মূল্যস্ফীতি কেন ঘটে

এস এম জাহাঙ্গীর আলম

দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বাড়ার প্রধান কারণ হলো অর্থের জোগান বৃদ্ধি। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশে অর্থ সরবরাহের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে দেশে অর্থ সরবরাহের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ সালনাগাদ অর্থ সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯,৩১৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ সালনাগাদ অর্থ সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৯৭,১৩৬ কোটি টাকা। সুতরাং অর্থের জোগানের ক্রমাগত বৃদ্ধি বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে দায়ী।

মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো উৎপাদন হ্রাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া শিল্পের কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতির অভাব ও সুষ্ঠু শিল্পনীতির অভাবে দেশে উৎপাদন বিশেষ করে শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন আশানুরূপ বাড়েনি। বস্তুত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে উৎপাদন সে হারে বৃদ্ধি না পাওয়ায় দেশে-দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ক্রমশ তীব্র হচ্ছে এবং মুদ্রাস্ফীতির মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্বাধীনতা লাভের পর দেশের যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন ও পুনঃনির্মাণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ঋণদান যথেষ্ট উদার করা হয়। ফলে দেশের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১,৩৩৯ কোটি টাকা। ১৯৯৫-৯৬ সাল নাগাদ ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৬,৮৬৯ কোটি টাকা। ২০১০-১১ সাল নাগাদ মোট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩,৯৪,২২২ কোটি টাকা। এভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কর্তৃক ব্যাপক ঋণদানের ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি : উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিভিন্ন খাতে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এসব ব্যয়ের বিপরীতে সমপরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বাড়ছে এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ তীব্রতর হচ্ছে।

খাদ্য ঘাটতি : দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুন বাংলদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। দেশে চাহিদার তুলনায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের মূল্য এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশে সার্বিক মূল্যস্তর বৃদ্ধি পায়।

টাকার অবমূল্যায়ন : অবমূল্যায়নের ফলে টাকার বাহ্যিক মূল্য হ্রাস পায়। এর ফলে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং দেশের অভ্যন্তরে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। স্বাধীনতা লাভের পর বহুবার ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালে টাকা ডলারের গড় বিনিময় হার ছিল ১ ডলার=৭.৩০ টাকা। ২০১১-১২ সালে টাকা ও ডলারের গড় বিনিময় হার দাঁড়ায় ১ ডলার=৭৮.১৮ টাকা। বর্তমান বাংলাদেশি টাকায় ডলারের বিনিময় হার হলো ৮০.০০ টাকারও বেশি। টাকার অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের মূদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ।

জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি : আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকারকে বিভিন্ন সময়ে গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে হয়েছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে।

অধিক রপ্তানির প্রবণতা : দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট না হওয়া সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক পণ্য ব্যাপক হারে রপ্তানি করা হয়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং এসব দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।

আমদানি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি : সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশে^র বাজারে পেট্রোলিয়াম, গম, ভোজ্যতেল, সার, সিমেন্ট ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির দরুন বাংলাদেশে এসব আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি : উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, যেমন- শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট এবং পেট্রোল ও পেট্রোলজাত দ্রব্যের সরবরাহ মূল্য বৃদ্ধির দরুন উৎপাদন ব্যয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমদানি নীতির প্রভাব : বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল আমদানি নীতি। বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতার জন্য বাংলাদেশে বিদেশ হতে পণ্য সামগ্রীর আমদানির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ কার হয়েছে। বিলাসজাত দ্রব্য এবং কিছু কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানির উপর উচ্চহারে শুল্ক ও কর ধার্য করা হয়েছে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

মজুতদারি ও চোরাকারবার : স্বাধীনতা লাভের পর দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। মজুতদার, কালোবাজারি, মুনাফাখোর, চোরাচালানি প্রভৃতি অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের অভ্যন্তরে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চলেছে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপের ফলে দ্রব্যমূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

অতিরিক্ত পরোক্ষ কর : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হল পরোক্ষ করের প্রভাব। বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে পরোক্ষ কর হতে। বাণিজ্য শুল্ক, আবগারি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর প্রভৃতি পরোক্ষ কর ধার্যের ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ তীব্রতর হয়েছে।

সুষ্ঠু পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো সুষ্ঠু পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধার দরুন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত পণ্যসামগ্রী স্থানান্তরিত করা যায় না। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃত্রিম অভাবের সৃষ্টি হয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

বেতন ও মজুরি বৃদ্ধি : স্বাধীনতার পর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির দরুন বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীরা এবং বিভিন্ন শ্রমিক-সংঘ বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। স্বাধীনতার পর কয়েক দফা সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারি ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পায়। ২০১০ সালের গোড়ার দিকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন বাড়েনি। এ কারণে বেতন বৃদ্ধির ফলে দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনুৎপাদন শীল খাতে অধিক ব্যয় : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো অনুন্নয়ন ও অনুৎপাদনশীল খাতে অধিক ব্যয়। বিগত কয়েক বছরে দেশে স্টেডিয়াম, শিশুপার্ক নির্মাণ প্রভৃতি অনুৎপাদনশীল খাতে যথেষ্ট ব্যয় করা হয়। কিন্তু এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গতি তীব্রতর হয়েছে। এসব কারণে স্বাধীনতা লাভের পর দেশে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে দেশে মুদ্রাস্ফীতিজনিত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তাকে মোটামুটি তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে; যথা- (ক) আর্থিক ব্যবস্থা, (খ) রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থা এবং (গ) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হলো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি দূর করতে হলে অর্থের পরিমাণ কমাতে হবে। এ অর্থের পরিমাণ কমাতে হলে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণও কমাতে হবে। কারণ বর্তমান অর্থ ব্যবস্থায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহায্যে বহু লেনদেন হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

[লেখক: সাবেক কর কমিশনার]

শুক্রবার, ২২ এপ্রিল ২০২২ , ০৯ বৈশাখ ১৪২৮ ২০ রমাদ্বান ১৪৪৩

মূল্যস্ফীতি কেন ঘটে

এস এম জাহাঙ্গীর আলম

দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বাড়ার প্রধান কারণ হলো অর্থের জোগান বৃদ্ধি। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশে অর্থ সরবরাহের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে দেশে অর্থ সরবরাহের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ সালনাগাদ অর্থ সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯,৩১৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ সালনাগাদ অর্থ সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৯৭,১৩৬ কোটি টাকা। সুতরাং অর্থের জোগানের ক্রমাগত বৃদ্ধি বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে দায়ী।

মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো উৎপাদন হ্রাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া শিল্পের কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতির অভাব ও সুষ্ঠু শিল্পনীতির অভাবে দেশে উৎপাদন বিশেষ করে শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন আশানুরূপ বাড়েনি। বস্তুত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে উৎপাদন সে হারে বৃদ্ধি না পাওয়ায় দেশে-দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ক্রমশ তীব্র হচ্ছে এবং মুদ্রাস্ফীতির মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্বাধীনতা লাভের পর দেশের যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন ও পুনঃনির্মাণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ঋণদান যথেষ্ট উদার করা হয়। ফলে দেশের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১,৩৩৯ কোটি টাকা। ১৯৯৫-৯৬ সাল নাগাদ ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৬,৮৬৯ কোটি টাকা। ২০১০-১১ সাল নাগাদ মোট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩,৯৪,২২২ কোটি টাকা। এভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কর্তৃক ব্যাপক ঋণদানের ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি : উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিভিন্ন খাতে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এসব ব্যয়ের বিপরীতে সমপরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বাড়ছে এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ তীব্রতর হচ্ছে।

খাদ্য ঘাটতি : দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুন বাংলদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। দেশে চাহিদার তুলনায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের মূল্য এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশে সার্বিক মূল্যস্তর বৃদ্ধি পায়।

টাকার অবমূল্যায়ন : অবমূল্যায়নের ফলে টাকার বাহ্যিক মূল্য হ্রাস পায়। এর ফলে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং দেশের অভ্যন্তরে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। স্বাধীনতা লাভের পর বহুবার ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালে টাকা ডলারের গড় বিনিময় হার ছিল ১ ডলার=৭.৩০ টাকা। ২০১১-১২ সালে টাকা ও ডলারের গড় বিনিময় হার দাঁড়ায় ১ ডলার=৭৮.১৮ টাকা। বর্তমান বাংলাদেশি টাকায় ডলারের বিনিময় হার হলো ৮০.০০ টাকারও বেশি। টাকার অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের মূদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ।

জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি : আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকারকে বিভিন্ন সময়ে গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে হয়েছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে।

অধিক রপ্তানির প্রবণতা : দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট না হওয়া সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক পণ্য ব্যাপক হারে রপ্তানি করা হয়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং এসব দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।

আমদানি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি : সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশে^র বাজারে পেট্রোলিয়াম, গম, ভোজ্যতেল, সার, সিমেন্ট ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির দরুন বাংলাদেশে এসব আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি : উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, যেমন- শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট এবং পেট্রোল ও পেট্রোলজাত দ্রব্যের সরবরাহ মূল্য বৃদ্ধির দরুন উৎপাদন ব্যয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমদানি নীতির প্রভাব : বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল আমদানি নীতি। বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতার জন্য বাংলাদেশে বিদেশ হতে পণ্য সামগ্রীর আমদানির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ কার হয়েছে। বিলাসজাত দ্রব্য এবং কিছু কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানির উপর উচ্চহারে শুল্ক ও কর ধার্য করা হয়েছে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

মজুতদারি ও চোরাকারবার : স্বাধীনতা লাভের পর দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। মজুতদার, কালোবাজারি, মুনাফাখোর, চোরাচালানি প্রভৃতি অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের অভ্যন্তরে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চলেছে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপের ফলে দ্রব্যমূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

অতিরিক্ত পরোক্ষ কর : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হল পরোক্ষ করের প্রভাব। বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে পরোক্ষ কর হতে। বাণিজ্য শুল্ক, আবগারি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর প্রভৃতি পরোক্ষ কর ধার্যের ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ তীব্রতর হয়েছে।

সুষ্ঠু পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো সুষ্ঠু পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধার দরুন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত পণ্যসামগ্রী স্থানান্তরিত করা যায় না। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃত্রিম অভাবের সৃষ্টি হয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

বেতন ও মজুরি বৃদ্ধি : স্বাধীনতার পর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির দরুন বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীরা এবং বিভিন্ন শ্রমিক-সংঘ বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। স্বাধীনতার পর কয়েক দফা সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারি ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পায়। ২০১০ সালের গোড়ার দিকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন বাড়েনি। এ কারণে বেতন বৃদ্ধির ফলে দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনুৎপাদন শীল খাতে অধিক ব্যয় : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো অনুন্নয়ন ও অনুৎপাদনশীল খাতে অধিক ব্যয়। বিগত কয়েক বছরে দেশে স্টেডিয়াম, শিশুপার্ক নির্মাণ প্রভৃতি অনুৎপাদনশীল খাতে যথেষ্ট ব্যয় করা হয়। কিন্তু এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গতি তীব্রতর হয়েছে। এসব কারণে স্বাধীনতা লাভের পর দেশে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে দেশে মুদ্রাস্ফীতিজনিত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তাকে মোটামুটি তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে; যথা- (ক) আর্থিক ব্যবস্থা, (খ) রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থা এবং (গ) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হলো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি দূর করতে হলে অর্থের পরিমাণ কমাতে হবে। এ অর্থের পরিমাণ কমাতে হলে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণও কমাতে হবে। কারণ বর্তমান অর্থ ব্যবস্থায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহায্যে বহু লেনদেন হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

[লেখক: সাবেক কর কমিশনার]