছে। ভবিষ্যৎটাও অস্পষ্ট নয়। ফলে আগ্রহ বেশি। বৃত্তির ভোক্তাদের শক্ত নজরদারিতে রাখা হয়। লেখাপড়ায় অমনোযোগ কিংবা ধারাবাহিক অকৃতকার্যতায় বৃত্তির শর্ত লঙ্ঘিত হয়। পক্ষান্তরে, উপকারভোগীরা কোর্স শেষে কে কোথায় আছেÑতার রেকর্ডও পরিষদ রাখে। অভিজ্ঞতা বলছেÑপেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠার পর এরাই প্রকল্পের ডোনার হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই সমাজের প্রতি নব প্রজন্মের দায়বদ্ধতা বাড়ছে। গড়ে উঠছে প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানা ও নাগরিকতাবোধ।

ইউনিয়ন পরিষদের দেশজোড়া খ্যাতির নেপথ্য কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করলাম। প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো জনগণের ঐক্য ও শৃঙ্খলা। মানুষের মধ্যে উন্নয়নের আকাক্সক্ষা সঠিকভবে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে উদ্বুদ্ধ একটা স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদল, যারা যে কোন সময়ে অন্যের জন্য সময় ও সেবা দিতে প্রস্তুত। ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা রাতারাতি অর্জন সম্ভব নয়। এর জন্য অনেক শ্রম, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা প্রয়োজন। বার বার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে। সব পরীক্ষায় যখন ব্যবস্থাপনা কাঠামো উত্তীর্ণ হয়, তখনই জনগণের আস্থা জয় করে প্রতিষ্ঠান। নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয় নেতৃত্ব। অনেক কঠিন লক্ষ্যও তখন অনায়াসে নাগালের মধ্যে চলে আসে। নেতৃত্বে যদি মেধা ও দেশপ্রেম যুক্ত হয়, তখন তা অসাধারন কীর্তির সৌধ গড়ে তোলে। বেতাগা ইউনিয়ন পরিষদে তাই ঘটেছে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

শিক্ষার্থীর পাশে ইউনিয়ন পরিষদ

অমিত রায় চৌধুরী

একটি ব্যতিক্রমী সময়ের সেদিন সাক্ষী হয়েছিলাম। বেতাগা উচ্চশিক্ষা সহায়তা প্রকল্পের দশকপূর্তি অনুষ্ঠান। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদ। এখনো বলা যায় এটিই দেশের সবচেয়ে কার্যকর ও জনসম্পৃক্ত এলজি ইউনিট। দেশকে এগিয়ে নিতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অফুরন্ত সম্ভাবনা। সঠিকভাবে এ উৎসগুলো কাজে লাগাতে পারলে সমষ্টিগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। সমাজের সুষম বিকাশ সম্ভব হয়। সুযোগের অসমতা দূর করা বা জীবনমানের গুণগত উন্নয়নের মতো কাজ সহজ হয়ে ওঠে। দেশের অনেক স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বেতাগা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম অনুসরণ করছেন। তাদের অনেকের মত-ওয়ার্ড সভার মাধ্যমে অগ্রাধিকার নির্ণয় করে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো যেভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। পরিষদের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলোÑসিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ, ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও অংশীজনের আস্থা, যা উন্নয়নকে টেকসই করার ইঙ্গিত দেয়। অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নে কন্যাবর্তিকা ও উচ্চশিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি সর্বত্রই যথেষ্ট উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। জনগণের নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তোলা শিক্ষা প্রকল্পটি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নজর কেড়েছে। খোদ বিশ্বব্যাংকও দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই উদ্যোগটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে।

কোভিড-উত্তর অর্থনীতি, ইউরোপীয় যুদ্ধ এমনকি আঞ্চলিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিত দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের বহুমাত্রিক গুরুত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কোন বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় দরকার রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা। আর তা এক দিনে গড়ে ওঠে না। সে জন্য সবার আগে চাই দেশপ্রেম, সংকল্প ও মানসম্পন্ন শিক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রের পক্ষে সুস্থ সমাজ গঠনের শর্ত পূরণ অসম্ভবও ছিল না। কারণ যাই হোক, বাস্তবতা হলো, তা হয়নি। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় স্বনির্ভরতার ধারণাও বদলে গেছে। কার্যত পরস্পর সহযোগিতার মধ্য দিয়েই সভ্যতার নতুন কাঠামো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের লক্ষ্যই হলো দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়। উন্নততর জীবনের সন্ধান। বিশ্বজনীন জ্ঞান অর্জনই এখন সর্বোত্তম উন্নয়ন কৌশল, কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের হাতিয়ার। আমাদের মতো দেশের বড় ঐশ্বর্য তারুণ্য। এই বিপুল জনবল দক্ষ হলে তা হয় সম্পদ, না হলে বোঝা। নির্ণায়ক এই সত্যটি উপলব্ধি না করলে বিপদ। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে আমাদের সমাজে বিভক্তির ক্ষতটা গভীর। সমৃদ্ধি যত বেড়েছে, বৈষম্য ততই বেড়েছে। সে কারণে টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক শর্ত হয়েছে অন্তর্ভুক্তি। সমকালীন চাহিদাই আমাদের গন্তব্য ঠিক করে দিচ্ছে। শিক্ষাই আজ শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। গুণগত শিক্ষার পরিধি হতে হবে বিস্তৃত। সময়ের এই দাবিকে আমলে নিয়েই আমজনতার অংশীদারত্বে শিক্ষা সহায়তার ভাবনা দেশের প্রত্যন্ত এ জনপদে। মেধাবী যেন টাকার অভাবে ঝরে না যায় তা নিশ্চিত করছে স্থানীয় সরকার, বৃহত্তর অর্থে সমাজ। সরকার নয়, অর্থ জোগাচ্ছে দিনমজুর হতে শিল্পপতি।

যুক্তির জগৎটাকে মজবুত মনে হয়েছে। উদ্দেশ্যে মহত্ত্বও আছে। দেশে বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামোর সিংহভাগই ছড়িয়ে রয়েছে মফস্বলে। তবে দুর্নাম আছেÑগ্রামীণ শিক্ষা পরিকাঠামো ভীষণ দুর্বল। দালান-কোঠা, ল্যাব বা লাইব্রেরির যেমন ঘাটতি, যোগ্য শিক্ষকেরও অভাব তীব্র। গ্রামীণ শিক্ষায় অবকাঠোমো বা শিক্ষকের সংকট বৃহত্তর অবহেলার অংশমাত্র। বঞ্চনার ঐতিহ্য দীর্ঘ। অনেক প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শাখা নেই। আবার শাখা থাকলেই যে বিজ্ঞান পড়া যাবে, তা নয়। কারণ তার সঙ্গে প্রাইভেট পড়ার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং শিক্ষক থাকলেই হবে না। মেধা বা আকাক্সক্ষা থাকলেও না; দরকার স্রেফ আর্থিক সঙ্গতি। সামর্থ্য থাকলে শিক্ষাবাজার থেকে মূল্য দিয়ে ভবিষ্যৎ কিনে নেয়া যায়-কৌশলের এ ছকটা এখন শিক্ষার্থী বা অভিভাবক-অনেকেরই মগজে গেঁড়ে বসেছে। আবার দক্ষতার বাজারে আরেক বিপত্তি হানা দিচ্ছে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ কাজের বাজারে গ্রেডভিত্তিক ভালো শিক্ষার্থীর বড় অংশই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। কারণ, এরা পরীক্ষাকে টার্গেট করে তৈরি হয়েছে। অধ্যায় বেছে প্রস্তুতি। আর মডেল পরীক্ষা। হাতে-কলমে জ্ঞানের দুনিয়ায় বেশ অসহায়। স্কুল-কলেজে প্র্যাকট্যিাল ক্লাস অনেক আগেই পাটে উঠেছে। সুতরাং কার্যকর মনিটরিং প্রয়োজন। এখানেও সমাজের প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা জরুরি। এ বিষয়টিও ইউনিয়নের শিক্ষাবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির নজর এড়ায়নি।

ইউনিয়ন পরিষদটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠোমো উন্নয়নে হাত দিয়েছে। একাডেমিক ভবন, সীমানা প্রাচীর এমনকি বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের চেইঞ্জ রুম নির্মাণ স্থানীয় উন্নয়ন এজেন্ডায় অগ্রাধিকার পেয়েছে। এসব কাজ হচ্ছে পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে বা অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ সংকোচনের মাধ্যমে। মনিটরিং কাঠামোকে ফলপ্রসূ করেছে প্রযুক্তির সংযোগ। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধি-সবাই এখন তদারকি প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত। বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময় দুর্বলতার নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলিকে চিনিয়ে দিচ্ছে। অভিজ্ঞতা ও তথ্য বিনিময়ের সুফল ভোগ করছে প্রতিষ্ঠানগুলি; যা কার্যত জবাবদিহি, সহযোগিতা ও সমষ্টি চেতনার মঞ্চকে উর্বর করছে। প্রায়োগিক ভাষা শিক্ষা ও বিতর্ক অনুশীলন চলছে জোরেশোরে। এ উদ্যোগগুলো অপ্রচলিত; কিন্তু সুস্থ ও বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজ গঠনে সহশিক্ষা কার্যক্রমের প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করে না। আর অবশ্যই তা বাস্তব জীবন ও কর্মক্ষেত্রের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

ফকিরহাট উপজেলা বিশেষকরে এ জনপদে মানুষের জীবিকা প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ধান, মাছ, সবজি, দুধ-এ জাতীয় কৃষিপণ্য উৎপাদন করে স্থানীয় চাষি-খামারিরা। দুই দশক আগেও দারিদ্র্য এদের পায়ে পায়ে হেঁটেছে। শিক্ষার কুলীন সমাজে এরা ব্রাত্যই থেকেছে। জীবনমানে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা এদের তীব্র। হয়তো এ লক্ষ্যই তাদের একাত্ত করেছে। নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি তাদের প্রাণিত করেছে, সংগঠিত করেছে। উৎপাদনের প্রচলিত বৃত্ত ভাঙার সংকল্পে এরা মুষ্টিবদ্ধ। শুধু কায়িক নয়, মগজনির্ভর অভিজাত বৃত্তিতেও অংশীদারত্ব চায় নতুন এ প্রজন্ম। এ লক্ষ্যে তারা অবিচল, স্থির। একে অপরকে সাহায্য করতে উদগ্রীব, সমষ্টিগত লক্ষ্যভেদে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভ্যানচালক, মুদি দোকানদার, প্রান্তিক কৃষক, শিক্ষক, ব্যাঙ্কার, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিল্পপতি, জনপ্রতিনিধি-সবার নিয়মিত ও স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তায় চলে এ শিক্ষা তহবিল। একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকারকে শুনলাম-উচ্চশিক্ষায় ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের তাৎক্ষণিক আবাসনের জন্য ঢাকায় নিজের বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। সদিচ্ছা ও সহযোগিতার দুর্লভ দৃষ্টান্তটি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত শক্তিকে আরেকবার চিনিয়ে দিল।

ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অতুলনীয় বলে মনে হলো। ভালো ছেলেমেয়েরা যাতে অসচ্ছলতার কারণে উচ্চশিক্ষা হতে বঞ্চিত না হয়Ñতা নিশ্চিত করাই এ প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ। কার্যক্রমটি কীভাবে আরও ভালো করা যায়Ñতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নিয়েছে অংশীজনেরা। একের পর এক প্রস্তাব বা সুপারিশ এসেছে। কর্মসূচির পরিধি সম্প্রসারণ বা উদ্যোগকে টেকসই করার আগ্রহই অংশীজনের একাত্ততা প্রমাণ করে। এক কোটির বেশি টাকা নিয়ে এই শিক্ষা সহায়তা তহবিল, যা জনগণের অর্থে গঠিত ও পরিচালিত। তার অনুপূঙ্খ হিসাব সব অংশীজনের কাছে। সেটা উপস্থাপন হচ্ছে নিয়মিত সাধারণ সভায়। এককালীন ৩ লক্ষ টাকার ৭ জন নতুন ডোনার এই বৃত্তি তহবিলে এই দিনেই নাম লেখালেন। এমন ডোনারের সংখ্যা ১৬; যাদের নামে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বৃত্তি দেয়া হয়। শেখ হেলালউদ্দীন ফাউন্ডেশনও এখানে ডোনার; যার সহায়তা ক্ষেত্র উপজেলাব্যাপী চিকিৎসা-প্রকৌশল শিক্ষা।

ইউনিয়নের কাঠামোগত আকর্ষণ হলো-স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো একদম কেতাবি ছকে গড়ে তোলা। সদস্যরা জানেন তাদের কাজ কী, গন্তব্য কোথায়। বড় কথা-উদ্যোগের লভ্যাংশ সমাজ এ প্রজন্মেই ভোগ করছে। ভবিষ্যৎটাও অস্পষ্ট নয়। ফলে আগ্রহ বেশি। বৃত্তির ভোক্তাদের শক্ত নজরদারিতে রাখা হয়। লেখাপড়ায় অমনোযোগ কিংবা ধারাবাহিক অকৃতকার্যতায় বৃত্তির শর্ত লঙ্ঘিত হয়। পক্ষান্তরে, উপকারভোগীরা কোর্স শেষে কে কোথায় আছেÑতার রেকর্ডও পরিষদ রাখে। অভিজ্ঞতা বলছেÑপেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠার পর এরাই প্রকল্পের ডোনার হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই সমাজের প্রতি নব প্রজন্মের দায়বদ্ধতা বাড়ছে। গড়ে উঠছে প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানা ও নাগরিকতাবোধ।

ইউনিয়ন পরিষদের দেশজোড়া খ্যাতির নেপথ্য কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করলাম। প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো জনগণের ঐক্য ও শৃঙ্খলা। মানুষের মধ্যে উন্নয়নের আকাক্সক্ষা সঠিকভবে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে উদ্বুদ্ধ একটা স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদল, যারা যে কোন সময়ে অন্যের জন্য সময় ও সেবা দিতে প্রস্তুত। ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা রাতারাতি অর্জন সম্ভব নয়। এর জন্য অনেক শ্রম, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা প্রয়োজন। বার বার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে। সব পরীক্ষায় যখন ব্যবস্থাপনা কাঠামো উত্তীর্ণ হয়, তখনই জনগণের আস্থা জয় করে প্রতিষ্ঠান। নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয় নেতৃত্ব। অনেক কঠিন লক্ষ্যও তখন অনায়াসে নাগালের মধ্যে চলে আসে। নেতৃত্বে যদি মেধা ও দেশপ্রেম যুক্ত হয়, তখন তা অসাধারন কীর্তির সৌধ গড়ে তোলে। বেতাগা ইউনিয়ন পরিষদে তাই ঘটেছে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]