শ্রমিক কেন অর্ধেক বেতন পাবেন

সজীব ওয়াফি

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ৩ মে ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ রকম হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটিতে যাবে ২ মে থেকে। তার আগে ১ মে থাকবে মে দিবসের ছুটি। সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে আগের দুই দিন। অর্থাৎ সরকারি ছুটির আমেজ শুরু হবে হবে ২৯ এপ্রিল নাগাদ। কিন্তু আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো? কারখানার শ্রমিকদের খবর কি? তাদের ছুটি হবে কত তারিখে? উত্তর হলো- কারখানার শ্রমিকদের দিয়ে শুক্রবারেও কাজ করানোর নজির আছে অহরহ। উপরন্তু সরকারি ক্যালেন্ডারে শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও শ্রমিকদের বেলায় এই ছুটি অনুপস্থিত। মে দিবসের ছুটি মালিকপক্ষকে যেহেতু বাধ্য হয়েই দিতে হবে; সে হিসেবে ৩ মে তারিখেই ঈদ হলে কারখানাগুলো ৩০ এপ্রিলের কর্মঘণ্টা শেষ করে ছুটিতে যাবে। কোন কোন কারখানা হয়তো সাপ্তাহিক দুই দিন ছুটি অন্তর্ভুক্ত করে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে। অর্থাৎ চলতি মাসের মধ্যেই সব ধরনের শিল্পকারখানায় শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ অপরিহার্য।

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে শ্রম মন্ত্রণালয় এক ত্রিপক্ষীয় সভা সমাপ্ত করেছে। উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক, মালিক এবং সরকারপক্ষের প্রতিনিধিত্ব। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে ছুটির আগেভাগেই রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পসহ অন্য সব খাতের শ্রমিকেরা চলতি এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত কর্মঘণ্টার, নির্দিষ্ট করে বললে মাসের অর্ধেক বেতন পাবেন। অর্ধেক বেতনের কথা শুনলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কি অনেক টাকা বেতন পায়, যেটা তাদের চাহিদা পূরণের পরও অতিরিক্ত? নতুবা অর্ধেক বেতনের প্রশ্ন কেন আসবে? তাহলে এবার একটু শ্রমিকের বেতন বা মজুরির দিকে তাকানো যাকÑ বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা ৮ হাজার টাকা।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মালিকপক্ষ এ ৮ হাজার বলতে মোট বেতন বুঝে থাকেন, বেসিক বেতন নয়। যেখানে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার হয়ে থাকলে বেসিক ৪ হাজার ২০০ টাকা; বাকি ৩ হাজার ৮০০ টাকা বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা এবং গাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা। বিতর্কের বিষয় অধিকাংশ কারখানাতেই এই নির্দেশনা বলবৎ নেই। ৬ থেকে ৭ হাজার টাকাও মোট বেতন ধরা হয়। এমনকি কোন কোন নতুন কারখানায় পেটেভাতে, মোট ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেতনে টিকে থাকতে হয়। বছরান্তে এই বেতন বেসিকের ৫% করে বাড়ে। যখন বোনাসের বিষয় সামনে আসে তখন বেসিকের ১০০% হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। আটকে দেয়া হয় ঘণ্টায় বেসিকের দ্বিগুণ ওভারটাইম কর্মঘণ্টা মজুরি। অথচ যে ওভারটাইম শ্রমিকদের বাধ্য করে করানো হয় তাদের ইচ্ছার বিপরীতে, ত্যাগ করতে হয় শ্রমিকের ঘুম-বিশ্রাম। কোন কোন কারখানায় বকেয়া ফেলে রাখা হয় শ্রমিকদের ২ থেকে ৩ মাসের বেতন।

বিগত ছয় মাস ধরে দ্রব্যমূল্য হু হু করে বাড়ছে, বর্তমানে যার লাগামছাড় পরিস্থিতি। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। মোটা দাগে বলতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আর হাতের নাগালে নেই। যেই মোটা চালের ভাত খেয়ে শ্রমিকেরা কাজে বেরিয়ে পরে তার দাম পৌঁছেছে ৫০ টাকায়। তরিতরকারি দাম কেজিতে ৬০ টাকার নিচে অকল্পনীয়। কোন কোন সবজির দাম কেজিতে ১০০ টাকারও অনেক ওপরে ছাড়িয়েছে। শ্রমিকদের জন্য সামান্য মুরগির মাংস এবং চিকন মিনিকেট চালের ভাত এখন বিলাসিতা। বরাবরের মতো সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদেরও কম বেশি বাড়ে। বাড়ে না শুধু শ্রমিকের বেলায়। যতক্ষণে না আন্দোলন করবে, আন্দোলনে কারও জীবন বিপন্ন না হবে ততক্ষণে সবাই চুপচাপ। দ্রব্যমূল্য যদি এভাবে বাড়তে থাকে তখন বহু আগে নির্ধারণ করা মাসিক মজুরিতে তাদের চলে কি করে? এমতাবস্থায় ঈদের মাসে অর্ধেক বেতন দেয়ার পরিকল্পনা শ্রমিকের ঘামের সঙ্গেই স্রেফ প্রতারণার সামিল।

বর্তমানে পোশাক কারখানায় অর্ডারের চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। এত পরিমাণে অর্ডার আসছে যে অনেক প্রতিষ্ঠান আর অর্ডার গ্রহণ করতে পারছেন না। যে পরিমাণসংখ্যক শ্রমিক বিভিন্ন কারখানা কাজ করছে তাতে কুলিয়ে ওঠা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ করোনায় চীনের নতুন করে লকডাউন, শ্রীলঙ্কার দুর্ভিক্ষ, কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ক্রেতারা নিশ্চয়তার খোঁজে বাংলাদেশে স্থানান্তর হয়েছেন। বাধ্য করে শ্রমিকদের ওভারটাইম করানো হচ্ছে, ব্যস্ততায় রাখা হচ্ছে রাত-দিনের কয়েক শিফটে। এত পরিমাণ অর্ডার যে, অর্ডারের প্রাচুর্যে যথাসময়ে শিপমেন্ট করা নিয়েও আছে উদ্বেগ। অর্থনীতির চালচিত্রে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চে ৯ মাসে একমাত্র নিট খাত থেকেই এসেছে ১৭ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলারের বৈদিক মুদ্রা। অর্থাৎ গত বছরের এ সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। ওভেন পোশাক রপ্তানিতে ৯ মাসে এসেছে ১৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।

এককভাবে হিসাব করলে শুধু গেল মার্চ মাসেই বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার এসেছে বাংলাদেশে। বিনিময় হারে হিসাব করলে এই অর্থ ৪১ হাজার কোটি টাকারও অনেক বেশি। শুধু পোশাক খাতেই না; স্পিনিং মিল, লেদার কারখানা, স্টিল মিল, ফুড মিল, সিরামিকস-মেলামাইন ফ্যাক্টরি ইত্যাদিতেও পড়েছে অস্বাভাবিক অর্ডার কাজের চাপ। অন্যদিকে উৎসবের সময়ে পুরোদমে কেনাকাটার হিসাব করে উৎপাদন-সরবরাহের চাপ থাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থানীয় বাজারেও। সামনে ঈদ থাকায় শ্রমিকেরা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে যান, কারণ ঈদের দিন স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ-উল্লাসে কাটাবেন, ফূর্তি করবেন। অথচ পুরো মাস অতিরিক্ত পরিশ্রম করেও এবার তাদের ভাসতে হবে চোখের জলে।

স্বজনদের কাছে গ্রামের বাড়িতে যেতে হলে প্রত্যেককে অবশ্যই আগামী মাসের ঘর ভাড়া, খাওয়ার খরচ, বিভিন্ন বিলসহ নানা খরচের চিন্তা আগে করতে হবে। কেননা আগামী মাসে কারখানা খুলেই তো বিগত অর্ধেক মাসের পাওনা কোন প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে না। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির বাজারে এত কিছুর হিসাব মেলানোর পর পরিশেষে বাড়িতে যেতে হলে পরিবার-স্বজনদের জন্য কিছু কেনাকাটা, যাতায়াত খরচ, ঈদের দিনের জন্য অন্তত এক প্যাকেট সেমাই-চিনি এবং সামান্য কিছু খাবার কি এই অর্ধেক বেতন-বোনাসে সম্ভব? ঈদের ছুটিতে যাওয়ার আগে শ্রমিকেরা কাজ করবেন পুরো মাসের, তাহলে বেতন কেন অর্ধেক মাসের পাবেন? এটা অন্যায় নয় কি? কথা হলো শ্রমিকদের এমন সর্বনাশ করতে কোন ধরনের শ্রমিক প্রতিনিধিরা সভাকক্ষে উপস্থিত ছিলেন? তারা কি আদতে শ্রমিক? শ্রমিক প্রতিনিধি হয়ে থাকলে তিনি তো নিজ শ্রেণী স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারেন না। নামে মাত্র এমন শ্রমিক প্রতিনিধি বানিয়েছেনই বা কে? এই শ্রমিক প্রতিনিধি কি সব শ্রমিকের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত অথবা সমর্থিত? সেটা যদি না হয়ে থাকে তবে এ ধরনের দায়সারা বিপজ্জনক কার্যকলাপ শ্রমিকদের ভেতরে ক্ষোভের জন্ম দেবে। পরিণামে শ্রমিকদের ক্ষোভের বিস্ফোরণে কি ঘটতে পারে, তার বাস্তবিক পরিস্থিতি আমরা নানা সময়ে উপলব্ধি করেছি।

২০১৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র মতে ৪০ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টসে কাজ করেন। গত সাত বছরে গার্মেন্টস যেমন বেড়েছে তেমনি শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়েছে ঢের বেশি। বর্তমানে শ্রমিকের এই সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া স্বাভাবিক। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা একত্রে যোগ করলে বাংলাদেশে শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটিরও অনেক ওপরে। সে হিসেবে সবার ন্যূনতম বেসিক গড় মজুরি যদি ৮ হাজারে হিসাব করা হয় এবং তার অর্ধেক মজুরি দাঁড়ায় ৪ হাজার টাকা, যা ঈদের মাসে পাওয়া যাবে না। শ্রমিক সংখ্যার সঙ্গে এই মজুরি টাকা গুন করলে দাঁড়ায় ৮ হাজার কোটি টাকা। শ্রমিকেরা এই বিপুল অঙ্কের টাকাটা খরচ করত বাস ভাড়ায়, কাপড়, জুতাসহ নানান জিনিস কেনাকাটা, খাবারে আর সামান্য বিনোদনে। এবারে ওই সব সেবা এবং জিনিসপত্রের বিক্রেতাদের বাজারেও মন্দা তৈরি হবে। উৎসবের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতির বাজারের যে সম্পর্ক রয়েছে সেখানে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পরছে অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের ফলে। পরে চলতি মাসের এই বাকি অর্ধেক মজুরি যে বকেয়ার খাতায় পড়ল, তা আগামী মাসের মজুরির সঙ্গে আদায় হওয়া নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের ভেতরে সন্দেহ থেকে যায়।

চীনের করোনা, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট, পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং কম্বোডিয়ায় নানা জটিলতা ক্রয়াদেশ সরে যেই মুহূর্তে বাংলাদেশে স্থানান্তর হচ্ছে তখন শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি দুঃখজনক। এমনিতেই নামেমাত্র মজুরি, কাজের অনুপযুক্ত পরিবেশ! সেখানে সারা বছরে তাকিয়ে থাকা দিনটাই যদি জীবন থেকে নাই হয়ে যায়, স্বজনদের কাছে না যেতে পারে কিংবা চোখের জলে ভাসতে হয়, সে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ আঁধারের ঘনঘটা। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচারের ওপর দাঁড়িয়ে। শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা দূরে থাক; ন্যায় বিচারই নিশ্চিত করা হচ্ছে না, তৈরি করা যাচ্ছে না সমতার বিধান। শ্রমিকদের বিষয়ে নানা সময়ে অবিবেচকের মতো নানা সিদ্ধান্ত নেয়ায় ক্রমেই তৈরি হয়েছে বৈষম্য, শ্রমিকবান্ধব রাষ্ট্র কায়েম হয়নি। কাজেই নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি না করে শ্রমিকের সম্পূর্ণ ন্যায্য পাওনা যথা সময়ে বুঝিয়ে দেয়া মালিকপক্ষের কর্তব্য। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে দাবি রাখে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২ , ০৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

শ্রমিক কেন অর্ধেক বেতন পাবেন

সজীব ওয়াফি

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ৩ মে ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ রকম হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটিতে যাবে ২ মে থেকে। তার আগে ১ মে থাকবে মে দিবসের ছুটি। সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে আগের দুই দিন। অর্থাৎ সরকারি ছুটির আমেজ শুরু হবে হবে ২৯ এপ্রিল নাগাদ। কিন্তু আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো? কারখানার শ্রমিকদের খবর কি? তাদের ছুটি হবে কত তারিখে? উত্তর হলো- কারখানার শ্রমিকদের দিয়ে শুক্রবারেও কাজ করানোর নজির আছে অহরহ। উপরন্তু সরকারি ক্যালেন্ডারে শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও শ্রমিকদের বেলায় এই ছুটি অনুপস্থিত। মে দিবসের ছুটি মালিকপক্ষকে যেহেতু বাধ্য হয়েই দিতে হবে; সে হিসেবে ৩ মে তারিখেই ঈদ হলে কারখানাগুলো ৩০ এপ্রিলের কর্মঘণ্টা শেষ করে ছুটিতে যাবে। কোন কোন কারখানা হয়তো সাপ্তাহিক দুই দিন ছুটি অন্তর্ভুক্ত করে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে। অর্থাৎ চলতি মাসের মধ্যেই সব ধরনের শিল্পকারখানায় শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ অপরিহার্য।

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে শ্রম মন্ত্রণালয় এক ত্রিপক্ষীয় সভা সমাপ্ত করেছে। উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক, মালিক এবং সরকারপক্ষের প্রতিনিধিত্ব। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে ছুটির আগেভাগেই রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পসহ অন্য সব খাতের শ্রমিকেরা চলতি এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত কর্মঘণ্টার, নির্দিষ্ট করে বললে মাসের অর্ধেক বেতন পাবেন। অর্ধেক বেতনের কথা শুনলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কি অনেক টাকা বেতন পায়, যেটা তাদের চাহিদা পূরণের পরও অতিরিক্ত? নতুবা অর্ধেক বেতনের প্রশ্ন কেন আসবে? তাহলে এবার একটু শ্রমিকের বেতন বা মজুরির দিকে তাকানো যাকÑ বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা ৮ হাজার টাকা।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মালিকপক্ষ এ ৮ হাজার বলতে মোট বেতন বুঝে থাকেন, বেসিক বেতন নয়। যেখানে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার হয়ে থাকলে বেসিক ৪ হাজার ২০০ টাকা; বাকি ৩ হাজার ৮০০ টাকা বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা এবং গাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা। বিতর্কের বিষয় অধিকাংশ কারখানাতেই এই নির্দেশনা বলবৎ নেই। ৬ থেকে ৭ হাজার টাকাও মোট বেতন ধরা হয়। এমনকি কোন কোন নতুন কারখানায় পেটেভাতে, মোট ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেতনে টিকে থাকতে হয়। বছরান্তে এই বেতন বেসিকের ৫% করে বাড়ে। যখন বোনাসের বিষয় সামনে আসে তখন বেসিকের ১০০% হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। আটকে দেয়া হয় ঘণ্টায় বেসিকের দ্বিগুণ ওভারটাইম কর্মঘণ্টা মজুরি। অথচ যে ওভারটাইম শ্রমিকদের বাধ্য করে করানো হয় তাদের ইচ্ছার বিপরীতে, ত্যাগ করতে হয় শ্রমিকের ঘুম-বিশ্রাম। কোন কোন কারখানায় বকেয়া ফেলে রাখা হয় শ্রমিকদের ২ থেকে ৩ মাসের বেতন।

বিগত ছয় মাস ধরে দ্রব্যমূল্য হু হু করে বাড়ছে, বর্তমানে যার লাগামছাড় পরিস্থিতি। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। মোটা দাগে বলতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আর হাতের নাগালে নেই। যেই মোটা চালের ভাত খেয়ে শ্রমিকেরা কাজে বেরিয়ে পরে তার দাম পৌঁছেছে ৫০ টাকায়। তরিতরকারি দাম কেজিতে ৬০ টাকার নিচে অকল্পনীয়। কোন কোন সবজির দাম কেজিতে ১০০ টাকারও অনেক ওপরে ছাড়িয়েছে। শ্রমিকদের জন্য সামান্য মুরগির মাংস এবং চিকন মিনিকেট চালের ভাত এখন বিলাসিতা। বরাবরের মতো সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদেরও কম বেশি বাড়ে। বাড়ে না শুধু শ্রমিকের বেলায়। যতক্ষণে না আন্দোলন করবে, আন্দোলনে কারও জীবন বিপন্ন না হবে ততক্ষণে সবাই চুপচাপ। দ্রব্যমূল্য যদি এভাবে বাড়তে থাকে তখন বহু আগে নির্ধারণ করা মাসিক মজুরিতে তাদের চলে কি করে? এমতাবস্থায় ঈদের মাসে অর্ধেক বেতন দেয়ার পরিকল্পনা শ্রমিকের ঘামের সঙ্গেই স্রেফ প্রতারণার সামিল।

বর্তমানে পোশাক কারখানায় অর্ডারের চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। এত পরিমাণে অর্ডার আসছে যে অনেক প্রতিষ্ঠান আর অর্ডার গ্রহণ করতে পারছেন না। যে পরিমাণসংখ্যক শ্রমিক বিভিন্ন কারখানা কাজ করছে তাতে কুলিয়ে ওঠা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ করোনায় চীনের নতুন করে লকডাউন, শ্রীলঙ্কার দুর্ভিক্ষ, কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ক্রেতারা নিশ্চয়তার খোঁজে বাংলাদেশে স্থানান্তর হয়েছেন। বাধ্য করে শ্রমিকদের ওভারটাইম করানো হচ্ছে, ব্যস্ততায় রাখা হচ্ছে রাত-দিনের কয়েক শিফটে। এত পরিমাণ অর্ডার যে, অর্ডারের প্রাচুর্যে যথাসময়ে শিপমেন্ট করা নিয়েও আছে উদ্বেগ। অর্থনীতির চালচিত্রে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চে ৯ মাসে একমাত্র নিট খাত থেকেই এসেছে ১৭ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলারের বৈদিক মুদ্রা। অর্থাৎ গত বছরের এ সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। ওভেন পোশাক রপ্তানিতে ৯ মাসে এসেছে ১৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।

এককভাবে হিসাব করলে শুধু গেল মার্চ মাসেই বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার এসেছে বাংলাদেশে। বিনিময় হারে হিসাব করলে এই অর্থ ৪১ হাজার কোটি টাকারও অনেক বেশি। শুধু পোশাক খাতেই না; স্পিনিং মিল, লেদার কারখানা, স্টিল মিল, ফুড মিল, সিরামিকস-মেলামাইন ফ্যাক্টরি ইত্যাদিতেও পড়েছে অস্বাভাবিক অর্ডার কাজের চাপ। অন্যদিকে উৎসবের সময়ে পুরোদমে কেনাকাটার হিসাব করে উৎপাদন-সরবরাহের চাপ থাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থানীয় বাজারেও। সামনে ঈদ থাকায় শ্রমিকেরা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে যান, কারণ ঈদের দিন স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ-উল্লাসে কাটাবেন, ফূর্তি করবেন। অথচ পুরো মাস অতিরিক্ত পরিশ্রম করেও এবার তাদের ভাসতে হবে চোখের জলে।

স্বজনদের কাছে গ্রামের বাড়িতে যেতে হলে প্রত্যেককে অবশ্যই আগামী মাসের ঘর ভাড়া, খাওয়ার খরচ, বিভিন্ন বিলসহ নানা খরচের চিন্তা আগে করতে হবে। কেননা আগামী মাসে কারখানা খুলেই তো বিগত অর্ধেক মাসের পাওনা কোন প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে না। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির বাজারে এত কিছুর হিসাব মেলানোর পর পরিশেষে বাড়িতে যেতে হলে পরিবার-স্বজনদের জন্য কিছু কেনাকাটা, যাতায়াত খরচ, ঈদের দিনের জন্য অন্তত এক প্যাকেট সেমাই-চিনি এবং সামান্য কিছু খাবার কি এই অর্ধেক বেতন-বোনাসে সম্ভব? ঈদের ছুটিতে যাওয়ার আগে শ্রমিকেরা কাজ করবেন পুরো মাসের, তাহলে বেতন কেন অর্ধেক মাসের পাবেন? এটা অন্যায় নয় কি? কথা হলো শ্রমিকদের এমন সর্বনাশ করতে কোন ধরনের শ্রমিক প্রতিনিধিরা সভাকক্ষে উপস্থিত ছিলেন? তারা কি আদতে শ্রমিক? শ্রমিক প্রতিনিধি হয়ে থাকলে তিনি তো নিজ শ্রেণী স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারেন না। নামে মাত্র এমন শ্রমিক প্রতিনিধি বানিয়েছেনই বা কে? এই শ্রমিক প্রতিনিধি কি সব শ্রমিকের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত অথবা সমর্থিত? সেটা যদি না হয়ে থাকে তবে এ ধরনের দায়সারা বিপজ্জনক কার্যকলাপ শ্রমিকদের ভেতরে ক্ষোভের জন্ম দেবে। পরিণামে শ্রমিকদের ক্ষোভের বিস্ফোরণে কি ঘটতে পারে, তার বাস্তবিক পরিস্থিতি আমরা নানা সময়ে উপলব্ধি করেছি।

২০১৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র মতে ৪০ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টসে কাজ করেন। গত সাত বছরে গার্মেন্টস যেমন বেড়েছে তেমনি শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়েছে ঢের বেশি। বর্তমানে শ্রমিকের এই সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া স্বাভাবিক। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা একত্রে যোগ করলে বাংলাদেশে শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটিরও অনেক ওপরে। সে হিসেবে সবার ন্যূনতম বেসিক গড় মজুরি যদি ৮ হাজারে হিসাব করা হয় এবং তার অর্ধেক মজুরি দাঁড়ায় ৪ হাজার টাকা, যা ঈদের মাসে পাওয়া যাবে না। শ্রমিক সংখ্যার সঙ্গে এই মজুরি টাকা গুন করলে দাঁড়ায় ৮ হাজার কোটি টাকা। শ্রমিকেরা এই বিপুল অঙ্কের টাকাটা খরচ করত বাস ভাড়ায়, কাপড়, জুতাসহ নানান জিনিস কেনাকাটা, খাবারে আর সামান্য বিনোদনে। এবারে ওই সব সেবা এবং জিনিসপত্রের বিক্রেতাদের বাজারেও মন্দা তৈরি হবে। উৎসবের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতির বাজারের যে সম্পর্ক রয়েছে সেখানে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পরছে অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের ফলে। পরে চলতি মাসের এই বাকি অর্ধেক মজুরি যে বকেয়ার খাতায় পড়ল, তা আগামী মাসের মজুরির সঙ্গে আদায় হওয়া নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের ভেতরে সন্দেহ থেকে যায়।

চীনের করোনা, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট, পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং কম্বোডিয়ায় নানা জটিলতা ক্রয়াদেশ সরে যেই মুহূর্তে বাংলাদেশে স্থানান্তর হচ্ছে তখন শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি দুঃখজনক। এমনিতেই নামেমাত্র মজুরি, কাজের অনুপযুক্ত পরিবেশ! সেখানে সারা বছরে তাকিয়ে থাকা দিনটাই যদি জীবন থেকে নাই হয়ে যায়, স্বজনদের কাছে না যেতে পারে কিংবা চোখের জলে ভাসতে হয়, সে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ আঁধারের ঘনঘটা। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচারের ওপর দাঁড়িয়ে। শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা দূরে থাক; ন্যায় বিচারই নিশ্চিত করা হচ্ছে না, তৈরি করা যাচ্ছে না সমতার বিধান। শ্রমিকদের বিষয়ে নানা সময়ে অবিবেচকের মতো নানা সিদ্ধান্ত নেয়ায় ক্রমেই তৈরি হয়েছে বৈষম্য, শ্রমিকবান্ধব রাষ্ট্র কায়েম হয়নি। কাজেই নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি না করে শ্রমিকের সম্পূর্ণ ন্যায্য পাওনা যথা সময়ে বুঝিয়ে দেয়া মালিকপক্ষের কর্তব্য। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে দাবি রাখে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]