৯ বছরে হত্যা মামলায় বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ, পরবর্তী তারিখ ২৯ মে

মামলার ৪১ আসামির দু’জনের মৃত্যু

আজ ২৪ এপ্রিল। দেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। ২০১৩ সালের এই দিনে ঘটেছিল সেই ট্র্যাজেডি। ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহত হয় ১১৩৬ জন শ্রমিক। আহত হন আরও কয়েক হাজার। এ দিনটিতে শ্রমিক সংগঠন আয়োজন করে নানা কর্মসূচি।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত রানা প্লাজায় তিনটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিদিনের মতো ওইদিন সকাল ৮টায় হাজির হন কর্মস্থলে। উৎপাদনও শুরু করেন নির্ধারিত সময়ে। হঠাৎ সাড়ে ৯টার দিকে বিকট শব্দ। আশপাশে উড়তে থাকে ধুলো-বালি। ধসে পড়ে রানা প্লাজা। শুরু হয় আহত শ্রমিকদের আহাজারি। উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। চলে বিরতিহীন উদ্ধার অভিযান।

এদিকে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৯ মে মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেছেন আদালত। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া এই দিন ধার্য করেন। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার। সাভার থানার তৎকালীন এসআই ওয়ালী আশরাফ এই মামলার বাদী। ওই ঘটনায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। ওই মামলায় ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। অভিযোগ গঠনের প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় গত ৩১ জানুয়ারি শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। এই ৪১ জন আসামির মধ্যে দুইজন মারা গেছেন। বর্তমানে আসামির সংখ্য ৩৯ জন। এই ঘটনায় হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে একটি মামলা নিষ্পতি হয়েছে। ইমারত আইনে অন্য একটি মামলায় উচ্চ আদালের আদেশে স্থাগিত রয়েছে বলে ওই মামলার অতিরিক্তি পিপি আনোয়ারুল কবীর বাবুল জানিয়েছেন।

আদালত সূত্র জানায়, রানা প্লাজা ধসের জন্য ছয়জন সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি না পাওয়ায় মামলাটি তিন বছর ঝুলে ছিল। সে সময় জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল, যারা বড় অপরাধ করেননি, তাদের অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি তারা দিতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত সরকারের অনুমোদন না পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিজিএমই-এর কর্মকর্তারা রানা প্লাজা ভবনে আসেন। গার্মেন্টসের মালিকদের পরামর্শ দেন, বুয়েটের ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম যেন বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু পাঁচ গার্মেন্ট মালিক এবং তাদের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে পরদিন ২৪ এপ্রিল শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে। সঙ্গে যোগ দেন রানা প্লাজা ভবনের মালিক খালেক ও সোহেল রানা। সোহেল রানা সেদিন বলেছিলেন, আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না। কিন্তু তারপর ঘটলো সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

যা ছিল ভবনটিতে

রানা প্লাজার প্রথম তলায় ছিল বিভিন্ন দোকান। দ্বিতীয় তলায়ও ছিল দোকান আর ব্যাংক। তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে এবং ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেড, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় ইথারটেক্স লিমিটেড গার্মেন্টস।

হতাহতের সংখ্যা

রানা প্লাজা ধসে ১১৩৬ জন শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে উদ্ধারকর্মীরা। আর ২৪৩৮ শ্রমিককে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আহতদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেকে আবার মানসিক রোগী হয়ে আছেন।

তৈরি হয়েছে শহীদ বেদি

নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৩ সালের ২৪ মে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সামনে নির্মাণ করেন একটি শহীদ বেদি। অস্থায়ী শহীদ বেদিটির নামকরণ করা হয় ‘প্রতিবাদ-প্রতিরোধ’। এ শহীদ বেদিটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন চালিয়ে আসছে নানা আন্দোলনের কর্মসূচি।

বর্তমান রানা প্লাজার চিত্র

অধিকাংশ ধ্বংসস্তূপই সরিয়ে নিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে বংশাই নদীর পাড়ে। এখনও কংক্রিটের সুরকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে রানা প্লাজার ১৮ শতাংশ জমির ওপর। চারপাশটা কাঁটাতার ও টিনের বেড়া দিয়ে রেখেছিল জেলা প্রশাসক। তাও আজ মিশে গেছে। সামনেই বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেছে শহীদ বেদি। প্রায় প্রতিদিনই রানা প্লাজায় আহত, নিহত আর নিখোঁজ স্বজনের আনাগোনা চোখে পড়ত। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নানা দাবিতে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে আন্দোলন করেছে।

সোহেল রানার সব ভূমি সরকারের দখলে

সোহেল রানার মালিকানাধীন রানা প্লাজার ভূমি, রানা টাওয়ারের ভূমি ও ধামরাইয়ের রানা ব্রিকসের ভূমি সরকার দখলে নিয়েছে। আদালতের নির্দেশে রানার মালিকানাধীন সব ভূমি বাজেয়াপ্ত করে ঢাকা জেলা প্রশাসন দখল বুঝে নিয়েছে।

কালের সাক্ষী অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ

বেদনার সাক্ষী হয়ে আছে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ। ঘটনার দিন থেকে টানা ১৭ দিন ওই বিদ্যালয়ের মাঠে নিহতদের নিয়ে রাখা হতো। আর সেখান থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হতো। প্রিয় মানুষটির সন্ধান পেতে সে সময় স্বজনরা দিগি¦দিগ ছুটাছুটি করতেন। রানা প্লাজা থেকে বিদ্যালয়ের মাঠ দেড় কিলোমিটারজুড়ে সে সময় অ্যাম্বুলেন্সের মুহুর্মুহু শব্দ সবাইকে জাগিয়ে তুলতো। আর অপেক্ষারত স্বজনরা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। এই বুঝি এলো নিখোঁজ মানুষটি। আজও সেই মাঠটি আছে, তবে নেই সেই চিত্র। তবে মাঠটি যেন আগের মতো আর হাসে না। প্রাণচঞ্চলতা যেন হারিয়ে ফেলেছে।

অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ফরিদ জানান, আগে সকাল-দুপুর-রাত এমন কোন সময় নেই যে মাঠে না আসতাম, কোন ভয় ছিল না। তবে রানা প্লাজার ধসে পড়ার পর মৃত লাশগুলো সারি সারি করে রাখা হয়েছিল। এরপর থেকে আর সাহস পাই না।

শ্রমিক নেতাদের দাবি

রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রায় শ্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই নড়েচড়ে বসে। শ্রমিকদের কর্ম-পরিবেশ নিরাপদ রাখতে আন্দোলন শুরু করে। নিহত ও আহতদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিও করেন তারা। ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করার জোর দাবি তোলেন তারা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের আশুলিয়া থানার সভাপতি মো. ইব্রাহিম বলেন, রানা প্লাজার এখনও অনেক শ্রমিক রয়েছে যারা ক্ষতিপূরণ পায়নি। দ্রুত ওইসব শ্রমিকদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। এছাড়া সরকার সোহেল রানার যেসব সম্পত্তি জব্দ করেছে সেসব সম্পতি নিহত ও আহত পরিবারের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার দাবি জানান তিনি।

এমনটি নাও হতে পারত

এ ঘটনার জন্য সে সময় স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতিকেই দায়ী করছিলেন স্থানীয় সুশীল সমাজ ও আহত শ্রমিকরা। তাদের দাবি ছিল, ভবনটি ধসের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগেই ফাটল দেখা দিয়েছিল চার ও পাঁচ তলার কয়েকটি পিলারে। যা দেখে শ্রমিকরা কর্মস্থল থেকে নেমে আসেন মহাসড়কে। এমন সংবাদের পর সেখানে ছুটে যান স্থানীয় সংবাদকর্মীরা। তবে সংবাদকর্মীদের ওই স্থানে প্রবেশ করতে দেয়নি মালিক কর্তৃপক্ষ। এ সময় সংবাদকর্মীরা যোগাযোগ করেন স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সংবাদ প্রচার হয় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়।

পরে ওইদিন বিকেলেই ভবনের ফাটল দেখতে আসেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদার। তিনি এসে ভবনটির কয়েকজন ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করে বলেন, এ ফাটলে তেমন কোন সমস্যা নেই, বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই। সামান্য প্লাস্টার উঠে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এই বলে তিনি চলে যান। তার এ বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই এ ভবনটিতেই ঘটলো দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভবন ধসের ঘটনা। নিভে গেলো হাজার প্রাণের জীবনপ্রদীপ। সে সময় পদক্ষেপ নিলে এমন হতাহত নাও হতে পারত। অবশ্য এ ঘটনায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদারকে সরিয়ে দেয়া হয়।

রবিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২২ , ১১ বৈশাখ ১৪২৮ ২২ রমাদ্বান ১৪৪৩

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

৯ বছরে হত্যা মামলায় বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ, পরবর্তী তারিখ ২৯ মে

মামলার ৪১ আসামির দু’জনের মৃত্যু

মাসুদ রানা ও মাহবুবুল হক

আজ ২৪ এপ্রিল। দেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। ২০১৩ সালের এই দিনে ঘটেছিল সেই ট্র্যাজেডি। ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহত হয় ১১৩৬ জন শ্রমিক। আহত হন আরও কয়েক হাজার। এ দিনটিতে শ্রমিক সংগঠন আয়োজন করে নানা কর্মসূচি।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত রানা প্লাজায় তিনটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিদিনের মতো ওইদিন সকাল ৮টায় হাজির হন কর্মস্থলে। উৎপাদনও শুরু করেন নির্ধারিত সময়ে। হঠাৎ সাড়ে ৯টার দিকে বিকট শব্দ। আশপাশে উড়তে থাকে ধুলো-বালি। ধসে পড়ে রানা প্লাজা। শুরু হয় আহত শ্রমিকদের আহাজারি। উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। চলে বিরতিহীন উদ্ধার অভিযান।

এদিকে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৯ মে মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেছেন আদালত। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া এই দিন ধার্য করেন। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার। সাভার থানার তৎকালীন এসআই ওয়ালী আশরাফ এই মামলার বাদী। ওই ঘটনায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। ওই মামলায় ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। অভিযোগ গঠনের প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় গত ৩১ জানুয়ারি শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। এই ৪১ জন আসামির মধ্যে দুইজন মারা গেছেন। বর্তমানে আসামির সংখ্য ৩৯ জন। এই ঘটনায় হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে একটি মামলা নিষ্পতি হয়েছে। ইমারত আইনে অন্য একটি মামলায় উচ্চ আদালের আদেশে স্থাগিত রয়েছে বলে ওই মামলার অতিরিক্তি পিপি আনোয়ারুল কবীর বাবুল জানিয়েছেন।

আদালত সূত্র জানায়, রানা প্লাজা ধসের জন্য ছয়জন সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি না পাওয়ায় মামলাটি তিন বছর ঝুলে ছিল। সে সময় জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল, যারা বড় অপরাধ করেননি, তাদের অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি তারা দিতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত সরকারের অনুমোদন না পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিজিএমই-এর কর্মকর্তারা রানা প্লাজা ভবনে আসেন। গার্মেন্টসের মালিকদের পরামর্শ দেন, বুয়েটের ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম যেন বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু পাঁচ গার্মেন্ট মালিক এবং তাদের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে পরদিন ২৪ এপ্রিল শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে। সঙ্গে যোগ দেন রানা প্লাজা ভবনের মালিক খালেক ও সোহেল রানা। সোহেল রানা সেদিন বলেছিলেন, আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না। কিন্তু তারপর ঘটলো সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

যা ছিল ভবনটিতে

রানা প্লাজার প্রথম তলায় ছিল বিভিন্ন দোকান। দ্বিতীয় তলায়ও ছিল দোকান আর ব্যাংক। তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে এবং ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেড, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় ইথারটেক্স লিমিটেড গার্মেন্টস।

হতাহতের সংখ্যা

রানা প্লাজা ধসে ১১৩৬ জন শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে উদ্ধারকর্মীরা। আর ২৪৩৮ শ্রমিককে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আহতদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেকে আবার মানসিক রোগী হয়ে আছেন।

তৈরি হয়েছে শহীদ বেদি

নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৩ সালের ২৪ মে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সামনে নির্মাণ করেন একটি শহীদ বেদি। অস্থায়ী শহীদ বেদিটির নামকরণ করা হয় ‘প্রতিবাদ-প্রতিরোধ’। এ শহীদ বেদিটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন চালিয়ে আসছে নানা আন্দোলনের কর্মসূচি।

বর্তমান রানা প্লাজার চিত্র

অধিকাংশ ধ্বংসস্তূপই সরিয়ে নিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে বংশাই নদীর পাড়ে। এখনও কংক্রিটের সুরকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে রানা প্লাজার ১৮ শতাংশ জমির ওপর। চারপাশটা কাঁটাতার ও টিনের বেড়া দিয়ে রেখেছিল জেলা প্রশাসক। তাও আজ মিশে গেছে। সামনেই বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেছে শহীদ বেদি। প্রায় প্রতিদিনই রানা প্লাজায় আহত, নিহত আর নিখোঁজ স্বজনের আনাগোনা চোখে পড়ত। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নানা দাবিতে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে আন্দোলন করেছে।

সোহেল রানার সব ভূমি সরকারের দখলে

সোহেল রানার মালিকানাধীন রানা প্লাজার ভূমি, রানা টাওয়ারের ভূমি ও ধামরাইয়ের রানা ব্রিকসের ভূমি সরকার দখলে নিয়েছে। আদালতের নির্দেশে রানার মালিকানাধীন সব ভূমি বাজেয়াপ্ত করে ঢাকা জেলা প্রশাসন দখল বুঝে নিয়েছে।

কালের সাক্ষী অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ

বেদনার সাক্ষী হয়ে আছে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ। ঘটনার দিন থেকে টানা ১৭ দিন ওই বিদ্যালয়ের মাঠে নিহতদের নিয়ে রাখা হতো। আর সেখান থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হতো। প্রিয় মানুষটির সন্ধান পেতে সে সময় স্বজনরা দিগি¦দিগ ছুটাছুটি করতেন। রানা প্লাজা থেকে বিদ্যালয়ের মাঠ দেড় কিলোমিটারজুড়ে সে সময় অ্যাম্বুলেন্সের মুহুর্মুহু শব্দ সবাইকে জাগিয়ে তুলতো। আর অপেক্ষারত স্বজনরা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। এই বুঝি এলো নিখোঁজ মানুষটি। আজও সেই মাঠটি আছে, তবে নেই সেই চিত্র। তবে মাঠটি যেন আগের মতো আর হাসে না। প্রাণচঞ্চলতা যেন হারিয়ে ফেলেছে।

অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ফরিদ জানান, আগে সকাল-দুপুর-রাত এমন কোন সময় নেই যে মাঠে না আসতাম, কোন ভয় ছিল না। তবে রানা প্লাজার ধসে পড়ার পর মৃত লাশগুলো সারি সারি করে রাখা হয়েছিল। এরপর থেকে আর সাহস পাই না।

শ্রমিক নেতাদের দাবি

রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রায় শ্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই নড়েচড়ে বসে। শ্রমিকদের কর্ম-পরিবেশ নিরাপদ রাখতে আন্দোলন শুরু করে। নিহত ও আহতদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিও করেন তারা। ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করার জোর দাবি তোলেন তারা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের আশুলিয়া থানার সভাপতি মো. ইব্রাহিম বলেন, রানা প্লাজার এখনও অনেক শ্রমিক রয়েছে যারা ক্ষতিপূরণ পায়নি। দ্রুত ওইসব শ্রমিকদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। এছাড়া সরকার সোহেল রানার যেসব সম্পত্তি জব্দ করেছে সেসব সম্পতি নিহত ও আহত পরিবারের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার দাবি জানান তিনি।

এমনটি নাও হতে পারত

এ ঘটনার জন্য সে সময় স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতিকেই দায়ী করছিলেন স্থানীয় সুশীল সমাজ ও আহত শ্রমিকরা। তাদের দাবি ছিল, ভবনটি ধসের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগেই ফাটল দেখা দিয়েছিল চার ও পাঁচ তলার কয়েকটি পিলারে। যা দেখে শ্রমিকরা কর্মস্থল থেকে নেমে আসেন মহাসড়কে। এমন সংবাদের পর সেখানে ছুটে যান স্থানীয় সংবাদকর্মীরা। তবে সংবাদকর্মীদের ওই স্থানে প্রবেশ করতে দেয়নি মালিক কর্তৃপক্ষ। এ সময় সংবাদকর্মীরা যোগাযোগ করেন স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সংবাদ প্রচার হয় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়।

পরে ওইদিন বিকেলেই ভবনের ফাটল দেখতে আসেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদার। তিনি এসে ভবনটির কয়েকজন ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করে বলেন, এ ফাটলে তেমন কোন সমস্যা নেই, বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই। সামান্য প্লাস্টার উঠে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এই বলে তিনি চলে যান। তার এ বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই এ ভবনটিতেই ঘটলো দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভবন ধসের ঘটনা। নিভে গেলো হাজার প্রাণের জীবনপ্রদীপ। সে সময় পদক্ষেপ নিলে এমন হতাহত নাও হতে পারত। অবশ্য এ ঘটনায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদারকে সরিয়ে দেয়া হয়।