বিভিন্ন স্থানে তুমুল যুদ্ধ, রাজাকারদের আস্ফালন

একাত্তরের ২২ এপ্রিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানীদের সমর্থনকারী রাজাকাররাও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাস্তিানিদের পক্ষ নিয়ে নানা তৎপরতা চালায়।

কুমিল্লার গঙ্গাসাগরে ২২ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর হামালা চালায়। প্রচ- যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের ছয় সৈন্য নিহত হয়। হানাদার বাহিনী অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটলে মুক্তিযোদ্ধারা গোলাবারুদ ও অস্ত্র দখল করে নেয়।

এদিনে হিলিতে পাকিস্তানি হানাদাররা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্ত রেখার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। অতর্কিত হামলায় মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ভূখ-ে আশ্রয় নেন।

রাজশাহীর গোদাগাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তান বাহিনী হামলা চালায়। পাকিস্তানি হানাদারদের আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের হামলায় বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এদিনেই পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণে বগুড়া শহরের পতন হয়।

এদিনে পাকিস্তানি হানাদারেরা পাবনার সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িতে গোলাবর্ষণ শুরু করলে মুক্তিবাহিনী পাল্টা হামলা করে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের পর বাঘাবাড়ি ও শাহজাদপুর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদাররা।

পাকিস্তানি হানাদারেরা হেলিকপ্টারে করে মাদারীপুরে এসে শহরের ওপর গোলাবর্ষণ করে। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল মাদারীপুরের সংগ্রাম কমিটির কার্যালয় ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ মিলন সিনেমা হল। এই হামলায় কেউ নিহত না হলেও বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ আহত হন।

২২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারেরা নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম থেকে ত্রিমুখী আক্রমণ করে ফেনীর ওপর। মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফেনী দখল করতে না পেরে ক্যাম্পে ফিরে যায় তারা। এইদিন চট্টগ্রামের দোহাজারীতে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।

রাজশাহী থেকে পাকিস্তানি হানাদারেরা ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নওগাঁ শহরে প্রবেশ করে। নওগাঁ শহরে তা-বলীলা চালায়। ময়মনসিংহের মধুপুর জঙ্গলে পাকিস্তানি হানাদারেরা মুক্তিবাহিনীর ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী প্রথমে পিছু হটলেও পরে হালুয়াঘাটে এসে অবস্থান নেয়।

পাকিস্তানি হানাদারেরা সাতক্ষীরা থেকে কালীগঞ্জে এসে অবস্থান নেয়। এর আগের দিন পাকিস্তানি হানাদারেরা সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুলে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের মধ্য থেকে বেশিরভাগ শরণার্থীকে পার্শ্ববর্তী দিনেশ কর্মকারের বাড়িতে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একই দিন সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া এলাকার অ্যাডভোকেট কাজী মসরুর আহমেদের দ্বিতল বাড়ির পূর্বাংশ ধ্বংস করে তাকে ও তার শ্যালক শেখ মাসুদার রহমানকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এরপর হানাদারেরা সুলতানপুর কুমোরপাড়ায় একই পরিবারের তিন জনকে হত্যা করে এবং শেখ মশির আহমেদের বাড়ি ধ্বংস করে সেই বাড়ির সামনে সিলভার জুবিলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদের ও সাতক্ষীরা কোর্টের মোহরার পুণ্য শাহকে গুলি করে হত্যা করে।

এই দিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না। তিনি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি দল, মত, পেশা, বয়স নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার ও সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

এই দিন ঢাকায় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খাজা খয়ের উদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শান্তি কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা। দেশদ্রোহী ভারতের দালাল মুক্তিবাহিনীর কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে।’

শুক্রবার, ২২ এপ্রিল ২০২২ , ০৯ বৈশাখ ১৪২৮ ২০ রমাদ্বান ১৪৪৩

২২ এপ্রিল ১৯৭১

বিভিন্ন স্থানে তুমুল যুদ্ধ, রাজাকারদের আস্ফালন

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একাত্তরের ২২ এপ্রিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানীদের সমর্থনকারী রাজাকাররাও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাস্তিানিদের পক্ষ নিয়ে নানা তৎপরতা চালায়।

কুমিল্লার গঙ্গাসাগরে ২২ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর হামালা চালায়। প্রচ- যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের ছয় সৈন্য নিহত হয়। হানাদার বাহিনী অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটলে মুক্তিযোদ্ধারা গোলাবারুদ ও অস্ত্র দখল করে নেয়।

এদিনে হিলিতে পাকিস্তানি হানাদাররা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্ত রেখার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। অতর্কিত হামলায় মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ভূখ-ে আশ্রয় নেন।

রাজশাহীর গোদাগাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তান বাহিনী হামলা চালায়। পাকিস্তানি হানাদারদের আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের হামলায় বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এদিনেই পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণে বগুড়া শহরের পতন হয়।

এদিনে পাকিস্তানি হানাদারেরা পাবনার সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িতে গোলাবর্ষণ শুরু করলে মুক্তিবাহিনী পাল্টা হামলা করে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের পর বাঘাবাড়ি ও শাহজাদপুর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদাররা।

পাকিস্তানি হানাদারেরা হেলিকপ্টারে করে মাদারীপুরে এসে শহরের ওপর গোলাবর্ষণ করে। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল মাদারীপুরের সংগ্রাম কমিটির কার্যালয় ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ মিলন সিনেমা হল। এই হামলায় কেউ নিহত না হলেও বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ আহত হন।

২২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারেরা নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম থেকে ত্রিমুখী আক্রমণ করে ফেনীর ওপর। মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফেনী দখল করতে না পেরে ক্যাম্পে ফিরে যায় তারা। এইদিন চট্টগ্রামের দোহাজারীতে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।

রাজশাহী থেকে পাকিস্তানি হানাদারেরা ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নওগাঁ শহরে প্রবেশ করে। নওগাঁ শহরে তা-বলীলা চালায়। ময়মনসিংহের মধুপুর জঙ্গলে পাকিস্তানি হানাদারেরা মুক্তিবাহিনীর ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী প্রথমে পিছু হটলেও পরে হালুয়াঘাটে এসে অবস্থান নেয়।

পাকিস্তানি হানাদারেরা সাতক্ষীরা থেকে কালীগঞ্জে এসে অবস্থান নেয়। এর আগের দিন পাকিস্তানি হানাদারেরা সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুলে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের মধ্য থেকে বেশিরভাগ শরণার্থীকে পার্শ্ববর্তী দিনেশ কর্মকারের বাড়িতে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একই দিন সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া এলাকার অ্যাডভোকেট কাজী মসরুর আহমেদের দ্বিতল বাড়ির পূর্বাংশ ধ্বংস করে তাকে ও তার শ্যালক শেখ মাসুদার রহমানকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এরপর হানাদারেরা সুলতানপুর কুমোরপাড়ায় একই পরিবারের তিন জনকে হত্যা করে এবং শেখ মশির আহমেদের বাড়ি ধ্বংস করে সেই বাড়ির সামনে সিলভার জুবিলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদের ও সাতক্ষীরা কোর্টের মোহরার পুণ্য শাহকে গুলি করে হত্যা করে।

এই দিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না। তিনি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি দল, মত, পেশা, বয়স নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার ও সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

এই দিন ঢাকায় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খাজা খয়ের উদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শান্তি কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা। দেশদ্রোহী ভারতের দালাল মুক্তিবাহিনীর কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে।’