শিক্ষকদের নিরাপত্তা দেবে কে

মাছুম বিল্লাহ

দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকরা কমিটির সদস্যদের হাতে, কিংবা রাজনৈতিক কোন নেতার হাতে, তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে, অভিভাবকের হাতে এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন। এটি কেমন বিষয়? একজন শিক্ষক তা সে যে কোন পর্যায়েরই হোক, যে কোন বিষয়েরই হোক তিনি শিক্ষকই। তার গায়ে মানুষ কীভাবে হাত তোলে? আর সমাজ ও রাষ্ট্র সেটিকে নিয়ে কেন রাজনীতি করে, কালক্ষেপণ করে? সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, কি হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের? কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সভ্যতাকে, জাতিকে টিকিয়ে রাখবে যেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের পদে পদে অপদস্থ হতে হতে হচ্ছে সমাজের বখাটেদের কাছে? ১৩ এপ্রিল গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় জোহরের নামাজ শেষে কলেজ মসজিদ থেকে বের হয়ে কয়েকজন যুবককে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে বেপরোয়াভাবে মোটরবাইক চালানোরত অবস্থায় দেখতে পান। ফলে স্বীয় দায়িত্ববোধ থেকেই অধ্যক্ষ মহোদয় যুবকদের থামিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে এভাবে বাইক চালাতে নিষেধ করেন। এতেই যুবকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। এরা কাদের সন্তান? বুঝতে কষ্ট হয় না। এরা জানে যে, এদের কিছু হবে না। এরা এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটিয়েছে। একজন শিক্ষক তো শুধু ক্যাম্পাসের নয়, সমাজের নেতা, সমাজের অভিভাবক। তিনি সমাজে যে কোন ধরনের অঘটন ঘটতে দেখলে বাঁধা দিবেন, এটিই তার ধর্ম, এটিই তার কর্ম, এজন্যই তিনি শিক্ষক। কিন্তু কি হয়েছে সমাজে?

৩০ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে বহিঃপরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আগত অন্য কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধানের সম্মানে বিভাগের পক্ষ থেকে ছোট পরিসরে খাবারের আয়োজন করা হয়। ওই খাবার অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায়, একটি ছাত্রসংগঠনের কলেজ শাখার সভাপতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে ২০-২৫ জন কর্মীসহ বাংলা বিভাগে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকের সঙ্গে বাগ্বিত-ায় লিপ্ত হয় এবং একপর্যায়ে বাংলা বিভাগের একজন প্রভাষককে লাথি ও কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। পুলিশ মামলা নেয়নি। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেয়ার অপরাধে হেনস্তা করা হয়েছে বহু শিক্ষককে। এসব ঘটনায় ছুরিকাঘাতও করেছে শিক্ষকদের। এসব ক্ষেত্রে মামলাও করা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে হার মেনেছে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণে বিষয়টি। এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ইতোমধ্যেই শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মান ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরে গেছে।

হৃদয় ম-ল নামে আর একজন শিক্ষক ১৯ দিন কারাগারে থাকার পর ১০ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল, স্পর্শকাতর বিষয় যাতে সবাইকে দ্রুত ক্ষেপানো যায়। তিনি আসলে কি করেছিলেন সেটি ভাবার আগেই যেহেতু ধর্ম নিয়ে কথা তাই সবাই ক্ষেপে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেছে। তার ওরপর আক্রমণ মানে গোটা শিক্ষক সমাজের ওপর আক্রমণ। একজন শিক্ষক যে মতাদর্শেরই হোক না কেন, যে কোন ধর্মেরই হোক না কেন তিনি কখনই অন্য ধর্মের অবমাননা করবেন না। ঘটনা ঘটার পরপরই আমরা বুঝতে পেরেিেছ কিন্তু যারা পানি ঘোলাটে করে মাছ শিকার করতে চায় সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তাদের কথা চিন্তা করে না, ব্যবস্থা নেয় না, লাগামহীনভাবে ঘটনাগুলোর ঘটতে দেয়।

হৃদয় ম-ল তার ওপর আক্রমণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘কতজন মানুষ সেখানে হামলা করেছিল, সেটা আমি দেখিনি, রুমের ভেতরে ছিলাম। তাদের চিৎকারের শব্দ শুনছিলাম। পরবর্তী সময়ে পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়। পুলিশ যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেখানে থেকে বের করেছে, সেটা না করলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। রুম থেকে বের হয়ে দেখতে পাই বড় বড় লাঠি নিয়েও অনেকে সেখানে ছিল। পুলিশ আমাকে গাড়িতে তুলে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখনো মানুষ আমার মারার চেষ্টা করছিল, ইট ছুড়ছিল। অনেক গাড়িতে ওঠারও চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। তারা প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত আমকে তাড়া করে।’

এখানে পুলিশ একটি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পুলিশ তো সর্বত্র ও সব সময় শিক্ষকদের এভাবে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকেই কাজটি করতে হবে। কারাগারের ছোট ফটক দিয়ে যখন হৃদয় ম-ল বের হলেন তার মাথা নিচু করে, সেটি কিন্তু গোটা শিক্ষক সমাজেরই মাথা নিচু হওয়ার ইঙ্গিত বা প্রতীক। এটি কোন সমাজে হতে দেয়া ঠিক নয়।

একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে যতটুকু জানা যায়, তা হচ্ছে, স্কুলের টেস্ট পরীক্ষায় জোর করে নম্বর বাড়িয়ে না দেয়া, প্রাইভেট টিউশন নিয়ে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে বিরোধ, প্রাইভেট টিউশনের অন্য শিক্ষকেরা স্কুলে পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নানা অনৈতিক সুবিধা দেন, যা হৃদয় ম-ল করেন না। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিককালে এলাকায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা তৈরি এর পেছনে কাজ করেছে। মূলত স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনীতি, ধর্মীয় প্রভাব, বিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে ঘুরেফিরে একটি চক্র জড়িত। কিছু শিক্ষক, কর্মচারী, ম্যানেজিং কমিটির কিছু সদস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালী এর সঙ্গে জড়িত। তারাই ইন্ধন জুগিয়েছে এ ঘটনায়। কয় দিন আগে ফেসবুকে দেখলাম একজন মাদ্রাসা শিক্ষককে হাতির মতো এক ব্যক্তি উন্মুক্ত মাঠে সবার সামনে বেদম প্রহার করছে। এ কি সমাজ? সবাই আবার সেটি দেখছে? কেউ কিছু বলছে না, শুধু একজন দুর্বলভাবে ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু দৈত্যের মতো মানুষটিকে ফেরাতে পারছেন না। বুঝলাম এলকার মাস্তান কিংবা তথাকথিত লিডার হবেন, তা না হলে এত মানুষের সামনে কজন মানুষকে এভাবে অন্য কেউ হেনস্তা করবে না।

আমাদের সংসদে অনেক কিছুই আলোচনা হয়। অনুরোধ করব একটি আইন যাতে পাস করা হয় যে, কোন ধরনের শিক্ষকের গাঁয়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। কেউ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ধরনের আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। যদি কেউ করার চেষ্টাও করে সেটি হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল, মানবতা ভূলুণ্ঠিত করার সামিল। সর্বাগ্রে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সমাজে যে পচন ধরেছে এ সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। এখান থেকেই শুরু হোক। এটি নিয়ে কোন ধরনের রাজনীতি যাতে কেউ না করে সেজন্য সবাইকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]

সোমবার, ২৫ এপ্রিল ২০২২ , ১২ বৈশাখ ১৪২৮ ২৩ রমাদ্বান ১৪৪৩

শিক্ষকদের নিরাপত্তা দেবে কে

মাছুম বিল্লাহ

দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকরা কমিটির সদস্যদের হাতে, কিংবা রাজনৈতিক কোন নেতার হাতে, তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে, অভিভাবকের হাতে এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন। এটি কেমন বিষয়? একজন শিক্ষক তা সে যে কোন পর্যায়েরই হোক, যে কোন বিষয়েরই হোক তিনি শিক্ষকই। তার গায়ে মানুষ কীভাবে হাত তোলে? আর সমাজ ও রাষ্ট্র সেটিকে নিয়ে কেন রাজনীতি করে, কালক্ষেপণ করে? সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, কি হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের? কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সভ্যতাকে, জাতিকে টিকিয়ে রাখবে যেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের পদে পদে অপদস্থ হতে হতে হচ্ছে সমাজের বখাটেদের কাছে? ১৩ এপ্রিল গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় জোহরের নামাজ শেষে কলেজ মসজিদ থেকে বের হয়ে কয়েকজন যুবককে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে বেপরোয়াভাবে মোটরবাইক চালানোরত অবস্থায় দেখতে পান। ফলে স্বীয় দায়িত্ববোধ থেকেই অধ্যক্ষ মহোদয় যুবকদের থামিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে এভাবে বাইক চালাতে নিষেধ করেন। এতেই যুবকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। এরা কাদের সন্তান? বুঝতে কষ্ট হয় না। এরা জানে যে, এদের কিছু হবে না। এরা এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটিয়েছে। একজন শিক্ষক তো শুধু ক্যাম্পাসের নয়, সমাজের নেতা, সমাজের অভিভাবক। তিনি সমাজে যে কোন ধরনের অঘটন ঘটতে দেখলে বাঁধা দিবেন, এটিই তার ধর্ম, এটিই তার কর্ম, এজন্যই তিনি শিক্ষক। কিন্তু কি হয়েছে সমাজে?

৩০ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে বহিঃপরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আগত অন্য কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধানের সম্মানে বিভাগের পক্ষ থেকে ছোট পরিসরে খাবারের আয়োজন করা হয়। ওই খাবার অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায়, একটি ছাত্রসংগঠনের কলেজ শাখার সভাপতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে ২০-২৫ জন কর্মীসহ বাংলা বিভাগে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকের সঙ্গে বাগ্বিত-ায় লিপ্ত হয় এবং একপর্যায়ে বাংলা বিভাগের একজন প্রভাষককে লাথি ও কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। পুলিশ মামলা নেয়নি। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেয়ার অপরাধে হেনস্তা করা হয়েছে বহু শিক্ষককে। এসব ঘটনায় ছুরিকাঘাতও করেছে শিক্ষকদের। এসব ক্ষেত্রে মামলাও করা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে হার মেনেছে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণে বিষয়টি। এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ইতোমধ্যেই শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মান ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরে গেছে।

হৃদয় ম-ল নামে আর একজন শিক্ষক ১৯ দিন কারাগারে থাকার পর ১০ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল, স্পর্শকাতর বিষয় যাতে সবাইকে দ্রুত ক্ষেপানো যায়। তিনি আসলে কি করেছিলেন সেটি ভাবার আগেই যেহেতু ধর্ম নিয়ে কথা তাই সবাই ক্ষেপে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেছে। তার ওরপর আক্রমণ মানে গোটা শিক্ষক সমাজের ওপর আক্রমণ। একজন শিক্ষক যে মতাদর্শেরই হোক না কেন, যে কোন ধর্মেরই হোক না কেন তিনি কখনই অন্য ধর্মের অবমাননা করবেন না। ঘটনা ঘটার পরপরই আমরা বুঝতে পেরেিেছ কিন্তু যারা পানি ঘোলাটে করে মাছ শিকার করতে চায় সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তাদের কথা চিন্তা করে না, ব্যবস্থা নেয় না, লাগামহীনভাবে ঘটনাগুলোর ঘটতে দেয়।

হৃদয় ম-ল তার ওপর আক্রমণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘কতজন মানুষ সেখানে হামলা করেছিল, সেটা আমি দেখিনি, রুমের ভেতরে ছিলাম। তাদের চিৎকারের শব্দ শুনছিলাম। পরবর্তী সময়ে পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়। পুলিশ যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেখানে থেকে বের করেছে, সেটা না করলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। রুম থেকে বের হয়ে দেখতে পাই বড় বড় লাঠি নিয়েও অনেকে সেখানে ছিল। পুলিশ আমাকে গাড়িতে তুলে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখনো মানুষ আমার মারার চেষ্টা করছিল, ইট ছুড়ছিল। অনেক গাড়িতে ওঠারও চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। তারা প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত আমকে তাড়া করে।’

এখানে পুলিশ একটি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পুলিশ তো সর্বত্র ও সব সময় শিক্ষকদের এভাবে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকেই কাজটি করতে হবে। কারাগারের ছোট ফটক দিয়ে যখন হৃদয় ম-ল বের হলেন তার মাথা নিচু করে, সেটি কিন্তু গোটা শিক্ষক সমাজেরই মাথা নিচু হওয়ার ইঙ্গিত বা প্রতীক। এটি কোন সমাজে হতে দেয়া ঠিক নয়।

একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে যতটুকু জানা যায়, তা হচ্ছে, স্কুলের টেস্ট পরীক্ষায় জোর করে নম্বর বাড়িয়ে না দেয়া, প্রাইভেট টিউশন নিয়ে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে বিরোধ, প্রাইভেট টিউশনের অন্য শিক্ষকেরা স্কুলে পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নানা অনৈতিক সুবিধা দেন, যা হৃদয় ম-ল করেন না। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিককালে এলাকায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা তৈরি এর পেছনে কাজ করেছে। মূলত স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনীতি, ধর্মীয় প্রভাব, বিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে ঘুরেফিরে একটি চক্র জড়িত। কিছু শিক্ষক, কর্মচারী, ম্যানেজিং কমিটির কিছু সদস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালী এর সঙ্গে জড়িত। তারাই ইন্ধন জুগিয়েছে এ ঘটনায়। কয় দিন আগে ফেসবুকে দেখলাম একজন মাদ্রাসা শিক্ষককে হাতির মতো এক ব্যক্তি উন্মুক্ত মাঠে সবার সামনে বেদম প্রহার করছে। এ কি সমাজ? সবাই আবার সেটি দেখছে? কেউ কিছু বলছে না, শুধু একজন দুর্বলভাবে ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু দৈত্যের মতো মানুষটিকে ফেরাতে পারছেন না। বুঝলাম এলকার মাস্তান কিংবা তথাকথিত লিডার হবেন, তা না হলে এত মানুষের সামনে কজন মানুষকে এভাবে অন্য কেউ হেনস্তা করবে না।

আমাদের সংসদে অনেক কিছুই আলোচনা হয়। অনুরোধ করব একটি আইন যাতে পাস করা হয় যে, কোন ধরনের শিক্ষকের গাঁয়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। কেউ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ধরনের আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। যদি কেউ করার চেষ্টাও করে সেটি হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল, মানবতা ভূলুণ্ঠিত করার সামিল। সর্বাগ্রে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সমাজে যে পচন ধরেছে এ সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। এখান থেকেই শুরু হোক। এটি নিয়ে কোন ধরনের রাজনীতি যাতে কেউ না করে সেজন্য সবাইকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]