স্ত্রীর ওপর জেদ করে প্রতিবন্ধী শ্যালককে অপহরণ, মুক্তিপণ চেয়ে ফোন

১২ বছর বয়সী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু সজীব বাবু। দাম্পত্য কলহের কারণে বোন আলাদা থাকলেও বোনের শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাবুর। গত বছরের ২৩ মে দুপুরেও বোনের শ্বশুরবাড়িতে যায় সে। তারপর আর বাড়ি ফেরেনি। থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও মেলেনি বাবুর সন্ধান। নিখোঁজ বাবুর পরিবারের অভিযোগ, বোনের ওপর জেদ করে বাবুকে অপহরণ করেছে দুলাভাই পাপ্পু শেখ। অপহরণের টাকা চেয়ে একাধিকবার বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোনও করেছে সে।

অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত উভয় পরিবারের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ২০১৯ সালের ২০ জুন পারিবারিকভাবে পাপ্পু শেখের সঙ্গে বিয়ে হয় সাথী আক্তারের। বিয়ের এক বছরের মাথায় এক ছেলের জন্ম হয়। তারপরই দাম্পত্য কলহের কারণে দুইজন পৃথক থাকা শুরু করেন। বর্তমানে পোশাক কারখানার শ্রমিক সাথী আক্তার থাকেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের নামাপাড়া এলাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাড়া বাড়িতে। আর পাপ্পু শেখ ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদনগর এলাকার এক নম্বর গলিতে তার পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তিনি পেশায় একজন ময়দার মিলের শ্রমিক।

সাথী আক্তারের অভিযোগ, বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাত। প্রায় সময় এই কারণে তিনি বাবার বাড়িতে এসে থাকতেন। বাচ্চা হওয়ার পর তিনি আর শ্বশুরবাড়ি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছোট ভাই সজীব প্রায় সময়ই ওই বাড়িতে যেত। এতে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিরক্তও হতো। গত বছরের ২৩ মে দুপুরেও পাপ্পুদের বাড়িতে গিয়েছিল সজীব। তারপর থেকেই নিখোঁজ প্রতিবন্ধী এই শিশু।

প্রায় এক বছর যাবত একমাত্র ছেলের কোনো সন্ধান না পেয়ে দিশেহারা আবুল কালাম ও হালিমা বেগম দম্পতি। হালিমা ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বিয়ার পর থেইকাই পাপ্পু টাকা চাইতো। আমরা গরিব, অসহায় মানুষ। নিজেগো সংসারই চলে না, জামাইরে টাকা দিমু কই থেইকা! এই নিয়া মাইয়ারে মারতো। মাইয়ায় সংসার ছাইড়া চইলা আইলো। মাইয়ার ওপর জিদ কইরা জামাই এই কামডা করছে। তিন মেয়ের পর আমার একটাই ছেলে। থানা, পুলিশ, উকিল, কতকিছু ধরলাম। কেউ পাত্তা দিলো না।’ বলেই কাঁদতে থাকেন হালিমা।

ছেলের খোঁজ পেতে গত বছরের ২৯ মে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর- ১০৬৪) করেছিলেন বলে জানান আবুল কালাম। আইসক্রিম কারখানার এই শ্রমিক সংবাদকে বলেন, ‘এই দুনিয়ায় টাকা না থাকলে কিছু হয় না। জিডি কইরাও পোলার কোন খোঁজ যখন পাই নাই তখন গেছিলাম মামলা করতে। পুলিশ তখন অভিযোগ একটা লেখাইয়া পরে আর মামলা নেয় নাই। অভিযোগের একটা কাগজ দিয়াও সেইটা নিয়া গেছিলো গা।’

নিখোঁজ সজীবের বোন সাথী সংবাদকে বলেন, সজীব নিখোঁজ হওয়ার দুই মাসের মাথায় ১১ জুলাই একটি নম্বর থেকে কল করে সজীবের মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। পরপর দুইদিন আরও পৃথক দুটি নম্বর থেকে কল করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সর্বশেষ ডিসেম্বরে পৃথক আরেকটি নম্বর থেকে ২ লাখ টাকা দাবি করেন। মুঠোফোনের ওই প্রান্তে মুক্তিপণ দাবি করা যুবকের কণ্ঠ তার স্বামী পাপ্পু শেখ বলে সন্দেহ করেন সাথী। পরে এ নিয়ে যাচাই করতে শ্বশুরবাড়িতে যান তিনি। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অসংলগ্ন কথাবার্তা সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়।

সাথী আরও বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কথাবার্তায় সন্দেহ হলে অপহরণ মামলা দিতে চাইলেও পুলিশ তা নেয় নাই। উকিল ধরছিলাম, উকিলও খালি ঘুরাইছে। অপহরণ মামলা করতে চাইছি কিন্তু করাইছে যৌতুকের মামলা। আমরা কিছু চাই না, ছোট ভাইডারে খুঁইজা পাইতে চাই।’

এদিকে মুক্তিপণ চেয়ে কল করা পৃথক চারটি মুঠোফোনের নম্বরের তিনটির সংযোগ পাওয়া যায়নি। একটি নম্বরের গ্রাহক জানান, তিনি রাজধানী ঢাকায় একটি কারখানায় কাজ করেন। তার মুঠোফোনের নম্বর থেকে কারও মুক্তিপণ চাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন।

এ বিষয়ে কথা বলতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদনগর এলাকার এক নম্বর গলিতে অভিযুক্ত পাপ্পু শেখের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের লোকজন জানিয়েছে, স্ত্রীর মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে পাপ্পু। পাপ্পু শেখের মা রেনু বেগম অপহরণের অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে সংবাদকে বলেন, ‘সজীব আমাদের বাড়িতে এসেছিল এই কথা সত্য। দুপুরে তারে শহীদনগর ব্রিজের দিকে দিয়ে আসি এবং বাসায় যেতে বলি। এরপর থেকে আর কিছু জানি না। আমরা ওরে কিডন্যাপ করমু কেন? প্রতিবন্ধী একটা বাচ্চা।’

এদিকে নিখোঁজ সজীবের সন্ধানে সদর মডেল থানায় যে সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন সেটি তদন্ত করেছিলেন থানার তৎকালীন এসআই হর বিলাস ম-ল। বর্তমানে তিনি আছেন জেলা গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি)। মুঠোফোনে হর বিলাস ম-ল বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ওই শিশুর সন্ধান তিনি পাননি। তবে অপহরণের অভিযোগের বিষয়টি তিনি জানেন না। তিনি জিডির সূত্র ধরেই তদন্ত চালিয়েছিলেন।

রবিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২২ , ১১ বৈশাখ ১৪২৮ ২২ রমাদ্বান ১৪৪৩

স্ত্রীর ওপর জেদ করে প্রতিবন্ধী শ্যালককে অপহরণ, মুক্তিপণ চেয়ে ফোন

প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ

১২ বছর বয়সী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু সজীব বাবু। দাম্পত্য কলহের কারণে বোন আলাদা থাকলেও বোনের শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাবুর। গত বছরের ২৩ মে দুপুরেও বোনের শ্বশুরবাড়িতে যায় সে। তারপর আর বাড়ি ফেরেনি। থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও মেলেনি বাবুর সন্ধান। নিখোঁজ বাবুর পরিবারের অভিযোগ, বোনের ওপর জেদ করে বাবুকে অপহরণ করেছে দুলাভাই পাপ্পু শেখ। অপহরণের টাকা চেয়ে একাধিকবার বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোনও করেছে সে।

অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত উভয় পরিবারের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ২০১৯ সালের ২০ জুন পারিবারিকভাবে পাপ্পু শেখের সঙ্গে বিয়ে হয় সাথী আক্তারের। বিয়ের এক বছরের মাথায় এক ছেলের জন্ম হয়। তারপরই দাম্পত্য কলহের কারণে দুইজন পৃথক থাকা শুরু করেন। বর্তমানে পোশাক কারখানার শ্রমিক সাথী আক্তার থাকেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের নামাপাড়া এলাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাড়া বাড়িতে। আর পাপ্পু শেখ ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদনগর এলাকার এক নম্বর গলিতে তার পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তিনি পেশায় একজন ময়দার মিলের শ্রমিক।

সাথী আক্তারের অভিযোগ, বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাত। প্রায় সময় এই কারণে তিনি বাবার বাড়িতে এসে থাকতেন। বাচ্চা হওয়ার পর তিনি আর শ্বশুরবাড়ি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছোট ভাই সজীব প্রায় সময়ই ওই বাড়িতে যেত। এতে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিরক্তও হতো। গত বছরের ২৩ মে দুপুরেও পাপ্পুদের বাড়িতে গিয়েছিল সজীব। তারপর থেকেই নিখোঁজ প্রতিবন্ধী এই শিশু।

প্রায় এক বছর যাবত একমাত্র ছেলের কোনো সন্ধান না পেয়ে দিশেহারা আবুল কালাম ও হালিমা বেগম দম্পতি। হালিমা ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বিয়ার পর থেইকাই পাপ্পু টাকা চাইতো। আমরা গরিব, অসহায় মানুষ। নিজেগো সংসারই চলে না, জামাইরে টাকা দিমু কই থেইকা! এই নিয়া মাইয়ারে মারতো। মাইয়ায় সংসার ছাইড়া চইলা আইলো। মাইয়ার ওপর জিদ কইরা জামাই এই কামডা করছে। তিন মেয়ের পর আমার একটাই ছেলে। থানা, পুলিশ, উকিল, কতকিছু ধরলাম। কেউ পাত্তা দিলো না।’ বলেই কাঁদতে থাকেন হালিমা।

ছেলের খোঁজ পেতে গত বছরের ২৯ মে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর- ১০৬৪) করেছিলেন বলে জানান আবুল কালাম। আইসক্রিম কারখানার এই শ্রমিক সংবাদকে বলেন, ‘এই দুনিয়ায় টাকা না থাকলে কিছু হয় না। জিডি কইরাও পোলার কোন খোঁজ যখন পাই নাই তখন গেছিলাম মামলা করতে। পুলিশ তখন অভিযোগ একটা লেখাইয়া পরে আর মামলা নেয় নাই। অভিযোগের একটা কাগজ দিয়াও সেইটা নিয়া গেছিলো গা।’

নিখোঁজ সজীবের বোন সাথী সংবাদকে বলেন, সজীব নিখোঁজ হওয়ার দুই মাসের মাথায় ১১ জুলাই একটি নম্বর থেকে কল করে সজীবের মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। পরপর দুইদিন আরও পৃথক দুটি নম্বর থেকে কল করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সর্বশেষ ডিসেম্বরে পৃথক আরেকটি নম্বর থেকে ২ লাখ টাকা দাবি করেন। মুঠোফোনের ওই প্রান্তে মুক্তিপণ দাবি করা যুবকের কণ্ঠ তার স্বামী পাপ্পু শেখ বলে সন্দেহ করেন সাথী। পরে এ নিয়ে যাচাই করতে শ্বশুরবাড়িতে যান তিনি। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অসংলগ্ন কথাবার্তা সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়।

সাথী আরও বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কথাবার্তায় সন্দেহ হলে অপহরণ মামলা দিতে চাইলেও পুলিশ তা নেয় নাই। উকিল ধরছিলাম, উকিলও খালি ঘুরাইছে। অপহরণ মামলা করতে চাইছি কিন্তু করাইছে যৌতুকের মামলা। আমরা কিছু চাই না, ছোট ভাইডারে খুঁইজা পাইতে চাই।’

এদিকে মুক্তিপণ চেয়ে কল করা পৃথক চারটি মুঠোফোনের নম্বরের তিনটির সংযোগ পাওয়া যায়নি। একটি নম্বরের গ্রাহক জানান, তিনি রাজধানী ঢাকায় একটি কারখানায় কাজ করেন। তার মুঠোফোনের নম্বর থেকে কারও মুক্তিপণ চাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন।

এ বিষয়ে কথা বলতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদনগর এলাকার এক নম্বর গলিতে অভিযুক্ত পাপ্পু শেখের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের লোকজন জানিয়েছে, স্ত্রীর মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে পাপ্পু। পাপ্পু শেখের মা রেনু বেগম অপহরণের অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে সংবাদকে বলেন, ‘সজীব আমাদের বাড়িতে এসেছিল এই কথা সত্য। দুপুরে তারে শহীদনগর ব্রিজের দিকে দিয়ে আসি এবং বাসায় যেতে বলি। এরপর থেকে আর কিছু জানি না। আমরা ওরে কিডন্যাপ করমু কেন? প্রতিবন্ধী একটা বাচ্চা।’

এদিকে নিখোঁজ সজীবের সন্ধানে সদর মডেল থানায় যে সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন সেটি তদন্ত করেছিলেন থানার তৎকালীন এসআই হর বিলাস ম-ল। বর্তমানে তিনি আছেন জেলা গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি)। মুঠোফোনে হর বিলাস ম-ল বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ওই শিশুর সন্ধান তিনি পাননি। তবে অপহরণের অভিযোগের বিষয়টি তিনি জানেন না। তিনি জিডির সূত্র ধরেই তদন্ত চালিয়েছিলেন।