হাওরের কৃষি : বন্যা নিয়ন্ত্রণই চ্যালেঞ্জ

মিহির কুমার

হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশাল জলরাশি, যা বর্ষার চিত্র। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। গ্রামগুলো যেন দ্বীপের মতো ভাসতে থাকে পানির ওপর। আবার শুকনো মৌসুমে যেদিকে চোখ যায় অবারিত সবুজের সমারোহ। হাওরজুড়ে শুধু ধান আর ধান। সাধারণত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওরসমূহ নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত; যেখানে রয়েছে ৬২টি উপজেলার ৫৪১টি ইউনিয়ন।

হাওরে সাধারণত চৈত্রের শেষে ধান কাটা শুরু হয় এবং চলে বৈশাখ মাসজুড়ে। এ ধান দিয়েই হাওরপারের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। এ বছরও সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ একর জমির ধান ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে। অনেক বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল। কৃষক ও এলাকাবাসী দিনরাত বাঁধের পাশে থেকে নিজেরাই বিনা শ্রমে বাঁধে মাটি কাটছেন। আর দায়িত্বশীল পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে কাঁকড়া আর ইঁদুরকে চিহ্নিত করেছেন; যারা ভুক্তভোগী কৃষক তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, যারা প্রকৃত জমির মালিক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বাঁধ নির্মাণ কমিটিতে রাখা হয় না। সঠিকভাবে বাঁধের কাজ হয় না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নের ধান। তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ পরিস্থিতিতে ওই এলাকার কৃষকের কিছুই করার নেই। কারণ বেশির ভাগ জমির ধান থাকে কাঁচা। আর কাঁচা ধান তো কাটার উপায় নেই। কাঁচা ধান কেটেও লাভ নেই। চেয়ে চেয়ে দেখা আর বোবা কান্না ছাড়া যেন কিছুই করার নেই।

আবার বেষ্টিক অর্থনীতির মানদন্ডে হাওর অঞ্চল থেকে যে ধান উৎপাদন হয়ে চাল আকারে দেশের কেন্দ্রীয় স্টকে জমা হতো; যার আর্থিক মূল্য ৩ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা- যা দেশের জিডিপিতে অবশ্যই একটা প্রভাব ফেলবে নিশ্চয়ই। কারণ দেশের সার্বিক উন্নয়নে হাওর অঞ্চল থেকে শতকরা ১৮ ভাগ চাউল খাদ্য নিরাপত্তায় সংযোজন হয় এবং শতকরা ২২ ভাগ গবাদি পশু এই অঞ্চলে লালিত পালিত হয়, মৎস্য ভান্ডারে ভরপুর এ অঞ্চল দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে এক গুরত্বত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে বর্তমান দুটি মাসেই কৃষকরা একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে পাহাড়ি ঢলের বন্যার পানি কখন আসবে। যেমন এ বছর এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার ছোট-বড় শতাধিক হাওরের মধ্যে ১৫টিতেই সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে পানি। ভাঙছে বাঁধ ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে আনুমানিক ৭ হাজার হেক্টর বোরো ফসল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১২টি বাঁধ ভেঙে ৪৩৫০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

সময় মতো বাঁধের কাজ শেষ না করা, অর্থ ছাড় না করা, প্রকৃত কৃষকদের পিআইসির অন্তর্ভুক্ত না করার ফলেই দুর্বল বাঁধের কাজ হওয়ায় প্রথম ধাক্কায় বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে কৃষকদের স্বপ্ন সাধ চুরমার হয়ে গেছে, এমন অভিযোগ সুনামগঞ্জবাসীর। সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ৪২টি হাওরে ৭২৭টি পিআইসি ১৩৫টি ক্লোজারসহ মোট ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের ও সংস্কারের জন্য সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ১২১ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রদান করে।

বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ না হওয়ার পর আর ও ১০ দিন সময় বৃদ্ধি করার পর ও কাজ শেষ হয়নি। এরই মধ্যেই সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢল এসে ফসল রক্ষা বাঁধের সর্বনাশ করে সুনামগঞ্জবাসীকে চরম উদ্বিগ্ন করে। ইতোমধ্যে সেখানকার দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর ও ধর্মপাশায় বিভিন্ন ছোট-বড় হাওরে ধান তলিয়ে গেছে। আর যেগুলো এখনো তলিয়ে যায়নি সেগুলোও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ২০১৭ সালের কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন কৃষকরা। ওই বছরের অকাল বন্যায় হাওর অঞ্চলের কাঁচা ধান তলিয়ে গিয়েছিল পানির নিচে। ভাসিয়ে নিয়েছিল ক্ষেতের ধান, সেই সঙ্গে মাছ, মুরগি, গরু-ছাগলের খামারও।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় হাওরাঞ্চলে সাধারণত এপ্রিলের শেষদিকে ভারত থেকে নেমে আসে উজানের পাহাড়ি ঢল এবং এ পানিটা থাকে কয়েক মাস। আর কৃষকরা সাধারণত বৈশাখের শুরুর দিকে অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝিতে পাকা ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে তোলে। হাওরে ২০১৭ সালে বন্যা হয়েছিল এপ্রিলের শুরুর দিকে। এবারও হয়েছে প্রায় একই সময়ে। সেখানকার কৃষকেরা তাই খুব আতঙ্কের মধ্যে আছেন।

কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি সুনামগঞ্জ এসেছিলেন ভাটির মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য যে প্রজ্ঞা, মেধা ও সংগ্রামকে লালন করেছিন তা হাওরের এই দান। তাই আজ রাষ্ট্রপতির চেয়ে আমার বড় পরিচয় তিনি হাওরী মানুষ। এজন্য তিনি ভালো করেই জানেন এখানকার প্রতিটি মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র নির্ধারক হাওরের বোরো ধান। সত্যি কথা বলতে কি, এখানকার মানুষের স্বপ্নের প্রতিটি উপাদানই হাওরকেন্দ্রিক। কিন্তু প্রায় প্রতি বছর এই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় গুটিকয়েক কারণে।

সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার, ৪২টি হাওরের প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। এই ফসল রক্ষার জন্য প্রতি বছর এই কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এবারো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৬৯ কোটি টাকা। ২০১১ সালে এই বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি টাকা। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, ভাটির বুকে একটি কথা প্রচলিত আছে, বাঁধের জন্য যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হয়, সেই টাকা ধাতব মুদ্রায় রূপান্তরিত করে বাঁধ দিলে তা ডুববে না। তারপরেও অধিকাংশ বছরই বাঁধ তলিয়ে যায়। কোনো কোনো বছর ভাগ্যবিধাতা সহায় হলে রক্ষা পায়। হাওর পারের অনেক বাঁধই স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা সম্ভব। বাঁধের ওপর স্থায়ী বসতি স্থাপন ও পর্যটন স্পট গড়ে তোলা সম্ভব।

হাওর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্টদের এখনেই ব্যবস্থা নিতে না পারলে খুব ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ ক্ষতি শুধু হাওর অঞ্চলের কৃষকদের নয়। এ ক্ষতি সারা দেশের। এটা ঠিক, হাওরের অকাল বন্যা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার উৎসস্থল আবার দেশের বাইরে। তা ছাড়া মেঘালয় ও আসামে যে বৃষ্টি হয় তার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট নদীগুলো হয়ে আমাদের হাওরেই এসে জমা হয়। অতএব এ দুর্যোগ ঠেকানো সহজ ব্যাপার নয়। আবার এটাও তো ঠিক যে, সীমান্তের ওপারে বছরে কোন সময়ে কতটুকু বৃষ্টি হয় তার রেকর্ড আমাদের অজানা নয়। আবার সেখানে আগামী কয়েক দিন কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তার আগাম তথ্য জানাও দুই দেশের মধ্যে বন্যা বা আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় চুক্তি থাকার কারণে খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। এসব তথ্য জানা থাকলে পাহাড়ি ঢল ঠেকানো না হোক তার কারণে যাতে কম ক্ষয়ক্ষতি হয় অন্তত সেই ব্যবস্থা নেয়া যায় নিশ্চয়ই।

[লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ]

শুক্রবার, ২২ এপ্রিল ২০২২ , ০৯ বৈশাখ ১৪২৮ ২০ রমাদ্বান ১৪৪৩

হাওরের কৃষি : বন্যা নিয়ন্ত্রণই চ্যালেঞ্জ

মিহির কুমার

image

হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশাল জলরাশি, যা বর্ষার চিত্র। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। গ্রামগুলো যেন দ্বীপের মতো ভাসতে থাকে পানির ওপর। আবার শুকনো মৌসুমে যেদিকে চোখ যায় অবারিত সবুজের সমারোহ। হাওরজুড়ে শুধু ধান আর ধান। সাধারণত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওরসমূহ নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত; যেখানে রয়েছে ৬২টি উপজেলার ৫৪১টি ইউনিয়ন।

হাওরে সাধারণত চৈত্রের শেষে ধান কাটা শুরু হয় এবং চলে বৈশাখ মাসজুড়ে। এ ধান দিয়েই হাওরপারের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। এ বছরও সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ একর জমির ধান ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে। অনেক বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল। কৃষক ও এলাকাবাসী দিনরাত বাঁধের পাশে থেকে নিজেরাই বিনা শ্রমে বাঁধে মাটি কাটছেন। আর দায়িত্বশীল পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে কাঁকড়া আর ইঁদুরকে চিহ্নিত করেছেন; যারা ভুক্তভোগী কৃষক তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, যারা প্রকৃত জমির মালিক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বাঁধ নির্মাণ কমিটিতে রাখা হয় না। সঠিকভাবে বাঁধের কাজ হয় না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নের ধান। তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ পরিস্থিতিতে ওই এলাকার কৃষকের কিছুই করার নেই। কারণ বেশির ভাগ জমির ধান থাকে কাঁচা। আর কাঁচা ধান তো কাটার উপায় নেই। কাঁচা ধান কেটেও লাভ নেই। চেয়ে চেয়ে দেখা আর বোবা কান্না ছাড়া যেন কিছুই করার নেই।

আবার বেষ্টিক অর্থনীতির মানদন্ডে হাওর অঞ্চল থেকে যে ধান উৎপাদন হয়ে চাল আকারে দেশের কেন্দ্রীয় স্টকে জমা হতো; যার আর্থিক মূল্য ৩ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা- যা দেশের জিডিপিতে অবশ্যই একটা প্রভাব ফেলবে নিশ্চয়ই। কারণ দেশের সার্বিক উন্নয়নে হাওর অঞ্চল থেকে শতকরা ১৮ ভাগ চাউল খাদ্য নিরাপত্তায় সংযোজন হয় এবং শতকরা ২২ ভাগ গবাদি পশু এই অঞ্চলে লালিত পালিত হয়, মৎস্য ভান্ডারে ভরপুর এ অঞ্চল দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে এক গুরত্বত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে বর্তমান দুটি মাসেই কৃষকরা একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে পাহাড়ি ঢলের বন্যার পানি কখন আসবে। যেমন এ বছর এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার ছোট-বড় শতাধিক হাওরের মধ্যে ১৫টিতেই সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে পানি। ভাঙছে বাঁধ ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে আনুমানিক ৭ হাজার হেক্টর বোরো ফসল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১২টি বাঁধ ভেঙে ৪৩৫০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

সময় মতো বাঁধের কাজ শেষ না করা, অর্থ ছাড় না করা, প্রকৃত কৃষকদের পিআইসির অন্তর্ভুক্ত না করার ফলেই দুর্বল বাঁধের কাজ হওয়ায় প্রথম ধাক্কায় বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে কৃষকদের স্বপ্ন সাধ চুরমার হয়ে গেছে, এমন অভিযোগ সুনামগঞ্জবাসীর। সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ৪২টি হাওরে ৭২৭টি পিআইসি ১৩৫টি ক্লোজারসহ মোট ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের ও সংস্কারের জন্য সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ১২১ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রদান করে।

বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ না হওয়ার পর আর ও ১০ দিন সময় বৃদ্ধি করার পর ও কাজ শেষ হয়নি। এরই মধ্যেই সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢল এসে ফসল রক্ষা বাঁধের সর্বনাশ করে সুনামগঞ্জবাসীকে চরম উদ্বিগ্ন করে। ইতোমধ্যে সেখানকার দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর ও ধর্মপাশায় বিভিন্ন ছোট-বড় হাওরে ধান তলিয়ে গেছে। আর যেগুলো এখনো তলিয়ে যায়নি সেগুলোও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ২০১৭ সালের কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন কৃষকরা। ওই বছরের অকাল বন্যায় হাওর অঞ্চলের কাঁচা ধান তলিয়ে গিয়েছিল পানির নিচে। ভাসিয়ে নিয়েছিল ক্ষেতের ধান, সেই সঙ্গে মাছ, মুরগি, গরু-ছাগলের খামারও।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় হাওরাঞ্চলে সাধারণত এপ্রিলের শেষদিকে ভারত থেকে নেমে আসে উজানের পাহাড়ি ঢল এবং এ পানিটা থাকে কয়েক মাস। আর কৃষকরা সাধারণত বৈশাখের শুরুর দিকে অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝিতে পাকা ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে তোলে। হাওরে ২০১৭ সালে বন্যা হয়েছিল এপ্রিলের শুরুর দিকে। এবারও হয়েছে প্রায় একই সময়ে। সেখানকার কৃষকেরা তাই খুব আতঙ্কের মধ্যে আছেন।

কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি সুনামগঞ্জ এসেছিলেন ভাটির মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য যে প্রজ্ঞা, মেধা ও সংগ্রামকে লালন করেছিন তা হাওরের এই দান। তাই আজ রাষ্ট্রপতির চেয়ে আমার বড় পরিচয় তিনি হাওরী মানুষ। এজন্য তিনি ভালো করেই জানেন এখানকার প্রতিটি মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র নির্ধারক হাওরের বোরো ধান। সত্যি কথা বলতে কি, এখানকার মানুষের স্বপ্নের প্রতিটি উপাদানই হাওরকেন্দ্রিক। কিন্তু প্রায় প্রতি বছর এই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় গুটিকয়েক কারণে।

সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার, ৪২টি হাওরের প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। এই ফসল রক্ষার জন্য প্রতি বছর এই কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এবারো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৬৯ কোটি টাকা। ২০১১ সালে এই বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি টাকা। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, ভাটির বুকে একটি কথা প্রচলিত আছে, বাঁধের জন্য যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হয়, সেই টাকা ধাতব মুদ্রায় রূপান্তরিত করে বাঁধ দিলে তা ডুববে না। তারপরেও অধিকাংশ বছরই বাঁধ তলিয়ে যায়। কোনো কোনো বছর ভাগ্যবিধাতা সহায় হলে রক্ষা পায়। হাওর পারের অনেক বাঁধই স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা সম্ভব। বাঁধের ওপর স্থায়ী বসতি স্থাপন ও পর্যটন স্পট গড়ে তোলা সম্ভব।

হাওর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্টদের এখনেই ব্যবস্থা নিতে না পারলে খুব ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ ক্ষতি শুধু হাওর অঞ্চলের কৃষকদের নয়। এ ক্ষতি সারা দেশের। এটা ঠিক, হাওরের অকাল বন্যা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার উৎসস্থল আবার দেশের বাইরে। তা ছাড়া মেঘালয় ও আসামে যে বৃষ্টি হয় তার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট নদীগুলো হয়ে আমাদের হাওরেই এসে জমা হয়। অতএব এ দুর্যোগ ঠেকানো সহজ ব্যাপার নয়। আবার এটাও তো ঠিক যে, সীমান্তের ওপারে বছরে কোন সময়ে কতটুকু বৃষ্টি হয় তার রেকর্ড আমাদের অজানা নয়। আবার সেখানে আগামী কয়েক দিন কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তার আগাম তথ্য জানাও দুই দেশের মধ্যে বন্যা বা আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় চুক্তি থাকার কারণে খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। এসব তথ্য জানা থাকলে পাহাড়ি ঢল ঠেকানো না হোক তার কারণে যাতে কম ক্ষয়ক্ষতি হয় অন্তত সেই ব্যবস্থা নেয়া যায় নিশ্চয়ই।

[লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ]