পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৎপরতা বৃদ্ধি

একাত্তরের ২৩ এপ্রিল বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৎপরতা ব"দ্ধি করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। এদিনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্রিটিশ এমপি ডগলাস ম্যানকে নিয়ে বেনাপোল সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি সফর করেন এবং সেখানে তারা একটি বৈঠকে করেন।

একাত্তরের এদিনে পাকিস্তান সরকার কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের সাবেক ডেপুটি হাই-কমিশন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং একই সময়ে ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাই-কমিশন বন্ধে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

এদিনে যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় শ্রমিক দলীয় সদস্য ও অর্থনৈতিক সাহায্যবিষয়ক কমিটির সাবেক সচিব পিটার শোর এক বিব"তিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকার যে আচরণ করছে তা বন্য হিংস্র মনোভাবকেও হার মানিয়েছে। এই গণহত্যা উপো করা, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক উদ্যোগ এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে। আমি অনুরোধ করছি শ্রমিক দল যেন পার্লামেন্টে বিষয়টি উত্থাপন করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সব সহায়তা বন্ধ করে গণহত্যা বন্ধে সামরিক প্রশাসনের ওপর চাপ স"ষ্টি করে।’

১৯৭১ সালের এদিনে ঠাকুরগাঁওয়ের জাটিভাঙ্গায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তান বাহিনী। পাকিস্তানিদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া, শুখানপুকুরী, জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিংগিয়া, চন্ডীপুর, বাসুদেবপুর, মিলনপুর, গৌরীপুর, খামার ভোপলা, ভোপলা, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার পলাশবাড়ী ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার সংখ্যালঘু পরিবার ভারতে আশ্রয় নিতে সীমান্তে সমবেত হয়। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ওপর হামলা করে। তাদের নদীর পাড়ে নিয়ে সারিবদ্ধ করে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেখানে প্রায় আড়াই হাজারের মতো নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়।

১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর তিনটার দিকে পাকিস্তানি হানাদাররা রাজাকারদের সহযোগিতায় তিনটি সামরিক ট্রাক নিয়ে তাহেরপুর হাটে প্রবেশ করে। এরপর ¯'ানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হাটের অনেক ¯'ানে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এ সময় তারা ২২ জন নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে ‘হিন্দু এবং ভারতের দালাল’ অভিযোগে নির্মমভাবে হত্যা করে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে। গোমস্তাপুর থানার নিকটবর্তী বাজারপাড়া হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের ৩১ পুরুষকে ধরে নিয়ে যায় এবং পুরো গ্রামে তা-ব চালিয়ে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। হিন্দু ব্যক্তিদের থানার পেছন দিকে মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে ১৫ ও ১৬ জনের দুটি সারিতে ভাগ করা হয়। ১৫ জনের প্রথম দলটিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। এরপর অন্য দলটির ১৬ জনকেও একইভাবে গুলি করে হত্যা করে তারা। ব্রাশফায়াারের পরে মরদেহগুলো পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া নির্দেশ দিলে ওই ৩১ জনের মধ্য থেকে অমিল কর্মকার নামে এক ব্যক্তি ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। তখনই তাকেও গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

এদিনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সেনা যশোরের কাগজপুকুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অব¯'ানে আক্রমণ চালায়। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা বেনাপোল কাস্টম কলোনি ও চেকপোস্ট এলাকায় বিকল্প প্রতিরা ব্যব¯'া নেন। এ যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর নায়েক সুবেদার মজিবুল হকসহ ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে হানাদারদের ৫০ জন সেনা নিহত ও বহু সেনা আহত হয়েছিল।

এদিনে রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে পাকিস্তানি হানাদারদের দুইশ’ সেনা যাত্রা করলে ক্যাপ্টেন কাদের ও লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এদিনে ফেনীর পতন হয়। পাকিস্তানি হানাদারেরা ফেনী দখল করলে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অনেক ¯'ানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

পাকিস্তানি হানাদারেরা ’৭১ এর এদিনে তিস্তা ও লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি থেকে প্রবল গুলিবর্ষণ করতে করতে কুড়িগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। হানাদারদের ভারি অস্ত্রের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অব¯'ান ছেড়ে পিছু হটে নিরাপদ ¯'ানে অব¯'ান নেন।

ঢাকায় কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এ.এস.এম. সোলায়মান, নেজামে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানী, সাবেক এমএলএ রহিমুল্লাহ চৌধুরী ও আবদুস সোবহান প"থক প"থক বিব"তিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তেেপর প্রচেষ্টা দেশপ্রেমিক জনগণ ও সশস্ত্র সেনাবাহিনী নস্যাৎ করে দিয়েছে। জনগণ মুক্তিবাহিনী ও ভারতের চরদের প্রশ্রয় দিবে না। আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য গর্বিত। ভারতের চরদের হটাতে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা উচিৎ জনগণের।’

এদিন সিলেটে শান্তি কমিটির উদ্যোগে নেজামে ইসলাম ও শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকাররা শহরে মিছিল করে। এই মিছিলে তারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া খান জিন্দাবাদ এবং ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার, সাবধানসহ নানা সেøাগান দেয়। পরে মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সভায় শান্তি কমিটির নেতারা বলেন, ‘ভারতের চর মুক্তিবাহিনীকে উৎখাত করে পাকিস্তানের অখ-তা বজায় রাখতে হবে।’

শনিবার, ২৩ এপ্রিল ২০২২ , ১০ বৈশাখ ১৪২৮ ২১ রমাদ্বান ১৪৪৩

২৩ এপ্রিল ১৯৭১

পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৎপরতা বৃদ্ধি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একাত্তরের ২৩ এপ্রিল বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৎপরতা ব"দ্ধি করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। এদিনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্রিটিশ এমপি ডগলাস ম্যানকে নিয়ে বেনাপোল সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি সফর করেন এবং সেখানে তারা একটি বৈঠকে করেন।

একাত্তরের এদিনে পাকিস্তান সরকার কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের সাবেক ডেপুটি হাই-কমিশন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং একই সময়ে ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাই-কমিশন বন্ধে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

এদিনে যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় শ্রমিক দলীয় সদস্য ও অর্থনৈতিক সাহায্যবিষয়ক কমিটির সাবেক সচিব পিটার শোর এক বিব"তিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকার যে আচরণ করছে তা বন্য হিংস্র মনোভাবকেও হার মানিয়েছে। এই গণহত্যা উপো করা, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক উদ্যোগ এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে। আমি অনুরোধ করছি শ্রমিক দল যেন পার্লামেন্টে বিষয়টি উত্থাপন করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সব সহায়তা বন্ধ করে গণহত্যা বন্ধে সামরিক প্রশাসনের ওপর চাপ স"ষ্টি করে।’

১৯৭১ সালের এদিনে ঠাকুরগাঁওয়ের জাটিভাঙ্গায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তান বাহিনী। পাকিস্তানিদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া, শুখানপুকুরী, জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিংগিয়া, চন্ডীপুর, বাসুদেবপুর, মিলনপুর, গৌরীপুর, খামার ভোপলা, ভোপলা, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার পলাশবাড়ী ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার সংখ্যালঘু পরিবার ভারতে আশ্রয় নিতে সীমান্তে সমবেত হয়। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ওপর হামলা করে। তাদের নদীর পাড়ে নিয়ে সারিবদ্ধ করে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেখানে প্রায় আড়াই হাজারের মতো নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়।

১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর তিনটার দিকে পাকিস্তানি হানাদাররা রাজাকারদের সহযোগিতায় তিনটি সামরিক ট্রাক নিয়ে তাহেরপুর হাটে প্রবেশ করে। এরপর ¯'ানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হাটের অনেক ¯'ানে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এ সময় তারা ২২ জন নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে ‘হিন্দু এবং ভারতের দালাল’ অভিযোগে নির্মমভাবে হত্যা করে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে। গোমস্তাপুর থানার নিকটবর্তী বাজারপাড়া হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের ৩১ পুরুষকে ধরে নিয়ে যায় এবং পুরো গ্রামে তা-ব চালিয়ে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। হিন্দু ব্যক্তিদের থানার পেছন দিকে মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে ১৫ ও ১৬ জনের দুটি সারিতে ভাগ করা হয়। ১৫ জনের প্রথম দলটিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। এরপর অন্য দলটির ১৬ জনকেও একইভাবে গুলি করে হত্যা করে তারা। ব্রাশফায়াারের পরে মরদেহগুলো পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া নির্দেশ দিলে ওই ৩১ জনের মধ্য থেকে অমিল কর্মকার নামে এক ব্যক্তি ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। তখনই তাকেও গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

এদিনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সেনা যশোরের কাগজপুকুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অব¯'ানে আক্রমণ চালায়। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা বেনাপোল কাস্টম কলোনি ও চেকপোস্ট এলাকায় বিকল্প প্রতিরা ব্যব¯'া নেন। এ যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর নায়েক সুবেদার মজিবুল হকসহ ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে হানাদারদের ৫০ জন সেনা নিহত ও বহু সেনা আহত হয়েছিল।

এদিনে রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে পাকিস্তানি হানাদারদের দুইশ’ সেনা যাত্রা করলে ক্যাপ্টেন কাদের ও লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এদিনে ফেনীর পতন হয়। পাকিস্তানি হানাদারেরা ফেনী দখল করলে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অনেক ¯'ানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

পাকিস্তানি হানাদারেরা ’৭১ এর এদিনে তিস্তা ও লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি থেকে প্রবল গুলিবর্ষণ করতে করতে কুড়িগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। হানাদারদের ভারি অস্ত্রের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অব¯'ান ছেড়ে পিছু হটে নিরাপদ ¯'ানে অব¯'ান নেন।

ঢাকায় কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এ.এস.এম. সোলায়মান, নেজামে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানী, সাবেক এমএলএ রহিমুল্লাহ চৌধুরী ও আবদুস সোবহান প"থক প"থক বিব"তিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তেেপর প্রচেষ্টা দেশপ্রেমিক জনগণ ও সশস্ত্র সেনাবাহিনী নস্যাৎ করে দিয়েছে। জনগণ মুক্তিবাহিনী ও ভারতের চরদের প্রশ্রয় দিবে না। আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য গর্বিত। ভারতের চরদের হটাতে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা উচিৎ জনগণের।’

এদিন সিলেটে শান্তি কমিটির উদ্যোগে নেজামে ইসলাম ও শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকাররা শহরে মিছিল করে। এই মিছিলে তারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া খান জিন্দাবাদ এবং ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার, সাবধানসহ নানা সেøাগান দেয়। পরে মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সভায় শান্তি কমিটির নেতারা বলেন, ‘ভারতের চর মুক্তিবাহিনীকে উৎখাত করে পাকিস্তানের অখ-তা বজায় রাখতে হবে।’